পৃথিবীতে মানুষ মানুষের কাছে তার ভালোলাগার মানুষদের গল্প করে। আর আমি গল্প করি আমার অপছন্দের মানুষগুলো নিয়ে। আমার অপছন্দের তালিকায় বাংলাদেশের কয়েকজন সেলিব্রেটি আছেন। আছেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক আজমত স্যার, বাকি বিল্লাহ স্যারসহ অনেকে। শাবির সেই তালিকার একেবারে প্রথম দিকের একজন।
আমি শাবিরের একটি কথা বুঝতে পারিনি। তার বাবা নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে ইয়াহিয়া ভুট্টোকে গালাগাল দেয় তা বুঝলাম; কিন্তু এর সাথে তার বাবার ধার্মিক, নবী-প্রেমিক হবার কী সম্পর্ক?
খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাবিরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর বাবা ১৯৭১ এর ঘটনার জন্য ইয়াহিয়া-ভুট্টোকে গালাগালি করে, বুঝলাম; কিন্তু এর সাথে তার ধার্মিক বা নবী-প্রেমিক হবার কী হেতু?
শাবির চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে বলল, ইয়াহিয়া-ভুট্টো ঠিক যে-দোষে বাবার গালি খায়, ইসলামের নবীও ঠিক একই দোষে দোষী; কিন্তু বাবা ইয়াহিয়া ভুট্টোকে রোজ গালি দিলেও, ইসলামের নবীর জন্য তিনি একেবারে দিওয়ানা। আশেকে রাসূল। পিয়ারে রাসূল। একেই বলে অন্ধবিশ্বাস। ধর্মান্ধতা।
সাজিদ শাবিরের দিকে তাকাল। সে তাকানোয় একধরনের বিস্ময় আছে। কোনো ছেলে তার বাবাকে নিয়ে এভাবে মন্তব্য করতে পারে দেখে সাজিদ হয়তো অবাক-ই হয়েছে। সাজিদ বলল, আমি ঠিক বুঝলাম না। তুই কী বোঝাতে চাচ্ছিস? ইয়াহিয়া ভুট্টো-ইসলামের নবী… সব গুলিয়ে ফেলেছিস মনে হচ্ছে।
ব্যাপারটি স্পষ্ট করার জন্য নড়েচড়ে বসল শাবির। বলল, সাজিদ, তুই তো ১৯৭১ সালের ঘটনা জানিস, তাই না?
হুম।
ইয়াহিয়া-ভুট্টো বাঙালিদের ওপরে যে-পাশবিকতা চালিয়েছিল, সেটিও নিশ্চয় জানিস?
হুম।
বাঙালির কি কোনো অপরাধ ছিল এতে?
না।
ঠিক একইভাবে বনু কুরাইজার ওপরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তোদের নবী। অথচ বনু কুরাইজা গোষ্ঠীর কোনো অপরাধ ছিল না। অপরাধ কী ছিল জানিস?
সাজিদ বলল, বল শুনি…।
বনু কুরাইজা গোষ্ঠীর অপরাধ ছিল মুহাম্মদকে যখন মক্কার কুরাইশরা স্বদেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তখন মদীনার এই বনু কুরাইজাসহ অন্যান্য ইহুদী গোষ্ঠী মুহাম্মাদকে মদীনায় আশ্রয় দিয়েছিল।
এরপর?
বনু কুরাইজারা মুহাম্মদকে নেতা নির্ধারণ করেছিল।
তারপর?
বনু কুরাইজারা সংখ্যালঘু ছিল।
শাবির থামল। চায়ে ফু দিয়ে চুমুক দিল সাজিদ। এরপর বলল, আর কিছু?
এভাবে নিরপরাধ একটি জাতিকে উচ্ছেদ করা কোনো বিবেকবান লোক সহ্য করতে পারে?
