সাজিদ ঘামতে শুরু করেছে; কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। এতজনের সামনে এভাবে সে আগে কোনোদিন কথা বলেনি। এজন্যেই হয়তো একটু অসুবিধে হচ্ছে তার। সে আবার শুরু করল-দ্বিতীয় প্রমাণ হলো, তর্কের খাতিরে যদিও ধরে নিই যে, Satanic Verses সত্য, তাহলে চলুন, সূরা নাজমের আয়াতের সাথে ওই তথাকথিত শয়তানের আয়াতগুলো মিলিয়ে আমরা আরেকবার দেখে নিই :
[১৯] তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উযযা সম্পর্কে?
[২০] এবং আরেক (দেবী) মানাত সম্পর্কে?
[২১] তারা হলেন খুবই উঁচু পর্যায়ের (ক্ষমতাবান দেবী)
[২২] এবং তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায়…
[২৩] এগুলো তো কেবল (এই যে লাত, উযযা, মানাত এসব) কতকগুলো নাম, যে নাম তোমরা আর তোমাদের পিতৃপুরুষেরা রেখেছ, এর পক্ষে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। তারা তো শুধু অনুমান আর প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, যদিও তাদের কাছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে পথ নির্দেশ এসেছে।
খেয়াল করুন, ২১ এবং ২২ নম্বর আয়াতের পরে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছ থেকে কোনোরকম সংশোধনী আসার আগেই ঠিক ২৩ নম্বর আয়াতে এসে বলা হচ্ছে, এগুলো (লাত, উয্যা, মানাত ইত্যাদি) তো কেবল কতগুলো নামমাত্র, যা তোমরা (মুশরিকরা) এবং তোমাদের পূর্বপুরুষেরা রেখেছ। এদের (ক্ষমতার) পক্ষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি।
বড়ই আশ্চর্যের, তাই না? একটু আগে বলা হলো, তারা হলেন খুবই উঁচু পর্যায়ের দেবী। তাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া যায়। আবার, তার ঠিক পরেই বলা হচ্ছে, এগুলো তো কেবল কিছু নাম মাত্র, যা তোমাদের মস্তিষ্কপ্রসূত। What a double stand! এরকম ডিগবাজি দেওয়ার পরেও যারা একত্ববাদে বিশ্বাস রেখে নতুন ইসলামে এসেছে, তারা কি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ছেড়ে তৎক্ষণাৎ চলে যেত না?
আর কুরাইশরা এত পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়েও এটি বুঝতে পারল না যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে মাইন্ড গেইম খেলছে?
সাজিদ থামল। পঙ্কজ দা জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে, বলা হয় যে, আবিসিনিয়ায় হিজরত করা একটি দল এই ঘটনার কথা শুনে অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক মুশরিকদের দেব-দেবীদের স্বীকৃতি দেওয়ার ঘটনা শুনে ফেরত চলে এলো, তাদের ব্যাপারে কী বলবে?
সাজিদ বলল, হ্যাঁ, তারা ফেরত এসেছিল ঠিকই; কিন্তু তারা ফেরত এসেছে এই ঘটনা শুনে নয়, অন্য ঘটনা শুনে। নবুওয়াতের ৫ম বছরে তৎকালীন আরবের অন্যতম বীর উমার ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে, মক্কার পরিস্থিতিকে কিছুটা নিরাপদ ভেবে, তারা ফেরত এসেছিল। তথাকথিত Satanic Verses নাযিলের কথা শুনে নয়। প্রত্যেক সহীহ রেওয়ায়েতেই এটার বর্ণনা পাওয়া যায়।
আমাদের কারও মুখে কোনো কথা নেই। সাজিদ পিকলু দার দিকে তাকিয়ে বলল, পিকলু দা?
হু।
আচ্ছা, তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?
না।
ঠিক তো?
হ্যাঁ।
বিশ্বাস করো যে, ঈশ্বর বলে কেউ নেই?
