তাই নাকি? জানতে চাইল রমেশ আচার্য।
জি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম শুনেছেন? পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক?
হ্যাঁ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি উপন্যাসের নাম হচ্ছে প্রথম আলো। ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক রথী-মহারথী ব্যক্তিত্বের জীবনী তিনি সেখানে চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। ব্রিটিশ ভারতের সময়কালে, অর্থাৎ ১৯০০ সালের দিকে ত্রিপুরার মহারাজ চন্দ্র মাণিক্যের যে অনেকগুলো রক্ষিতা ছিল, সেই কাহিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুব সুন্দরভাবেই তুলে ধরেছেন উপন্যাসটিতে। চন্দ্র মাণিক্যের ওই রক্ষিতাদের গর্ভে তার অনেক সন্তান জন্মলাভ করে, যাদের চন্দ্র মাণিক্যের পৌরুষের প্রতীক বলা হতো।
আই সী, অবাক হলেন দীনেশ আচার্য।
এই হচ্ছে আমাদের সমাজের খুব নিকট-অতীতের কথা। আর, রমেশ দা বলছেন আমি কেন চৌদ্দশো বছর আগের কালচার টেনে একাধিক বিয়েকে জাস্টিফাই করছি।
রমেশ আচার্য কাচুমাচু মুখ নিয়ে বললেন, সরি টু সে সাজিদ। এসব আসলে আমার জানা ছিল না।
ফাইন। আমি আপনাকে বিব্রত করার জন্যে এসব ইতিহাস টেনে আনিনি। আমি শুধু এটি দেখাতে চেয়েছিলাম যে, এই কালচারটি কত আগেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংস্কার করে গিয়েছেন। নারীদের তিনি দিয়ে গেছেন তাদের প্রাপ্য মর্যাদা। পরিপূর্ণ অধিকার…।
দীনেশ আচার্য বললেন, আমার মনে হয় কী জানো? মুহাম্মাদের এগারোটি বিয়ের পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে। তোমার কী মনে হয় সাজিদ?
অবশ্যই, সাজিদ বলল। আপনি যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের সব ঘটনা পরম্পরায় সাজান, আপনি অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করবেন যে, সেগুলোর পেছনে যৌক্তিক কোনো-না-কোনো কারণ অবশ্যই রয়েছে। আর বিয়ে হলো একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বেলাতেও সেটি প্রযোজ্য। এরকম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর পেছনে কোনো লজিক থাকবে না, তা কীভাবে হয়?
কী সেই কারণগুলো?, জানতে চাইল রমেশ আচার্য।
সাজিদ বলতে লাগল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়ে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন, তখন তিনি হয়ে উঠলেন মুসলমানদের একচ্ছত্র নেতা, একচ্ছত্র সেনাপতি। তার কিছু বিয়ে ছিল সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব অর্পণের জন্য। যেমন সাওদা রাযিয়াল্লাহু আনহা। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা মারা যাওয়ার পরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চার কন্যাসন্তানকে দেখভালের তাগিদেই তিনি তাকে বিয়ে করেন। তার কিছু বিয়ে ছিল অন্য গোত্রের সাথে জোরদার সম্পর্ক তৈরির খাতিরে। যেমন বনু মুসতালিক গোত্রের নেতা হারেসার কন্যা জুরাইরিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহার কথাই ধরুন। পিতা হারেসার সাথে বন্দি হয়ে আসার পরে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মুক্তি চাইলে তিনি তাকে মুক্তি দেন এবং বিবাহেরও প্রস্তাব দেন। এতে তিনি রাজি হন এবং তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরে হারেসা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্বশুর হয়ে গেলেন। এদিকটি বিবেচনা করে সাহাবীরা বনু মুসতালিক গোত্রের সবাইকে মুক্ত করে দেয়। এতে বনু মুসতালিক গোত্রের সকলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সঙ্গীদের আচার, আচরণ ও মহত্ত্ব দেখে ইসলাম গ্রহণ করে। ঠিক একই রকম ব্যাপার সাফিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহার বেলাতেও। এভাবে ইসলামের চরম শত্র গোত্রগুলো পরিণত হলো ইসলামের পরম মিত্র গোত্রে। বলুন তো বড়দা, একজন পলিটিশিয়ান হিশেবে, একজন রাষ্ট্রনায়ক হিশেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই কৌশলকে আপনি কীভাবে দেখবেন?
ইট ওয়াজ ডেফিনেটলি অ্যা গুড ডিসিশান। বড়দা বললেন। এরপর নিজের খুব কাছের সাহাবীদের সাথে সম্পর্ক আরও মজবুত, আরও শক্তিশালী করার জন্যে তিনি তাদের সাথেও সম্পর্ক পেতেছেন। তিনি বিয়ে করেছেন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর কন্যা হাফসা রাযিয়াল্লাহু আনহা এবং আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর কন্যা আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে। শুধু তা-ই নয়, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের কন্যা ফাতিমা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাথে এবং কুলসুম আর রুকাইয়াহকে বিয়ে দিয়েছেন উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাথে। আপনি ইসলামের ইতিহাস দেখুন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর কিন্তু এই চারজনই ধারাবাহিকভাবে খলীফা তথা মুসলমানদের আমীর নির্বাচিত হয়। এবার বুঝতে পেরেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কৌশলটি কত বিস্তৃত ছিল?
বড়দা এবং রমেশ আচার্য, দুজনেই চুপ করে আছে। সাজিদ বলতে লাগল, যাইনাব বিনতে জাহাশ, যিনি ছিলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফাত বোন, তার সাথেও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। কেন জানেন?
রমেশ আচার্য জানতে চাইল, কেন?
কারণ, আরবের প্রচলিত নিয়ম ছিল, পালকপুত্র হলো নিজের পুত্রের মতো। তাই পালকপুত্রের স্ত্রীকে পরে কেউ বিয়ে করতে পারত না, নিষিদ্ধ ছিল। ইসলাম এসে এই সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করে। রাসূল তার পালকপুত্র যায়েদের কাছ থেকে তালাক পাওয়া যাইনাব বিনতে জাহাশকে বিয়ে করে আরবদের জৈবনিক প্রমাণ দিয়ে দেখালেন যে, পালকপুত্র কখনোই নিজের পুত্র হতে পারে না। তাদের তালাক দেওয়া, তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়া নারীদেরও বিয়ে করা যায়। এটাই হলো যাইনাব বিনতে জাহাশ রাযিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ে করার পেছনে অন্যতম মাহাত্ম্য।