সৌরভ ডায়েরির পাতা উল্টে পড়তে লাগল। খেয়াল করলাম, সে ডায়েরির একেবারে শেষদিক থেকে শুরু করেছে। ডায়েরির পাতায় বড় বড় করে একটি শিরোনাম লেখা, গল্পে জল্পে ডারউইনিজম। সৌরভ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করল…
ডারউইন হলেন বিবর্তনবাদের জনক। পৃথিবীতে সকল উদ্ভিদ এবং প্রাণী এসেছে একটি এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে, এই তত্ত্বকে জনপ্রিয় করার নেপথ্যনায়ক হলেন এই ডারউইন। তার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে নানান রকম গল্প, ঘটনা জানা যায়; কিন্তু আজকে আমি ডারউইন তথা তার তত্ত্বের যে-দিকটি লিখতে যাচ্ছি, সেটি একটি বিধ্বংসী দিক। এই দিকটার কথা খুব কম বিবর্তনবাদী জানে অথবা জানলেও স্বীকার করে না।
প্রকৃতিতে প্রাণীদের টিকে থাকার ব্যাপারে যে-তত্ত্ব ডারউইন প্রস্তাব করেছিল, সেটি ছিল ন্যাচারাল সিলেকশান। অর্থাৎ প্রকৃতিই বেছে নেবে দিনশেষে প্রকৃতিতে কে টিকবে আর কে বিলুপ্ত হবে। ডারউইন তার বিখ্যাত বই, যেটিকে বিবর্তনবাদের বাইবেল বলা হয়, সেটির নামও রাখেন এটিকে মূল বিষয় ধরে। বইটির নাম Origin of species: By means of natural selection. বইটির নাম থেকেই বইটির বিষয়বস্তু সহজে অনুমেয়। কীভাবে প্রকৃতির বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রাণীর উদ্ভব হয়। বলা বাহুল্য, এই ন্যাচারাল সিলেকশান-কে অনেকে সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট হিশেবেও উল্লেখ করে থাকে। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট মানে হলো যোগ্যতমের টিকে থাকার লড়াই। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্টের মূল কথা হলো, প্রকৃতিতে একটি অবিরাম সংগ্রাম চলছে। এই সংগ্রাম হলো টিকে থাকার সংগ্রাম। দিনশেষে প্রকৃতিতে তারাই টিকে থাকবে, যারা যোগ্য। অযোগ্য এবং দুর্বলেরা বিলুপ্ত হবে।
আপাতদৃষ্টিতে এই কথাগুলোকে বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা মনে হলেও এই কথাগুলো দ্বারা উৎসাহিত হয়ে মানব-ইতিহাসে ঘটে গেছে এমন কিছু ঘটনা, যার দায় ডারউইনিজম কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
সৌরভ খুব অবাক হলো। বায়োলজির একজন ছাত্র হিশেবে তাকে ডারউইনিজম পড়তে হয়। পড়তে হয় ন্যাচারাল সিলেকশানের কথা, এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের আবির্ভাবের ব্যাপারেও তাকে পড়াশোনা করতে হয়। সে জানে এই থিওরিটি বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত একটি থিওরি। এই থিওরির বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীমহল থেকে নানান ধরনের ক্রিটিসিজম আসলেও সে সম্পর্কে খুব-একটা কনসার্ন নন অ্যাকাডেমিক সাইন্সের হর্তাকর্তারা। কোনো এক অদৃশ্য কারণে তারা মাইকেল বেহে, মাইকেল ডেন্টন, জোনাথন ওয়েলস, ডগুলাস এক্স, স্টিফেন মায়ারসহ আরও অনেক বিজ্ঞানীর বিবর্তনের বিরুদ্ধে অ্যাকাডেমিক কাজকে পাত্তা দেন না। সৌরভ কারও কারও কাছে শুনেছে, পশ্চিমা বস্তুবাদী মহল নাকি পুরোটাই টিকে আছে এই বিবর্তনবাদের ওপর ভর করে। বিবর্তনবাদ ভেঙে পড়লে তাদের সব পরিকল্পনা মুহূর্তেই ভেস্তে যাবে আর পৃথিবী ধর্মহীন করার যে-চক্রান্ত, সেটি নস্যাৎ হয়ে পড়বে। এ জন্যেই বর্তমান বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া বস্তুবাদীরা বিজ্ঞানের অন্দরমহলে কখনোই স্রষ্টাকে ঢুকতে দেবে না। ধর্মহীন পৃথিবী গড়তে একমাত্র বিবর্তনবাদই হলো তাদের তুরুপের তাস; কিন্তু এই ডায়েরিতে এমন কী লেখা আছে, যা সম্পর্কে সৌরভ জানে না? বেড়ে গেল তার কৌতূহলের মাত্রা। সে পরের পৃষ্ঠা উল্টাল। আবারও গভীর মনোযোগের সাথে পড়তে লাগল সে।
হিটলারের ঘটনা আমরা সকলেই জানি। প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদী খুন করার মাধ্যমে সে পৃথিবী থেকে ইহুদী-জাতিকে বিলুপ্ত করে দিতে চেয়েছিল। নিঃসন্দেহে, এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বোরোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম। ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও হিটলার হয়ে ওঠে একজন বিধ্বংসী নাস্তিক। তার দৃষ্টিতে ইহুদীরা ছিল নিচু জাত, ম্লেচ্ছ। যারা ম্লেচ্ছ, তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার থাকতে পারে না এটাই ছিল হিটলারের চিন্তাধারা। এই চিন্তাধারার বীজ কোথায় প্রোথিত আমরা কি তা জানি? এই চিন্তাধারার বীজ প্রোথিত ছিল ডারউইনের সেই Natural selection থিওরিতে। হিটলার তার Mein Kampf তথা My Struggle নামের আত্মজীবনীতে GIC3301, If nature doesnt wish that weaker individuals should mate with the stronger, she wishes even less that a superior race should intermingle with an inferior one; because in such cases all her efforts, throughout hundreds of thousands of years, to establish an evolutionary higher stage of being, may thus be rendered futile.
But, such a preservation goes hand-in-hand with the inexorable law that it is the strongest and the best who must triumph and that they have right to endure. he who would live, must fight. he who doesnt wish to fight in this world, where permanent struggle is the law of life, hasnt the right to exist.[১]
হিটলারের আত্মজীবনীর এই কথাগুলো খুব মনোযোগের সাথে যদি আমরা খেয়াল করি, তাহলে দেখব যে—এখানে ঠিক সেই কথাগুলোই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যা আমাদের চার্লস ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশান শেখায়। হিটলার বলেছে If nature doesnt wish, এখানে Nature বলতে হিটলার কী বুঝিয়েছে? চার্লস ডারউইনের সেই ন্যাচারাল সিলেকশান নয়তো? হিটলার খুব স্পষ্ট করেই দুটি ধারার কথা বলেছেন। একটি হলো Superior race, অন্যটি হলো Inferior race. অর্থাৎ সবল আর দুর্বলের মধ্যে একটি সংঘাত, একটি লড়াই যে প্রকৃতিতে বলবৎ, সেটি হিটলার খুব স্পষ্ট করেই লিখেছেন। ঠিক একই কথাগুলো আমরা ন্যাচারাল সিলেকশান তথা প্রকৃতির বাছাইকরণ পদ্ধতির মধ্যেও দেখতে পাই।