সহীহ বুখারী-তে ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর বরাতে বলা হয়েছে, বনু কুরাইজার ঘটনার দিন তাদের কিছু লোক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ক্ষমা করে দেন। পরে তারা ইসলাম গ্রহণ করে। সুতরাং, সকল পুরুষ হত্যার যে মিথ্যা বর্ণনা আমরা শুনি, তা এই হাদীস দিয়ে বাতিল করে দেওয়া যায়। কারণ, সেদিন ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের মধ্যে অনেক নারী-পুরুষ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত।
সাজিদ থামল। আলম ভাই তার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলে সে ঢকঢক করে পানিটুকু গলাধঃকরণ করল। এরপর আবার বলতে শুরু করল, তাহলে, আমরা দেখলাম যে
(১) বনু নাযীর এবং কায়নুকা সম্প্রদায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী। তাই তাদের রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা বেআইনি ছিল না; বরং আইনসিদ্ধ ছিল।
(২) বনু কুরাইজা সম্প্রদায় নিরপরাধ ছিল না। তারাও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী ছিল। তাদের অপরাধ প্রথমবার ক্ষমা করা হয়। তথাপি তারা তাদের অপরাধ থেকে সরে না এসে বারবার মুসলিমদের বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে, তাদের রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় আনা যুক্তিযুক্ত।
(৩) বনু কুরাইজার সকল পুরুষ নয়; বরং সকল যোদ্ধ হত্যা করা হয়েছিল।
(৪) হত্যার রায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নন, দিয়েছিলেন ইহুদীদের একসময়কার সমগোত্রীয় নেতা সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু।
(৫) হত্যার রায় দেওয়া হয়েছিল ইহুদীদের ধর্মীয় বিধানমতেই। সুতরাং, এতে আপত্তি তোলার অবকাশ নেই।
(৬) কুরাইজা গোত্রের সকলকে হত্যা করা হয়নি। যারা ক্ষমা চেয়েছিল, তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল।
এই ঘটনাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, একটি রাষ্ট্রীয় সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে বনু নাযীর, বনু কায়নুকা এবং বনু কুরাইজার সাথে হওয়া ঘটনাগুলো কোনোভাবেই অমানবিক নয়; বরং আইনসম্মত ছিল। এই আইন প্রয়োগ করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরং একজন ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব-ই পালন করেছিলেন।
সাজিদের কথা বলা শেষ হলে আমি শাবিরের মুখের দিকে তাকালাম। বললাম, ইশ! এতক্ষণ কী সুন্দর বাঙালি-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গুলিয়ে ফেলা গল্প শুনছিলাম। সাজিদ এসে সেগুলোকে ঠাকুরমার ঝুলি বানিয়ে দিল।
আমার কথা শুনে আলম ভাই হা-হা-হা করে হেসে উঠল। এই লোকের হাসিটি খুবই চমৎকার। বাঁধাই করে রাখার মতো।
———-
১ সহীহ বুখারী, খণ্ড : ৫; হাদীস : ৩৬২
২ সুনানু আবি দাউদ, ২২৯৯
৩ Deuteronomy: 20-25
০৬. স্যাটানিক ভার্সেস ও শয়তানের ওপরে ঈমান আনার গল্প
রোববার আমাদের কাছে আড্ডাবার বলে খ্যাত। রোববারে আমরা শাহবাগে বসে আড্ডা দিই। আমাদের আড্ডার বিষয়বস্তু থাকে সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন আবিষ্কার ও বিভিন্ন বই নিয়ে।
গত রোববারের আড্ডায় আমাদের সাথে পিকলু দা-ও ছিলেন। পিকলু দা হলেন আমাদের সবার কাছে প্রিয় ও পরিচিত মুখ। ক্যাম্পাসে পিকলু দাকে চেনে না— এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। কেনই-বা চিনবে না? যে-লোক জাপান, হংকং এবং কানাডা থেকে চার চারবার ফটোগ্রাফিতে গোল্ড মেডেল পায়, তাকে আবার চিনবে না—এমন কেউ থাকতে পারে নাকি?
আমরা পিকলু দাকে একজন উঁচু মাপের ফটোগ্রাফার হিশেবে জানলেও, সাজিদের কাছে পিকলু দার কদর অন্য জায়গায়। সাজিদ পিকলু দাকে একজন উঁচু মানের বইপড়ুয়া হিশেবে চেনে। সাজিদের ভাষ্যমতে—পুরো পৃথিবী থেকে যদি তন্ন তন্ন করে খুঁজে সেরা দশজন বইপড়ুয়া লোক খুঁজে বের করা হয়, তাহলে পিকলু দার Rank সেখানে সেরা তিনে থাকবে, শিওর…।
পিকলু দার সাথে আমাদের চেয়ে সাজিদের সখ্যই বেশি। এর কারণ, ঢাবিতে ভর্তির পরে পুরো এক বছর সাজিদ আর পিকলু দা হলের একই রুমে ছিল। সাজিদের কাছে শুনেছি, একবার ঘোর বর্ষার সময়, পিকলু দা ঠিক করলেন যে, তিনি বান্দরবান যাবেন। চারদিকে করুণ অবস্থা। পানিতে টইটম্বুর সবকিছু। ভারী বজ্রপাতের সাথে বিরতিহীন বৃষ্টির ফোয়ারা, এর মধ্যেই পিকলু দা চাচ্ছে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়তে। সাজিদ খুবই অবাক হলো। বলল, এরকম পরিস্থিতিতে কেউ কি বাইরে যায় নাকি?
পিকলুদা কয়েক সেকেন্ডও সময় না নিয়ে বললেন, Without such environment, you cant enjoy adventure, my dear…
সাজিদ দেখল, সেই যাত্রায় পিকলুদা ব্যাগের মধ্যে ক্যামেরার সাথে শেক্সপিয়ারের A Mid Summer Nights Dream এবং রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের বই দুটোও পুরে নিচ্ছে। সাজিদ আবারও অবাক হলো। বলল, বৃষ্টি-বাদলের মধ্যে ভিজবে নাকি বই পড়বে?
পিকলু দা সেবার কিছু না বলে মুচকি হেসে বেরিয়ে পড়ল। ফিরল ঠিক দশদিন পরে। জ্বরে কাঁপাকাঁপি অবস্থা। অন্য কেউ হলে এই মুহূর্তে বেহাল দশা হয়ে যেত। অথচ, পিকলুদার মুখে অসুখের কোনো চিহ্নই নেই। মনে হচ্ছে মনের মধ্যে রাজ্য জয়ের সুখ বিরাজ করছে।
সাজিদ জিজ্ঞাসা করল, কী অবস্থা করে এসেছ নিজের?
পিকলু দা সাজিদের কথা কানে নিল বলে মনে হলো না। গোল্ডলিফ সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, জানিস তো, অনেকগুলো অসাধারণ ছবি তুলে এনেছি এবার। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে গিয়েছিলাম। চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ ক্রস করে কোনো এক পাহাড়ের দেশে ঢুকে পড়েছি।