সাজিদ হাঁটা শুরু করেছে। সে খুব ধীরপায়ে হাঁটে। তাকে বললাম, ব্যাটাকে বেশ ভালো জব্দ করেছিস।
সাজিদ আমার দিকে উদাস নয়নে তাকাল। আমার এই কমপ্লিমেন্ট সে গায়ে মাখল না। অবশ্য সে প্রশংসার কোনো কিছুই গায়ে মাখে না।
০৯. গল্পে জল্পে ডারউইনিজম
সৌরভ। সোহরাওয়ার্দী হলে নতুন উঠেছে। সারা দিন আমার পেছনে ছায়ার মতো লেগে থাকে। তার একটি ব্যাপার আমার খুব চোখে পড়ে। সে যখন আমাকে ভাইয়া বলে ডাকে, তখন তার দুই গালে খুব সুন্দর টোল পড়ে। তার গালে টোল-পড়া দেখে আমার হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত কবিতার দুটো লাইন মনে পড়ে যায়। কবি লিখেছিলেন—
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাব
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে।
সৌরভ অবশ্য শিশু নয়, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া তাগড়া যুবক। তবুও তার গালে টোল পড়া দেখে তাকে শিশুদের মতোই দেখায়।
তিন দিন ধরে সে আমার কাছে বায়না ধরেছে। তার খুব ইচ্ছা সে সাজিদকে দেখবে। আমার কাছে সাজিদের এত এত গল্প শুনে সে নাকি সাজিদের বিশাল বড় ফ্যান হয়ে গেছে। সেদিন ভোরবেলায় দেখি আমার রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। বলা-কওয়া ছাড়া তার এমন আগমনে বিস্মিত হয়ে বললাম, এত সকাল সকাল আমার কাছে?
সে বলল, তোমার কাছে আসিনি তো। সাজিদ ভাইয়ার কাছে এসেছি।
আমি বেশ অবাক হওয়ার মতো করে বললাম, সাজিদের কাছে যে এসেছিস, সাজিদ জানে?
সে মুখ কালো করে বলল, তা কী করে জানবে? সাজিদ ভাইয়াকে তো আমি চিনি না। ভাইয়াও আমাকে চেনে না।
আমি কঠিন চেহারায় বললাম, তাহলে বললি যে, সাজিদের কাছে এসেছিস?
সে বলল, ওমা! তুমিই তো বলেছিলে তোমরা একই রুমে থাকো। ভাবলাম হঠাৎ করেই চলে আসি। তোমাকে আর সাজিদ ভাইয়াকে, দুজনকেই চমকে দিই।
সৌরভের চমকে দেওয়ার কথা শুনে আমার নিজেরই চমকে যাওয়া উচিত। সাজিদকে ভালো করে চিনলে সে সাজিদকে চমকে দেওয়ার কথা মুখেই আনত না। যে-ছেলের পাশে বোমা ফাটলেও টনক নড়ে না, সৌরভকে দেখে সে যে চমকে যাবে, এই দৃশ্য ভাবতেই আমার হেসে কুটিকুটি হতে মন চাচ্ছে। সৌরভকে বললাম, তোর টাইমিংটা ভুল ছিল রে। এক সপ্তাহ হলো সাজিদ নেই। বাড়িতে গেছে।
সৌরভ হতাশ কণ্ঠে বলল, ওহ।
সমস্যা নেই। আমি তো আছি। বল তোর কী কী জানা লাগবে? সাজিদের চেয়ে আমি ভালো উত্তর দিয়ে থাকি আজকাল।
সৌরভ হেসে উঠে বলল, ফাজলামো কোরো না তো। সাজিদ ভাইয়াকে সেই কবে থেকেই দেখতে চাচ্ছি।
আচ্ছা, ফাজলামো বাদ। ভেতরে এসে বস। একটি সারপ্রাইজ আছে তোর জন্যে।
সারপ্রাইজের কথা শুনে সৌরভের চোখমুখ ঝলমল করে উঠল। সে বলল, সাজিদ ভাইয়া ভেতরেই আছে, তাই না?
না তো।
তার চেহারার ঝলমলে ভাবটি মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল। বলল, তাহলে সারপ্রাইজটি কী?
