—
আওরঙ্গজেবকে নিয়ে প্রচলিত লোকরঞ্জক ধারণা কেন বাতিল করার জরুরি, তার দ্বিতীয় কারণ হলো, যাতে আমরা তাকে ইতিহাসের পরিভাষায় বুঝতে পারি। আওরঙ্গজেব ছিলেন তার সময়ের মানুষ, আমাদের সময়ের নয়। আমি যুক্তি দিয়েছি যে আওরঙ্গজেব ন্যায়বিচার নিয়ে তার আদর্শের আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নিজের রাজনৈতিক ও নৈতিক আচরণের (আদব ও আখলাক) প্ৰতি দায়বদ্ধ ছিলেন, রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করেছেন। আওরঙ্গজেবের বিশ্ববীক্ষা তার নিজের ধর্মভক্তি ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মোগল সংস্কৃতির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম সঙ্ঘাত (আধুনিক সময় এ ধারণাটিতে আচ্ছন্ন) তার স্বার্থের অনুকূলে ছিল না, বরং তিনি তার ধারণার আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মোগল ঐতিহ্য সমুন্নত রাখা এবং উপমহাদেশজুড়ে তার মুষ্ঠি সম্প্রসারণ করার দিকে নজর দিয়েছিলেন।
কিন্তু তারপরও আওরঙ্গজেব সহজে সংক্ষিপ্ত করাকে প্রতিহত করেন। তিনি ছিলেন প্রবল বৈপরীত্যপূর্ণ ও ধাঁধাময় এক ব্যক্তিত্ব। আওরঙ্গজেব নিয়ম অনুসরণে পুরোপুরি আচ্ছন্ন ছিলেন। এমনকি রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা নিয়েও সর্বক্ষণ অস্থির থাকতেন। কিন্তু বাবাকে বন্দী করা ছাড়া তার কাছে আর কোনো উপায় দেখতে পাননি, অবশ্য এই কারণে এশিয়ার একটি বড় অংশে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। তিনি দারা শুকোহসহ তার পরিবার সদস্যদের হত্যা করতে কিংবা শত্রুদের টুকরা টুকরা করে কাটতেও (এই যেমন শম্ভুজির ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই) দ্বিধা করেননি। আবার তিনি নিজ হাতে টুপি সেলাই করতেন, ধার্মিক জীবনযাপন করার আকাঙ্ক্ষা লালন করতেন। খারাপ প্রশাসক, পচা আম, অপদার্থ ছেলেদের প্রতি ক্রুদ্ধ হতেন তিনি। তিনি ছিলেন সঙ্গীতের সমঝদার, এমনকি গায়িকা হিরাবাইয়ের প্রেমেও পড়েছিলেন। কিন্তু মধ্যবয়সের শুরুতে তিনি নিজেকে সঙ্গীত শিল্পের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষ বয়সে আরেক সঙ্গীতশিল্পী উদয়পুরির সঙ্গ উপভোগ করতেন। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, অথচ নিজের কবরের জন্য অচিহ্নিত একটি স্থান বেছে নিয়েছিলেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাত্রায় সম্প্রসারিত করলেও নিজেকে চরম ব্যর্থ মনে করতেন ।
আওরঙ্গজেব ছিলেন রহস্যময় সম্রাট। অধিকন্তু, আওরঙ্গজেবের শাসনকাল সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ইতিহাসবিদ কাফি খান তাকে পারস্য ঐতিহ্যের কিংবদন্তিপ্রতীম শাসক জামশিদের সাথে তুলনা করে বলেছেন, ‘জামশিদের সমমানের একজন শাসকের ৫০ বছরের শাসনকালের প্রধান ঘটনাগুলোর সারাংশ টানার চেষ্টা সাগর থেকে এক কলস পানি নেওয়ার মতো।’ এই উৎসুক্য সৃষ্টিকারী সম্রাট এবং যে সাম্রাজ্য তিনি শাসন করেছেন, সে সম্পর্কে অনেক কথা বলা এখনো বাকি রয়ে গেছে। কল্পকথার আওরঙ্গজেবের আবরণটি পরিষ্কার করার পরই আমরা কেবল মধ্য যুগের ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সম্রাট আওরঙ্গজেবের মুগ্ধতা সৃষ্টিকারী ধাঁধার মুখোমুখি হতে পারি ।
পুনশ্চ : মধ্য যুগের ফারসি সাহিত্য পাঠ নিয়ে নোট
আওরঙ্গজেবের জীবন ও রাজত্ব বিশাল বিস্তৃত নথিপত্রে বিন্যস্ত হয়ে রয়েছে। ইতিহাস, রাজকীয় আদেশ, খবর প্রতিবেদন, চিঠিপত্র, ভ্রমণকাহিনী ও অন্যান্য দলিল-দস্তাবেজে (এগুলো মূলত লেখা হয়েছে ফারসি ভাষায়) মধ্য যুগের ভারতবর্ষীয় এ সম্রাটকে নিয়ে লিখিত ভাষ্যের বিশাল ভাণ্ডার সৃষ্টি করেছে। তবে ইতিহাসবিদেরা এই প্রাচুর্যপূর্ণ আর্কাইভের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
আওঙ্গজেব সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও ইতিহাসে ইতিহাসবিদদের প্রবেশগম্যতার অভাব রয়েছে। অসংখ্য নথিপত্র কখনো ছাপা সংস্করণের মুখ না দেখে পাণ্ডুলিপির লাইব্রেরিগুলোতে অবহেলিতভাবে পড়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব লাইব্রেরিতে যাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের বিপুল সময় ও অর্থের প্রয়োজন হয়। আবার অনেক স্থান ফটোগ্রাফির ওপর এমন বিধিনিষেধ রয়েছে যে সেগুলোর আর্কাইভ সামগ্রীর সত্যিকারের ব্যবহার প্রায় অসম্ভব। এছাড়া ভাষাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ । আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের সরকারি প্রশাসনিক ভাষা ফারসি হওয়ায় এ ভাষাতেই মোগলদের বেশির ভাগ ইতিহাস লেখা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান ভারতে এটি বিদেশী ভাষা । অনেক ইতিহাসবিদের মূল ফারসি পাণ্ডুলিপিগুলো বাদ দিয়ে এর বদলে ইংরেজি অনুবাদের ওপর নির্ভর করার কারণ প্রয়োজনের তাগিদ ও এগুলোর প্রাপ্তি সহজলভ্য হওয়া। এই দৃষ্টিভঙ্গি লাইব্রেরি সামগ্রীর ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস করে। আবার মোগল পাণ্ডুলিপিগুলোর অনেক অনুবাদের মান প্রশ্নবোধক। ভুল অনুবাদ ও সংক্ষিপ্তকরণ রয়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। ভুল বা বিভ্রান্তিকর অনুবাদের কিছু কিছু বেশ সুবিধাজনকভাবেই অনুবাদকদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে উপনিবেশ যুগের অনুবাদগুলোর কথা বিশেষভাবে বলা যায়। এসব অনুবাদে ইন্দো-মুসলিম সম্রাটদের সবচেয়ে খারাপভাবে উপস্থাপন করতে চাওয়া হয়েছিল যাতে তাদের তুলনায় ব্রিটিশদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ইলিয়ট ও ডসনের হিস্টরি অব ইন্ডিয়া, অ্যাস টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টোরিয়ান্স। এসব বই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ সম্পর্কে জানার বিশাল উৎস হলেও মোগল ভারতবর্ষ সম্পর্কে ভ্রান্ত চিত্র উপস্থাপন করে ।