পরের দিন ক্যাম্পাসে পিকলু দা আমাদের অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বান্দরবানের দুর্গম এলাকা থেকে তুলে আনা ছবিগুলো দেখাচ্ছিলেন। আমরাও খুব আগ্রহভরে দেখছিলাম ছবিগুলো। আসলেই সব কয়টি ছবিই ছিল দারুণ। আমার সাধ্য থাকলে প্রতিটি ছবির জন্য পিকলু দাকে একটি করে গোল্ড মেডেল দিয়ে দিতাম।
আমরা সবাই ছবি দেখাদেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, সাজিদের সেদিকে মোটেও আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে সে পিকলু দার কাছে জানতে চাইল সাথে নিয়ে যাওয়া বইগুলোর ব্যাপারে। পিকলু দা ফিক করে হেসে দিলেন। এরপর, সাতখণ্ড রামায়ণ পাঠের মতো করে তিনি শেক্সপিয়ারের A Mid Summer Nights Dream এবং রবি ঠাকুরের গোরা উপন্যাসের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করা শুরু করলেন। আমরাও আগ্রহভরে শুনছিলাম আর আবিষ্কার করছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পিকলু দাকে। যিনি কেবল ছবির মাঝেই ডুব দেন না, বইয়ের মাঝেও অসাধারণভাবে ডুব দিতে পারেন…।
বলছিলাম গত রোববারের আড়ার কথা। সে আড্ডায় আমাদের সাথে পিকলু দা-ও ছিলেন। ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সোহেল রানা এবং সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সৌরভ ধর। আরও ছিলেন ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের আহমেদ ইমতিয়াজ এবং রসায়নের সুমন্ত বর্মণ দা। সুমন্ত দা খুব ভালো গিটার বাজাতে পারেন। তিনি যখন গিটারে তাল ধরেন, তখন সবাই সমস্বরে মান্না দার সেই বিখ্যাত গানটি গেয়ে ওঠে :
কাকে যেন ভালোবেসে, আঘাত পেয়েছে শেষে, পাগলা গারদে আছে রমা রায়
অমলটা ধুকছে দুরন্ত ক্যান্সারে, জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়
কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই…
আমাদের আড্ডা শুরুর প্রাক্কালে, সৌরভ পিকলু দার কাছে জিজ্ঞেস করল, দাদা, তুমি কি সালমান রুশদির The Satanic Verses পড়েছ?
পিকলু দা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে জানালেন, তিনি পড়েছেন। এরপর সৌরভ সাজিদের কাছে জানতে চাইল, সে পড়েছে কি না। সাজিদও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। পিকলু দা সাজিদের কাছে জানতে চাইল, তোর কেমন লাগলরে বইটি?
সাজিদ বাদাম ছুলে মুখে দিতে দিতে বলল, ফিকশনাল বই হিশেবে বলব নাকি ঐতিহাসিক উপন্যাস হিশেবে বলব?
পিকলু দা খানিকটা অবাক হলেন বলে মনে হলো। বললেন, মানে কী?
কিছুই না। ফিকশনাল বই হিশেবে বললে এটি মোটামুটি ভালো; কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর নির্ভর করে লেখা কোনো বই হিশেবে যদি বিচার করতে বলল। তাহলে এটি পাস মার্ক পাবে বলে মনে হয় না।
পিকলুদা আরও খানিকটা অবাক হলেন। বললেন, বইটাতে রুশদি যে ইনফরমেশান ব্যবহার করেছে, সে ব্যাপারে তোর কোনো আপত্তি আছে?
সাজিদ বলল, আলবত আছে।
কিন্তু তুই কি জানিস, ওই বইতে রুশদি যে ইনফরমেশান ব্যবহার করেছে তার সবটাই ইসলামিক সোর্স থেকে নেওয়া? পিকলুদা বললেন।
হ্যাঁ, জানি।
তুই বলতে চাচ্ছিস এসব ইসলামিক সোর্সে ভুল ইনফরমেশান দেওয়া আছে?
থাকতেও পারে। দুনিয়ায় কুরআন ছাড়া সকল গ্রন্থ মানুষের লেখা। আর মানুষের লেখায় ভুল থাকাটাই স্বাভাবিক। সাজিদের সরল উত্তর।
এবার কথা বলে উঠল ইমতিয়াজ ভাই। তিনি বললেন, দাঁড়াও দাঁড়াও। সালমান রুশদিকে তো চিনি এবং The SatanicVerses নামক তার বইটার নামও শুনেছি আমি; কিন্তু যেটি বুঝতে পারছি না সেটি হলো তোমাদের বিতর্কের বিষয়। তোমরা দুজনে The Satanic Verses নিয়ে বেশ ঝড়ো আলাপ করছ। মূল কাহিনিটা আসলে কী?
পিকলুদা সাজিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুই একটু ব্রিফ করে দে এ ব্যাপারে।
পিকলু দার কথায় সাজিদ বলতে শুরু করল, ইন্ডিয়ান লেখক সালমান রুশদি একটি বই লিখে খুবই বিতর্কিত হয়ে পড়েন। বইটার নাম : The Satanic Verses। রুশদি সেই বইতে কিছু ইসলামিক সোর্স থেকে দলিল টেনে ইসলামকে আক্রমণ করে এবং প্রমাণের চেষ্টা করে যে-কুরআন আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হওয়া নয়; বরং শয়তান থেকে প্রাপ্ত কিতাব। রুশদি সোর্স হিশেবে উল্লেখ করে আত-তাবারী এবং ইবনু সাদ-এর মত সীরাতগ্রন্থ।
আত-তাবারী এবং ইবনু সাদ-এ একটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। ঘটনাটি হলো এরকম, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় যখন দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন, তখন একদিন তিনি কাবা শরীফের প্রাঙ্গণে বসে সদ্য ইসলামে দাখিল হওয়া মুসলিমদের মাঝে বক্তৃতা করছিলেন। সেখানে মক্কার অন্যান্য পৌত্তলিক কুরাইশরাও ছিল।
ঠিক এমন সময়ে, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ওহী নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আগমন করেন। সেদিন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম সূরা নাজম নিয়ে অবতীর্ণ হন। তাবারী এবং ইবনু সাদ বলছেন, সেদিন সূরা নাজমের ১৯ এবং ২০ নম্বর আয়াতের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বাড়তি দুটি আয়াত তিলাওয়াত করেন, যা আদতে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ওহী হিশেবে নিয়ে আসেননি। এই দুই আয়াত মূলত শয়তান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধোঁকা দিয়ে কুরআনের আয়াতের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। পরে জিবরাঈল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ব্যাপারে সতর্ক করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ওহী ছিল না বলে বাদ দেন।
সূরা নাজমের ১৯ এবং ২০ নম্বর আয়াত হলো মুশরিকদের পূজিত সবচেয়ে বড় তিন দেবী : লাত, উযযা এবং মানাতকে নিয়ে। ওই সূরার ১৯ এবং ২০ নম্বর আয়াত হলো, তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উযযা সম্পর্কে? এবং আরেক (দেবী) মানাত সম্পর্কে?