দুই. বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং এর সরকারকে উচ্ছেদ কিংবা কোনো অংশের স্বাধীনতা খর্ব করার কোনো ষড়যন্ত্র কেউ করলে তার শাস্তি—যাবজ্জীবন বা অনূর্ধ্ব ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
তিন. কেউ যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে সৈন্য, অস্ত্র, গোলা-বারুদ সংগ্রহ করে, তাহলে সে (বা তারা) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
বিমল দা মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ। এরকমই তো লেখা।
এবার প্রশ্ন করল শাবির। সে বলল, কিন্তু সাজিদ, তুই হঠাৎ এরকম আইন-আদালত নিয়ে বসলি কেন এখানে?
আগে আমার কথা শেষ হোক বলে সাজিদ আবার বলতে আরম্ভ করল, আচ্ছা বিমল দা, তুমি এখন আমাদের রাষ্ট্রপতি, ঠিক আছে?
মাথা নাড়ল বিমল দা।
ধরো, যদি আমি এবং আরিফ তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্লট আঁকি? যদি আমরা তোমাকে মান্য করার, তোমার তৈরি সংবিধান মান্য করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েও তোমার বিরুদ্ধে, তোমার আইনের বিরুদ্ধে যাই? যদি তোমার শত্রুদের সাহায্য করি? অস্ত্র দিই? সৈন্য দিই? তাহলে তুমি তোমার সংবিধান-মতে আমাদের কী বিচার করবে?
বিমল দা কিছুক্ষণ ভাবল। এরপর বলল, হয়তো তোদের দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দেবো, নয়তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড…।
এক্সাক্টলি! তুমি ঠিক এটাই করবে এবং রাষ্ট্রনেতা হিশেবে, সংবিধান-মতে, তোমার ঠিক এটাই করা উচিত। সাজিদ বলল। সে আরও বলতে লাগল, এবার একই চিত্রপটে আরেকটি ঘটনায় আসো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হিজরত করে মদীনায় আসলেন, তখন মদীনায় ইহুদী সম্প্রদায় ছিল তিনটি। বনু নাযীর, বনু কায়নুকা এবং বনু কুরাইজা। মদীনায় এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার নেতা হলেন এবং মদীনার ইহুদী সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সম্প্রদায় নিয়ে তিনি একটি রাষ্ট্রীয় সংবিধান তৈরি করলেন। সেই সংবিধানের নাম : মদীনা সনদ। এটুকু তো সবাই জানি, তাই না?
হু, বিমল দার সম্মতি।
সেই মদীনা সনদের অনেকগুলো ধারা ছিল। ধারাগুলোতে বলা ছিল : মদীনায় মুসলিম, ইহুদী এবং অন্যান্যরা পরস্পর সহাবস্থান করবে এবং কেউ মদীনা আক্রমণ করলে সবাই একযোগে যুদ্ধ করবে। মদীনার কেউ কখনোই কুরাইশদের সাহায্য সহযোগিতা করবে না ইত্যাদি।
এখন, সীরাত থেকে আমরা জানতে পারি, মদীনায় ইহুদী গোষ্ঠী বনু নাযীর এবং বনু কায়নুকা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্লট আঁকে। তাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করে। কুরাইশদের সাথেও গোপনে যোগাযোগ রাখে, যা ছিল স্পষ্ট সনদবিরুদ্ধ। এমতাবস্থায়, এই দুই সম্প্রদায়কে মদীনা থেকে বহিষ্কার করলে কি তা সংবিধানবিরুদ্ধ হবে? আমাদের পেনাল কোড- ১৮৬০ অনুসারে এদের কী শাস্তি হওয়া উচিত?
বিমল দা চুপ করে আছে। সাজিদ কেন এত লম্বা গল্প ফাঁদল এতক্ষণে বুঝলাম। বিমল দা যে বলেছিল, দয়ার নবী কেবল বনু কুরাইজা নয়, বনু নাযীর আর বনু কায়নুকা গোত্রও স্বদেশ ছাড়া করেছিল, এর জবাব দেওয়ার জন্যই সে এতদূর কাহিনি সাজিয়েছে।
সাজিদ আবার বলতে লাগল, আমাদের পেনাল কোড অনুযায়ী-ই তো এটি স্বতঃসিদ্ধ। তাহলে একজন রাষ্ট্রনায়ক হয়ে, মদীনার সর্বোচ্চ নেতা হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি আইনের প্রয়োগ করে, তাতে কেন অসুবিধা হবে বিমল দা?
কারও মুখে কোনো কথা নেই। বিমল দা একদম চুপসে গেছে। আলম ভাই চায়ের কেতলি চুলোয় তুলে দিচ্ছেন আর মুচকি মুচকি হাসছেন।
একটু থেমে সাজিদ এবার শাবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল, এবার তোর পয়েন্টে আসি, শাবির। তুই বলতে চাস যে, বনু কুরাইজা গোত্র নিরপরাধ ছিল, তাই তো?
হ্যাঁ, শাবির বলল।
তোর দাবির পক্ষে প্রমাণ আছে?
শাবির বলল, সীরাতে ইবনে ইসহাক-এ বর্ণনা করা আছে, মুহাম্মদ যখন খন্দকের যুদ্ধের জন্য পরিখা খনন করে ঘরে এসে অস্ত্র ত্যাগ করে গোসলের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই জিবরাঈল এসে তাকে কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধে ফুসলিয়ে দেয়। ব্যস, মুহাম্মদ তার সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে তাদের হত্যা করে আসে। অথচ, বনু কুরাইজা ছিল নিরপরাধ। একটি নিরপরাধ গোত্রের সকলকে নির্বিচারে হত্যা করে ফেলা কি অমানবিক নয়?
সাজিদ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর কত পৃষ্ঠায় এটি আছে?
৮২ পৃষ্ঠায়, শাবিরের উত্তর।
তার মানে, তুই সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর বর্ণনা টেনে প্রমাণ করতে চাইছিস যে, বনু কুরাইজা কোনো অপরাধ করেনি।
হ্যাঁ। সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর এই বর্ণনাতে তাদের অপরাধের কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। এটাই প্রমাণ করে বনু কুরাইজা গোষ্ঠী নিরপরাধ ছিল।
সাজিদ বলল, তুই সীরাতে ইবনে ইসহাক পুরোপুরি পড়েছিস কখনন? এই প্রশ্ন শুনে বিমল দা, শাবির এবং আমি সাজিদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম।
সাজিদ বলল, তুই সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর ৮২ পৃষ্ঠার বর্ণনা টেনে প্রমাণ করতে চাইছিস যে, বনু কুরাইজা নিরপরাধ। অথচ সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর ৮০ পৃষ্ঠাতেই আছে, And news came that the Jewish tribe of Banu Qurayza had broken their treaty with Muhammad
অর্থাৎ জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে খবর দেওয়ার আগেই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে খবর চলে আসে যে, বনু কুরাইজা গোত্র চুক্তিভঙ্গ করেছে। সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর এই লাইনগুলো মনে হয় তোর চোখ এড়িয়ে গেছে, তাই না?