হয়েছে।
—
প্রথম ব্যর্থ কৌশলে স্বীকার করে নিতে হয়েছিল যে আওরঙ্গজেব ছিলেন ধর্মীয় স্বৈরশাসক, আবার সেইসাথে প্রধানত আকবর ও দারাশিকোর মতো ‘প্রচলিত মতবাদবিরুদ্ধ মুসলিম’ মোগল ব্যক্তিত্বদের চেয়ে ভিন্ন। এই যুক্তিতে বলা হয়, গোঁড়া আওরঙ্গজেবের তুলনায় আকবর ও দারা অনেক বেশি হিন্দু ধ্যান-ধারণা আত্মস্থ করেছিলেন। আর এভাবেই তারা উপমহাদেশের গ্রহণযোগ্য শাসক হওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিমাণে ‘ভারতীয়তে’ পরিণত হয়েছিলেন। এই চিন্তাধারায় আওরঙ্গজেবকে পুনঃবিবেচনা বা পুনঃমূল্যায়ন করা হয় না। এর বদলে তৃতীয় মোগল সম্রাট ও আওরঙ্গজেবের দাদার বাবা আকবরের নির্মিত কথিত সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ধ্বংস করা ও আওরঙ্গজেবের বড় ভাই দারা শুকোহর কাছ থেকে মোগল রাজমুকুট ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে কলঙ্কিত করা হয়। অবশ্য, মনে করা হয় যে ইতিহাসের মহা পথ-পরিক্রমায় আদর্শমূলক ভারতীয় মুসলিমদের সমন্বয়বাদী উত্তরাধিকারে ভারসাম্য রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করেছে আওরঙ্গজেবের সাম্প্রদায়িকতাবাদ । এই চিন্তাধারা এমনকি হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক প্রচারক ভি ডি সাভারকারের মতো লোকজনও লালন করেন। দিল্লির আওরঙ্গজেব রোডের নাম বদল নিয়ে বিতর্কের সময় এই যুক্তি অনুসরণ করেই সেটির নতুন নাম দারা শুকোহ রোড রাখার প্রস্তাবও এসেছিল।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, আওরঙ্গজেবের মতো আকবর ও দারা শুকোহ উভয়েই তাদের নিয়ে লোকরঞ্জক খ্যাতিতে যা বলা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল ছিলেন। আওরঙ্গজেবের সাথে ভারসাম্য করার জন্য আকবর ও দারাকে সামনে আনতে গিয়ে এসব লোক সম্পর্কে নতুন কিছু শিখতে আমরা ব্যর্থ হই, তাদের মুসলমানিত্ব অনুযায়ী মোগল বাদশাহদের মান নির্ণয় করার কাজে নিজেদের শৃঙ্খলিত করে ফেলি। এই তুলনা করতে গিয়ে আমরা এই ধারণা পোষণ করে বিরাট ভুল করে বসি যে ভারতবর্ষের ইতিহাস, তথা ইন্দো-মুসলিম অতীতের সবকিছুই ধর্মবিষয়ক। আওরঙ্গজেব মুসলিম ছিলেন। তবে তার আধুনিক অনুসারীরা বা সমর্থকেরা তাকে যে ধরনের মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করে, তেমন ছিলেন না তিনি। অধিকন্তু, আওরঙ্গজেবকে তার বিশ্বাসের মধ্যে খর্ব করা যায় না। অতীতের কাছে সৎ থাকার জন্য আমাদের যুবরাজ ও সম্রাট হিসেবে তার পূর্ণতর ছবিটি পুনরুদ্ধার করতে হবে।
—
আক্রমণে ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে কেউ কেউ যুক্তি দেন যে আমরা খুবই কঠোরভাবে আওরঙ্গজেবকে বিচার করছি। সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে ঘৃণ্য মুসলিম বদমাসটি আসলে ততটা জঘন্য ছিলেন না?
