সাজিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বুঝতে পেরেছি লম্বা একটি লেকচার ঝাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। তবে এই মুহূর্তে তার লেকচার শোনার কোনোরকম ইচ্ছে আমার নেই। উঠে হাঁটতে পারলেই বাঁচি; কিন্তু সম্মানিত এক সিনিয়র বড় ভাই সাথে আছেন বলে এভাবে ওঠা-ও সম্ভব না। তাই ইচ্ছে না থাকলেও সাজিদের লেকচার গলাধঃকরণ ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো উপায় নেই।
এবার সাজিদ বলতে শুরু করল, বুঝতে পেরেছি। তুমি নিশ্চয়ই সূরা বাকারার ২২৩ নাম্বার আয়াতের কথা বলছ, তাই না?
নীলু দা না জানার ভান করে বলল, আমি আসলে জানি না কুরআনের কোথায় এটা বলা আছে। তবে আমি নিশ্চিত হয়েছি এরকম কিছু ব্যাপারে। এরকম কিছু যদি থেকে থাকে, তাহলে এই বক্তব্যের সাথে কি তুই একাত্মতা পোষণ করিস, সাজিদ?
সাজিদ আবারও কয়েক মুহূর্ত ভাবল। এরপর বলল, আমি একাত্মতা পোষণ করি কি, সেটি জরুরি নয়। জরুরি হচ্ছে কুরআনের এই আয়াত থেকে তুমি কী বুঝেছ সেটি।
নীলু দা বলল, নতুন করে আর কী বুঝব? ওখানে তো খুব স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে নারীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। তোমরা তাদের যেভাবে মন চায় ব্যবহার করো। নারীর জন্য এর চেয়ে অপমানজনক কথা আর কিছু কি থাকতে পারে, বল?
সাজিদ নীলু দার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, এভাবে উত্তেজিত হচ্ছ কেন দাদা ভাই? কুল! আমি তো তোমাকে ঠান্ডা মাথার লোক হিশেবেই জানি। তোমার কাছ থেকে এরকম তাড়াহুড়ো কিন্তু একদম আশা করি না।
সাজিদের কথা শুনে নীলু দা একটু নরম হলো বলে মনে হচ্ছে। নীলু দা বলল, কিন্তু সাজিদ, ব্যাপারটা খুবই সাংঘাতিক নয় কি? একটি ধর্মগ্রন্থে কীভাবে এরকম কথা লেখা থাকতে পারে বল? আবার এই কথা কোটি কোটি মানুষ পড়ে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করে। কী অদ্ভুত!
তুমি যেভাবে ভাবছ ব্যাপারটি আসলে সেরকম নয়।
সাজিদের কথা শুনে বেশ অবাক হলো নীলু দা। বলল, মানে কী? তুই বলতে চাইছিস কুরআনে এমন কোনো কথা নেই?
থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে।
তাহলে?
কুরআনের ওই কথাগুলোকে তোমরা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে থাক।
বিতর্ক জমে উঠছে। সাজিদের সাথে রাগ করে উঠে না গিয়ে ভালোই করেছি। আমার সাবেক তার্কিক বড় ভাইয়ের সাথে বর্তমান বন্ধুর তর্কটা উপভোগ্য হবে বলেই মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে নীলু দার জায়গায় মফিজুর রহমান স্যার হলে নিশ্চিত সাজিদকে মহামতি আইনস্টাইন বলে ঠাট্টা করত; কিন্তু নীলু দা সেরকম নয়। খুবই ঠান্ডা মেজাজের লোক। বলল, তুই বলতে চাচ্ছিস যে, কুরআনের এই কথার অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে?
হ্যাঁ।
কী সেটি? জানতে চাইল নীলু দা।
সাজিদ দীর্ঘ বক্তব্য শুরুর আগে যা করে এবারও তাই করল। প্রথমে ঝেড়ে কেশে নিল। এরপর বলতে শুরু করল, সবার আগে আমরা কুরআন থেকে ওই অংশটুকু দেখে নিই যা নিয়ে তুমি কথা উঠিয়েছ। এটি আছে সূরা বাকারার ২২৩ নাম্বার আয়াতে। কুরআনে বলা হয়েছে, Your wives are a tilth for you, so go to your tilth when or how you will. অর্থাৎ তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্রস্বরূপ। সুতরাং, তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করো। আয়াতটির অর্থ বলা শেষ হলে সাজিদ আবার বলতে লাগল, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এই আয়াতটি দ্বারা কুরআন নারীদের অতি তুচ্ছ শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা তো করেছে, সাথে তাকে পুরুষের যৌন-চাহিদা মেটানোর জন্য নারীদের যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করার অনুমতিও দিচ্ছে, তাই না?
নীলু দা লল, তা নয়তো কী?
হাসল সাজিদ। হেসে বলল, দেখা যাক কুরআন আসলে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছে। আচ্ছা নীলু দা, তোমাকে একটি প্রশ্ন করি। তুমি কি জানো, কুরআন কার ওপর নাযিল হয়েছিল?
নীলু দা বলল, নবী মুহাম্মদের ওপর।
এক্সাক্টলি। তাহলে কুরআনকে আমাদের ঠিক সেভাবেই বুঝতে হবে, যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝেছেন এবং বুঝিয়েছেন, তাই না?
মাথা নাড়ল নীলু দা। সাজিদ তার বক্তব্য চালিয়ে গেল, কুরআনের আয়াতগুলো বুঝতে হলে সবার আগে সেগুলো নাযিলের প্রেক্ষাপট, অবস্থা এবং ঘটনার পরম্পরা ঝতে হবে। সুতরাং তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করো এই অংশ দিয়ে কি সত্যিই নারীদের ওপর পুরুষের যেমন ইচ্ছা যৌন-ক্ষুধা নিবারণের নির্দেশ কুরআন দেয় কি না এটা জানার আগে তোমাকে তৎকালীন আরবে ইহুদীদের একটি কুসংস্কার সম্পর্কে জানাই। সেটি হচ্ছে, তৎকালীন আরবের ইহুদীরা বিশ্বাস করত যে, যদি স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের সাথে পেছনের দিক হতে সহবাস করে তাহলে উক্ত মিলনের ফলে তাদের গর্ভে ট্যারা সন্তানের জন্ম হবে। অর্থাৎ পেছনের দিক হতে সবাস করাটা তৎকালীন ইহুদীরা নাজায়েয মনে করত। তারা ভাবত এতে করে নাকি ট্যারা সন্তান ভূমিষ্ট হয়। ইমাম ইবনু কাসীর রাহিমাহুল্লাহ তার বিখ্যাত তাফসীর তাফসীরে ইবনে কাসীর-এ এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এসম্পর্কিত বেশকিছু বিশুদ্ধ হাদীসের রেফারেন্স টেনেছেন। সেখানে একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, একবার ইবনু উমার কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। কুরআন তিলাওয়াত করতে করতে তিনি যখন এই আয়াতে, অর্থাৎ তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্রস্বরুপ। সুতরাং, তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করো-তে এলেন, তখন পাশের একজন সাহাবীকে ডেকে বললেন, নাফী! এইমাত্র আমি যে আয়াত তিলাওয়াত করলাম সেটি নাযিলের প্রেক্ষাপট কি তুমি জানো?