বড়দা বললেন, বুঝতে পারলাম।
এগুলো হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু বিবাহের কিছু কারণ। এসব ছাড়া আরও কারণ আছে। যেমন—পুরুষদের জন্য যে-সব মাসআলা-মাসায়েল, সেগুলো তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে সরাসরি জেনে নিতেন বা শুনে নিতে পারতেন; কিন্তু নারীদের ব্যাপারে সে সুযোগ ছিল না। কারণ, পর্দার বিধান লঙ্ঘন করে তিনি নারীদের সামনে গিয়ে মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আলাপ করতে পারেন না। তাহলে নারীরা কীভাবে রাসূলের কাছ থেকে শিখবে? জ্ঞানার্জন করবে? তাদের জন্য এই কাজটি সহজ হয়ে যায় উম্মুল মুমিনীন তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের মাধ্যমে। তিনি স্ত্রীদের সাথে যে-সব মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আলাপ করতেন, তার স্ত্রীগণ সেগুলো অন্য নারীদের জানিয়ে দিতেন। এভাবেই দ্বীনের জ্ঞান নারীদের মধ্যেও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে; কিন্তু একজন স্ত্রীর পক্ষে একা কখনোই এই দায়িত্ব পালন করা সহজ ছিল না। এ ছাড়াও, বহু স্ত্রীর মধ্যে কীভাবে সমতা রক্ষা করতে হবে এই শিক্ষা উম্মাহকে দিয়ে যাওয়াও অন্যতম একটি কারণ।
সাজিদ কথা বলা থামিয়ে আরেক গ্লাস পানি পান করল। রমেশ আচার্য নামের লোকটি কিছুই বলছে না। বড়দা ওরফে দীনেশ আচার্য বললেন, রমেশ দা কিছু বলবে?
তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, না।
আমাদের হাতের সময় ফুরিয়েছে। চলে আসার জন্য আমরা উঠে দাঁড়ালাম। দুই আচার্যের সাথে হ্যান্ডশেক করে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। বড়দা আমাদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। বাইরে আসামাত্র সাজিদ বলল, তুই যে-সাদা ফুলগুলোর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলি, সেই ফুলগুলোর নাম জানিস?
সাজিদের কথা শুনে আমি হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার অবাক হবার কারণ হলো, আমি যখন ফুলগুলো দেখছিলাম তখন সে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে ছিল। সে কীভাবে বুঝল যে আমি তখন সাদা রঙের ফুলগুলো দেখছিলাম?
আমি যে-বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি সেদিকে তার কোনো ভুক্ষেপ নেই। সে বলল, ওই ফুলগুলোর নাম হলো মধুমঞ্জরি। ইংরেজরা ওই ফুলগুলোকে ডাকে রেংগুনকিপার নামে। আর আসার সময় প্রকাণ্ড সাইজের মাথাওয়ালা যে-লোকটির সাথে ঝগড়া করেছিস, সে ওগুলোকে উইকেটকিপার নামে ডাকে। বড়দা তাকে কত করে শেখায় এই ফুলগুলোর নাম রেংগুনকিপার, বেচারা তবুও ভুল করে ডাকে উইকেটকিপার বলে। হা হা হা…। সাজিদের হাসি দেখে আমারও হাসি পায়। ফুলের নাম উইকেটকিপার! দারুণ তো!…
০৮. জান্নাতেও মদ?
সকালবেলার ক্যাম্পাস অন্যরকম সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। দোয়েল চত্বরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলগাছটির মগডাল দেখলে প্রথমেই আগুনের গোলা ভেবে যে-কেউ ভুল করতে পারে। মন্টু দার দোকানের পেছনে এঁকেবেঁকে উঠে যাওয়া অর্কিডের গাছ আর রাস্তার দু-পাশে সেনাপতির মতো দাঁড়িয়ে থাকা বকুল, সবমিলিয়ে ক্যাম্পাসটি যেন পৃথিবীর বুকেই এক টুকরো স্বর্গ।
সকালে বুক ভরে মুক্ত বাতাস গ্রহণের তাগিদে এই তল্লাটে অনেকের আগমন ঘটে থাকে। পিজি হাসপাতালের রোগী থেকে শুরু করে বিজি বিজনেসম্যান, পড়ুয়া ছাত্র থেকে শুরু করে পড়ানো শিক্ষক—সকালবেলা সবাই খুব ফুরফুরে মন নিয়ে এদিকটায় হেঁটে যায়।
আজ রবিবার। আমার আর সাজিদ, দুজনের একজনেরও ক্লাস নেই। এদিনটায় আমরা সাধারণত আড্ডা দিয়ে থাকি। খুব ভোরবেলায় সাজিদ রুম থেকে বের হয়েছে। এখনো ফেরার নামগন্ধ নেই। চোখ কচলাতে কচলাতে গতরাতে করা অ্যাসাইনমেন্টের ওপরে ফাইনাল রিভিশন দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের পাশের যে রুমে পার্থরা থাকে, সেখান থেকে জোর ভলিউমে রবীন্দ্রনাথের গান ভেসে আসছে।
খেয়াল করলাম বাইরে থেকে গানের আওয়াজ ছাড়াও কিছু কর্কশ চিৎকার আর আওয়াজের শব্দ ভেসে আসছে। কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকেই যে এই শব্দ আসছে সেটি নিশ্চিত। অ্যাসাইনমেন্ট পেপার ভাঁজ করে টেবিলে রেখে গায়ে শাল জড়িয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ফাগুনের এ সময়টায় ভোরবেলা মৃদুমন্দ শীত পড়ে। এই শীতে গায়ে শাল জড়ানোর দরকার পড়ে না অবশ্য; কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে লুকোনো জ্বর আর সর্দিতে কাহিল হয়ে ওঠা শরীর এই শীতকেও প্রচণ্ড রকম ভয় পাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে গায়ে শাল তোলা। যাই হোক, রুম থেকে বেরিয়ে দূর থেকে আসা চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ লক্ষ্য করে এগোতে থাকলাম। দেখতে পেলাম, পূর্বপাশে অবস্থিত থার্ড বিল্ডিংটার নিচে ছোটখাটো একটি জটলা হয়ে গেছে। ওই বিল্ডিংয়ের সবাইকেই চিনি না আমি। কোনো একটি ব্যাপার নিয়ে তারা বেশ তর্কাতর্কি আর হট্টগোল শুরু করেছে বুঝতে পারছি।
আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম জটলাটার দিকে। খুব কাছে না গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়ালাম। কোনো একটি জায়গায় যখন সব মানুষ একসাথে কথা বলে, তখন সম্ভবত কেউই কারও কথা শুনতে পায় না। শুনতে না পেলেও মানুষগুলো অনর্গল কথা বলেই যায়। বলে আনন্দ পায়। তারা ভাবে, তাদের কথা অন্যরা খুব আগ্রহভরে শুনছে। এরকম দূরত্বে থেকে আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না আসলে ঘটনা কী।
মধ্যবয়স্ক গোছের একজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আঙ্কেল, একটু কথা বলা যাবে?