সাজিদ বলল, একদমই না। এটি একেবারে মেনে নেওয়া যায় না।
হঠাৎ, পেছন থেকে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল কেউ একজন। পাশ ঘুরতেই দেখলাম বিমল দা।
বিমল দা হচ্ছে আমাদের ডিবেট ক্লাবের সেক্রেটারি। তিনি খুবই ভালো মানুষ; কিন্তু একটাই দোষ। ধর্মবিরোধী। এজন্য বিমল দাকে আমি কিছুটা অপছন্দ করি। আমি কেন যেন ধর্মবিরোধী লোকগুলোকে একদম সহ্য করতে পারি না। এই যেমন শাবির, আমার ক্লাসমেট। অথচ ওর কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে পারলেই যেন বাঁচি; কিন্তু সাজিদের ওঠা-বসা, মেলামেশা সব এদের সাথেই। ওর কথা হচ্ছে, জগতের সবার মতামতকে শুনতে হয়, বুঝতে হয়। আমি বাপু এত মতামত শোনার পক্ষে না।
বিমল দা আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল
ইচ্ছে করে শালিক হতে নীল আকাশের কোলে
ইচ্ছে করে ধুলোয় লুটাই আমার মায়ের বোলে।
ইচ্ছে করে মেঘের দেশে বৃষ্টি হতে ফের–
যখন তখন হারিয়ে যাবার ইচ্ছে আমার ঢের!
এটি আমার লেখা কবিতার একটি অংশ। বিমল দার মুখে এটি প্রায়ই শুনি। বিপ্লব দা এবং বিমল দা আমার কবিতার একনিষ্ঠ ভক্ত। কবিতার এই লাইনগুলো আবৃত্তি করে বিমল দা বলল, কী ব্যাপার! কবিদের সভা হচ্ছে নাকি এখানে? আমাকে ছাড়া টিএসসিতে কোনো কবিতার আড্ডা হতে দেওয়া চলবে না। এ জন্য আজকে হরতাল!!!
তার কথা শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম। আমাদের সাথে সাথে আলম ভাইও হেসে ফেললেন। বিমল দা খুবই মজার লোক। মানুষকে হাসাতে পারার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। শাবির বলল, না দাদা, এখানে কবিতার সভা হচ্ছে না, ধর্ম নিয়ে আলাপ হচ্ছে…।
বিমল দা বলে উঠল, ওম শান্তি ওম শান্তি!!
বিমল দা এটি টিটকারি করে বলল নাকি মজা করে বলল ঠিক বুঝলাম না। বিমল দা আবার বলল, তা ধর্মের কোন অংশটি নিয়ে আলাপ হচ্ছে? রামের লঙ্কা জয়, নাকি যিশু খ্রিষ্টের মরেও বেঁচে যাওয়া? অথবা, মুহাম্মাদের ধর্মযুদ্ধ? কোনটা?
আমি আর সাজিদ চুপ করে আছি। শাবির বলল, দাদা, ইসলামের নবী শান্তি প্রতিষ্ঠার নাম করে যে নিরপরাধ বনু কুরাইজা সম্প্রদায়কে হত্যা করেছিল, এটি নিয়েই বলছি…।
ও আচ্ছা। বনু কুরাইজা নিরপরাধ তো ছিলই, তাদের গোত্রের সকল পুরুষকেই হত্যা করেছিলেন দয়ার নবী। শুধু তা-ই না, বনু কুরাইজা সম্প্রদায়কে হত্যা করার আগে দয়ার নবীকে মদীনায় আশ্রয় দেওয়া আরও দুই ইহুদী সম্প্রদায় বনু কায়নুকা এবং বনু নাযীরকেও তিনি মদীনা থেকে বের করে দেন। অথচ, তিনি নাকি স্রষ্টার কাছ থেকে রহমতস্বরূপ এই ধরাধামে অবতরণ করেছেন। What an irony…!
না! আর চুপ করে থাকা যাচ্ছে না। দুজনের টিটকারি আর উপহাসে আমার গা ঘিনঘিন করছে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, সাজিদ আমাকে ইশারা করে চুপ করতে বলল। ইতোমধ্যেই বিমল দা তার হাতে থাকা চায়ের কাপে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোঁয়া খোলা আকাশে ফু দিয়ে বিলীন করে দিতে দিতে বলল, কই, আলাপ কি থেমে গেল নাকি?