ট্রেন থেকে নামার আগে ভদ্রলোক আমাদের হাতে তার অফিসের কার্ড দিয়ে বললেন, বয়েজ, সময় করে আমার অফিস থেকে কফি খেয়ে যেয়ো।
আমি তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে বললাম, জি আচ্ছা।
আমার উত্তর শুনে তিনি বললেন, তোমার আবার কফিতে এলার্জি নেই তো আরিফ?
এটা বলে ভদ্রলোক হা-হা-হা করে হাসলেন। আমি খুব লজ্জা পেলাম। সাজিদের দিকে তাকালাম। সেও মুচকি হাসছে।
———
১ সূরা বাকারা, ০২ : ২৫৬
২ সূরা নাহল, ১৬ : ১২৫
৩ সূরা বাকারা, ০২ : ১৯০
৪ সূরা কাফিরুন, ১০৯ : ০৬
৫ সুনানু আবি দাউদ, ৩/ ১৭০
৬ সহীহ আল-বুখারী, ০৩ / ২২৯৫
৭ ফাতহুল বারী, ইমাম ইবনু হাজার আল-আসকালীন, খণ্ড : ০৮; পৃষ্ঠা : ১৮
৮ সুনানু বায়হাকী, খণ্ড : ০৮; পৃষ্ঠা : ৩০
৯ কানযুল আমাল, খণ্ড : ০৪; পৃষ্ঠা : ৪৫৫
১০ তাবাকাত ইবনু সাদ, খণ্ড : ০১; পৃষ্ঠা : ২২৮ ১১ কিতাব আল-খিরাজ, ইমাম আবু ইউসুফ, পৃষ্ঠা : ১৫৫
০৪. কুরআনে বৈপরীত্যের সত্যাসত্য
সকালবেলায় ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় একটি চক্কর না দিলে আমার চলে না। পুরো পার্কটি একবার ঘুরে আসা চাই। যদিও পার্ক এলাকাটিতে যুবকদের তুলনায় বয়স্কদের আনাগোনাই বেশি।
এখানে এসে এই বয়স্ক লোকগুলোর চেহারা দেখতে আমার খুবই ভালো লাগে। আমি এদের দেখি। এই যে লোকগুলো, এরা আজ থেকে বিশ বছর আগে কেমন ছিল? টগবগে তরুণ। তাদের গায়ে তখন যৌবনের উন্মত্ততা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হয়তো এদের গর্জন আর হুংকারে প্রতিনিয়ত প্রকম্পিত হতো। শার্টের কলার খোলা রেখেই এরা ঢুকত আর বের হতো। এরা চাইলেই ক্লাস হতো নয়ত হতো না।
এরা মিছিল করত, মিটিং করত। এদের কেউ হয়তো-বা ছিল পাক্কা রাজনীতিবিদ। মোদ্দাকথা, এদের শিরদাঁড়া তখন তালগাছের মতো খাড়া ছিল। বুক ফুলিয়ে হাঁটত এরা ক্যাম্পাসজুড়ে।
কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! ঠিক বিশ বছর পরে এসে এদের তালগাছের মতো খাড়া-শিরদাঁড়া নুয়েপড়া কলাগাছের মতো ঝুঁকে গেছে। যে তারুণ্য নিয়ে অহংকারে মাটিতে তাদের পা পড়ত না, আজ তা অতীত। যে শরীর নিয়ে তাদের অহংকারের অন্ত ছিল না, তা আজ নেতিয়ে পড়েছে। যাদের পায়ের শব্দে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা গমগম করত, আজকে তারা দু-মিনিট হাঁটতেই হাঁপিয়ে উঠছে। এই দৃশ্যগুলো থেকে মানুষের অনেককিছু শেখার আছে। বোঝার আছে।
বেলা বাড়তেই ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকাটি সরগরম হয়ে ওঠে। চারদিকে বাড়তে থাকে মানুষের কোলাহল। বাদাম-বিক্রেতা, আইসক্রিম-বিক্রেতারা তাদের মালপত্র নিয়ে হাজির হয়। পাশেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রছাত্রীদের আগমনে পুরো এলাকাটি আরও মুখরিত হয়ে ওঠে।
