চিন্তা করুন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কীসের লোভ দেখানো হলো? রাজা হওয়ার এবং আরবকুলের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারীদের ভোগ করতে পারার লোভ; কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী বলেছিলেন সেদিন, জানেন?
কী?
তিনি তাদের প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমার একহাতে যদি সূর্য আর অন্য হাতে চাঁদও এনে দাও, তবুও আমি এই সত্যপ্রচার থেকে একটুও পিছপা হবো না। কী আশ্চর্য! যে-লোককে আজ নাস্তিকরা নারীলোভী বলতে চাচ্ছে, সেই লোকের সামনে যখন আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারীদের হস্তগত করার সুযোগ এলো, তিনি সেই প্রস্তাব হেসেই উড়িয়ে দিলেন। বলুন তো বড়দা, এরকম নারীলোভী আপনি কখনো দেখেছেন জীবনে?
খেয়াল করলাম, দীনেশ আচার্য নামের লোকটি ঢোক গিলল দু-বার। টেবিলে থাকা জগ থেকে পানি ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে পান করে সাজিদ আবার বলতে শুরু করল—মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে যে-কয়টি বিবাহ করেছেন তাদের সবাই ছিলেন বয়স্কা এবং বিধবা; কেবল আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা ব্যতীত। অথচ একটি হাদীসে পাওয়া যায়, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার জাবির ইবনু আব্দিল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কুমারী কোনো নারীকে বিয়ে করেছেন কি না। জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন বললেন, তিনি একজন বিধবাকেই বিয়ে করেছেন, তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কুমারী মেয়েকে বিয়ে করলে না কেন? তাহলে তোমরা দুজনে মিলে আনন্দ করতে পারতে।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন যে, কুমারী নারী বিয়ে করলে শারীরিক তৃপ্তি বেশি পাওয়া যায়। তাই তিনি জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহুকে কুমারী কেন বিয়ে করল না সে-ব্যাপারে প্রশ্ন করলেন। অথচ তিনি নিজে যাদের বিয়ে করেছেন তাদের সবাই ছিলেন বয়স্কা এবং বিধবা। যদি তিনি নারীলোভীই হতেন, তাহলে তো তিনি বেছে বেছে কুমারী মেয়েদেরই বিয়ে করতেন, তাই না?
এক্সাক্টলি, আমি বললাম।
সাজিদ বলতে লাগল, এই আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনোই নারীলোভী ছিলেন না। এটি স্রেফ তার নামে অপবাদ।
রমেশ আচার্য বলে উঠলেন, মাই ডিয়ার সাজিদ, আমি এখনো এই বিষয়টাই বুঝতে পারলাম না, কেন তার এতগুলো স্ত্রীর দরকার ছিল?
লোকটার কথা শুনে আমার মাথা তৃতীয় বারের মতো গরম হয়ে গেল। সাজিদ কিছু বলার আগে আমি বলে উঠলাম, মি. আচার্য, আমি কিছু বলতে চাই। লোকটি আমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, শিওর।
আপনি কি নিজেকে একজন নাস্তিক দাবি করেন?
অবশ্যই করি।
আপনি কি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী?
অবশ্যই।
আপনি যখন ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, তাহলে আরেকজন লোক কেন এতগুলো বিয়ে করল সেটি তো আপনার মাথাব্যথার কারণ হতে পারে না, তাই না? কে কতগুলো বিয়ে করল সে ব্যাপারে তো আপনার নাক গলানোর কিছু নেই।
তুমি খুব বেশিই রেগে যাচ্ছ মাই ডিয়ার, লোকটি বললেন।
সাজিদ আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় আমাকে ধৈর্য ধরতে এবং চুপ করতে বলল। লোকটিকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম; কিন্তু সাজিদের অনুরোধে নিজের ক্ষোভ নিজের ভেতরেই চাপা দিলাম।
সাজিদ বলতে লাগল, আচ্ছা, আমার একটি প্রশ্ন আছে। বহুবিবাহ ব্যাপারটি যদি কোনো সমাজে পারমিটেড কিছু হয়, তাহলে সেটি অনুসরণ করতে কোনো অসুবিধে আছে কি?
না, বললেন সাজিদের বড়দা ওরফে দীনেশ আচার্য।
ঠিক আছে। আমরা যদি তৎকালীন আরবের দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাব, জাহিলিয়াতের ওই সময়টায় নারীদের না ছিল কোনো মর্যাদা, না ছিল কোনো অধিকার। সে-সময়ে জীবন্ত কন্যাশিশুদের কবরস্থ করা হতো। পুরুষকুল নারীদের রক্ষিতা হিশেবে ব্যবহার করত। ঠিক এমনই একটি সময়ে এসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের মর্যাদা সমুন্নত করে দিলেন। তিনি নিজে নারীদের স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে দেখিয়ে দিলেন—নারীরা রক্ষিতা হবার জিনিস নয়।
রমেশ আচার্য বলে উঠলেন, বাট, চৌদ্দশো বছর আগে আরবের কালচারে কী ছিল আর কী হতো তা দিয়ে তো তুমি মুহাম্মাদের বহুবিবাহকে জাস্টিফাই করতে পারো না সাজিদ।
কোনটি চৌদ্দশো বছর আগের কালচার?, সাজিদ জানতে চায়।
এই যে, আরবে তখন নারীদের রক্ষিতা হিশেবে রাখার ব্যাপারটি।
এটি তো শুধু আরবের কালচার ছিল না, এটি পুরো বিশ্বেরই একটি চিত্র। শুধু কি চৌদ্দশো বছর আগের ঘটনা এসব? এগুলো তো আমাদের সমাজে সেদিন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
বুঝলাম না কথাটা। নড়েচড়ে বসলেন দীনেশ আচার্য। সাজিদ বলতে লাগল, বুঝিয়ে বলছি। ১৯৩৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া আমেরিকান লেখিকা Pearl S. Buck এর নাম শুনেছেন?
রমেশ আচার্য বললেন, হ্যাঁ। শুনেছি।
তার অধিকাংশ উপন্যাস চীনের সামাজিক পটভূমির ওপরেই রচিত। তিনি তার fasno terasa A House Divided, East Wind : West Wind, The Good Earth ইত্যাদিতে ১৯০০ সালের দিকে চীনের সামাজিক প্রেক্ষাপটের ব্যাপারে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসসমূহে তিনি দেখিয়েছেন ওই সময়গুলোতে চীনের পুরুষেরা স্ত্রীর পাশাপাশি কীভাবে একাধিক রক্ষিতা রাখত। ওই রক্ষিতাদের গর্ভে চীনের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদদের জন্ম হয়, যারা কোনোদিন পিতার পরিচয় পাননি। শুধু তা-ই নয়, আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের নিকট-অতীতের ইতিহাসের দিকে তাকালেও আপনি একই রকম চিত্র দেখতে পাবেন।