ফিরছিলাম রাজশাহী থেকে। গিয়েছিলাম দাওয়াতে। সাজিদের ফুফাত ভাইয়ের বিয়ে সেরে ফেলা হলো। দাওয়াত-খাওয়া আর মহাস্থানগড় ভ্রমণ করা। সাহিত্যের ভাষায় যাকে রথ দেখা আর কলা বেচা বলে।
সে যাহোক, রাতের ট্রেন। তিন দিনের সফর শেষে বাসায় যাচ্ছি। আমি খুব ক্লান্ত। মনে হচ্ছে বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুম চলে আসবে। সাজিদের দিকে তাকালাম। সে। বসে আছে আমার পাশেই। তার চেহারায় ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেউ যদি তাকে ৫০০ মিটার দৌড়ে আসতে বলে তবুও সে হাসিমুখেই। রাজি হয়ে যাবে।
আমাদের ঠিক উল্টোদিকের সামনের সিটে, সাজিদের মুখ বরাবর মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। চুল আর দাড়িতে মেহেদীর কলপ করেছেন বলে বয়স তেমন বোঝা যাচ্ছে না। খুবই শৌখিন মানুষ হয়তো। শৌখিন মানুষগুলোই চুল-দাড়িতে মেহেদীর কলপ করে থাকে সাধারণত। আমার দাদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের সরকারি চাকুরিজীবী। দাদাও প্রতিমাসে তার চুল আর দাড়িতে মেহেদীর কলপ লাগাতেন। আমাদের বাড়ির উঠোনে ইয়া বড় একটি মেহেদী গাছ ছিল। দাদির দাবি, এই গাছের দুই-তৃতীয়াংশ পাতা দাদাই ব্যবহার করতেন। মৃত্যুর মাস
দেড়েক আগেও দাদা চুল-দাড়িতে মেহেদীর কলপ লাগিয়েছিলেন বলে দাদির কাছে শুনেছিলাম। সে যাহোক, আমাদের সামনে যে ভদ্রলোক বসে আছেন, তার হাতে একটি ইংরেজি পত্রিকার ম্যাগাজিন। নাম-Lifestyle.
দাড়িতে মেহেদী লাগিয়ে সেগুলোকে কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতো টকটকে লাল করে ফেলার পদ্ধতিটি হয়তো এই ম্যাগজিন থেকেই শেখা। এই মুহূর্তে আমার খুব ঘুম দরকার; কিন্তু ট্রেন চলার শব্দ আর ঝাঁকুনির কবলে পড়ে চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেছে ততক্ষণে।
সাজিদ একমনে বই পড়ছে। বইটির নাম There is a God: How Worlds most notorious Atheists changed his mind. একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ ফিলোসফারের লেখা বই, যিনি একসময় কট্টর নাস্তিক ছিলেন। পরে নাস্তিকতা থেকে ফিরে এসে তিনি এই বই লিখে ব্যাপক হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। সাজিদের পাশে বসে আমি কেবল হাই তুলছি আর ঝিমুচ্ছি।
একটুপরে আমাদের সামনের ভদ্রলোক কথা বলে উঠলেন। তিনি একটি চিপসের প্যাকেট খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন—Please Take.
ভদ্রলোকের আবদার দেখে আমার হাই আর ঝিমুনি দুইটাই উবে গেল। মুহূর্তেই আমি স্বাভাবিক চেহারা বানিয়ে বললাম—No, Thanks.
ভদ্রলোক একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ভয় পাচ্ছ নাকি?
আমি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। ভদ্রলোক ভাবছেন হয়তো তাকে কোনো হাইজ্যাকার-টাইজ্যাকার ভেবে আমি তার কাছ থেকে চিপস নিতে চাচ্ছি না। আমার হয়ে জবাব দিল সাজিদ। বলল, আঙ্কেল, ওর আসলে ফাস্টফুডে এলার্জি আছে।
ওহ আচ্ছা। তাই বলো ভদ্রলোক বললেন। এরপর সাজিদের দিকে প্যাকেটখানা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তুমি নাও।
সাজিদ নিল। দুটুকরো পটেটো চিপস মুখে পুরে দিয়ে সে ভদ্রলোককে বলল, Thank You.
