সাজিদ মাথা নেড়ে জানাল, না, কোনো কষ্ট হয়নি।
আমাদের আসতে কোনো কষ্ট হয়নি শুনে ভদ্রলোক পা দুখানা নামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমরা একটু বসো। আমি আসছি বলে তিনি ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। আমি সাজিদকে বললাম, হ্যাঁ রে! লোকটার চেহারাটি বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আগে কোথাও দেখেছি?
সাজিদ চুপ করে রইল।
খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আগে কোথাও দেখে থাকতে পারি কি?
তিনিই হয়তো ভালো বলতে পারবেন, এই বলে সাজিদ সোফার সামনে টি-টেবিলে থাকা বইটি উল্টাতে লাগল। রাশিয়ান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা মা উপন্যাসটি। কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা বিখ্যাত এই উপন্যাস সাজিদ এর আগেও কয়েকবার পড়েছে। যেহেতু উপন্যাসটি আগেই পড়া আছে, এই মুহূর্তে সেটি উল্টানোর কারণ কী? সাজিদের এমন গা-ছাড়া উত্তর শুনে আমার পিত্তি জ্বলে উঠল। ইচ্ছে করছিল তার পিঠে আস্ত একটি কিল বসিয়ে জবাব দিই; কিন্তু সম্ভব না। ভদ্রলোকের বাড়ি। এখানে বন্ধুত্বের ষোলকলা ফলাতে যাওয়া বিপদ। কোনোরকমে নিজেকে সংবরণ করে বললাম, আমি কিন্তু এরকম ঠাট্টা-টাইপ জবাবের আশায় প্রশ্নটি করিনি। তাকে সত্যিই খুব পরিচিত লাগছে। মনে হচ্ছে আগে কোথায় যেন দেখেছি।
দেখেও থাকতে পারিস।
তাকেই?
হয়তো তাকে অথবা তার মতো কাউকে। অসম্ভব তো না।
বুঝতে পারছি সাজিদ আমার সাথে লুকোচুরি খেলছে। সোজা আঙুলে যেমন ঘি ওঠে না, তেমনই সোজা কথায় ওর পেট থেকে মূল কাহিনি বের হয় না। ওর বাম কান মলে দিয়ে বললাম, সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে কি তোর খুব কষ্ট হয়?
সাজিদ উহ! শব্দ করে বলল, ছাড়! ব্যথা লাগছে তো।
বল তাহলে এই লোককে কোথায় দেখেছি?
সাজিদ বুঝতে পারল আমি নাছোড়বান্দা। বলল, পৃথিবীতে কাছাকাছি চেহারার মানুষ তো থাকতেই পারে, তাই না? যেমন ধর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অনেকে বলে তার চেহারার সাথে রাজা রামমোহন রায়ের প্রথম যৌবনের চেহারার মিল আছে। এখন কেউ যদি রামমোহনের যৌবনকালের একটি ছবি এবং সুনীল দার যৌবনকালের ছবি পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বলে—এরা দুজন একই ব্যক্তি, সেটি কি ঠিক? আবার ধর হিটলারের কথা। কথিত আছে হিটলার একটি কারাগারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে দুই হাজার কয়েদিকে হত্যা করেছিল। সেই কয়েদিদের মধ্যে জুলিয়ান নামে একজন কবিও ছিলেন। এর ঠিক দু-বছর পরে কবি জুলিয়ানকে আবার পশ্চিম জার্মানির রাস্তায় উলঙ্গ অবস্থায় হাওয়া খেয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল। সবাই তো খুবই অবাক! অলৌকিক কাহিনি না তো? কিন্তু কবি জুলিয়ান এভাবে উলঙ্গ অবস্থায় ঘুরে বেড়াবে কেন? বোদ্ধা মহল সেই ঘটনার পক্ষেও যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলল। তারা জানাল, কোনো এক অলৌকিক শক্তিবলে জুলিয়ান সেদিন প্রাণে বেঁচে যান; কিন্তু এমন আকস্মিক ঘটনার প্রভাব তিনি সইতে পারেননি। কথায় আছে, অধিক শোকে পাথর। বেচারা জুলিয়ান হয়তো অধিক শোকে পাথর হবার বদলে পাগল হয়ে যান। এরপর, একদিন জানা গেল এই পাগলটি আসলে জুলিয়ান ছিল না। হুবহু কবি জুলিয়ানের মতো দেখতে ছিল বটে। দেখ, মানুষ কতভাবেই-না বিভ্রান্ত হতে পারে, তাই না?
