মঈনুল কিছু না বলে চুপ করে আছে। সাজিদের ওপর এতক্ষণ অভিমান করে থাকলেও এখন আর সেটি নেই। আমার খুব করে মঈনুলকে আরেকবার জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে—সে কোন কোন পণ্ডিতের কাছে কুরআন পড়েছে। কিন্তু না; এই মুহূর্তে তাকে আর অপমান করা ঠিক হবে না।
———–
১ জামি তিরমিযী, হাদীস : ২৩৫৩, ২৩৫৪
২ সহীহ মুসলিম, ৯৮৭, মুসনাদে আহমদ, ০২ / ৩৮৩
৩ মুসনাদে আহমদ, ০২/১১২
০৫. বনু কুরাইজা হত্যাকাণ্ড—ঘটনার পেছনের ঘটনা
শাবিরকে আমি সবসময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কারণ, আমাকে দেখলেই সে মোল্লা বলে টিটকারি করে। আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করাটা তার কাছে আনন্দের ব্যাপার। তোর ধর্ম এমন-তেমন বলে বলে আমাকে সে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। আরে বাপু, দু-চার লাইন পড়ে পণ্ডিত হয়েছিস ভালো কথা, প্যান প্যান করে অন্যের মাথা খেতে হবে কেন শুনি?
ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে তার অসংখ্য অভিযোগ! এত অভিযোগ সম্ভবত মক্কার কুরাইশ নেতাদেরও ছিল না। সেদিন দোয়েল চত্বরে তার সাথে দেখা। দূর থেকে দেখেই আমি পাশ ফিরে গেলাম। বিরক্তিকর লোকগুলো সবসময়ই আমার আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। কী জ্বালা! শাবির ঠিক-ই আমাকে চিনে ফেলল। এসেই তার ফোকলা দাঁতগুলো বের করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস আরিফ?
ভালো।
আমার উচিত সে কেমন আছে জিজ্ঞেস করা; কিন্তু এই ক্যাটাগরির লোকগুলোর সাথে যত কম কথা বলা যাবে, ততই উত্তম। সে আবার জিজ্ঞেস করল, কারও জন্য অপেক্ষা করছিস?
না
চল চা খাই?
না! আমার তাড়া আছে।
রোবটের মতো উত্তর দিচ্ছিস কেন?
মন চাচ্ছে ওর সামনে থেকে দৌড়ে পালাতে। ওর প্রশ্নের এখনো যে আমি রোববাটিক গলায় উত্তর দিচ্ছি সেটিই তো ঢের আশ্চর্যের ব্যাপার! শাবির আমার হাত ধরে বলল, চল, চা খাব। কতদিন হয় তোর সাথে চা খাই না।
চোখেমুখে মহাবিরক্তি নিয়ে আমি তার পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করলাম। চেষ্টা করেও তার অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। শাবির বলল, তুই আমাকে খুব অপছন্দ করিস, তাই না?
