আজকের আড্ডার টপিক ঠিক করা হলো বিজ্ঞান। বলবেন সৌমিত্র দা। আমাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আরিফ, আড্ডা শুরুর আগে তুই আমাদের একটি। কবিতা আবৃত্তি করে শোনা। সবকিছুরই একটি উদ্ভোধনী থিম থাকে। আমাদের আজকের আড্ডার উদ্বোধন হোক তোর আবৃত্তির মাধ্যমে।
সৌমিত্র দার এই আবদারের সাথে তাল মিলালো পঙ্কজ আর মিলন। বলল, একদম ঠিক বলেছ সৌমিত্র দা। আজকাল আরিফ আর আমাদের কবিতা শোনায় না। কবিতার কথা উঠলেই সে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।
সৌমিত্র দা আমাকে বললেন, কীরে, অভিযোগ কি সত্য? কবিতার সাথে তোর এমন বিচ্ছেদের কারণ কী?
আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম। সৌমিত্র দা আবার বললেন, কবিতার সাথে বিচ্ছেদ হোক আর যা-ই হোক, আজকে তোর কবিতা না শুনে আড্ডা শুরু হবে না, ব্যস।
সৌমিত্র দার সাথে আবার মাথা নেড়ে সায় জানাল মিলন আর পঙ্কজ। তাদের জোরাজুরি কবি হেলাল হাফিজের দুই লাইনের একটি কবিতা শুনিয়ে দিলাম সবাইকে।
নিউট্রন বোমা বোঝো
মানুষ বোঝে না।
এই দুই লাইনের কবিতা আবৃত্তি শেষ হলেই সৌমিত্র দা জানতে চাইলেন, কবিতা শেষ?
আমি বললাম, হুম।
কী বলিস! এত ছোট কবিতা দিয়ে কীভাবে উদ্বোধন হবে? উদ্বোধন হতে হয় বিশাল সাইজের কবিতা দিয়ে। জসীম উদ্দীনের কবর কবিতা, ফররুখের পাঞ্জেরি অথবা রবি ঠাকুরের সোনার তরীর মতো সাইজে বিশাল না হলে কবিতা শুনে মজা আছে, বল?
আমার বেশ রাগ লাগল। বললাম, দেখো সৌমিত্র দা, তুমি শুধু একটি কবিতা আবৃত্তিই শুনতে চেয়েছিলে। আমাকে কিন্তু কবিতার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কেমন হবে তা বলে দাওনি।
কবিতার দৈর্ঘ্য-প্রস্থের কথা শুনে খলখল করে হেসে উঠল সৌমিত্র দা। হাসি থামিয়ে বলল, রাগ করিস না ভাই। এমনিতেই মজা করলাম। তবে, হেলাল হাফিজের এই ছোট্ট কবিতাটি কিন্তু আমার অলটাইম ফেভারিট। আমি আমার সম্পাদিত লিটল ম্যাগ ফুর-এর স্লোগান হিশেবে এই দুই লাইন ব্যবহার করতাম।
আমাদের আড্ডাস্থল থেকে অল্প দূরেই একজন বাদামওয়ালা বাদাম বিক্রি করছেন। শুকনো মুখে আড্ডা জমবে না বিধায় নবীন গিয়ে ত্রিশ টাকার বাদাম নিয়ে এলো। বাদাম মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে সৌমিত্র দা বলল, আরিফ যখন নিউট্রন বোমা নিয়ে কবিতা শোনাল, তখন আমারও ইচ্ছে করছে নিউট্রন-প্রোট্রন আর পরমাণুর গল্প বলতে। কী বলিস তোরা?
সবাই হ্যাঁ বলে সম্মতি জানাল। সবার সম্মতি পেয়ে বলতে শুরু করল সৌমিত্র দা। সবুজকে উদ্দেশ্য করে বলল, অ্যাই এডিসন, তুই কি কখনো ডেমোক্রিটাসের নাম শুনেছিস?
