লোকটা বলল, -‘নাহ। কিন্তু, এগুলো দিয়ে তুমি কি বোঝাতে চাও?’
সাজিদ বলল, -‘খালু, ইতিহাস থেকে আমরা আরো জানতে পারি, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চতুর্থ আমেনহোটেপ এর আগে যে সকল শাসকেরা মিশরকে শাসন করেছে, তাদের সবাইকেই ‘রাজা’ বলে ডাকা হতো। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চতুর্থ আমেনহোটেপ এর পরে যে সকল শাসকেরা মিশরকে শাসন করেছিল তাদের সবাইকে ‘ফেরাউন’ বলে ডাকা হতো। ইউসুফ সা. মিশরকে শাসন করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের চতুর্থ আমেনহোটেপ এর আগে। আর, মুসা আঃ মিশরে জন্ম লাভ করেছিলেন চতুর্থ আমেনহোটেপ এর কমপক্ষে আরও ২০০ বছর পরে। অর্থাৎ, যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন মিশরের শাসকদের আর ‘রাজা’ বলা হতো না, ‘ফেরাউন’ বলা হতো।’
-‘হুম, তো?’
-‘কিন্তু খালু, কোরআনে ইউসুফ আঃ এবং মুসা আঃ দুইজনের কথাই আছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, কোরআন ইউসুফ আঃ এর বেলায় শাসকদের ক্ষেত্রে ‘রাজা’ শব্দ ব্যবহার করলেও, একই দেশের, মুসা আঃ এর সময়কার শাসকদের বেলায় ব্যবহার করেছে ‘ফিরাউন’ শব্দটি। বলুন তো খালু, মরুভুমির বালুতে উট চরানো বালক মুহাম্মদ সা. ইতিহাসের এই পাঠ কোথায় পেলেন? তিনি কিভাবে জানতেন যে ইউসুফ আলাই সালাম এর সময়ের শাসকদের রাজা বলা হতো মুসা আলাই সাল্লাম এর সময়কার শাসকদের ফেরাউন এবং ঠিক সেই মতো শব্দ ব্যবহার করে তাদের পরিচয় দেওয়া হল?
মহব্বত আলী নামের ভদ্রলোকটি হো হো হো করে হাসতে লাগলো। বললো, -‘মুসা আর ইউসুফ এর কাহিনী তো বাইবেলেও ছিল। সেখান থেকে কপি করেছে, সিম্পল।’
সাজিদ মুচকি হেসে বলল, -‘খালু ম্যাটার অফ সরো দ্যাট, বাইবেল এই জায়গায় চরম একটি ভুল করেছে। বাইবেল ইউসুফ আঃ এবং মুসা আঃ দুজনে সময়কার শাসকদের জন্যই ‘ফেরাউন’ শব্দ ব্যবহার করেছে, যা ঐতিহাসিক ভুল। আপনি চাইলে আমি আপনাকে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে প্রমাণ দেখাতে পারি।’
লোকটা কিছুই বলল না চুপ করে আছে। সম্ভবত উনার প্রমান দরকার হচ্ছে না। সাজিদ বলল, -‘যে ভুল হয় বাইবেল করেছে, সে ভুল অশিক্ষিত আরবের বালক মুহাম্মদ সা. এসে ঠিক করে দিল, তা কিভাবে সম্ভব, যদি না তিনি কোন প্রেরিত দূত হন, আর কোরআন কোন ঐশী গ্রন্থ না হয়?’
লোকটি চুপ করে আছে। এর মধ্যেই তিনটি সিগারেট খেয়ে শেষ করেছে। নতুন আরেকটি ধরাতে ধরাতে বলল, -‘হুম, কিছুটা যোক্তিক।’
সাজিদ আবার বলতে লাগল, -‘খালু, কোরআনে একটি সূরা আছে। সূরা আল ফজর নামে। ৬ নম্বর আয়াতটি এরকম, -‘তোমরা কি লক্ষ্য করনি, তোমাদের পালনকর্তা ইরাম গোত্রের সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন?’
