সাজিদ কলিংবেল বাজালো।
ঘরের দরজা খুলে দিলো একটি তের-চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলে। সম্ভবত কাজের ছেলে।
আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ছেলেটি বলল, -‘আপনারা এখানে বসুন। আমি কাকাকে ডেকে দিচ্ছি।’
ছেলেটা একদম শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে। বাড়ির মালিককে স্যার বা মালিক না বলে কাকা বলছে। সম্ভবত উনার কোন গরীব আত্মীয়ের ছেলে হবে হয়তো। যাদের খুব বেশি টাকা পয়সা হয়, তারা গ্রাম থেকে গরীব আত্মীয়দের বাসার কাজের চাকরি দিয়ে দয়া করে।
ছেলেটা ভদ্রলোকটি ডাকার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ঘরের ভেতরটা আরো চমৎকার। নানান ধরনের দামি দামি মার্বেল পাথর দিয়ে দেয়াল সাজানো।
দু’তলার কোন এক রুম থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর ভেসে আসছে, -‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে…..’
আমি সাজিদকে বললাম, -‘কিরে তোর এরকম মোঘলাই স্টাইলের একটা খালু আছে, কোনদিন বললি না যে?’
সাজিদ রসকষহীন চেহারায় বলল, -‘মোঘলাই স্টাইলের খালু তো, তাই বলা হয়নি।’
-‘তোর খালুর নাম কি?’
-‘এম এম আলী।’
ভদ্রলোকের নামটা ওনার বাড়ির মতোই গাম্ভীর্যপূর্ণ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, -‘এম এম আলী মানে কি?’
সাজিদ আমার দিকে তাকালো। বলল, -‘মোহাম্মদ মহব্বত আলী।’
ভদ্রলোকের বাড়ি আর ঐশ্বর্যের সাথে নামটা একদম যাচ্ছে না। এজন্য হয়ত মোহাম্মদ মহব্বত আলী নামটাকে শর্টকাট করে এম এম আলী করে নিয়েছেন।
ভদ্রলোক আমাদের সামনের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসলেন। মধ্যবয়স্ক। চেহারায় বার্ধক্যের কোন ছাপ নেই। চুল পেকেছে, তবে কলপ করায় তা ভালোমতো বোঝা যাচ্ছে না।
তিনি বললেন। -‘তোমাদের মধ্যে সাজিদ কে?’
আমি লোকটার প্রশ্ন শুনে অবাক হলাম খুব। সাজিদের খালু, অথচ সাজিদকে চিনে না। এটা কি রকম কথা?
সাজিদ বলল, -‘জি, আমি।’
-‘হুম, I guessed that’ –লোকটা বলল। আরো বলল, -‘তোমার কথা বেশ শুনেছি, তাই তোমার সাথে আলাপ করার ইচ্ছে জাগলো।’
আমাদের কেউ কিছু বললাম না। চুপ করে আছি।
লোকটা আবার বলল, -‘প্রথমে আমার সম্পর্কে দরকারি কিছু কথা বলে নিই। আমার পরিচয় তো তুমি জানোই, সাজিদ। যেটা জানো না, সেটা হলো, -বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে আমি একজন অবিশ্বাসী। খাঁটি বাংলায় নাস্তিক। হুমায়ুন আজাদকে তো চেনো, তাই না? আমরা একই ব্যাচের ছিলাম। আমি নাস্তিক হলেও আমার ছেলেমেয়েরা কেউই নাস্তিক নয়। সে যাহোক, এটা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’
সাজিদ বলল, -‘খালু, আমি সব জানি।’
লোকটা অবাক হবার ভান করে বললো, -‘জানো? ভেরি গুড। ক্লেভার বয়।’
-‘খালু, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন তা বলুন।’
-‘ওয়েট ! তাড়াহুড়া কিসের?’ -লোকটা বলল।
