লোকটা না সূচক মাথা নাড়ল।
আমি বললাম, ধর্মগ্রহণে ইসলাম কখনোই জোরজবরদস্তি করে না। কুরআন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে—তোমার ধর্ম তোমার জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য।[৪]
সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, গেল কুরআনের কথা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী দেখলেই বোঝা যায়, তিনি অমুসলিমদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কতটা তৎপর ছিলেন।
ভদ্রলোক বললেন, যেমন?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সাবধান! তোমাদের যে-ব্যক্তি কোনো নিরপরাধ অমুসলিম ব্যক্তির ওপর নির্যাতন চালাবে, তার অধিকার খর্ব করবে, তাকে দুঃখ দেবে, অথবা তার অনুমতি ব্যতীত তার কাছ থেকে কোনোকিছু ছিনিয়ে নেবে, জেনে রাখো কিয়ামতের মাঠে আমি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবো।[৫] এরচেয়ে উত্তম কিছু আর কী হতে পারে বলুন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম স্বয়ং সেই মুসলিমের সাথে যুদ্ধে নামার ঘোষণা দিচ্ছেন, যে একজন নিরপরাধ অমুসলিমকে কষ্ট দেয়, আঘাত করে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। তিনি আরও বলেছেন, যদি কোনো মুসলিম কোনো নিরপরাধ অমুসলিমকে বিনা কারণে হত্যা করে, তাহলে সে জান্নাতের খুশবু পর্যন্ত পাবে না, যদিও জান্নাতের এই খুশবু ৪০ হাজার বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।[৬]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সঙ্গীরা যখন নিজেদের ওপর অকথ্য, অবর্ণনীয় অত্যাচার, নির্যাতনের পরে প্রিয় স্বদেশ ত্যাগ করে মদীনায় চলে যান, কয়েক বছর পরে তারা মক্কা বিজয় করে আবার দেশে ফিরে আসেন। মক্কায় ফেরার পরে মুসলিমদের এক সেনাপতি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করে বসেন, আজ হচ্ছে আমাদের প্রতিশোধ নেবার দিন। তার মুখে এই কথা শুনে রাসূল। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, না! আজ হচ্ছে উন্মুক্ত ক্ষমার দিন। এরপরে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার মুশরিকদের দিকে ফিরে বললেন, আজ তোমরা আমার কাছ থেকে কেমন আচরণ আশা করো? মুশরিকরা বলল, আমরা আপনার কাছ থেকে তেমন আচরণই আশা করি, যেমন আচরণ ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার পাপিষ্ঠ ভাইদের সাথে করেছিলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিক সেই কথাটাই, বললেন যা ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার ভাইদের সাথে বলেছিলেন—আজ তোমাদের আর কোনো প্রশ্ন করা হবে না। আজ তোমরা সকলেই মুক্ত।[৭]
সাজিদ বলে চলল, কতটুকু নরম, কোমল প্রকৃতির অধিকারী হলে একজন নেতা তার পরম শত্রুদের এত সহজ ও স্বাভাবিকভাবে ক্ষমা করে দিতে পারে?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা করা আমার ওপর আরোপিত বিশেষ কর্তব্যগুলোর একটি।[৮]
আমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে সাজিদের কথা শুনছি। সে বলে যাচ্ছে—একবার মিশরের এক মুসলিম শাসক একজন অমুসলিমকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিয়েছিলেন। এই খবর যখন খলিফা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু এর কানে এলো, তখন তিনি সেই অমুসলিমকে নির্দেশ দিলেন; মুসলিম শাসককে ঠিক সেভাবেই শাস্তি দেওয়ার জন্য যেভাবে অমুসলিম ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তিনি তখন ক্ষুন্ধস্বরে মুসলিম শাসককে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, কখন থেকে মানুষকে তুমি তোমার দাস ভাবা শুরু করেছ?[৯]
দেখুন, এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে অমুসলিমদের অধিকার, মর্যাদা রক্ষায় ইসলাম কতটা উদার ও তৎপর।
সাজিদ থামল। ভদ্রলোক বললেন, ইসলামী শাসন চালু হলে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের সাথে কী করা হবে?
সাজিদ পানির বোতল থেকে পানি ঢেলে মুখে ছিটিয়ে নিল হালকা। এরপরে বলল, আরেকটি চমৎকার প্রশ্ন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজরান অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের ভূমি এবং তার শাসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের জীবন, তাদের ভূমি, তাদের সম্পদ, তাদের উপসনালয় সবকিছুরই নিরাপত্তা দেওয়া হবে। কোনো যাজককে তার কাজ হতে, কোনো অফিসারকে তার চাকরি থেকে চাকরিচ্যত করা হবে না।[১০]
শুধু তাই নয়, মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত কোনো অমুসলিম বহিঃশত্রুদের সাথে কোনো প্রকার যুদ্ধে অংশ নিতেও বাধ্য নয়। বাইরের কোনো শত্রু যদি মুসলিমরাষ্ট্র আক্রমণ করে, তাহলে মুসলিমরাই তাদের প্রতিহত করবে। সেই মুসলিমরাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমরা কোনো ধরনের যুদ্ধে যেতে বাধ্য নয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, অমুসলিমরা কি এমনিতেই সুফল ভোগ করবে কোনোরকম ত্যাগ ছাড়াই?
সাজিদ বলল, না। অমুসলিমদের হয়ে মুসলিমরা সকল যুদ্ধ-বিগ্রহ সামলাবে ঠিক, তবে অমুসলিমদেরও কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। সেটি হলো অমুসলিমরা এর পরিবর্তে সামান্য ট্যাক্স দেবে কেবল।
আমি বললাম, ও আচ্ছা। যেটিকে জিজিয়া কর বলা হয়, তাই না?
ঠিক ধরেছিস। এটার নাম জিজিয়া কর। তবে ইসলামী আইনশাত্রে বলা আছে, গরিব, বৃদ্ধ এবং অসমর্থলোক এই জিজিয়া কর প্রদানের বিধানমুক্ত। শুধু তাই নয়, ইসলামী রাষ্ট্রের রাজকোষ বায়তুল মাল থেকে রাষ্ট্রের গরিব, দুঃস্থ, অসহায় অমুসলিমদের অর্থ প্রদান করে সহায়তারও বিধান রয়েছে ইসলামী আইনে।[১১]
আমাদের সামনে বসে থাকা ভদ্রলোকের চেহারায় হাসির আমেজ দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে তিনি তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। ইসলাম যে অমুসলিমদের সাথে কোনো অন্যায় করে না, তাদের অধিকার দানে যে কোনো কারচুপি করে না, সেটি হয়তো তিনি এখন বুঝতে পেরেছেন। লোকটির সাথে আমাদের আরও আলাপ হলো। জানতে পারলাম তার নাম মুহাম্মদ আজহার উদ্দীন। একটি বেসরকারী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে আছেন। রাজশাহীতে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছিলেন।