তাহলে, ঘটনার পরম্পরা এবং ইতিহাস বলছে—প্রথম সন্তান ইসহাক আলাইহিস সালাম নয়, ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। এইটুকু কি ক্লিয়ার?
আমরা উভয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। সাজিদ আবার বলতে লাগল,
এরপরের আয়াতে যান। বলা হচ্ছে-অতঃপর পুত্র-সন্তানটি যখন তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছাল, তখন ইবরাহীম বলল, বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন বলল, এ ব্যাপারে তোমার অভিমত কী? সে বলল, হে পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন।
আগের দুই আয়াত থেকে একটি ব্যাপার ক্লিয়ার যে, উক্ত সন্তান ছিলেন ইসমাঈল আলাইহিস সালাম, ইসহাক আলাইহিস সালাম নন এবং যাকে কুরবানী করার স্বপ্ন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দেখলেন, সেও তাহলে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। আর তখন কিন্তু ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মও হয়নি। কথাগুলোকে যদি আমরা প্রশ্নোত্তর-আকারে সাজাই তাহলে কীরকম দাঁড়ায় দেখা যাক—
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সন্তানের জন্য কখন প্রার্থনা করলেন?
যখন তিনি সন্তানহীন ছিলেন।
আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে যখন তাকে একজন পুত্র-সন্তানের সুসংবাদ দেন, সে কি প্রথম সন্তান না দ্বিতীয়?
প্রথম সন্তান।
ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রথম সন্তানের নাম কী?
ইসমাঈল আলাইহিস সালাম।
আয়াতে কোন সন্তানকে কুরবানী করার কথা বলা আছে?
দোয়া কবুলের পর সুসংবাদ-প্রাপ্ত সন্তানকে।
সেই সন্তান কে ছিলেন?
ইসমাঈল আলাইহিস সালাম।
সুতরাং, এখান থেকে এটি প্রমাণিত হলো যে, আয়াতে উল্লিখিত সন্তান ইসমাঈল আলাইহিস সালাম, ইসহাক আলাইহিস সালাম নয়।
এতটুকু বলে সাজিদ থামল। আমাদের দুজনের কেউ কোনো কথা বলছি না দেখে সে আবার বলতে শুরু করল—এবার তাহলে মিশনারিদের লজিকে আসা যাক। তারা। বলছে-কুরআন প্রথমে একজন পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছে; কিন্তু কারও নাম উল্লেখ করেনি। কিছুদূর এসে কুরআন আবারও সুসংবাদসহ ইসহাক আলাইহিস সালামের নাম উল্লেখ করেছে। এখান থেকে তারা ধরে নিচ্ছে যে, কুরবানী করতে নিয়ে যাওয়া পুত্র ইসহাক ছিলেন, ইসমাঈল নয়; কিন্তু ইতিপূর্বে আমরা এই আয়াতগুলো থেকে এটা প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, এই আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট ইসমাঈল আলাইহিস সালামের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, ইসহাক আলাইহিস সালামের নয়।
যদি তাদের দাবি মেনেও নিই, তাহলে ব্যাপারটি কেমন দাঁড়ায়? ধরে নিই যে এখানে ইসমাঈল নয়, ইসহাক আলাইহিস সালামের কথাই বলা হচ্ছে। তাহলে আয়াতের পরম্পরা অনুযায়ী দেখুন তো কেমন দেখায় ব্যাপারটি—
প্রথমে পুত্র ইসহাক আলাইহিস সালামের সুসংবাদ দেওয়া হলো। এরপর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ইসহাক আলাইহিস সালামকে কুরবানী করার স্বপ্ন দেখলেন এবং ইসহাক আলাইহিস সালাম রাজি হলেন। ইসহাককে কুরবানী করতে নিয়ে যাওয়া হলো। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কুরবানী করতে উদ্যত হলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অনুগ্রহ করে তাকে বাঁচিয়ে দিলেন। এরপর? এরপর আরও নিচে এসে আবারও ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মের সুসংবাদ দেওয়া হলো।
ব্যাপারটা কেমন বেখাপ্পা দেখাচ্ছে দেখুন। একবার ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মের সুসংবাদ। এরপরে তার বেড়ে ওঠার কাহিনি। তারপরে তাকে কুরবানী করার ও তাকে বাঁচিয়ে নেওয়ার কাহিনি। শেষে এসে আবার তার জন্মের কাহিনি। কেমন নাব্যাপারটা?
আমি বললাম, হ্যাঁ, পুরোই বিদঘুটে ব্যাপার।
ইসহাক আলাইহিস সালামকে এখানে বসাতে হলে কুরআন নিজেই তার বাচনভঙ্গি থেকে সরে যাচ্ছে কিন্তু কুরআন এখানে ইসহাক আলাইহিস সালামকে নয়, ইসমাঈল আলাইহিস সালামকেই বুঝিয়েছে। তাছাড়া, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইচ্ছার কাছে নিজের জীবন এভাবে উৎসর্গ করে দিতে সর্বোচ্চ ধৈর্য শক্তির পরিচয় দিতে হবে। কুরআনের অনেক জায়গায় ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে ধৈর্যশীল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৫] অন্যদিকে, কুরআনে ইসহাক আলাইহিস সালামকে উল্লেখ করা হয়েছে জ্ঞানবান হিশেবে।[৬]
এখান থেকেও উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে, সেদিনের ঘটনায় ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ছিলেন, ইসহাক আলাইহিস সালাম নয়।
এছাড়াও, বিখ্যাত তাফসীরকারক ইবনু কাসীর রাহিমাহুল্লাহ তার বিখ্যাত বই আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে ইবনু আব্বাস রাহিমাহুল্লাহর উদ্ধৃতি টেনে লিখেছেন, সেদিন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যে-পশু দিয়ে কুরবানী করেছিলেন তার শিং কাবা শরীফের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে সংরক্ষিত ছিল।[৭]
এখান থেকেও বোঝা যায় যে, উক্ত ঘটনায় সেদিন ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-ই ছিলেন, ইসহাক আলাইহিস সালাম নয়। কারণ, এই বিষয়ে সকল ইতিহাসবিদ একমত যে, কেবল ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-ই মক্কায় অবস্থান করেছিলেন। ইসহাক আলাইহিস সালাম কখনোই মক্কায় আসেননি। তিনি ছিলেন মিশরে। সুতরাং, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মেরও হাজার বছর আগে থেকে আরবরা জানত, এখানে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজপুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কুরবানী দিতে এনেছিলেন। তাই ইসমাঈল আলাইহিস সালামের সেই স্মৃতি রক্ষার্থে তারা যুগ যুগ ধরে সেটা সংরক্ষণ করে রেখেছিল। যদি ইসমাঈলের জায়গায় ইসহাক আলাইহিস সালাম হতেন, তাহলে পশুর এই শিং প্রাচীন মক্কার আরবদের পাওয়ার কথাই না। এখান থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, সেদিন ঘটনাস্থলে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ছিলেন, ইসহাক আলাইহিস সালাম নয়।