মঈনুল কলেজ-লাইফ থেকেই আমাকে ভ্যাবলা বলে ডাকে। আমার চেহারা নাকি দেখতে ভ্যাবলা টাইপের, তাই। নিজেকে ভ্যাবলা ভাবতেই আমার গা ঘিনঘিন করত; কিন্তু মঈনুলকে কিছু বলতেও পারতাম না। কারণ, মঈনুল ছিল আমাদের ক্লাসে অঙ্কের বস। এমন কোনো অঙ্ক ছিল না, যা সে পারত না। দু-দুবার সে গণিত অলিম্পিয়াডে প্রথম হয়েছিল।
ভালো আছি, তুই কেমন আছিস?
ভালো। অনেকদিন পরে। থাকিস কোথায়?
কাছাকাছিই। তুই?
আমিও এদিকে থাকছি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কবিতা লিখিস আজকাল?
মঈনুল কিছু না বলে হাঁপাচ্ছে। আমি আবার বললাম, শুনলাম, তুই নাকি বিগড়ে গিয়েছিস?
মঈনুল আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। আমি কী বলতে চাচ্ছি সেটা মনে হয় সে বুঝতে পেরেছে। চোখমুখ শক্ত করে বলল, সত্য জানতে চাওয়া মানে কি বিগড়ে যাওয়া?
আমি বুঝতে পারলাম মঈনুল খুব সিরিয়াস মুডে আছে। এই মুহূর্তে তাকে পাল্টা উত্তর দিয়ে কাবু করে ফেলার ইচ্ছে আমার নেই। হাঁটতে হাঁটতে আমরা তখন পার্কের পশ্চিম দিকটায় চলে এসেছি। সাজিদ তখনো বই পড়ছে। আমি এসে সাজিদের সাথে মঈনুলের পরিচয় করিয়ে দিলাম। সাজিদের একটি গুণ এই, সে অপরিচিত কারও সাথে মুহূর্তেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।
প্রাথমিক পরিচয়-পর্ব সেরে আমি আর মঈনুল সাজিদের পাশে বসে পড়লাম। দুজনেই হাঁপাচ্ছি। মঈনুল মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। সাজিদ তার ব্যাগে থাকা পানির বোতলটি মঈনুলের দিকে বাড়িয়ে দেয়। মঈনুল হাত বাড়িয়ে বোতলটি নিয়েই ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি পেটের ভেতরে চালান করে দেয়। এরপর সে বোতলটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নে, পানি খা।
পানি পান করে শার্টের হাতায় মুখ মুছে নিয়ে বললাম, তা তোর বিগড়ে যাওয়ার রহস্যটা কীরে, মোটকু?
মঈনুল দাঁতমুখ খিচে আমার দিকে তাকাল। তাকে তখন আলিফ লায়লার কান খাড়া করা পিশাচের মতো দেখাচ্ছিল। আমি বললাম, সরি! সরি! আমি আসলে জানতে চাচ্ছিলাম, তোর এই পরিবর্তনের কারণ কী?
আমার কথা বেশ গায়ে লাগল তার। ভারী মুখ নিয়েই বলল, পড়াশোনা কর, জানতে পারবি…
তুই পড়াশোনা করেই এরকম বিগড়ে গিয়েছিস? মাই গুডনেস।
আমাদের এই ঝগড়া বেশিদূর আগাতে দিল না সাজিদ। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী নিয়ে তর্ক করছিস তোরা?
মঈনুলের দিক থেকে কঠিন দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি সাজিদের দিকে তাকালাম। বললাম, মঈনুল নাকি নাস্তিক হয়ে পড়েছে। আমাদের ধর্ম নিয়ে সে নাকি এত বেশি পড়াশোনা করে ফেলেছে যে, সে আস্ত একটা অশ্বডিম্ব হয়ে বসে আছে।
আমার কথায় বেশ রাগ ঝরছে দেখে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল সাজিদ। বলল, একজন লোক তো চাইলে অনেক বেশি পড়াশোনা করতে পারে। সেটি ধর্ম নিয়ে হোক বা অন্যকিছু।
তাই বলে নাস্তিক হয়ে যেতে হবে? আমার প্রশ্ন।
সেটি তো তোর মর্জিমাফিক হবে না। কে আস্তিক থাকবে আর কে নাস্তিক থাকবে ব্যাপারটি তো আমি আর তুই ঠিক করব না, তাই না?