সবচেয়ে বড় কথা, বাংলা সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র বলা হয় যে জায়গাটিকে, সেই বাংলাবাজার এলাকা তো ভিক্টোরিয়ার ঠিক পাশেই। কত কবি, সাহিত্যিক, লেখক, গল্পকার, রাজনীতিবিদ, কলা-কুশলী রোজ এই পথ মাড়িয়ে যায়, তার ইয়ত্তা নেই। তবু ভিক্টোরিয়া তার মতোই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
আজ আমার সাথে সাজিদও আছে। তার হাতে একটি বই। ড্যান ব্রাউনের লেখা অ্যাঞ্জেলস এন্ড ডেমনস।
বিখ্যাত ডিটেক্টিভ ক্যারেক্টার রবার্ট ল্যাঙডন-এর স্রষ্টা ড্যান ব্রাউনের নাম শোনেনি—এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়াই এখন দুষ্কর বলতে গেলে। পার্কের পশ্চিম। দিকটায় এসে সাজিদ বসে পড়ল। বই পড়বে। মঈনুল নামে আমার এক বন্ধু আছে। ভালো কবিতা লিখত একসময়ে। একবার একটি কবিতা লিখে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল। সেই কবিতার সবটা আমার মনে নেই, তবে দু-লাইন মনে করতে পারি অবশ্য। লাইন-দুটো ছিল এরকম—
একদিন লাশেরা চিৎকার করে উঠবে
চিহ্নিত হবে খুনীদের চেহারা …
এই কবিতা লিখে মঈনুল তখন রাতারাতি ক্যাম্পাসে কবি বনে যায়। এরপর থেকে দৈনিক পত্রিকাগুলো নিয়ম করে ওর কবিতা ছাপাতে শুরু করে। পত্রিকায় কবিতা ছাপা হওয়াতে আমাদের মঈনুল তখন ক্যাম্পাসের কবির বদলে দেশের কবি খেতাবে উন্নীত হয়ে যায়।
মঈনুলের একটি কবিতা পত্রিকায় ছাপা হতো, আর আমরা সবাই মিলে মিন্টু দার দোকানে গিয়ে ফুচকা খেয়ে ওর পকেট সাবাড় করতাম। বেচারা কবিতা লিখে টুকটাক যা কিছু কামাই করে, দেখা যেত তার সবটাই আমাদের পেটে ঢুকে পড়ত।
মঈনুলের সাথে খুব একটা যোগাযোগ হয় না আজকাল। দুনিয়ার ঘূর্ণাবর্তে আমরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। নিয়মের এই বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়লে সম্পর্কগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারাটা অনেক কঠিন হয়ে ওঠে। বন্ধু প্রতীমের কাছে জানতে পারলাম, মঈনুল এখন নাকি কবিতাচর্চা ছেড়ে নাস্তিকতা চর্চায় বিভোর হয়েছে। শুনে কিছুটা মর্মাহত হলাম। নটরডেমে আমরা একসাথে পড়েছি। ভালো ধার্মিক ছিল সে। নিয়মিত নামাজ-কালাম পড়ত। ওর বাবা ছিলেন মৌলবী। ছোটবেলায় পরিবারে ধর্মীয় শিক্ষা যে পায়নি, তাও বলা যাচ্ছে না।
ভিক্টোরিয়া পার্কে সেদিন সকালবেলা চতুর্থ চক্করটা দিতে যাব ঠিক তখন দেখলাম, উত্তর-পূর্ব দিক থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে মঈনুল আসছে। দেখতে অনেক নাদুস-নুদুস হয়েছে অবশ্য। ভুড়িও বেড়েছে অনেকটা। হালকা পাতলা ধরনের একটি বাদামী টি-শার্ট গায়ে থাকায় তার ভুড়িটা সামনের দিকে আরও হেলে এসেছে।
কাছাকাছি আসতেই মঈনুল আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কীরেভ্যাবলা! কেমন আছিস?