নীলু দা বলল, যত যুক্তিই থাকুক না কেন, শস্যক্ষেত্র শব্দটি নারীর জন্য যথেষ্ট অপমানজনক এবং অসম্মানের বলে মনে করি।
একজন কৃষক এবং তার শস্যক্ষেত্র নিয়ে ভুল ধারণা থাকলেই কেবল এই উপমাটিকে অপমানজনক বলা যায়। একজন কৃষকের কাছে তার শস্যক্ষেত্রের চেয়ে বেশি আপন আর কী হতে পারে? একজন কৃষক কতটা যত্নের সাথে, পরিচর্যার সাথে তার শস্যক্ষেতের দেখভাল করে তুমি জানো? তাছাড়া, এখানে শস্যক্ষেত্রের উপমাটি এজন্যেই টানা হয়েছে; কারণ, একজন কৃষক তার শস্যক্ষেত্রকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চাষ করতে পারে। সে চাইলে লম্বালম্বি চাষ করতে পারে, অথবা আড়াআড়িভাবে চাষ করতে পারে। এতে কিন্তু ফসলের কোনোই ক্ষতি হয় না। কুরআনও ঠিক একই উপমা টেনে বলছে—তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে যেভাবে ইচ্ছা সহবাস করো। সামনের দিক হতে অথবা পেছনের দিক হতে। এতে করে তোমাদের সন্তানেরা অবশ্যই ট্যারা হয়ে জন্মাবে না। এটা একটি কুসংস্কার। এই কুসংস্কার থেকে তোমরা বেরিয়ে আসো। কুরআন পুরুষদের কৃষক বানিয়ে বলছে-নারীরা হলো তোমাদের শস্যক্ষেত্রস্বরুপ। তোমাদের শস্যক্ষেত্রের জন্য যেমন তোমরা উত্তম বীজ, উত্তম সার, উত্তম পরিচর্যার ব্যবস্থা করে থাকো, ঠিক সেভাবেই তোমাদের স্ত্রীদের সাথেও তোমরা উত্তম ব্যবহার, উত্তম আচরণ, উত্তম কর্ম সম্পাদন করবে।
সাজিদের কথা শুনে নীলু দা আবারও চুপ হয়ে গেল। সাজিদ বলতে লাগল, নারীদের শস্যক্ষেত্র বলে কুরআন যদি তাদের অপমান করে থাকে, তাহলে একই সূরার ১৮৭ নাম্বার আয়াতে যে বলা আছে—They (your wives) are clothing for you and you are clothing for them. অর্থাৎ তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য বসূরূপ, আর তোমরা তাদের জন্য বস্রস্বরূপ। এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পুরুষদের নারীর বস্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন। বলো তো, কাপড়ের মতো খুবই তুচ্ছ জিনিসের সাথে তুলনা দিয়ে কুরআন কি তাহলে পুরুষদের অপমান করেছে? একদমই না। মূলত এই উপমা দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বুঝিয়েছেন যে—স্বামী আর স্ত্রী একে-অপরের খুবই কাছের। তারা এতই কাছের যেভাবে কাপড় শরীরের সাথে লেপ্টে থাকে।
মাগরিবের আযান পড়তে শুরু করেছে। এতক্ষণ পরে নীলু দা আমার দিকে তাকাল। আমি তখনো মন খারাপ করে বসে আছি। নীলু দা আমার পিঠে হালকা চিমটি কেটে বলল, কবি ভাই, আপনার কবিতার জন্য কিন্তু আমি অপেক্ষা করে আছি এখন।
আমার মনে পড়ল নীলু দাকে কবিতার একটি পাণ্ডুলিপি দেবো বলেছিলাম। পরীক্ষার চাপে সে কথা বেমালুম ভুলে বসে আছি আমি। নীলু দার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করে বললাম, পেয়ে যাবে নিশ্চয়ই।
আমার কথায় মুচকি হাসল নীলু দা। বলল, দেখো ভাই, সুনীলের কবিতার মতো হয়ে যেয়ো না যেন!
বললাম, সুনীলের কোন কবিতা?
ওই যে, কেউ কথা রাখেনি…। হা-হা-হা।
নীলু দার কথা শুনে আমরা তিনজনই হেসে উঠলাম। নীলু দাকে বিদায় জানিয়ে সালাত পড়ার জন্যে আমরা ছুটে এলাম সেন্ট্রাল মসজিদে। প্রথম রাকআতে ইমাম সাহেব তিলাওয়াত করছেন সূরা দোহা। সুললিত কণ্ঠের তিলাওয়াতে পুরো মসজিদ এক অপূর্ব সুরের মূর্ঘনায় ছেয়ে গেছে।
০২. A Reply to Christian Missionary
ভদ্রলোকের তারুণ্যদীপ্ত চেহারা। চুল আর দাড়িতে পাক ধরায় মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই যেন বয়স বেড়ে গেছে; কিন্তু চেহারার মধ্যে তারুণ্যের ছাপ স্পষ্ট। এই মুহূর্তে তিনি খুব মন খারাপ করে আমার সামনে বসে আছেন। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের মুখ ভারী হলে আশপাশের পরিবেশ গুমোট আকার ধারণ করে। ভদ্রলোকও সেরকম একজন মানুষ। মনখারাপ অবস্থাটা ওনার সাথে একদমই যাচ্ছে না।
তার ফোন বেজে উঠল। কপাল কুঁচকে তিনি ফোনের দিকে তাকালেন। দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তিনি খুবই বিরক্তি বোধ করছেন। ফোনটি বাজতে বাজতেই বন্ধ হয়ে গেল। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন। তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করলেন; কিন্তু কৃত্রিম হাসিতে তাকে একদম মানায়নি।
তাকে প্রশ্ন করলাম, তো, আপনি খ্রিষ্টান মিশনারিদের কোথায় পেলেন?
প্রশ্ন শুনে তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেন। বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি পান করলেন। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, আমার এক বৃটিশ বন্ধু লন্ডনে মিশনারিদের একটি দাওয়া-প্রোগ্রামে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল; সেখানেই।
আপনার বন্ধু কি মুসলিম?
না। খ্রিষ্টান।
ও আচ্ছা।
ভদ্রলোকের সমস্যা সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া দরকার। তিনি সম্প্রতি খ্রিষ্টান মিশনারিদের কাছ থেকে একটি তথ্য পেয়েছেন। এই তথ্যটি এতটাই বিদঘুটে যে, এর সত্যাসত্য না জানা অবধি ভদ্রলোক কোনো শাস্তি পাচ্ছেন না। তথ্যটি হলো—কুরআনে নির্দিষ্ট করে বলা নেই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সেদিন ঠিক কাকে কুরবানী করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে নাকি ইসহাক আলাইহিস সালামকে? হাদীসেও এটির তেমন কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না; কিন্তু মুসলিমরা নাকি অন্ধভাবেই বিশ্বাস করে যে—ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সেদিন ইসমাঈল আলাইহিস সালামকেই কুরবানী করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কুরআন এই ইস্যুতে কোনো নির্দিষ্ট নাম ব্যবহার না করলেও বাইবেলে উল্লেখ পাওয়া যায়, সেদিন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে নয়, ইসহাক আলাইহিস সালামকে কুরবানী করতে নিয়ে গিয়েছিলেন।