সাজিদের কথা শুনে আমার মাথায় যেন রক্ত চড়ে বসল। তার কাছে আমি শুনতে চাইলাম চর্যাপদের শ্লোক, সে আমাকে পুরো মহাভারত শুনিয়ে বসে আছে। আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম, এই! তোর দার্শনিক কথাবার্তা অন্যদের জন্য তুলে রাখ। তোর কাছে এত প্যাঁচাল শুনতে চাইনি। রাজা রামমোহন রায় আর সুনীলের মধ্যকার সাদৃশ্য কীরকম, কিংবা কবি জুলিয়ান-নামার প্রাগৈতিহাসিক বর্ণনা তোর কাছে কি চেয়েছি? যা জানতে চেয়েছি তার উত্তর দে।
সাজিদ ধপ করে দমে গেল। কথা বলতে শুরু করার পর তাকে যদি কেউ থামিয়ে দেয়, তখন সে তার চেহারা ঠিক বাঙলা পাঁচের মতো বানিয়ে ফেলে। ঝুমবৃষ্টির পর প্রকৃতিতে যেমন একটি থমথমে অবস্থা বিরাজ করে, সাজিদের চেহারার ভাবটাও এই মুহূর্তে সেরকম। আমাদের মাঝে রীতিমতো একটি ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। নীরব ঝগড়া। অবশেষে সে শান্ত গলায় বলল, লাস্ট ইয়ারে আমরা বার্সেলোনার যে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম, মনে আছে?
হ্যাঁ।
সেখানে এক লোক আমাদের বিরল প্রজাতির একটি সাদা রঙের গরিলা দেখিয়েছিল না?
হুম।
ওই লোকটার নাম মনে আছে?
ওই লোকটার নাম মনে করার চেষ্টা করলাম। কী যেন নাম ছিল? ধুর ছাই। মনে আসছে না। বললাম, ভুলে গেছি।
তার নাম ছিল ড্যানিয়েল।
ওহ হ্যাঁ, ড্যানিয়েল; মনে পড়েছে। তো?
তো আবার কী?
আমি তো তোর কাছে ড্যানিয়েল-সংক্রান্ত লঙ্কাকাহিনি শুনতে চাইনি। তোর সামনে উপবিষ্ট থাকা তোর বড়দার ব্যাপারে জানতে চেয়েছি। সাজিদ বলল, ওহ! ভুলে গিয়েছিলাম। এই সেই ড্যানিয়েল, যার সাথে আমাদের বার্সেলোনার চিড়িয়াখানায় দেখা হয়েছিল। আমাদের ইনিই তো পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন।
আমি যেন তাজ্জব বনে গেলাম। সাদা চামড়ার সেই স্প্যানিশ লোকটি কি জলবৎ তরলং করে বাংলা বলে যাচ্ছে! আমি সাজিদের দিকে ফিরে বললাম, দেখ সাজিদ, আজকাল তুই খুব বেশিই মজা করছিস। এরকম একজন নিখাদ বাঙালিকে তুই স্প্যানিশ ড্যানিয়েল বানিয়ে দিয়েছিস? তুই কি মনে করেছিস তোর সব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, কথাবার্তা আমি বিনাবাক্যে বিশ্বাস করে নেব? নেভার!