খুব সহজ ছিল না ব্যাপারটা। দেউড়ি দালান পার হয়ে সবার চোখ এড়িয়ে বন্ধুকে আনতে হয়েছিল অন্দরমহলে। পদে পদে ধরা পড়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও সত্যেন্দ্র যে এতদুর এগিয়েছিলেন সে শুধু তিনি প্রগতিবাদী ছিলেন বলে।
এবার তো মহর্ষি স্বয়ং অনুমতি দিয়েছেন। মন খুশিতে টইটুম্বুর। প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে। সত্যেন্দ্র স্ত্রীকে বোম্বাই নিয়ে যাবেন, স্ত্রী-স্বাধীনতার দ্বার খোলবার এক মহা সুযোগ উপস্থিত। গোছগাছ শুরু হয়ে গেল। কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনী কি পোশাক পরে বাইরে বেরোবেন? ঘরের কোণে বন্দী মেয়েদের সাজপোশাক নিয়ে এতদিন কেউ মাথা ঘামায়নি, শুধু একখানি শাড়ি পরলেই চলে যেত। নিজের পুরনো কথা বলার সময় জ্ঞানদানন্দিনী জানিয়েছেন, শীতকালে তারা এই শাড়ির ওপর জড়াতেন একটি করে চাদর। পুরাতনী থেকে আমরা এরকম আরো অনেক খুঁটিনাটি খবর পেয়েছি। কিন্তু মনে প্রশ্ন থেকে গেছে, এতদিন পর্যন্ত বাঙালী মেয়েরা অন্য কোন পরিচ্ছদ ব্যবহার করতেন না কেন? সত্যিই কি তাঁরা শাড়ি ছাড়া আর কিছুই পরতেন না। বাংলাদেশে বেশ অনেকদিন ধরেই মুসলমান শাসন শুরু হয়েছিল। নবাব-হারেমের দু-একটা ছবিতে মেয়েদের বেশ রুচিশোভন পোশাক পরতেও দেখা গেছে। সেই পোশাকটি কি বাঙালী মেয়েরা গ্রহণ করতে পারতেন না? সাধারণতঃ দেখা গেছে বাঙালী পুরুষদের চলায়-বলায় পোশাকে-আশাকে রুচিতে-বিলাসে সর্বত্রই মুসলমানী ছাপ পড়েছে। তাহলে মেয়েরা কেন বাদ পড়লেন? পেশোয়ার্জের ব্যবহার তো ছিল। যাই হোক, জ্ঞানদানন্দিীর জন্যে তখনকার মত ফরাসী দোকানে ফরমাশ দিয়ে বানানো হল কিম্ভুতকিমাকার ওরিয়েন্টাল ড্রেস। পরাও খুব কষ্টকর। জ্ঞানদাননিনী তো নিজে নিজে পরতেই পারলেন না। তবু ঐ পরেই কানরকমে তৈরি হলেন! প্রথমবারের এই পরিচ্ছদ-সমস্যা জ্ঞানদানন্দিনীকে এত বিব্রত করেছিল বলেই তিনি মেয়েদের সাজপোশাক নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। আধুনিক বাঙালী মেয়েদের রুচিশোভন সাজটি তার সেই চিন্তার ফসল। সে আরো পরের কথা। আপাততঃ যাত্রার কথাটা সেরে ফেলি।
সত্যেন্দ্র প্রস্তাব করলেন, বাড়ি থেকেই গাড়িতে ওঠা যাক। এবারও সবাই ছি ছি করে উঠতে দেবেন্দ্রনাথও রাজী হলেন না। সেকালে মেয়েদের গাড়ি চড়া ভারি নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল। তিনি বললেন, মেয়েদের পালকি করে যাবার নিয়ম আছে তাই রক্ষা করা হোক। অসূর্যস্প কুলবধু কর্মচারীদের সামনে পায়ে হেঁটে দেউড়ি পেরোবে এতটা ভাবতে বোধহয় মহর্ষিরও ভাল লাগেনি। সাবেকী পালকি জ্ঞানদানন্দিনীকে বোম্বাইগামী জাহাজে চাপিয়ে দিলে। এই শেষ। এরপরে তিনি আর কোনদিন পালকি চাপেননি।
বোম্বাইয়ে পুরো দুবছর কাটিয়ে অপরূপ বেশবাসে সেজে জ্ঞানদানন্দিনী আবার যেদিন কলকাতার মাটিতে পা দিলেন প্রকৃতপক্ষে সেই দিনটিতেই শুরু হল বাঙালী মেয়েদের জয়যাত্রা। তখন সবে সত্তরের দশক আরম্ভ হয়েছে! সর্বত্র বইছে এক উন্মাদনার হাওয়া। তবে বাংলাদেশে পর্দার কড়াকড়ি শিথিল হতে সময় লেগেছিল। ততদিন যে জ্ঞানদানন্দিনীকে একাই সব লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয়েছে তা নয়, তার সঙ্গী