লোকটা সাজিদকে বলছে, -‘তোকে কত করে বলেছি, আমার লেখা ‘আমার অবিস্বাস’ বইটা ভালো মতো পড়তে। পড়েছিলি?’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ স্যার। পড়েছি তো।’
-‘তাহলে আবার আস্তিক হয়ে গেলি কেন? নিশ্চয়ই কোন ত্যাদড়ের ফাঁদে পড়েছিস? কে সে? নাম বল? পেছনে যে আছে, কি জানি নাম?’
-‘ইডিয়েট আরিফ……..’
-‘হ্যাঁ, এই ত্যাদড়ের ফাঁদে পড়েছিস বুঝি? দাড়া, তাকে আমি মজা দেখাচ্ছি…….।
এই বলে লোকটা বসা থেকে উঠে গেল।
সাজিদ জোরে জোরে বলে উঠল, -‘না না স্যার। ও কিছু জানে না।’
-‘তাহলে?’
-‘আসলে স্যার, বলতে সংকোচবোধ করলেও সত্য এটাই যে নাস্তিকতার উপর আপনি যেসব লজিক দেখিয়েছে সেগুলো এতটাই দুর্বল যে, নাস্তিকতার উপর আমি বেশিদিন ঈমান রাখতে পারিনি।’
এইটুকু বলে সাজিদ মাথা নিচু করে ফেলল। লোকটার চেহারাটা মুহূর্তেই রুক্ষভাব ধারণ করলো। বললো, -‘তার মানে বলতে চাইছিস, তুই এখন আমার চেয়েও বড় পন্ডিত হয়ে গেছিস? আমার চেয়েও বেশি পড়ে ফেলেছিস? বেশি বুঝে ফেলেছিস?’
তখনও মাথা নিচু করে বসে আছে।
লোকটা বলল, -‘যাগ গে, একটা সিগারেট খাবো। ম্যাচ নাই। তোর কাছে আছে?’
-‘জি স্যার’- এই বলে সাজিদ ব্যাগ খুলে একটি ম্যাচ বের করে লোকটার হাতে দিল। সাজিদ সিগারেট খায় না, তবে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তার ব্যাগে থাকে সব সময়।
লোকটা সিগারেট ধরালো। কয়েকটা জোরে জোরে টান টান দিয়ে ফুস করে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লো। ধোয়াগুলো মুহূর্তেই কুণ্ডলী আকারে স্টেশন মাস্টারের ঘরের রেলিং বেয়ে উঠে যেতে লাগল উপরের দিকে। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি।
লোকটার কাশি উঠে গেল। কাশতে কাশতে লোকটা বসা থেকে উঠে পরল। এই মুহূর্তে উনার সিগারেট খাওয়ার আর সম্ভবত ইচ্ছে নেই। লোকটা সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরোটিকে নিচে ফেলে পা দিয়ে একটি ঘষা দিল। অমনি সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরোটি থেতলে গেল।
সাজিদের দিকে ফিরে লোকটা বলল, -‘তাহলে এখন বিশ্বাস করিস যে স্রষ্টা বলে কেউ আছে?’
সাজিদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
-‘স্রষ্টা এই বিশ্বলোক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছে বলে বিশ্বাস করিস তো?’
আবার সাজিদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
এবার লোকটা এত অদ্ভুত ভয়ংকর রকম হাসি দিলো। এই হাসি এতটাই বিদঘুটে ছিল যে, আমার গা ছমছম করতে লাগল।
লোকটি বলল, -‘তাহলে বল দেখি স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করলো?’
এই প্রশ্নটি করে লোকটি আবার সেই বিদঘুটে হাসিটা হাসল। গা ছমছমে।
সাজিদ বলল, -‘স্যার বাই ডেফিনিশন, স্রষ্টার কোন সৃষ্টিকর্তা থাকতে পারে না। যদি বলি X-ই সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টি করেছে, তৎক্ষণাৎ আবার প্রশ্ন উঠবে তাহলে X এর সৃষ্টিকর্তা কে? যদি বলি Y, তাহলে আবার প্রশ্ন উঠবে, Y এর সৃষ্টি কর্তা কে?এভাবেই চলতে থাকবে। কোন সমাধানে যাওয়া যাবেনা।’
লোকটি বলল, -‘সমাধান আছে।’
-‘কি সেটা?’
