আমরা দুজনই চুপ করে আছি। সাজিদ বলে চলল—এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের এই ঘটনার পেছনের ইতিহাস খতিয়ে দেখতে হবে। ইহুদী, খ্রিষ্টান, মুসলিম অর্থাৎ আব্রাহামিক ধর্মের সকল স্কলারগণ এই ব্যাপারে একমত যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম জীবনের অধিকাংশ সময় সন্তানহীন ছিলেন। তখন তার স্ত্রী ছিলেন সারা আলাইহাস সালাম। যখন সারা আলাইহাস সালামের গর্ভে কোনো সন্তানের জন্ম হচ্ছিল না, তখন তিনি তার একজন দাসীর সাথে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বিয়ের বন্দোবস্ত করেন। সেই দাসীর নাম ছিল হাজেরা আলাইহাস সালাম। রাইট?
হুম আমি বললাম।
তাদের বিয়ের পরে হজেরা আলাইহাস সালামের গর্ভ থেকে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ভূমিষ্ট হন যখন ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বয়স ছিল চুরাশি বছর, তাই না?
আহসান আঙ্কেল মাথা নেড়ে সায় দিলেন। সাজিদ বলতে লাগল—অর্থাৎ ইহুদী, খ্রিষ্টান এবং ইসলাম ধর্মের স্কলারগণ এই ব্যাপারে একমত যে, ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রথম পুত্র। ইসমাঈলের বয়স যখন ১৪ বছর, তখন সারা আলাইহাস সালাম, অর্থাৎ ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রথম স্ত্রী, গর্ভবতী হন এবং পরে ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্ম হয়। মোদ্দাকথা, ইসহাক আলাইহিস সালাম, ইসমাঈল আলাইহিস সালামের চেয়ে ১৪ বছরের ছোট ছিলেন। আরও পরিষ্কারভাবে বললে—ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এবং ইসহাক আলাইহিস সালামের মধ্যে ১৪ বছরের একটা টাইম-গ্যাপ থেকে যায়। এতটুকু কি ক্লিয়ার?
আহসান আঙ্কেল আবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।
তাহলে, এখান থেকে, অর্থাৎ বাইবেল থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ইসমাঈল আলাইহিস সালামের জন্মের পরে আরও ১৪ বছর পর্যন্ত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কেবল একজন সন্তানেরই পিতা ছিলেন। মানে তখন শুধু তার সন্তান ছিলেন—ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। রাইট?
হুম।
এখন, আমরা আবার বাইবেলের সেই অংশে ফিরে যাই, যে অংশে বলা হচ্ছে—তোমার পুত্রকে, তোমার একমাত্র পুত্রকে নিয়ে যাও আমার দেখানো পর্বতে। দেখুন আঙ্কেল, বাইবেল কিন্তু খুব স্পষ্ট করেই বলছে—তোমার একমাত্র পুত্রকে। এখন আমরা যদি খ্রিষ্টান মিশনারিদের কথামতো ধরেও নিই যে, এখানে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম নয়, ইসহাক আলাইহিস সালামকে বুঝানো হচ্ছে, তাহলে তোমার একমাত্র পুত্রকে বলার কারণ কী? ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মের পর তো ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মোট দুটো সন্তান হয়ে গেল। এখানে তো বলা উচিত তোমার পুত্রদের মধ্য থেকে অথবা তোমার দুই পুত্রের মধ্য থেকে ইত্যাদি। কারণ, এই ঘটনায় যদি ইসহাক আলাইহিস সালামকে টানি, তাহলে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সন্তান সংখ্যা দাঁড়ায় দুজন। তাহলে দুজন সন্তান থাকা সত্ত্বেও এখানে বাইবেল কেন তোমার একমাত্র পুত্রকে বলল? এটি এজন্যেই যে, এই একমাত্র পুত্র ছিলেন ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। এই ঘটনা অর্থাৎ সন্তান কুরবানীর ঘটনা যখন ঘটছে, তখন ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মও হয়নি। তখন কেবল ইবরাহীম আলাইহিস সালামের একজনই সন্তান ছিল— ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। তাহলে বাইবেল এবং বাইবেলীয় ইতিহাস মতে— ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সেদিন ইসহাক আলাইহিস সালামকে নয়, ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কুরবানী দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এতটুকু বলে সাজিদ একটু থামল। আহসান আঙ্কেল বললেন—কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে, সাজিদ। খ্রিষ্টানরা ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে নবী হিশেবে এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বৈধ পুত্র হিশেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না। কেন দিতে চায় না, জানো? কারণ, ইসমাঈল আলাইহিস সালামের জন্ম হয়েছিল একজন দাসীর গর্ভে, তাই।
আহসান আঙ্কেলের এই কথা শুনে সাজিদ হাসল। এরকম সিরিয়াস ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে সে কখনো হাসে না। আজ ব্যতিক্রম হলো। হাসি থামিয়ে বলল—কিন্তু আঙ্কেল, বাইবেল যে এ ব্যাপারে একদম ভিন্ন কথা বলে।
যেমন? আহসান আঙ্কেলের উৎসুক প্রশ্ন।
বাইবেলই বলছে, হাজেরা আলাইহাস সালাম ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বৈধ স্ত্রী ছিলেন। বাইবেলের জেনেসিসে বলা হয়েছে—Sara, Abrams wife, took Hagar the Egyptian, her slave-girl, and gave her to her husband Abram as his wife.[২]
অর্থাৎ সারা, যিনি ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্ত্রী ছিলেন, তার দাসী হাজেরা আলাইহাস সালামকে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে দিলেন স্ত্রী হিশেবে। এখান থেকে একেবারে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে হাজেরা আলাইহাস সালাম ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বৈধ স্ত্রী ছিলেন।
আহসান আঙ্কেল বললেন, আই সী।
তাছাড়া, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম শুধু মুসলিম নয়, খ্রিষ্টান এবং ইহুদীদের কাছেও একজন সম্মানিত প্রফেট। তাহলে তারা কীভাবে এটা ভেবে নিতে পারে যে এরকম সম্মানিত একজন প্রফেটের কারও সাথে অবৈধ সম্পর্ক থাকতে পারে এবং অবৈধ সন্তানও আসতে পারে?
সাজিদের কথায় ভীষণ যুক্তি আছে। আসলেই তো। যাকে নবী হিশেবে মানে, তার বিরুদ্ধে এরা কীভাবে এরকম ধারণা পোষণ করে?
আহসান আঙ্কেল বললেন—তোমার কথা বুঝতে পেরেছি আমি। তবে এ ব্যাপারে তাদের কাছে একটি যুক্তি আছে। তারা বলে—শিশু ইসমাঈল নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সন্তান হিশেবে ততদিন পর্যন্ত স্বীকৃত ছিলেন যতদিন ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্ম হয়নি। ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মের সাথে সাথে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সন্তান হবার মর্যাদা। হারিয়ে ফেলেন।