হয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির অন্য মেয়েরা, এবং কয়েকজন ব্রাহ্মিক। মহিলা। অবশ্য যেদিন তিনি বোম্বাই থেকে ফিরলেন সেদিন তার পাশে কেউ ছিল না। স্বর্ণকুমারী সেই মুহূর্তটিকে একটি কালির আঁচড়ে জীবন্ত করে তুলেছেন, ঘরের বৌকে মেমের মতো গাড়ি হইতে সদরে নামিতে দেখিয়া সেদিন বাড়িতে যে শোকাভিনয় ঘটিয়াছিল তাহা বর্ণনার অতীত। বাড়ির পুরনো চাকরদের চোখ দিয়ে দরদর করে নেমে এসেছিল অশ্রুধারা। নিজের পুরনো ঘরটিতে ফিরেও জ্ঞানদানন্দিনী যেন একঘরে হয়ে রইলেন। সমবেদনায় করুণ স্বর্ণকুমারী দেখতেন বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা বধূঠাকুরাণীর সঙ্গে অসংকোচ খাওয়া-দাওয়া করিতে বা মিশিতে ভয় পাইতেন। এই রকম পবৃিস্থিতিতে জ্ঞানদানন্দিনীর আচার-আচরণ দুঃসাহসিক বৈকি।
তিনি সত্যন্দ্রনাথের কথামতো গেলেন লাটভবনে, নিমন্ত্রণ রাখতে। সেখানে তাকে দেখে সবাই প্রথমে ভেবেছিলেন ভূপালের বেগম, কারণ তিনিই তখন একমাত্র বেরোতেন। ভোজসভায় ছিলেন পাথুরেঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুর। তিনি তো ঘরের বৌকে প্রকাশ্য রাজসভায় আসতে দেখে রাগে-লজ্জায় দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। আগে কোনো হিন্দু রমণী গভর্ণমেন্ট হাউসে যাননি। এখনই বা যাবার দরকার কি ছিলো? সে কথা সনাতনপন্থীরা বুঝবেন কি করে? বুঝেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাই পুলকিত হয়ে লিখেছেন, সে কী মহাব্যাপার! শত শত ইংরেজ মহিলার মাঝখানে আমার স্ত্রী সেখানে একমাত্র বঙ্গবালা! যতই হৈচৈ হোক না কেন রোগটা বড় ছোঁয়াচে। একটি দুটি করে আরো দরজা খুলতে শুরু করল।
জ্ঞানদানন্দিনী যে শুধু মেয়েদের পথের কাঁটা ঘুচিয়েছিলেন তা নয়, পুরুষের মনের বাধাও অনেকটা দূর করেছিলেন। প্রত্যক্ষ প্রমাণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। সমবয়সী এই দেওরটি তার অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। কিন্তু প্রথমে জ্যোতিরিন্দ্র নব্যপন্থী ছিলেন না বরং একটু রক্ষণশীল ছিলেন বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের মতো। কেশব সেনকে ব্যঙ্গ করে প্রহসন লেখার মধ্যেই তার মনোভাবটি ধরা পড়েছিল কিন্তু মেজ দাদা আর মেজ বৌঠানের সাহচর্য তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল নতুন পথে।
জ্ঞানদানন্দিনী আমাদের ঠিক কী দিয়েছিলেন সেটা সবার কাছে তেমন স্পষ্ট নয়। বাঙালী নারীর পথিকৃৎ হবার জন্যে তাকে আরো এগোতে হয়েছে। তিনি একাকিনী দু-তিনটি শিশু নিয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিলেত গিয়েছিলেন। যেখানে একলা যেতে ছেলেদেরও বুক কেঁপে উঠত। কালাপানি পার হয়ে বিলেত যাওয়া, বাপরে সে কি সহজ কথা! দু-দুজন কৃতী পুরুষ, রামমোহন আর দ্বারকানাথ গেলেন বিলেতে, কিন্তু ফিরলেন কই? সত্যেন্দ্রকে পাঠাবার সময়েই সবাই ভেবে অস্থির হয়েছিল, আর এ তো বাড়ির বৌ! যৎসামান্য ইংরেজী বিদ্যের পুজি নিয়ে সে কালাপানি পাড়ি দিলে কোন্ সাহসে? প্রসন্নকুমারের পুত্র প্রথম বাঙালী ব্যারিষ্টার জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর জাহাজঘাটে এসে তো হতবাক। অস্ফুটে শুধু বললেন, সত্যেন্দ্র এ কী করলেন? নিজে এলেন না।