সুজাতার হাতের কাজও বড় সুন্দর। দিদিদের মতো তিনিও শিল্পী। নানারকম জিনিষ তৈরি করতে পারেন তবে তার পানমশলার বাড়ি বোধহয় অনেকেই দেখেছেন। এই মশলার বাড়িও পাঠানো হত বিয়ের তত্ত্বে। সুজাতা মশলার বাড়ি করতেন শিল্পী মনের স্বপ্ন মিশিয়ে! যেমন তার নিজের বাড়ি ছিল পার্ক সার্কাসের কাছে। গগনেন্দ্রনাথ নিজের কয়েকখানি সুন্দর ছবি দিয়ে সে বাড়ি সাজিয়ে দিয়েছিলেন-রায়টের সময় সে বাড়ি লুঠ হয়ে যায়। সুজাতার বিয়ে হয়েছিল বিদ্যাসাগরের পুত্রের দৌহিত্র সরোজ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নতুন বাড়ি আবার সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়েছিল সুজাতাকে। পানমশলা। দিয়ে বাড়ি করা ছাড়াও তিনি তৈরি করেছেন সেতার-তবলা-হারমোনিয়াম। শর্মিলার বিয়েতে তো তৈরি করে দিয়েছিলেন একটা আস্ত ক্রিকেট টীম! এ ছাড়া সুজাতার ঝোঁক ফেলে দেওয়া, কুড়িয়ে-পাওয়া জিনিষ দিয়ে সুদৃশ্য পুতুল বা টুকিটাকি জিনিষ তৈরি করা। নতুন জিনিষ দিয়ে তো সবাই পারে। কিন্তু ফেলনা জিনিষ দিয়ে? সুজাতা দেখেছিলেন তার ছোটকাকা অবনঠাকুর নানারকম ফেলে দেওয়া জিনিষকেই কাজে লাগাচ্ছেন। তুচ্ছ কাঠের টুকরাকে কুটুমকাঁটামে রূপান্তরিত করাই শুধু নয়, তিনি লেখার পাণ্ডুলিপিতেও খবরের কাগজ, পাজী, শাড়ির লেবেল, বোতলের লেবেল, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবি, বিজ্ঞাপন, কাটুন কেটেকুটে লাগসই করে জুড়ে জুড়ে ছবি বানাতেন। খুদুর রামায়ণের পাণ্ডুলিপিটি এভাবেই তৈরি হয়েছিল। তিনি জানতেন তুচ্ছ কভু তুচ্ছ নয় শিল্পীর কাছে। সুজাতাও তৈরি করেছেন আইসক্রীম কাঠির বাড়ি, শিশিবোতলের পিনকুশান-মুনদান-পুতুল! আজকাল অব্যবহার্য জিনিষে তৈরি ঘর সাজাবার পুতুল সাজিয়ে অনেকেই বাহবা পাচ্ছেন। ফেনা জিনিষ তুলে এনে অসুন্দরকে সুন্দর করার জাদু জানতেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। খুব সম্ভব জাপানী শিল্পীদের আনাগোনার ফলে তারা চিনতে শিখেছিলেন প্রতিদিনের শত তুচ্ছের আড়ালে আড়ালে হারিয়ে যাওয়া সুন্দরকে।
দিদির মতো সুজাতা লেখেন না বড় একটা কিন্তু বাবার কথা যে অফুরান। তাই পূর্ণিমার পরে গগনেন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটির উদ্যোক্তারা সুজাতাকে দিয়েও লিখিয়েছেন। সেই ছোট্ট লেখাটিতে আছে আপন করা ঘরোয়া কথা ও সুর। একটুখানি দেখা যাক :
দার্জিলিং-এ দেখেছি বাবা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। শিল্পীর চোখে তিনি যা দেখেছিলেন আমাদেরও তাই দেখতে শেখালেন। মহাদেব শুয়ে আছেন—নাক মুখ চোখের রেখা তখন স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তিনি আমাদের চোখ ফুটিয়ে দিলেন, তাই, নাহলে আগে শুধু বরফের পাহাড় বলেই দেখেছিলাম।
এভাবে দেখতে শেখানই ছিল অবন-গগনের নিজস্ব আর্ট। সুজাতার শিল্পীজীবনে এসেছে পরিতৃপ্তির আনন্দ। ছোটখাট অনেক কিছু করেছেন। তিনি। কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছেন হাতের কাজ—সেলাই আর আলপনার জন্যে। শুধু দুঃখ এসব কিছুই থাকে না। শুধু পঞ্চাশ বছরের পুরনো, নিজের হাতে করা বনসাই বটগাছটাই যা চারপাশে ঝুরি নামিয়ে বেঁচে আছে। আর কিই বা আছে? যে সব মেয়েদের কনে সাজালেন তারাও তো আজ গিন্নী। এখন আর পারেন না, হাত কেঁপে যায়। তবু এখনও অনেকে ধরে সাজিয়ে দেবার জন্যে। ঐ যে আদরের নাতনী শিঞ্জিতা, ঐ কি ছাড়ল? যতই মডার্ণ আর আলট্রা মডার্ণ হোক না কেন, বিয়ের দিন সেও চেয়েছিল শিল্পীকন্যার শিল্পমণ্ডিত হাত দুখানির চির নবীন স্পর্শ!