এরই মধ্যেই কাজের ছেলেটা ট্রেতে করে চা নিয়ে এল। আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। লোকটাকে একটি আলাদা কাপে চা দেয়া হল। সেটা চা নাকি কফি, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
লোকটি বলল, -‘সাজিদ, আমি মনে করি, তোমাদের ধর্মগ্রন্থ, আই মিন আল-কোরআন, সেটা কোন ঐশী গ্রন্থ নয়। এটা মোহাম্মদের নিজের লেখা একটি বই। মোহাম্মদ করেছে কি, এটাকে জাস্ট স্রষ্টার বাণী বলে চালিয়ে দিয়েছে।’
এইটুকু বলে লোকটা আমাদের দুজনের দিকে তাকাল। হয়তো বোঝার চেষ্টা করলো আমাদের রিএকশন কি হয়।
কিছু বলার আগেই লোকটি আবার বলল, ‘হয়তো বলবে, মুহাম্মদ লিখতে-পড়তে জানত না। সে কিভাবে এরকম একটি গ্রন্থ লিখবে? ওয়েল। এটা খুব লেইম লজিক। মুহাম্মদ লিখতে পড়তে না জানলে কি হবে, তার ফলোয়ারদের অনেকে লিখতে পড়তে পারতো। উচ্চশিক্ষিত ছিল। তারা করেছে কাজটা মোহাম্মদের ইশারায়।’
সাজিদ তার কাপে শেষ চুমুক দিল। তখনও সে চুপচাপ।
লোকটা বলল, -‘কিছু মনে না করলে আমি একটি সিগারেট ধরাতে পারি? অবশ্য কাজটি ঠিক হবে না জানি।’
আমি বললাম, -‘শিওর !’
এতক্ষণ পরে লোকটি আমার দিকে ভালো মত তাকালো। একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল, -‘Thank you’
সাজিদ বলল, -‘খালু, আপনি খুবই লজিক্যাল কথা বলেছেন। কোরআন মুহাম্মদ সা. এর নিজের বানানো হলেও হতে পারে। কারণ, কুরআন যে ফেরেশতা নিয়ে আসতো বলে দাবি করা হয়, সেই জিব্রাইল আঃ কে মুহাম্মদ সা. ছাড়া কেউই কোনো দিন দেখেনি।’
লোকটা বলে উঠল, -‘এক্সাক্টলি, মাই সান’
-‘তাহলে, কোরানকে আমরা টেস্ট করতে পারি, কি বলেন খালু?’
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ, করা যায়…..’
সাজিদ বলল, -‘কোরআন মুহাম্মদ সা. এর বানানো কিনা, তা বুঝতে হলে আমাদের ধরে নিতে হবে যে, মুহাম্মদ সা. স্রষ্টার কোন দূত নন। তিনি খুবই সাধারন, অশিক্ষিত একজন প্রাচীন মানুষ।’
লোকটা বলল, -‘সত্যিকার অর্থে মোহাম্মদ অসাধারণ কোন লোক ছিলেন না। স্রষ্টার দূত তো পুরোটাই ভুয়া।’
সাজিদ মুচকি হাসলো। বললো, -‘তাহলে এটাই ধরে নেই?’
-‘হুম’- লোকটার সম্মতি।
সাজিদ বলতে লাগল। -‘খালু ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি হযরত ইউসুফ আঃ এর জন্ম হয়েছিল বর্তমান ফিলিস্তিনে। ইউসুফ আঃ ছিলেন হযরত ইয়াকুব আঃ এর কনিষ্ঠতম পুত্র। ইয়াকুব আঃ এর কাছে ইউসুফ আঃ ছিলেন প্রাণাধিক প্রিয়। কিন্তু, ইয়াকুব আঃ এর ভালোবাসা ইউসুফ আঃ এর জন্য কাল হলো। তার ভাইয়েরা ষড়যন্ত্র করে ইউসুফ আঃ কে কূপে নিক্ষেপ করে দেয়। এরপর, কিছু বনিকদল কূপ থেকে ইউসুফ আঃ কে উদ্ধার করে তাকে মিশরে নিয়ে আসে। তিনি মিশরের রাজ পরিবারে বড় হন। ইতিহাস মতে, এটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের আমেনহোটেপ এর রাজত্বকালের আর তিনশো বছর পূর্বে। খালু, এই বিষয়ে আপনার কোন দ্বিমত আছে?’