হুম, বিশ্বাস করি যে—ঈশ্বর বলে আদৌ কেউ নেই।
আচ্ছা, তুমি কি বিশ্বাস করো শয়তান বলে কেউ আছে, যাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না, বোঝা যায় না?
আরে না! আমি অমন ফাও জিনিসে বিশ্বাস-টিশ্বাস করি না।
ঠিক বলছ তো?
হ্যাঁ।
এবার সাজিদ হো-হো করে কিছুক্ষণ হাসল। এরপরে বলল, তাহলে কী করে তুমি সালমান রুশদির Satanic Verses বিশ্বাস করছ যেখানে তুমি শয়তান বলে কিছুতে বিশ্বাসই করো না? সালমান রুশদীকে বিশ্বাস করতে হলে তোমাকে আগে শয়তানের ওপরে ঈমান আনতে হবে। তারপরেই না Satanic Verses (শয়তানের আয়াত) বিশ্বাস করা যাবে। হা-হা-হা-।
এতক্ষণের নীরবতা ভেঙে সবাই এবার হাসিতে ফেটে পড়ল। অট্টহাসিতে ভরে উঠল আমাদের আড্ডাস্থল। মাগরিবের আযান হচ্ছে। পিকলু দা, পঙ্কজ দা আর সৌরভ উঠে চলে যাবার পথ ধরল। আমরা মসজিদের পথ ধরলাম।
দূরে পাখিরা আপনালয়ে ফিরে যাচ্ছে। আমি আর সাজিদ পাশাপাশি হাঁটছি। ভাবছি, ইশ! আজকের আড্ডাটি আরেকটু দীর্ঘ হলেও পারত…।
০৭. রাসূলের একাধিক বিবাহের নেপথ্যে
আমি আর সাজিদ বিশাল এক দালানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দালানের চারপাশ সুন্দর সব ফুলগাছে ভর্তি। একটি সাদা রঙের ফুলে আমার চোখ পড়ল। লাল রঙের টবে লিকলিকে এক লতা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সেই লিকলিকে লতার গায়ে সেনাপতির মতো শৌর্যবীর্য নিয়ে কিছু সাদা রঙের ফুল যেন তার বাড়ন্ত যৌবনের জানান দিচ্ছে। ফুলগুলোর কাছে গেলাম। এধরণের ফুল আগে কখনোই দেখিনি। অদ্ভুত এক নেশাজাগানিয়া সুবাস ছড়াচ্ছে তারা। সেই মাতাল করা গন্ধে মৌ মৌ করছে বাতাস।
যেই আমি ফুলগুলো ছুঁতে যাব, অমনি বিশালাকার গোঁফওয়ালা এক লোক কোথেকে যেন দৌড়ে এসে আমার সামনে হাজির। এই লোকের যে শুধু গোঁফই বিশাল তা নয়, শরীরের তুলনায় তার মাথাটাও বিশাল সাইজের। আস্ত একটা ফুটবলের সমান মাথা নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে লোকটি আমায় বলল, ফুলগাছে হাত দেওয়া নিষেধ, জানেন না?
তার প্রশ্ন শুনে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। আশপাশে ভালোভাবে তাকালাম। কোথাও কোনো সাইনবোর্ডে লেখা নেই যে, ফুল ছেড়া ও ফুলগাছে হাত দেওয়া নিষেধ। ত্বরিতগতিতে চারদিকে একনজর তাকিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞামূলক বাণীর সন্ধান না পেয়ে তার দিকে ফিরলাম। দেখলাম লোকটি তখনো আমার দিকে মারমুখী চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটোও স্বাভাবিকের তুলনায় বিশাল দেখাচ্ছে। মানুষ রেগে থাকলে যা হয় আর কি! কিন্তু এই লোক আমার ওপরে এত চটে বসার যথেষ্ট কোনো কারণ আমি খুঁজে পেলাম না। বললাম, ফুলগাছে হাত দিলে কী সমস্যা?