এখন বাবা এসে যদি প্রথমজনকে তার অন্যায়ের জন্য কোন শাস্তি না দেয়, তাহলে সেটা তার দ্বিতীয় সন্তান, যে নিষ্পাপ তার প্রতি অন্যায় করা হবে না?’
-‘হু’ – দেবজিৎ দা বললেন।
-‘স্রষ্টা এরকম নন। এ জন্যই তিনি জান্নাত আর জাহান্নাম দুটোই তৈরি করে রেখেছেন। আমাদের কর্ম নির্ধারণ করে দেবে আমাদের গন্তব্যস্থল। এতে কোন দুই নাম্বারি হবে না, কারো সাথে চুল পরিমানও অন্যায় হবে না।
দেবজিৎ দা বললেন, -‘তা বুঝলাম। কিন্তু যেহেতু তিনি স্রষ্টা, আমাদের চেয়ে হাজারগুণ দয়ালু হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই তিনি আবার আমাদের কর্ম পরিচালনা করছেন। আবার তিনি আমাদের ধরে ধরে জাহান্নামে পাঠাচ্ছেন। ব্যাপারটা কেমন না সাজিদ?’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, প্রথমত স্রষ্টা আমাদের কর্ম পরিচালনা করেন না। স্রষ্টা আমাদের একটা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সাথে পাঠিয়েছেন একটা গাইডবুক। এখন এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা কি তার দেখানো পথে চলবো, কি চলব না। যদি চলি আমরা জান্নাতে যাব, যদি না চলি আমরা জাহান্নামে যাব। মোদ্দাকথা, আমরা কোথায় যাব তা আমরাই নির্ধারণ করি আমাদের কর্মের মাধ্যমে।’
দেবজিৎ দা হাসলেন। বললেন, -‘ও আচ্ছা। তার মানে কি বলতে চাচ্ছি যে কিছু লোক স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে জাহান্নাম চুস করে নিচ্ছে ?’
-‘হ্যাঁ’
-‘উদ্ভট না কথাটা?’
-‘একদম না।’
-‘লজিক্যালি বল।’
-‘আচ্ছা ধরো, তুমি গভীর সাগরে জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে গেলে। পানিতে তুমি হাসপাস করছ। একটু পরে অতল তলে তলিয়ে যাবে। এখন ধরো, তোমাকে উদ্ধার করার জন্য আমি একটি লাইফ জ্যাকেট তোমার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।’
-‘হু, তো?’
-‘সেই মুহুর্তে তোমার কাছে দুটি অপশন। হয় লাইফ জ্যাকেটটি নিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাবে, নয়তো আমাকে ডিনাই করবে আর অতল সাগরে তলিয়ে যাবে এবং মৃত্যুবরণ করবে।
খেয়াল করো, আমি কিন্তু বাঁচার উপকরণ অর্থাৎ লাইফ জ্যাকেট তোমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি। এখন তুমি তোমার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে জ্যাকেটটি গ্রহণ করে প্রাণে বাঁচবে নাকি ডিনাই করে মৃত্যুকে বরণ করবে সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার। স্রষ্টাও জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপকরণ আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। সাথে আমাদের ফ্রি উইল দিয়ে দিয়েছেন। এখানে আমরা তা আঁকড়ে ধরে বাঁচবো নাকি উপেক্ষা করে মরবো, তা আমাদের উপর নির্ভর করছে।’
দেবজিৎ দা কিছু বললেন না। স্রষ্টা দয়ালু হয়েও কেন জাহান্নাম তৈরি করেছেন তার উত্তর তিনি মনে হয় পেয়ে গেছেন। চায়ের বিদেশ বিল পরিশোধ করে এসে দেবজিৎ দা বললেন, -‘স্রষ্টা যেহেতু আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দয়ালু, তিনি কিন্তু চাইলেই পারেন ক্ষমা করে দিতে।’
সাজিদ বলল, -‘স্রষ্টা শুধু তোমার চেয়ে অনেক বেশি দয়ালুই নয়, তোমার চেয়ে অনেক বেশি ন্যায়বিচারকও। সুতরাং…..’
সাজিদকে আর কিছুতেই বলতে দিল না দেবজিৎ দা। মনমরা করে বললেন, -‘বুঝেছি।’
সাজিদ হাসলো। দেবজিৎ দা’র এই চাহনি দেখে আমাদেরও হাসি পেলো। আমরাও হাসলাম। আমাদের হাসতে দেখে তিনিও আমাদের সাথে হাসা শুরু করলেন। হা হা হা।
স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করলো?
ল্যাম্পপোস্টের অস্পষ্ট আলোয় একজন বয়স্ক লোকের ছায়ামূর্তি আমাদের দৃষ্টিগোচর হলো। গায়ে মোটা একটি শাল জড়ানো। পৌষের শীত। লোকটা হালকা কাঁপছেও। আমরা খুলনা থেকে ফিরছিলাম। আমি আর সাজিদ।
স্টেশন মাস্টার রুমের পাশে একটি বেঞ্চিতে লোকটা আঁটোসাঁটো হয়ে বসে আছে। স্টেশনে এরকম কত লোকই তো বসে থাকে। তাই সেদিকে আমার বিশেষ কোন কৌতূহল ছিল না। কিন্তু সাজিদকে দেখলাম সে দিকে এগিয়ে গেল।
লোকটার কাছে গিয়ে সাজিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল। আমি দূর থেকে খেয়াল করলাম লোকটার সাথে সাজিদ হেসে হেসে কথাও বলছে।
আশ্চর্য ! খুলনার স্টেশন। এখানে সাজিদের পরিচিত লোক কোথা থেকে এলো? তাছাড়া লোকটিকে দেখে বিশেষ কেউ বলেও মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোন বাদাম বিক্রেতা। বাদাম বিক্রি শেষে ফোটেনি ওই জায়গায় বসেই রাত কাটিয়ে দেয়। আমাদের রাতের ট্রেন। এখন বাজে রাত দু’টো। এই সময় সাজিদের সাথে কারো দেখা করার কথা থাকলে তা তো আমি জানতামই। অদ্ভুত !আমি আর একটু এগিয়ে গেলাম। একটু অগ্রসর হয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের হাতে একটি বইও আছে। দূর থেকে আমি বুঝতে পারিনি।
সাজিদ আমাকে ইশারা দিয়ে ডাকলো। আমি গেলাম। লোকটার চেহারা টা বেশ চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু সঠিক মনে করতে পারছিনা। সাজিদ বলল, -‘এইখানে বোস। ইনি হচ্ছেন হুমায়ুন স্যার।’
হুমায়ুন স্যার? এই নামে কোন হুমায়ূন স্যারকে আমি তো চিনি না। সাজিদকে জিজ্ঞেস করতে যাব যে কোন হুমায়ুন স্যার, অমনি সাজিদ আবার বলল, -‘হুমায়ূন আজাদকে চিনিস না? ইন ইয়ার্কিইনি আর কি।’
এরপর সে লোকটার দিকে ফিরে বলল, -‘স্যার, এ হল আমার বন্ধু আরিফ।’
লোকটা আমার দিকে তাকালো না। সাজিদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি। আমার তখনও ঘোর কাটছেই না। কি হচ্ছে এসব? আমিও ধপাস করে সাজিদের পাশে বসে পড়লাম।
সাজিদ আর হুমায়ুন আজাদ নামের লোকটার মধ্যে আলাপ হচ্ছে। এমন ভাবে কথা বলছে যেন, তারা পরস্পর পরস্পরকে অনেক আগে থেকেই চিনে।