তোমার নাম? ভদ্রলোকের প্রশ্ন।
সাজিদ
কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
রাজশাহীতে বেড়াতে এসেছিলাম। ঢাকা ফিরছি।
এতটুকু আলাপের পরে সাজিদ আবার বই পড়ায় মন দিল। ততক্ষণে ভদ্রলোক পটেটো চিপসের প্যাকেটটি খালি করে সেটি জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিলেন। একটুপরে তিনি সাজিদকে জিজ্ঞেস করলেন, খুবই পারসোনাল একটি প্রশ্ন করতে পারি?
সাজিদ সাতপাঁচ না ভেবে বলল, কোনো সমস্যা নেই।
তোমার হাতে থাকা বইটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। কিছু মনে না করলে আমি কি বইটি একটু দেখতে পারি?
সাজিদ হাসি মুখে অবশ্যই বলতে বলতে ভদ্রলোকের দিকে বইটি এগিয়ে দিল। তিনি বইটি হাতে পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখলেন। এরপর বইটি আবার সাজিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। বেশ ভালো বই বলে মনে হলো।
সাজিদ কিছু না বলে বইটি খুলে আগের জায়গা থেকে পড়তে শুরু করল। ভদ্রলোক একটু পরে আবার বললেন, সরি, ইফ আই মাইট হ্যাভ বদারড ইউ। আমার মনে হচ্ছে তুমি কম্পারেটিভ রিলিজিওনের ছাত্র। আসলে তোমার হাতে থাকা বইটি দেখেই অনুমান করছি।
সাজিদ বলল, জি না। কম্পারেটিভ রিলিজিওন আমার অ্যাকাডেমিক সাবজেক্ট নয়। তবে বিষয়টি আমার খুব ফেভারিট। এজন্যেই সুযোগ পেলে আমি এটা নিয়ে পড়াশোনা করি।
সাজিদের উত্তর শুনে ভদ্রলোক বললেন, দ্যাটস গ্রেট। এরপর সাজিদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নাইস টু মিট ইউ।
সাজিদ মুখে কোনোকিছু না বলে হাত মিলাল। করমর্দন-পর্ব শেষ হতেই তিনি আবার বললেন, কিছু মনে না করলে আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতাম।
সাজিদ তার হাতে থাকা বইটি বন্ধ করে বলল, জি, অবশ্যই।
মুচকি হাসলেন ভদ্রলোক। সম্ভবত আড্ডা দেওয়ার মানুষ পেয়ে তিনি যারপরনাই খুশি এই মুহূর্তে।
প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে তিনি বললেন, আসলে, পারিবারিকভাবে আমি মুসলিম পরিবারের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয়েছে ইসলাম হলো একটি সাম্যের ধর্ম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার মনে নানা ধরনের প্রশ্ন দানা বাঁধতে শুরু করে। আমি অবশ্য ধর্ম কিংবা স্রষ্টা কোনোটিই অস্বীকার বা অবিশ্বাস করি না। ইসলাম নিয়েও আমার ঢের কোনো আপত্তি নেই। তবুও মাঝে মাঝে আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগে। আমার খুব করে জানতে মন চায় ইসলাম অমুসলিমদের স্বাধীনতা রক্ষায়, অধিকার রক্ষার ব্যাপারে আদৌ তৎপর কি না? তুমি প্রশ্ন করতে পারো, আমার মধ্যে এই প্রশ্ন জাগল কেন? আসলে, ব্যক্তিগত জীবনে এবং চাকরির সুবাদে দেশে-বিদেশে প্রচুর অমুসলিমের সাথে আমি লেনদেন করেছি। তাদের অধিকাংশকেই আমি সৎ ও ভালো মানুষ হিশেবে পেয়েছি। এমতাবস্থায়, যদি ধরে নিই যে, দেশে শারয়ী আইন বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাহলে তাদের সাথে ইসলামিক পারস্পেক্টিভ থেকে কীরকম আচরণ করা হবে? তাদের অধিকার কতটুকু নিশ্চিত করা হবে? তাদের ধর্মান্তকরণে জোর-জুলুম, জবরদস্তি করা হবে কি না?