আমার কথা শুনে তার চোখ দুটো যেন আরও বিশাল হয়ে উঠল। নাকটাও ফুলে উঠছে ক্রমশ। বুঝতে পারছি, লোকটি এখনো রাগের সর্বশেষ ধাপে পৌঁছায়নি। ওই ধাপে গেলে তার চেহারার কী-যে অবস্থা হবে, কে জানে। খুব ইচ্ছে করছিল তার রাগের সর্বশেষ পারদ দেখে যাওয়ার। কোনো এক গল্পে পড়েছিলাম, একবার এক ব্যাঙ নিজেকে ফুলাতে ফুলাতে একসময় পটাশ করে ফেটে গিয়েছিল। এই লোকের ক্ষেত্রে সে রকম ঘটার সম্ভাবনা যদিও ক্ষীণ, তবুও তাকে রাগতে দেখে আমি কেমন যেন অদ্ভুত মজা পাচ্ছি। আমার নজর তখন সাদা রঙের ফুলগুলোর চেয়ে লোকটির ওপরেই বেশি। পাশ ফিরে সাজিদকে ডাকতে যাব, ওমা! অমনি দেখি সাজিদ ভ্যানিশ! কোথায় গেল সে?
পরে সাজিদকে আবিষ্কার করলাম অন্য জায়গায়। এই দালানের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি কৃত্রিম ঝরনা আছে। বাঁধের মতো করে একটি ছোট্ট পুকুরসদৃশ কুয়া। সেখানে। বৈদ্যুতিক সংযোগের মাধ্যমে পানিকে সঞ্চারণ করে ওপর থেকে নিচের দিকে ফেলা হচ্ছে। সেই ঝরনার কাছে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি অনেকটা লম্বা লম্বা পা ফেলে তার কাছে ছুটে এলাম। আমাকে এভাবে স্থান ত্যাগ করতে দেখে লম্বা গোঁফওয়ালা লোকটি নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছে। সে নিশ্চয়ই ভাবছে আমি তার ভয়ে পালিয়ে এসেছি। বিজয়ীর মতো হেসে হেসে, গর্বে ফুলে ওঠা বুক নিয়ে সে নিশ্চয়ই তার জায়গায় চলে গেছে এতক্ষণে। তার চোখ আর নাকের কী অবস্থা, কে জানে! সেগুলো কি এখনো ফুলে-ফেঁপে আছে? নাকি চুপসে গেছে?
সাজিদের কাছে এসে বললাম, কীরে! এদিকে চলে এসেছিস যে? তোকে আমি খুজছিলাম চারদিকে।
সে আমার দিকে ফিরে বলল, কেন? দারোয়ানের ফোলানো নাক আর বিশালাকার চোখ দেখাতে?
যা বাবা! এই ব্যাপারটি সাজিদ কীভাবে জানল? সে তো আমার সাথে ছিল না সেখানে। আমি থতমত খেয়ে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। সে আমার অবাক করা দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে আবার ঝরনার দিকে মুখ ফেরাল। আমি তখনো এক অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ সে আমাকে বলল, আরিফ…?
এই ঝরনাটির দিকে তাকিয়ে দেখ!
কী দেখব?
কৃত্রিমতা দেখবি।
লাভ কী?
লাভ নেই।
তাহলে?
এবার সাজিদ আমার দিকে ফিরে বলল, মানুষ মনে করে কী জানিস? টাকা, বিশাল অট্টালিকা, দামি গাড়ি আর ঐশ্বর্যের মধ্যেই সুখ। এই ঐশ্বর্য আর ধন-সম্পদের পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, স্রষ্টার অনুপম প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখার, সবুজাভ প্রকৃতির কাছে গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার ফুরসত তার হয় না; কিন্তু সে জানে, দিনশেষে তার অট্টালিকা, তার বিশালাকার দালান তাকে মনোতৃপ্তি দিতে পারে না। সে এসবের মাঝে বন্দিজীবন পার করে; কিন্তু জীবন তাকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে যে, সে এই শৃঙ্খল থেকে কোনোভাবেই নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। তবুও তার একটু ফুরসত চাই। একটু অবসর। সেই অবসর, মনোরম পরিবেশ স্রষ্টার প্রকৃতি ছাড়া কোথায় পাবে? সে নিজের ইচ্ছেমতো তৈরি করে নেয় ঝরনা, কৃত্রিম হ্রদ ইত্যাদি। দিনশেষে সব আইডিয়া স্রষ্টার কাছ থেকেই ধার করা…।
আমি মন দিয়ে সাজিদের এক নাগাড়ে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনলাম। নিজ থেকে সে কখনোই আমার সাথে এভাবে কথা বলে না। তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দেয়, ব্যস! কিন্তু আজ তার এমন দার্শনিক কথাবার্তা দেখে আমি আরও একবার অবাক হলাম।
হঠাৎ একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের আগমন। আমার অবাক হবার রেশ কাটতে না কাটতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের মধ্যে সাজিদ কে?
আমি সাজিদ বলল।
আপনাকে বড়দা যেতে বলেছেন।
সাজিদের এসব বড়দা, মেঝদা, ছোট দাদের আমি চিনি না। অবশ্য আমার চেনার কথা-ও না। সে কোন দিন কাকে, কোথায়, কখন যে অ্যাপয়েনমেন্ট দিয়ে রাখে সেটা আমিও বুঝতে পারি না। আজকে এসেছি তার কোনো এক বড়দার বাড়িতে। ইতিপূর্বে এই বিশাল বাড়িতে এসেছি বলেও আমি স্মরণ করতে পারছি না। সাজিদের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে তার সেই বড়দার ঘরে ঢুকে পড়লাম। ঘরটি বেশ পরিপাটি করে সাজানো। ঘরের আসবাবপত্র আর দেয়ালে টাঙানো কারুকাজ করা চিত্রকর্ম দেখেই বোঝা যায় লোকটি বেশ শৌখিন। বেতগাছের সোফার ওপর ভদ্রলোক পা লম্বা করে দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে বই। সিগারেটটি জ্বলে শেষ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে; কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তিনি বইপড়ার মধ্যে মগ্ন হয়ে আছেন। সম্ভবত মজার কোনো বই-টই হবে।
সাজিদ গলা খাঁকারি দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢোকে। সাজিদের গলার আওয়াজ শুনেই ভদ্রলোক ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালেন। গোলগাল চেহারার এই লোকটি আমাদের দেখেই হাতে থাকা সিগারেট মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে থ্যাঁতলে দিয়ে বললেন, সাজিদ, এসো এসো, বসো। তিনি আমাদের সোফার দিকে ইশারা করে বসতে বললেন। আমি আর সাজিদ বাধ্যছেলের মতো সোজা গিয়ে সোফায় বসলাম। তিনি এবার তার রকিং চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বসলেন। ভদ্রলোকের চেহারার সাথে কার চেহারার যেন আমি অদ্ভুতরকম মিল পাচ্ছি। আমি কি এর আগে তাকে দেখেছি কোথাও? অথবা তার মতো কাউকে কি আমি চিনি? ঠিক মনে করতে পারছি না।
ভদ্রলোক বলে উঠলেন, তোমাদের কষ্ট হয়নি তো আসতে?