এই মুহূর্তে যদি তার মুখের ওপরেই বলতে পারতাম আমি তোকে এক্কেবারে অপছন্দ করি। তুই আর কোনোদিন আমার সাথে কথা বলবি না, তাহলে বেশ হতো; কিন্তু পৃথিবীতে মন চাইলেই সবকিছু করা বা বলা যায় না। আমিও বলতে পারলাম না। কেবল তার প্রশ্নের প্রতিউত্তরে নকল একটি হাসি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম—আমি তাকে আসলে অপছন্দ করি না।
আলম ভাইয়ের টং দোকানে এসে সামনে পেতে রাখা বেঞ্চিতে সে বসল। আলম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফোকলা দাঁতগুলো বের করে বলল, মামা, চা দাও দুই কাপ। আমারটায় চিনি কম দিবা, লিকার বেশি।
রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে বাদাম-বিক্রেতা, চা-বিক্রেতা সবাইকেই ঢাকা শহরের লোকজন মামা বলে ডাকে। কেবল আমিই একটু ভিন্ন। একটু কম বয়স হলে ভাইয়া ডাকি, একটু বেশি বয়স হলে আঙ্কেল। মামা ডাকি না কাউকেই। আলম ভাই আমাকে খুব ভালোভাবেই চেনেন। রোজ সকালে তার দোকান থেকেই চা খাই আমি আর সাজিদ। আলম ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটি হাসি দিলেন। শাবির ধমকের সুরে আমাকে বলল, আরে বস না ব্যাটা।
আমি বসলাম ওর পাশে। ইয়া লম্বা লম্বা চুল তার। হাতে ব্রেসলেট, গায়ের কয়েক জায়গায় ট্যাটু করা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সে বলল, জানিস, আমার বাবার একটি ব্যাপার না আমার খুব্বি ভালো লাগে। বাপ আমার উঠতে-বসতে ইয়াহিয়া খান আর ভুট্টোকে গালি দেয়। শোবার আগে গালি দেয়, শোয়া থেকে উঠে গালি দেয়; অবস্থা দেখে মনে হয় এই দুই ইনসানকে গালি না দিলে আমার বাপের পেটের ভাত হজম-ই হয় না।
মনে মনে বললাম, তোর বাপের গল্প শুনতে চেয়েছে কে-রে, নালায়েক!
সে আবার বলল, কেন গালি দেয়, জানিস?
না।
কারণ, এই দুই লোক বাঙালিদের ওপরে ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছিল। হত্যা করেছিল হাজার হাজার মানুষ। এই কারণে বাবা এদের দুজনকে একদমই দেখতে পারে না। বলতে পারিস দুজন-ই বাবার চোখের বিষ।
চুপ করে আছি আমি। সে অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে, কিন্তু আমার বাবা আবার খুবই ধার্মিক লোক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ-কালাম পড়ে। তার পিয়ারের পিয়ার নবীর জন্য তার যে কী দরদ! আহা!
আমি জানতাম শাবির ঘুরে-ফিরে এই টপিকেই চলে আসবে। খাঁজকাটা কুমিরের গল্পের মতো-ই সে সবখানে ধর্মকে টেনে আনে। মহাত্মা গান্ধীর ছাগল চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে দিলে তারমধ্যেও সে ধর্মকে টেনে এনে একহাত নেওয়ার চেষ্টা করবেই করবে।
এরই মধ্যে আমার মোবাইলে কয়েকবার রিং হয়ে গেল। সাজিদের ফোন। আমার মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় বুঝতে পারিনি। কল ব্যাক করতেই সাজিদ ওপ্রান্ত থেকে জানতে চাইল, কই আছিস?
আলম ভাইয়ের দোকানে। তোর ক্লাস কি শেষ?
হুম।
তাহলে চলে আয় এদিকে।
আচ্ছা বলে সাজিদ ফোনটি রাখল।
সাজিদ সম্ভবত কাছাকাছিই ছিল। আসতে বেশিক্ষণ লাগল না ওর। তাকে দেখে আলম ভাই আবারও মিষ্টি একটি হাসি দিলেন। এই লোকের হাসিটি খুবই চমৎকার। পাক্কা কোনো ফটোগ্রাফারের চোখে পড়লে ফ্রেমবন্দি হয়ে যাবে নিশ্চিত।
সাজিদের জন্যও এককাপ চা অর্ডার করা হলো। সে এসে আমার পাশে বসল। শাবিরকে সে আগে থেকেই চেনে। কবিতা আবৃত্তিশালায় একসাথে ওরা কবিতা আবৃত্তি শিখত। তা ছাড়া, আমি আর শাবির সেইম ডিপার্টমেন্টেই পড়ি। সেই সুবাদে শাবিরকে নিয়ে অনেক গল্প করা হয়ে গেছে সাজিদের সাথে।