ডেভিড বলল, গ্রেট, মাই ফ্রেন্ড। তোমার এক্সপ্লেনেশান আমার খুবই ভালো লেগেছে। এরপর সে অ্যালেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি কিছু বলবে অ্যালেন?
অ্যালেন না-সূচক মাথা নাড়ল। সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছে যে, তার দাবিটি ভুল ছিল। কাবার অস্তিত্ব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়কাল থেকে নয়; বরং যিশু খ্রিষ্টেরও বহু বহু আগ থেকেই এটির অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল।
অ্যালেন আমাদের কাউকে বিল পরিশোধ করতে দিল না। শ্যামলী স্কয়ার থেকে বের হয়ে আমরা অ্যালেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে আমরা তিনজনই উঠে পড়লাম তাতে। ট্যাক্সি ছেড়ে দেওয়ার পরে ডেভিড মাথা বের করে চিৎকার করে বলতে লাগল, অ্যালেন, ক্রিসমাস পার্টিতে যেয়ে না কিন্তু, মাই ফ্রেন্ড।
ডেভিডের কথা শুনে অ্যালেন মুচকি হাসল। হাসলাম আমরাও। ডেভিডের মতো সহজ-সরল মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর।
দ্রুতই অ্যালেন আমাদের দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল। মিলিয়ে গেল ঢাকা শহরের যানবাহনের মধ্যে। আমরা ছুটে চললাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। বিকেল হতে চলেছে। মসজিদে আসরের আযান পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণে।
————-
১ The history of decline & the fall of the Roman Empire, Volume- 5, Page : 223-224
২ Gustave E. Von Grunebaum, Classical Islam: A History 600-1258, Page : 19
১৫. নিউটনের ঈশ্বর
বাংলাদেশে আজ ডেভিডের তৃতীয় দিন। সে এতদিন ক্যান্টিনে খাওয়ার বায়না করে যাচ্ছিল; কিন্তু গতরাতে আমার কাছে ক্যান্টিনের বিখ্যাত-সব গল্প শুনে পারলে তো সে বমি করে বসে। তাকে বলছিলাম ক্যান্টিনগুলোর ঐতিহ্যবাহী গল্পগুলো। গল্প বলা শেষ হলে সে খক খক করে বলে উঠল, আসলেই কি তরকারিতে মশা-মাছি পাওয়া যায়?
আমি জোর দিয়ে বললাম, শুধুই কি মশা-মাছি? কপাল ভালো হলে জুট মিলের রশিও পাওয়া যেতে পারে। কপাল আরেকটু ভালো হলে নেংটি ইদুরের বাচ্চা, এমনকি তেলাপোকার সন্ধান লাভেও বিস্ময়ের কিছু নেই।
আমার কথা শুনে সে আবার খক খক করে ওয়াশ রুমের দিকে দৌড় দিল। সাদা চামড়ার আমেরিকানের কাছে এসব বিদঘুটে লাগতেই পারে; কিন্তু বাঙালি ছাত্রদের কাছে এই ব্যাপারগুলো এখন একপ্রকার ঐতিহ্যের মতো হয়ে গেছে। ক্যান্টিনে খেতে এসেছে অথচ কোনোদিন এরকম ঘটনার সাক্ষী হয়নি, এমন ছাত্র খুজে পাওয়াই ঢের মুশকিল হবে। আর আমাদের ক্যান্টিনের বিখ্যাত ডাল-কাহিনির কথা তো বাদই দিলাম।
নীলনদের পানিকেই সবচেয়ে স্বচ্ছ পানি বলে জানতাম; কিন্তু যেদিন প্রথম ক্যান্টিনের ডালের চেহারা দেখেছি, সেদিনই ভুলটি ভেঙে গেছে। আমাদের ক্যান্টিনের ডালের পানির চেয়ে স্বচ্ছ আর কোনোকিছু থাকতেই পারে না।
এসব গল্প শোনার পরে ক্যান্টিনে খাওয়ার সব-আশা ডেভিড জলাঞ্জলি দিয়ে দিল। কিচেন থেকে তিন কাপ চা নিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হলো সাজিদ। ডেভিড আর আমার হাতে চা দিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল সে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ডেভিডের উদ্দেশ্যে সাজিদ বলল, আচ্ছা ডেভিড, ড্যান ব্রাউনের লেখা তোমার কেমন লাগে?
