হাসলেন সৌমিত্র দা। বললেন, আর বোলো না সেসব কথা। অ্যারিস্টটল জ্ঞানী লোক ছিলেন বটে, তবে তিনি জীবদ্দশায় যে-ভুলগুলো করে গিয়েছেন, সেগুলো ছিল খুবই মারাত্মক লেভেলের। এমনকি, তার একটি ভুলের কারণে পদার্থবিজ্ঞান অন্ধকারে ছিল পুরো দেড় হাজার বছর।
কোন ভুল?, জানতে চাইল সবুজ।
পৃথিবী ও সূর্যের ঘূর্ণন সম্পর্কে। অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে, সূর্য পৃদ্বিীকে কেন্দ্র করে ঘোরে। তার কথা যেহেতু গ্রিকবাসীরা ঈশ্বরের বাণীর মতোই বিশ্বাস করত, তাই এই মতের বাইরে কেউ কিছু চিন্তা করলেও সেটাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া হতো।
সৌমিত্র দার কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম। বললাম, আজব তো! অ্যারিস্টটল সত্যিই কি বিশ্বাস করত, সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে?
হ্যাঁ, বলল সৌমিত্র দা।
কথা বলতে বলতে ত্রিশ টাকায় কেনা বাদাম শেষ হয়ে গেল। সৌমিত্র দা আবার বলতে লাগলেন, যাহোক, প্রথমদিকে সবাই ডেমোক্রিটাসের বিরোধিতা করলেও পরে দেখা গেল ডেমোক্রিটাসই আসলে সঠিক ছিল। মহাবিশ্বের প্রতিটি বই ক্ষুদ্রতম সূক্ষ্ম কণার সমষ্টি। এটাকে বাংলাতে বলা হয় পরমাণু। পরম+অণু। পরমাণু হলো বস্তুর এমন একটি পর্যায়, যাকে আর ভাঙা বা বিভাজন করা যায় না। তবে মজার ব্যাপার হলো ডেমোক্রিটাস একটি জায়গায় সঠিক হলেও অন্য জায়গায় একদম ভুল ছিলেন।
সৌমিত্র দার এই ভুল-ঠিক এর মহড়া শুনতে শুনতে মনে হলো পৃথিবীর তাবৎ মহা ভুলগুলো সম্ভবত এই মোটা মাথার বিজ্ঞানীরাই করে গেছেন। নবীন বলল, ডেমোক্রিটাস কোন জায়গায় ভুল ছিলেন?
ডেমোক্রিটাস বলেছিলেন, পরমাণুই হলো বস্তুর সর্বশেষ অবস্থা। এরপর আর কোনো অবস্থা নেই। পরমাণুকে ভাঙা যায় না, বিভাজন করা যায় না ইত্যাদি; কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, পরমাণুই বস্তুর পরম অবস্থা নয়। অর্থাৎ পরমাণুই বস্তুর শেষ অবস্থা নয়।
পঙ্কজ বলল, আমি কিন্তু খুব মজা পাচ্ছি সৌমিত্র দা। আমার তো এখন মনে হচ্ছে এই বিজ্ঞানীদের আসলে বিশ্বাস করাই ঠিক না। হা-হা-হা।
পঙ্কজের কথা শুনে আমরা সকলে হেসে উঠলাম। সৌমিত্র দা বললেন, বিজ্ঞান তো এমনই। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। এ জন্যে এক নাম-না-জানা কবি বিচ্ছেদের পরে প্রেমিকাকে বিজ্ঞানের সাথে তুলনা করে বলেছিলেন, তোমরা উভয়েই ছলনাময়ী।