সবুজ কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, তুমি কি গ্রিক ফিলোসফার ডেমোক্রিটাসের কথা বলছ, যিনি প্রথম পরমাণুর ধারণা দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, বলল সৌমিত্র দা, আমি তার কথাই বলছি।
এই লোক ছিলেন একজন বিখ্যাত ফিলোসফার। যিশু খ্রিষ্টেরও অনেক আগে জন্মেছিলেন তিনি। তার সমসাময়িক অন্যান্য দার্শনিকদের মধ্যে একটি প্রশ্ন নিয়েই কেবল হইচই হতো। প্রশ্নটি ছিল, এই মহাবিশ্ব আসলে কী দিয়ে তৈরি?
দার্শনিকদের কেউ বলত মহাবিশ্ব হলো পানির তৈরি, কেউ বলত এই নিখিল বিশ্ব হলো বাতাসের তৈরি। কারও কারও মত ছিল এই মহাবিশ্ব আসলে আগুনের একটি পিণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। এরকম নানান কথা-উপকথা প্রচলিত ছিল তৎকালীন দার্শনিকদের মধ্যে; কিন্তু ওই সময়টায় বসে একেবারে ভিন্ন চিন্তা করতে পেরেছিলেন ডেমোক্রিটাস। তিনি কী বলেছিলেন জানো?
কী?, বলল মিলন।
ডেমোক্রিটাস বলেছিলেন যে, এই মহাবিশ্ব বাতাস, আগুন, পানি কোনোকিছু দিয়েই তৈরি নয়। এই মহাবিশ্ব আসলে অসংখ্য অদৃশ্য ক্ষুদ্রতম কণার সমষ্টি।
ডেমোক্রিটাস সেই অদৃশ্য কণাগুলোর নাম রেখেছিলেন অ্যাটম।
আমি বললাম, গ্রিক ভাষাতেও অ্যাটমকে কি অ্যাটমই বলা হতো?
ভালো প্রশ্ন, বলল সৌমিত্র দা। এরপর তিনি পকেট থেকে কলম আর এক টুকরো কাগজ বের করলেন। তাতে খচখচিয়ে কিছু একটি লিখে সেটি উল্টো করে আমাদের দিকে ধরলেন। আমরা দেখলাম তাতে একটি অপরিচিত ভাষায় লেখা dropos
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটি কী?
সৌমিত্র দা বললেন, গ্রিক ভাষায় অ্যাটমকে এভাবেই লেখে। ৫ অর্থ হলো। Never আর ropos অর্থ হলো ICut। তার মানে dropos শব্দের অর্থ দাঁড়ায়- Uncuttable। মানে, যা কাটা যায় না।
অর্থাৎ ডেমোক্রিটাস বলেছেন, অ্যাটম হচ্ছে কণার সেই অবস্থা, যাকে আর ভাঙা যায় না, কাটা যায় না, বিভাজন করা যায় না। তিনি বলতে চেয়েছেন, এই মহাবিশ্ব এমন কণা দ্বারা তৈরি যেগুলো চাইলেই আর বিভাজন করা যায় না, আলাদা করা যায় না।
এবার প্রশ্ন করল নবীন। সে বলল, তো, ডেমোক্রিটাসের এই কথা তখনকার সময়ে অন্যরা কি মেনে নিয়েছিল?
একদমই না, বলল সৌমিত্র দা। ডেমোক্রিটাসের সমসাময়িক দার্শনিক ছিলেন অ্যারিস্টটল। তখন তো চারদিকে অ্যারিস্টটলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। অ্যারিস্টটল যা বলত, সবাই তা বিনা বাক্যব্যয়ে বিশ্বাস করে নিত। কেউ কোনো আপত্তি করত না। ডেমোক্রিটাস যখন সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বললেন, মহাবিশ্ব আসলে আগুন, পানি আর বাতাসের তৈরি নয়, মহাবিশ্ব অ্যাটম দিয়ে তৈরি, তখন অন্য সবার সাথে ডেমোক্রিটাসের বিরোধিতা করেছিলেন স্বয়ং অ্যারিস্টটলও।
অদ্ভুত! অ্যারিস্টটলের মতো এরকম জ্ঞানী লোক কীভাবে ডেমোক্রিটাসের মতের বিরুদ্ধে যেতে পারে?, প্রশ্ন করলাম আমি।