ড্যান ব্রাউনের কথা শুনেই ডেভিড মুখ খিচিয়ে বলল, জঘন্য লাগে। ডেভিড মুখের যে এক্সপ্রেশন নিয়ে জঘন্য লাগে শব্দদ্বয় উচ্চারণ করল তা ছিল দেখার মতো। সাজিদ বলল, জঘন্য লাগার কারণ? ভদ্রলোক তো খুব ভালো লেখে। নিউ ইয়র্ক টাইমস কি বলল শোনোনি তাকে নিয়ে? হ্যারি পটারের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী কেবল ড্যান ব্রাউন। ভাবা যায়? কেউ কেউ তো আরও কয়েক কাঠি সরেস তার ব্যাপারে। একজন তো বলেই ফেলেছিল যে ড্যান ব্রাউন হচ্ছে ইতিহাসের সেই রাজপুত্রের মতো যে এলো, দেখল এবং জয় করে নিল।
ডেভিড তার মুখের অবস্থার কোনোরকম পরিবর্তন না করেই বলল, আই সী…! লোকটি যতখানি না লেখক তারচেয়ে বেশি হলো ধর্মবিদ্বেষী। ক্রিশ্চিয়ানিটি নিয়ে তার মধ্যে বেশ ভালো রকমের এলার্জি আছে। আমার কী মনে হয় জানো সাজিদ? আমার মনে হয় লোকটি নিজেই একজন ইলুমিনাতির সদস্য।
হেসে উঠল সাজিদ। বলল, হতেও পারে। দুনিয়ার কে যে কোনদিকে ইলুমিনাতি হয়ে বসে আছে তা আমরা কেউই টের পাই না। এমনও হতে পারে, তুমি নিজেই একজন ইলুমিনাতির সদস্য এবং আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে বেড়াচ্ছ।
সাজিদের কথা শুনে ডেভিড তার মুখটি আরও শক্ত করে বলল, আর ইউ কিডিং? হোয়াই শুড আই বি অ্যা মেম্বার অফ দ্যাট বুলশিট ইলুমিনাতি?
এই আমেরিকান যে কেবল ড্যান ব্রাউনের ওপরেই খেপে আছে তা নয়, গুপ্ত সংস্থা ইলুমিনাতির ওপরেও সে দেখছি ভীষণরকম বিরক্ত! সাজিদ বলল, তা, ড্যান ব্রাউনকে তোমার ধর্মবিদ্বেষী বলে মনে হয় কেন?
ধর্মবিদ্বেষী নয় তো কী? লোকটি জোর করে প্রমাণ করতে চায় যে ক্রিশ্চিয়ানিটি হলো বিজ্ঞানবিরোধী ধর্ম। আদিকাল থেকেই চার্চ নাকি বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এসেছে। তুমিই বলো সাজিদ, এসব কথার কি কোনো ভিত্তি আছে আদৌ? পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীরা খ্রিষ্টান ছিলেন। বিজ্ঞানী নিউটনের কথাই ধরো। তিনি তো আগাগোড়া একজন ধার্মিক খ্রিষ্টান লোক ছিলেন। কই, চার্চ কি কখনো তার বিজ্ঞানচর্চায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে? আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিই যার হাতে গড়া, আজীবন তিনি নিজেই ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ খ্রিষ্টান। ক্রিশ্চিয়ানিটি যে বিজ্ঞানবিরুদ্ধ কোনো ধর্ম নয়, এই প্রমাণ তো স্বয়ং নিউটনই, তাই না?