-‘মেনে নেওয়া যে -স্রষ্টা নাই, বাস !’ এইটুকু বলে লোকটি আবার হাসি দিল। হা হা হা হা।
সাজিদ আপত্তি জানালো। বলল, ‘আপনি ভুল স্যার।’
লোকটি চোখ কপালে তুলে বললো, -‘কী? আমি ভুল? আমি?
-‘জি স্যার।’
-‘তাহলে বল দেখি, স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করলো? উত্তর দে। দেখি কত বড় জ্ঞানের জাহাজ হয়েছিস তুই।’
আমি বুঝতে পারলাম এই লোক সাজিদকে যুক্তির গেরাকলে ফেলার চেষ্টা করছে।
সাজিদ বলল, -‘স্যার গত শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এই মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে আছে। মানে এটার কোনো শুরু নেই। তারা আরও ভাবতো, এটার কোন শেষ নেই। তাই তারা বলত যেতো এটার শুরু শেষ কিছুই নাই। সুতরাং এটার জন্য একটা সৃষ্টিকর্তারও দরকার নাই।
কিন্তু থার্মোডাইনামিক্স এর তাপ ও গতির সূত্র গুলো আবিষ্কার হওয়ার পর এই ধারণা তো পুরোপুরিভাবে ব্যানিশ হয়ই, সাথে পদার্থ বিজ্ঞানেও ঘটে যায় এক বিপ্লব। থার্মোডাইনামিক্স এর তাপ ও গতির দ্বিতীয় সূত্র বলছে, ‘এই মহাবিশ্ব ক্রমাগত ও নিরবিচ্ছন্ন উত্তাপ অস্তিত্ব থেকে পর্যায়ক্রমে উত্তাপহীন অস্তিত্বের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সুত্রটাকে উল্টো থেকে প্রয়োগ কখনোই সম্ভব নয়। অর্থাৎ, কম উত্তাপ অস্তিত্ব থেকে এটাকে বেশি উত্তাপ অস্তিত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। এই ধারণা থেকে প্রমাণ হয় মহাবিশ্বও চিরন্তন নয়। এটা অনন্ত কাল ধরে এভাবে নেই। এটার একটা নির্দিষ্ট শুরু আছে। থার্মোডাইনামিক্স এর সূত্র আরো বলে, -এভাবে চলতে চলতে একসময় মহাবিশ্বের সকল শক্তির অবক্ষয় ঘটবে। আর মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে।
লোকটি বলল, -‘উফফফ ! আসছেন বৈজ্ঞানিক লম্পু। সহজ করে বল ব্যাটা।’
সাজিদ বলল, -‘স্যার একটা গরম কফির কাপ টেবিলে রাখা হলে, সেটা সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে তাপ হারাতে হারাতে ঠান্ডা হতেই থাকবে। কিন্তু সেটা টেবিলে রাখার পর যে পরিমাণ গরম ছিল, সময়ের সাথে সাথে সেটা আরো বেশি গরম হয়ে উঠবে-এটাও অসম্ভব। এটা কেবল ঠান্ডাই হতে থাকবে। একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা যাবে কাপটা সমস্ত তাপ হারিয়ে একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে থার্মোডাইনামিক্স এর সূত্র।’
-‘হুম, তো?’
-‘এর থেকে প্রমান হয়, মহাবিশ্বের একটা শুরু আছে। তারও প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টি তত্ত্বের উপর এ যাবৎ যতগুলো থিওরি বিজ্ঞানী মহলে এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, প্রমাণের দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী থিওরি হলো বিগ ব্যাং থিওরি। বিগ ব্যাং থিওরি বলছে, -মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে বিস্ফোরণের ফলে। তাহলে নিশ্চিত যে মহাবিশ্বের একটি শুরু আছে।’