উঠতি ছেলেপিলেদের এই এক সমস্যা। ধৈর্য থাকে না মোটেও। খানিকটা কর্কশ গলায় বললাম, তোকে যখন বলেছি সারপ্রাইজ আছে, তখন তো কিছু একটি আছেই, তাই না? এত প্রশ্ন করিস কেন?
সৌরভ বেশ লজ্জিত চেহারায় বলল, সরি ভাইয়া।
ভাইয়া বলতে গিয়ে বেচারার গালে টোল-পড়া দেখে আমি হেসে দিলাম। বললাম, হয়েছে। এবার ভেতরে আয়।
সৌরভ ভেতরে এসে বসল। ছেলেটি বেশ ভদ্র। কম কথা বলে। কিছু বললে মনোযাগ দিয়ে শোনে। দ্বিমতের জায়গাগুলো খুব ধীরে-সুস্থে তুলে ধরে।
আমি তাকে বললাম, চা খাবি, সৌরভ?
সে মাথা নেড়ে বলল খাবে না। নিজের জন্যে এক কাপ চা করে নিয়ে আমি চেয়ারে এসে বসলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে, সাজিদের বুক শেলফটি দেখিয়ে বললাম, এটি হচ্ছে আমাদের বিখ্যাত মি. আইনস্টাইনের বুক শেলফ।
সৌরভ আমার দিকে বেশ অদ্ভুতভাবে তাকাল।বলল, আইনস্টাইনের বুক শেলফ মানে?
কোনা-চোখে সৌরভের দিকে তাকালাম। তার চোখেমুখে বিস্ময়ের রেশ ফুটে উঠেছে। বুঝতে পারলাম সাজিদের আইনস্টাইন হয়ে ওঠার গল্পটি তার কাছে করা হয়নি। এ জন্যেই বেচারা চমকে গেছে। বললাম, সে এক লঙ্কা-কাহিনি। অন্যদিন করা যাবে।
হালকা নীরবতার পরে সৌরভ বলল, কী সারপ্রাইজ সেটি তো বললে না?
আরে তাইতো!ওকে তো একটি সারপ্রাইজ দেববলেছিলাম; কিন্তুকী যেদিই! এদিক-সেদিক তাকাতেই আমার চোখ গিয়ে আটকালো সাজিদের ড্রয়ারের দিকে। ইউরেকা! এই ড্রয়ারেই তো তার বিখ্যাত ডায়েরিটি থাকে। মান্ধাতা আমলের সেই ডায়েরি…।
উঠে গিয়ে তার ড্রয়ার খুলে ডায়েরিটি বের করলাম। সৌরভের হাতে দিয়ে বললাম, এইটাই হলো সারপ্রাইজ!
সে চোখ বড় বড় করে ডায়েরিটির দিকে তাকিয়ে বলল, এটি তো একটি ডায়েরি মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ। ডায়েরিই তো।
এটি দিয়ে আমি কী করব?
পড়বি।
তোমার ডায়েরি পড়ে আমি কী করব?
ধুর! এটি আমার ডায়েরি না। এটি সাজিদের ডায়েরি। খুব বিখ্যাত ডায়েরি আমার মতে।
ডায়েরিটি সাজিদের এই কথা শুনে ওর মুখ ঝলমল করে উঠল। পরক্ষণেই বলল, কিন্তু সাজিদ ভাইয়ার ডায়েরি এভাবে পড়া কি ঠিক? তিনি যদি কিছু মনে করেন?
সৌরভের ব্যবহারের মতো তার কমনসেন্সটাও ভারি চমৎকার। অন্যের সামান্য ডায়েরি পড়ার ব্যাপারেও সে কতকিছু চিন্তা করে। আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এরকম কমন-সেন্সের বড়ই অভাব। আমি বললাম, শোন, এই ডায়েরিটি তার বিভিন্ন ভাবনা, ভ্রমণ-কাহিনি, অভিজ্ঞতার লেখাজোখাতে ঠাসা। সাজিদের এই ডায়েরি পড়ার অনুমতি আমার আছে। আমি তোকে অনুমতি দিলাম। তুই নিশ্চিন্তে পড়তে পারিস। মন চাইলে পড়। আমি হালকা পড়াশোনা করে নিই।