কনে সাজানোর কথায় মনে পড়ছে আরেকজনের কথা। তিনিও খুব ভাল কনে সাজাতেন, তার নাম মাধবিকা। সমরেন্দ্রনাথের মেয়ে। মাধবিকার পাঁচ বোন। যমজ বোন মালবিকা ছাড়াও ছিলেন সুপ্রিয়া, কমলা ও অণিমা। মাধবিকার বিয়ে হয়েছিল কবিকন্যা রেনুকার ছোট দেবর শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ঠাকুরবাড়িতে মেয়ে সাজানোর ব্যাপারে নাম ছিল মাধবিকার। সেখানে মেয়ে সাজানোর একটি বিশেষ ধরন ছিল। নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও মনে হয় তখনকার সন্ত্রস্ত পরিবারগুলির মধ্যে এক এক ধরনের মেয়ে সাজানোর বৈশিষ্ট্য ছিল। যাইহোক, ঠাকুরবাড়িতে এখনকার মতো লবঙ্গের টিপ দিয়ে চন্দনের নকশা কেটে মেয়ে সাজানো হত না। তার বদলে অনেকখানি চন্দন লেপে দেওয়া হত পুরো কপালে। ভুরু থেকে সিথি পর্যন্ত চন্দন লেপা হলে খুব সরু যশুরে চিরুনি দিয়ে চন্দনটা আঁচিড়ে দেওয়া হত। ভুরু থেকে চুল পর্যন্ত সারা কপালে চন্দনের খড়কে ডুয়ে কাঁটার পর চন্দন শুকোলে তার ওপর সিঁদুর-কুমকুমের টিপ ও নকশা কাঁটা হত।
ইন্দিরা যখন স্ত্রী-আচারের একখানি সংকলন প্রকাশের কথা ভাবছিলেন, তখন তার এ ব্যাপারে মাধবিকাকেই যোগ্যতমা বলে মনে হয়েছিল। একান্নবর্তী পরিবারে বহু বিয়ে তিনি দেখেছেন এবং এ বিষয়ে স্বাভাবিক ঔৎসুক্য থাকায় সবই মাধবিকার মনে ছিল। তার দেওয়া বিবরণ থেকেই আমরা ঠাকুরবাড়ির বিয়ের স্ত্রী-আচার সম্বন্ধে সব কিছু জানতে পারি। মহর্ষি পরিবার ব্রাহ্ম হয়ে যাবার পরেও মহর্ষি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে স্ত্রী-আচার বাদ দেননি। পাঁচ নম্বরে তো সাবেকী নিয়মই ছিল। মাধবিক। সব জানতেন। সবই মনে রেখেছিলেন। কত নিয়ম! নিয়ম তো নয় সে হল রীতি বা রীত। গায়ে হলুদ থেকে শুরু, বিয়ের পর নদিনে শেষ। মাধবিকা লিখেছেন ঠাকুরবাড়ির কথা, তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের স্ত্রী-আচারের তফাৎ নেই বললেই চলে। দু-একটার একটু নতুনত্ব আছে। যেমন :