এমনিতেই প্রচণ্ড রেগে আছি। তার ওপর সাজিদের এমন দরদমার্কা কথা শুনে আমার তো একেবারে গা জ্বলে যাওয়ার মতো অবস্থা।
আমাকে দুচার-কথা শুনিয়ে এবার সে মঈনুলের দিকে ফিরে খুব শান্ত গলায় বলল, মঈনুল ভাই, আরিফের কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না। সে আসলে অল্পতেই রেগে যায়। অস্থির স্বভাবের; কিন্তু বন্ধু হিশেবে সে যথেষ্টই ভালো মনের মানুষ।
সাজিদের কথা শুনে আমার রাগের মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেল। গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা হচ্ছে! খেয়াল করলাম মঈনুলের মুখ থেকে রাগের আভাটুকু সরে গেছে। সাজিদের কথাগুলো সে হয়তো পছন্দ করেছে। তাই বলল, না, কী মনে করব? ও আর আমি তো কলেজ-লাইফ থেকেই এরকম খুনসুটি করতাম। এগুলো আমাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার।
সাজিদ হেসে বলল, বাহ। তাহলে তো আর কোনো ঝামেলাই নেই। তা, কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন?
মঈনুল বলল, ম্যাথমেটিক্স।
খুব ভালো। আপনার কথা আরিফের কাছে আগে কখনোই শুনিনি। আজকে পরিচয় হয়ে খুব ভালো লাগল।
মঈনুল ইতস্তত করে বলল, আমরা তো একই বয়সের বলা চলে। আমাদের মধ্যে আপনি সম্বোধনটা না থাকলেই ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে।
মঈনুলের কথায় সায় দিয়ে সাজিদ বলল, ঠিক আছে। ঠিক আছে বলার পরে সাজিদ পুনরায় প্রশ্ন করল, আচ্ছা, যদি কিছু মনে না করো আমি কি তোমাকে
একটা প্রশ্ন করতে পারি?
অবশ্যই অবশ্যই বলল মঈনুল।
আরিফ একটু আগে বলল, তুমি নাকি নাস্তিক হয়ে গেছ। আমি অবশ্য জানতে চাইব না যে, কেন তুমি নাস্তিক হয়ে গেছ। আমি শুধু এটুকু জানতে চাচ্ছি, কোন জিনিসটা তোমাকে নাস্তিক হতে অনুপ্রাণিত করেছে?
আমি কুরআন নিয়ে পড়াশোনা করেছি। পড়াশোনা করে বুঝতে পেরেছি যে, এটা কখনোই স্রষ্টার বাণী হতে পারে না। স্রষ্টাকে যদি আমরা আউট অব মিসটেক হিশেবে ধরে নিই, তাহলে স্রষ্টার বাণীর মধ্যে কোনোরকম অসামঞ্জস্য কিংবা বৈপরীত্য থাকতে পারে না; কিন্তু কুরআনে এরকম অসামঞ্জস্য, বৈপরীত্য রয়েছে।—বলল মঈনুল
আমি ধৈর্য ধরে চুপ করে আছি। সাজিদ হাসিমুখে বলল, বুঝতে পেরেছি তোমার কথা। আচ্ছা, তুমি কুরআন নিয়ে কোথায় বা কার কাছে পড়াশোনা করেছ?
চুপ করে আছে মঈনুল। কুরআন নিয়ে কোথায় বা কার কাছে পড়েছে সে তার কোনো উত্তর দিতে পারল না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সাজিদ আবার বলল, আচ্ছা, বাদ দাও সেটা। তুমি বললে যে কুরআনে অসামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছ। দয়া করে আমাকে একটু বলবে কি, সেগুলো কীরকম? আমিও আসলে কুরআনকে বোঝার চেষ্টা করি। এজন্যেই জানতে চাইছি।