এই সূরা ফাজরে মূলত আদ জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। আদ জাতির আলাপের মধ্যে হঠাৎ করে ‘ইরাম’ নামে একটি শব্দ চলে এলো, যা কেউই জানত না এটা আসলে কি। কেউ কেউ বলল, এটা আদ জাতির কোন বীর পালোয়ানের নাম, কেউ কেউ বলল, এই ইরাম হতে পারে আদ জাতির শারীরিক কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কারণ এই সূরায় আদ জাতির শক্তিমত্তা নিয়ে আয়াত আছে। মোদ্দাকথা এই ইরাম আসলে কি সেটা সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি তখন। এমনকি গোটা পৃথিবীর কোন ইতিহাসে ইরাম নিয়ে কিছুই বলা ছিল না। কিন্তু ১৯৭৩ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সিরিয়ার মাটির নিচে শহর এর সন্ধান পায়। এটি ছিল আদ জাতিদের শহর। সেই শহরে পাওয়া যায় সুপ্রাচীন উচু উচু দালান। এমনকি এই শহরে আবিষ্কার হয় তখনকার একটি লাইব্রেরী। লাইব্রেরীতে একটি তালিকা পাওয়া যায়। এই তালিকায় তারা যেসকল শহরের সাথে বাণিজ্য করতো সেসব শহরের নাম উল্লেখ ছিল। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই -সেই তালিকায় ‘ইরাম’ নামের একটি শহরের নাম পাওয়া যায়, যেটা আদ জাতিদের একটি শহর ছিল। শহরটি ছিলো পাহাড়ের মধ্যে। এতেও ছিল সুউচ্চ দালান ।
চিন্তা করুন, যে ‘ইরাম’ শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা এর পূর্বে তাফসিরকারকরাও করতে পারেনি। কেউ এটাকে বীরের নাম, কেউ এটাকে আদ জাতির শারীরিক বৈশিষ্ট্যের নাম বলে ব্যাখ্যা করেছে।
১৯৭৩ সালের আগে যে ‘ইরাম’ শহরের সন্ধান পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাসে ছিল না, কোন ভূগোলবিদ, ইতিহাসবিদই এই শহরের সম্পর্কে কিছুই জানতো না, প্রায় ৪৩ শত বছর আগের আদ জাতিরদের সেই শহরের নাম কিভাবে কোরআন উল্লেখ করলো? যেটা আমরা জেনেছি ১৯৭৩ সালে, সেটা মুহাম্মদ সা. কিভাবে আরবের মরুভূমিতে বসে ১৪০০ বছর আগে জানলো? হাউ পসিবল? তিনিতো অশিক্ষিত ছিলেন। কোনদিন ইতিহাস-বা ভূগোল পড়েননি। কিভাবে জানলেন খালু?’
আমি খেয়াল করলাম, লোকটার চেহারা থেকে মোঘলাই ভাবটা সরে যেতে শুরু করেছে। পুত্রতুল্য ছেলের কাছ থেকে তিনি এতটা শক খাবেন, হয়তো আশা করেন নি।
সাজিদ আবার বলতে লাগল-
‘খালু আর রহমান নামে কোরআন একটি সূরা আছে। এই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে, –
‘হে জিন ও মানুষ ! তোমরা যদি আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে পারো, তবে কর। যদি তোমরা তা পারবেনা প্রবল শক্তি ছাড়া।’
মজার ব্যাপার হলো, এই আয়াতটি মহাকাশ ভ্রমন নিয়ে। চিন্তা করুন, আজ থেকে চোদ্দশ বছর আগে আরবের লোক যাদের কাছে যানবাহন বলতে কেবল ছিল উট আর গাধা, ঠিক সেই সময়ে বসে মুহাম্মদ সা. মহাকাশ ভ্রমন নিয়ে কথা বলছে, ভাবা যায়?