ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়;
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
উঠোনজুড়ে জোছনা নেমেছে। শিমুলের গা বেয়ে লকলকিয়ে উঠেযাওয়া সন্ধ্যামালতির চারা, গোয়ালঘরটার কোণে বুড়োর মতো ঝিমুতে থাকা ডালিম ফলের গাছ আর পুব দিকে বুক ফুলিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা অশ্বথের চেহারা এই আলো-আঁধারীতেও বেশ বোঝা যাচ্ছে। আমরা আবার এসেছি সাজিদদের গ্রামে। বরিশাল জেলার রসুলপুর গ্রাম। গত বছরও ঠিক এই সময়টায় আমরা রসুলপুরে এসেছিলাম।
উঠোনে বিছানো মাদুরে গোল হয়ে বসে আছি। রাহাত, জোবায়ের, সঞ্জু, সাজিদ আর আমি। এরা মূলত সাজিদের বন্ধু। আমার সাথে গতবারই প্রথম পরিচয়। রাহাত শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে। জোবায়ের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রিতে পড়ত; কিন্তু উদ্যোক্তা হবার ঝোঁক ওঠায় পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এখন গরুর খামার নিয়ে ব্যস্ত। সঞ্জু আবার এতদূর আগাতে পারেনি। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে টাকা-পয়সার অভাবে পড়াশোনার ইতি টেনে দিয়েছে। সাজিদ এসেছে শুনে বেচারা চৌদ্দ মাইলের রাস্তা সাইকেলে পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে। আমাদের মাঝখানে আছে সরিষার তেল দিয়ে মাখানো মুড়ি। খাঁটি সরিষার তেলের গন্ধে আমার নাকে ইতোমধ্যেই জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে। ঢাকার দূষিত আবহাওয়া আর ভেজাল খাদ্যদ্রব্য খেতে খেতে খাঁটি জিনিসে রি-অ্যাকশান দেখা দিচ্ছে কি না কে জানে!
মুড়ি চিবোতে চিবোতে রাহাত আমায় বলল, তুমি মশাই ভালোই ম্যাজিক পারো।
বললাম, মানে!
মানে হলো, সাজিদের মতো গোঁড়া নাস্তিক আমি আমার জীবনে একটিও দেখিনি। তাকে কত রকমে বুঝাতাম সৃষ্টিকর্তা, ইসলাম, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে। কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। সে জেদ ধরে পাল্টা প্রশ্ন করত। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করতাম অবশ্য; কিন্তু সে গোঁ ধরে থাকত। তখন এত বিরক্ত লাগত যে, একটি সময় ওকে বোঝানোই ছেড়ে দিই। এরকম অসাধ্য তুমি ভাই সাধন করে ফেলেছ। রিয়েলি, ইউ ডিড অ্যা গ্রেট জব।
রাহাতের কথাগুলোতে বেশ বাড়াবাড়ি আছে। আমি আসলে সাজিদকে আস্তিক হবার মতো আহামরি কিছু বোঝাইনি কখনো। তবে একটি ব্যাপার ঠিক, সাজিদ কোনো কিছু জানতে চাইলে তখন সে খুব বেশি প্রশ্ন করে। প্রশ্ন করা অবশ্য খারাপ কিছু নয়। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সজল স্যার প্রায়ই বলেন, যে-ছাত্র প্রশ্ন করে না, ধরে নিতে হবে পড়াশোনায় সে বেশি ফাঁকিবাজ।এই মুহূর্তে আমার জায়গায় সাজিদ হলে রাহাতের এই বক্তব্যের বিপরীতে কুরআনের আয়াত টেনে বলত, হেদায়াত জিনিসটি কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার হাতে। কেউ ইচ্ছে করলেই কাউকে হেদায়েত দিতে পারে না। মানুষ কেবল চেষ্টা করতে পারে।
আমাদের কথার মাঝখানে জোবায়ের বলে উঠল, তো, আজকে আমরা কোন বিষয়ে গল্প করব?
