আওরঙ্গজেবের সাদামাটা কবরটি তার জটিল জীবনের একেবারে বিপরীত বিষয়। আওরঙ্গজেব তার ধার্মিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করার জন্যই কবরের স্থান হিসেবে এই গাম্ভীর্যতা ও পারিপার্শ্বিকতা বাছাই করেছিলেন । বস্তুত আওরঙ্গজেব তার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ক্রমবর্ধমান হারে ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। অবশ্য সম্রাটের আধুনিক সমালোচকেরা বিষয়টি যেভাবে কল্পনা করে, তিনি তা করেছিলেন তার চেয়ে ভিন্নভাবে। অন্যদের প্রতি ধর্মীয় উগ্রতাপূর্ণ আচরণ করার বদলে আওরঙ্গজেবের ধর্মভক্তি প্রকাশিত হয়েছিল তার অন্তঃমুখী উদ্বেগে যা তিনি করেছিলেন খোদার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তিনি তার শেষ বয়সের চিঠিপত্রে প্রায়ই হাশরের ময়দানের কথা উল্লেখ করতেন, পরবর্তী দুনিয়ায় প্রবেশ করতে উদ্যত এক অচেনা লোক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।
ইসলামের সাথে এই বহুরূপী সম্রাটের সম্পর্ক ছিল জটিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মের গণ্ডিতে আটকে রাখার মতো ছিলেন না তিনি। বস্তুত, আওরঙ্গজেব সম্পর্কে সাদামাটা বিষয়াদি রয়েছে সামান্যই। আওরঙ্গজেব ছিলেন ক্ষমতা, নিজস্ব ধরনের ন্যায়বিচার ও সম্প্রসারণে নিবেদিতপ্রাণ এক সম্রাট। তিনি ছিলেন দারুণ মেধাসম্পন্ন শাসক, সেইসাথে অনেক ভুলও করেছেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সম্প্রসারিত করেছিলেন, এবং সম্ভবত এটি ভাঙার অবস্থায়ও নিয়ে গিয়েছিলেন। কোনো একক বৈশিষ্ট্য বা পদক্ষেপে আওরঙ্গজেব আলমগিরকে আবদ্ধ করা যায় না। তিনি প্রায় ৫০ বছর মোগল সিংহাসনকে অলংকৃত করেছিলেন, জনসাধারণের কল্পনাশক্তিকে অনেক দূর পর্যন্ত বিমোহিত করেছেন।
৮. আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকার
আওরঙ্গজেবের পর
স্রষ্টা ছাড়া আর কারো নেই ভবিষ্যতের জ্ঞান;
যদি কেউ বলে সে তা জানে, তবে তাকে বিশ্বাস করো না!
–বাবা মুসাফির (মৃত্যু ১৭১৪) নকশবন্দিয়া সুফি দরবেশ, আওরঙ্গজেবের ছেলেদের মধ্যকার উত্তরাধিকার লড়াই নিয়ে মন্তব্য
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক দশকের মধ্যে মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে । আওরঙ্গজেব-পরবর্তী সময়ে মোগলদের পতন যত দ্রুত বা সামগ্রিক হয়েছিল বলে যে ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে, সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি মোটেই তেমন ছিল না। তবে এমনকি অতি সূক্ষ্ম তারতম্যকে অনুমোদন করা হলেও বলতে হবে, আওরঙ্গজেবের পর মোগল সাম্রাজ্যের ক্রমাগত পতন বেশ অবাক করা ।
সম্রাটের তিন জীবিত ছেলে একে অপরের বিরুদ্ধে উত্তারাধিকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তার দ্বিতীয় ছেলে মোয়াজ্জেম যুদ্ধে অপর দু’জনকে- আযম ও কাম বখশ- হত্যা করেন। তিনি বাহাদুর শাহ নাম ধারণ করে মোগল সিংহাসনে আরোহণ করেন। আপাত দৃষ্টিতে সবকিছুই স্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে। উত্তরাধিকার লড়াই ছিল প্রত্যাশিত এবং তা সাধারণত মোগল শক্তিকে নতুন করে উজ্জীবিত করত। কিন্তু এবার এই পরবর্তী ধাপে তা না হয়ে বরং মোগল সাম্রাজ্যে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে থাকা সমস্যাগুলো বিপর্যয় সৃষ্টি করে ।
আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে মোগল রাষ্ট্রের অখণ্ডতার প্রতি চলমান অনেক হুমকি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন বাহাদুর শাহ। উত্তরে জাট ও শিখেরা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, দক্ষিণে মারাঠারা ফুঁসছিল, অকার্যকর করের ফলে কোষাগার ফাঁকা হয়ে পড়ছিল, রাজপুতেরা বিদ্রোহ করছিল। বাহাদুর শাহের সিংহাসনে আরোহণের পর এসব সমস্যার আরো অবনতি ঘটে। কারণ মোগল কর্তৃত্বের প্রতি নতুন করে চ্যালেঞ্জ জানাতে অনেকেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বাহাদুর শাহ তার বাবার মতো ছিলেন না। তিনি মোগল সার্বভৌমত্বের বিরোধিতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মারওয়ারের রাঠোর রাজপুত পরিবার (তারা ৩০ বছর আগে আওরঙ্গজেবের সময় ব্যর্থ বিদ্রোহ করেছিল) আবারো চেষ্টা করে মোগল নিয়ন্ত্রণ ছুঁড়ে ফেলে দিতে। রাঠোরের শাসক অজিত সিং যোধপুর থেকে মোগল বাহিনীতে বিতাড়িত করেন, এমনকি নগরীতে রাজকীয় দখলদারিত্বের সময় নির্মাণ করা মসজিদগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করেন। বাহাদুর শাহ যোধপুর পুনর্দখল করেন। কিন্তু অজিত সিং অল্প সময়ের মধ্যেই মারওয়ারের জন্য বর্ধিত স্বাধীনতা লাভ করেন। এর অন্যতম কারণ ছিল বাহাদুর শাহ তখন পাঞ্জাবে শিখ-নেতৃত্বাধীন একটি বিদ্রোহের দিকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছিলেন। এটিও ছিল আওরঙ্গজেবের আমল থেকে রয়ে যাওয়া আরেকটি অস্থিরতা।
বাহাদুর শাহ মারা যান ১৭১২ সালে, তার বাবার মৃত্যুর মাত্র পাঁচ বছর পর। এরপর মোগল সাম্রাজ্য দ্রুত গতিতে ভেঙে পড়ে। ১৭১২ থেকে ১৭১৯ সাল পর্যন্ত সাত বছরে অল্প ব্যবধানে উত্তরসূরি হিসেবে শাসন করেছিলেন চারজন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর ১৩ বছরের মধ্যে পাঁচজন বাদশাহ মোগল সিংহাসনে বসেছিলেন, অথচ আগের ১৫০ বছরে রাজত্ব করেছিলেন মাত্র চারজন। বস্তুত, এ ধরনের অস্থিতিশীলতার কারণে মোগল রাজপরিবার অভিজাতদের ওপর থেকে কর্তৃত্ব হারিয়ে ধারাবাহিক কর আদায়সহ রাষ্ট্র পরিচালনার স্বাভাবিক কার্যক্রম পর্যন্ত চালাতে পারছিল না। রাজকীয় প্রশাসনে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়, অনেক এলাকা মোগল রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে পড়ে ।