এই যুক্তির ভিত্তি নিহিত রয়েছে আওরঙ্গজেবের আমল সম্পর্কে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা সংশোধন এবং মোটামুটিভাবে সঠিক হলেও যেসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সেগুলো উপস্থাপনের ওপর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লোকরঞ্জক বিশ্বাসের বিপরীতে আওরঙ্গজেব কখনো বড় মাত্রার এমন কোনো ধর্মান্তর কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেননি যাতে অমুসলিমদেরকে ইসলাম বা তরবারির কোনো একটিকে গ্রহণ করে নিতে হয়েছিল। আওরঙ্গজেব কখনোই হাজার হাজার হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেননি (খুব সম্ভবত সংখ্যাটি কয়েক ডজনে সীমিত থাকতে পারে)। তিনি হিন্দুদের পাইকারিভাবে হত্যার মতো জঘন্য কোনো কাজ করেননি। বস্তুত, তিনি তার সরকারের সর্বোচ্চ অবস্থানে হিন্দুদের বসিয়েছিলেন। তিনি হিন্দু ধর্মীয় গ্রুপগুলোর স্বার্থ সুরক্ষিত রেখেছিলেন, এমনকি ব্রাহ্মণদের হয়রানি বন্ধ করার জন্য স্বধর্মী মুসলিমদের নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তিনি তার সব প্রজার জন্য নিরাপদ রাস্তা ও মৌলিক আইন-শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন।
সব ঘটনার সঠিক বিবরণ দেওয়া ইতিহাসবিদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত বিষয়, এবং এটুকু সত্য : আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আওরঙ্গজেব ছিলেন তার সমসাময়িক খ্যাতির তুলনায় অন্যের প্রতি অনেক কম অকল্যাণকামী। তবে আওরঙ্গজেব পুরোপুরি জঘন্য ব্যক্তি ছিলেন না, কেবল এমন কথার ফুলঝুড়ি দিয়েই আমরা আওরঙ্গজেব সম্পর্কে লোকরঞ্জক নিন্দাগুলোর ঊর্ধ্বে উঠতে পারব না। আরো সমস্যার বিষয় হলো, আমরা ভারতবর্ষের জটিল অতীত সম্পর্কে ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হই। আওরঙ্গজেব কি একুশ শতকের স্পর্শকাতরতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলেন? এমন প্রশ্নের চেয়ে উপনিবেশ-পূর্ব ভারতবর্ষে অর্ধশত বর্ষ শাসনকারী ও রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দেওয়া লোকটি সম্পর্কে অনেক বেশি কথা বলার আছে। আমাদেরকে অবশ্যই তাড়াহুড়া করে আওরঙ্গজেবের বিচার করার প্রবল, আধুনিক প্রবৃত্তি দমন করে বরং এই প্রভাবশালী বাদশাহর কর্ম ও আদর্শগুলোকে প্রথমে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
আমাদের প্রয়োজন আওরঙ্গজেব সম্পর্কে নতুন ভাষ্য। আমি এখানে এ ধরনের একটি বক্তব্যই উপস্থাপন করছি।
—
আমার ভাষ্যে আওরঙ্গজেবের জীবন ও শাসনকাল সম্পর্কে বর্তমানে স্বল্প পরিচিত অনেক বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করে এর মাধ্যমে বিভ্রান্তির শিকার এক বাদশাহ-সম্পর্কে অতি-প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক গভীরতা যোগ করেছে। এতে আওরঙ্গজেবের কথিত ‘সবচেয়ে খারাপ’ বিষয়গুলো তথা তার মন্দির অবমাননা, কূটিল রাজনৈতিক বুদ্ধি, সহিংস পন্থা, কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নির্যাতন করার মতো অভিযোগের জবাব দেওয়া হলেও এগুলোতেই বইটি সীমাবদ্ধ নয়। যদি কেবল আওরঙ্গজেব সম্পর্কে কুৎসা রটনাকারীদের বিভ্রান্তিকর তথ্য ও সন্দেহজনক দাবিগুলো মোকাবিলা করা হয়, তবে তা হবে একটি ফাঁকা কাজ। কারণ এটি ইতিহাসের মূল নির্দেশিকা তথা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের তাদের নিজস্ব পরিভাষার ভিত্তিতে উপলব্ধি করার কাজটি বাস্তবায়ন করা হবে না ।