রাহাত বলল, ভ্রমণ কাহিনি বিষয়ক গল্প হতে পারে। সাজিদ তো দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে বেড়ায়। ওর কাছে কাশ্মীর, নেপালের পোখারা ভ্রমণের কাহিনি শুনতে পারি আমরা।
সাজিদের সব ভ্রমণের কাহিনিই আমার আদ্যোপান্ত শোনা আছে। তাই আমি মতামত দিলাম সাহিত্যালাপের পক্ষে। সঞ্জু কোনো মতামত দেয়নি। যেন শুনে যাওয়াতেই তার আনন্দ। জোবায়ের বলল, আচ্ছা, ইলুমিনাতি নিয়ে আলাপ করলে কেমন হয় রে? ড্যান ব্রাউনের থ্রিলার পড়ার পর থেকে আমি তো ইলুমিনাতি নিয়ে খুবই আগ্রহী হয়ে পড়েছি। সারাক্ষণ রহস্য নিয়ে ভাবতে মন চায়।
সাজিদ বলল, তো, নিজেকে তুই কি রবার্ট ল্যাঙডন ভাবতে শুরু করেছিস নাকি?
সাজিদের কথা শুনে আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম। হাসল জোবায়েরও। ইলুমিনাতি নিয়ে আমারও বেশ আগ্রহ আছে অনেক আগ থেকেই। এই সিক্রেট সোসাইটির ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত শুনতে শুনতে আগ্রহের পারদ উঁচু থেকে আরও উঁচুতে উঠেছে বলা যায়। আমি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা সাজিদ, ইলুমিনাতি বলতে সত্যিই কি কিছু আছে পৃথিবীতে? সাজিদ উত্তর দেওয়ার আগে জোবায়ের বলে উঠল, থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। তবে থাকার সম্ভাবনাই বেশি…।
কীভাবে?, আমি জানতে চাইলাম।
থাকার সম্ভাবনা বেশি এ কারণেই, কারণ, গডলেস একটি পৃথিবী নির্মাণের চিন্তা অনেক পুরোনো। সেই চিন্তার বাস্তবতা এখন আমরা সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি। আজকের উন্নত বিশ্ব থেকে বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিয়া, সবখানেই বস্তুবাদের রাজত্ব। আমি বললাম, তুমি কি বস্তুবাদকেই ইলুমিনাতি বলতে চাচ্ছ?
ঠিক তা নয়। তবে বস্তুবাদের ধ্যান-ধারণার সাথে ইলুমিনাতির চিন্তাভাবনার মধ্যে ব্যাপক মিল পাওয়া যায়।
এবার মুখ খুলল সঞ্জু। বলল, দাঁড়া। ইলুমিনাতি জিনিসটাই-বা কী সেটাই তো বুঝলাম না। এরকম নাম তো কখনো শুনিনি আমি।
জোবায়ের বলল, ইলুমিনাতি হলো একটি গোপন ভ্রাতৃসংঘের নাম। ইলুমিনাতি শব্দটির অর্থ এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়ন। এই গোপন সংঘে তারাই যোগ দিত, যারা হাইলি কোয়ালিফাইড; যেমন-বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, ব্যবসায়ী ইত্যাদি।
সঞ্জু বলল, তা বুঝলাম। তবে এটিকে গোপন ভ্রাতৃসংঘ বলছিস কেন?
এটি গোপন এ জন্যেই; কারণ, এটি তৈরিই হয়েছিল তৎকালীন খ্রিষ্টধর্মের বিরুদ্ধে।
কারণ কী?
কারণ, খ্রিষ্টধর্মের অনেক নিয়মকানুন তখনকার অনেকে মেনে নিতে পারেনি। খ্রিষ্টানদের কবল থেকে মুক্তি পেতে সমাজের সবচেয়ে জ্ঞানী লোকদের সমন্বয়ে এই ইলুমিনাতি গড়ে ওঠে বলে ধারণা করা হয়। তবে, ক্রিশ্চিয়ানিটির ব্যাপক প্রভাব এবং শক্তিমত্তার কারণে তারা কখনোই সামনে আসতে পারেনি।