এরকম কালজয়ী কবিতাশুনে আমরা আরেক দফা হেসে নিলাম। সৌমিত্র দা আবার বলতে শুরু করলেন, ডেমোক্রিটাসের এই তত্ত্ব বিজ্ঞান মহলে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল। সতেরোশো সালেও বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন, পরমাণুই হলো বস্তুর সর্বশেষ অবস্থা, যেটাকে আর কোনোভাবে ভাঙা বা বিভাজন করা যায় না। এরপর, ডেমোক্রিটাসের এই তত্ত্বকে আরও মজবুত ভিত্তি দেন ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডাল্টন। আঠারোশো সালের দিকে এসে তিনি পরমাণুর গঠন নিয়ে একটি মতবাদ দেন। তার সেই মতবাদ পাঁচটি স্বীকার্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তার দেওয়া সেই পাঁচটি স্বীকার্যের মধ্যে তিন নম্বর স্বীকার্যটি হলো, পরমাণুসমূহ কখনোই বিভাজিত, সৃষ্টি বা ধ্বংস হতে পারে না।
ডাল্টনের এই মতবাদ আসার পরে ডেমোক্রিটাসের তত্ত্ব আরও শক্ত ভিত্তি পেয়ে যায়। এভাবে চলেছিল আরও বেশ কয়েক বছর। এরপর, আঠারোশো সালের শেষের দিকে। এসে বিজ্ঞানী জে জে থমসন এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের ইতি ঘটিয়ে দিলেন।
কীভাবে?, প্রশ্ন করল সবুজ।
বিজ্ঞানী জে জে থমসন পরমাণু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে পরমাণুর ভেতরে আরেকটি নতুন অবস্থা আবিষ্কার করলেন। সেটি হলো ইলেক্ট্রন। অর্থাৎ এতদিন ধরে যে বিশ্বাস করা হতো, পরমাণুকে ভাঙা যায় না, বিভাজন করা যায় না, পরমাণুই বস্তুর সর্বশেষ অবস্থা, তার যবনিকাপতন হলো। বিজ্ঞানী জে জে থমসন প্রমাণ করে দেখালেন, পরমাণুকেও ভাঙা যায়, বিভাজন করা যায়। পরমাণুকে বিভাজন করলে ইলেক্ট্রন পাওয়া যায়। ব্যস, রাতারাতি ভেঙে পড়ল ডেমোক্রিটাস আর জন ডাল্টনের মতবাদ। প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন তত্ত্ব।
আমি বললাম, কিন্তু বিজ্ঞান তো আর ইলেক্ট্রনেই বসে নেই। পরমাণুকে ভাঙলে এর অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াসের মধ্যে নিউট্রন আর প্রোটনও পাওয়া যায়।
এক্সাক্টলি, বলল সৌমিত্র দা। আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হলো, কীভাবে একটি ভুল মতবাদ, ভুল তত্ত্ব দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে বিজ্ঞান মহলে টিকে ছিল চিন্তা করো।
পঙ্কজ বলল, তার মানে আঠারোশো সালের আগপর্যন্ত পৃথিবীর কেউই জানত না—পরমাণুর চেয়েও ছোট বস্তু থাকতে পারে?
হ্যাঁ, বলল সৌমিত্র দা। বিজ্ঞানী জে জে থমসনের আবিষ্কারের আগে পৃথিবীর কেউই জানত না—প্রমাণুর চেয়েও ছোট বস্তু থাকতে পারে। তখন সবাই এটাই বিশ্বাস করত যে, পরমাণুই হলো বস্তুর সর্বশেষ অবস্থা এবং একে আর ভাঙা যায় না।
এতক্ষণ ধরে সাজিদ একটি কথাও বলেনি। এবার মুখ খুলল সে। বলল, সৌমিত্র দা, আমি একটু কথা বলতে চাই।
সৌমিত্র দা বললেন, অবশ্যই অবশ্যই। আমি তো আরও ভাবছিলাম যে—আমার বলা শেষ হলেই আমি তোমার কাছ থেকে শুনব।
তোমার কি বলা শেষ?
হ্যাঁ।
আচ্ছা। তোমার গল্পটি কিন্তু বেশ উপভোগ্য ছিল। তুমি তো জানোই যে, তুমি আমার প্রিয় একজন বক্তা। সাজিদের কথা শুনে হাসল সৌমিত্র দা। বলল, মাই প্লেজার!