স্যার কপালের ভাঁজ একটু দীর্ঘ করে বললেন, -’আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো বলেছো কে কে?’
অদ্ভুত প্রশ্ন। সবাই থতমত খেলো।
একটু আগেই বলেছি স্যার একটু অন্যরকম। প্রাইমারি লেভেলের টিচারদের মতো ক্লাশে এসে বিকট চিৎকার করে Good Morning বলেন, সবাই কেমন আছে জানতে চান। এখন’আলহামদুলিল্লাহ্’ বলার জন্য কি প্রাইমারি লেভেলের শিক্ষকদের মতো বেত দিয়ে পিটাবেন নাকি?
সাজিদের তখন তার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বাবুল চন্দ্র দাশের কথা মনে পড়ে গেলো। এই লোকটা ক্লাশে কেউ দুটোর বেশি হাঁচি দিলেই বেত দিয়ে আচ্ছামতন পিটাতেন। উনার কথা হলো-’হাঁচির সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে দু’টি। দু’টির বেশি হাঁচি দেওয়া মানে ইচ্ছে করেই বেয়াদবি করা।’
যাহোক, বাবুল চন্দ্রের পাঠ তো কবেই চুকেছে, এবার মফিজ চন্দ্রের হাতেই না গণ পিটুনি খাওয়া লাগে।
ক্লাশের সর্বমোট সাতজন দাঁড়ালো। এরা সবাই’আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো’ বলেছে। এরা হচ্ছে- রাকিব, আদনান, জুনায়েদ, সাকিব, মরিয়ম, রিতা এবং সাজিদ।
স্যার সবার চেহারাটা একটু ভালোমতো পরখ করে নিলেন। এরপর পিক করে হেসে দিয়ে বললেন, -’বসো।’
সবাই বসলো। আজকে আর মনে হয় এ্যাকাডেমিক পড়াশুনা হবেনা। দর্শনের তাত্বিক আলাপ হবে।
ঠিক তাই হলো। মফিজুর রহমান স্যার আদনানকে দাঁড় করালো। বললেন, -’তুমিও বলেছিলে সেটা, না?’
-’জ্বি স্যার।’- আদনান উত্তর দিলো।
স্যার বললেন, -’আলহামদুলিল্লাহ্’র অর্থ কি জানো?’
আদনান মনে হয় একটু ভয় পাচ্ছে। সে ঢোঁক গিলতে গিলতে বললো, -’জ্বি স্যার, আলহামদুলিল্লাহ্ অর্থ হলো- সকল প্রশংসা কেবলি আল্লাহর।’
স্যার বললেন, -’ সকল প্রশংসা কেবলি আল্লাহর।’
স্যার এই বাক্যটি দু’বার উচ্চারণ করলেন। এরপর আদনানের দিকে তাকিয়ে বললেন, -’বসো।’
আদনান বসলো। এবার স্যার রিতাকে দাঁড় করালেন। স্যার রিতার কাছে জিজ্ঞেস করলেন, -’আচ্ছা, পৃথিবীতে চুরি-ডাকাতি আছে?’
রিতা বললো, -’আছে।’
-’খুন-খারাবি, রাহাজানি, ধর্ষণ?’
–’জ্বি, আছে।’
-’কথা দিয়ে কথা না রাখা, মানুষকে ঠকানো, লোভ-লালসা এসব?’
-’জ্বি, আছে।’
-’এগুলো কি প্রশংসাযোগ্য?’
-’না।’
‘তাহলে মানুষ একটি ভালো কাজ করার পর তার সব প্রশংসা যদি আল্লাহর হয়, মানুষ যখন চুরি-ডাকাতি করে, লোক ঠকায়, খুন-খারাবি করে, ধর্ষণ করে, তখন সব মন্দের ক্রেডিট আল্লাহকে দেওয়া হয়না কেনো? উনি প্রশংসার ভাগ পাবেন, কিন্তু দূর্নামের ভাগ নিবেন না, তা কেমন হয়ে গেলো না?’
রিতা মাথা নিঁচু করে চুপ করে আছে। স্যার বললেন, -’এখানেই ধর্মের ভেল্কিবাজি। ইশ্বর সব ভালোটা বুঝেন, কিন্তু মন্দটা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আদতে, ইশ্বর বলে কেউ নেই। যদি থাকতো, তাহলে তিনি এরকম একচোখা হতেন না। বান্দার ভালো কাজের ক্রেডিটটা নিজে নিয়ে নিবেন, কিন্তু বান্দার মন্দ কাজের বেলায় বলবেন-’উহু, অইটা থেকে আমি পবিত্র। অইটা তোমার ভাগ।’
স্যারের কথা শুনে ক্লাশে যে ক’জন নাস্তিক আছে, তারা হাত তালি দেওয়া শুরু করলো। সাজিদের পাশে যে নাস্তিকটা বসেছে, সে তো বলেই বসলো, -’মফিজ স্যার হলেন আমাদের বাঙলার প্লেটো।’
স্যার বলেই যাচ্ছেন ধর্ম আর স্রষ্টার অসারতা নিয়ে।
–
এবার সাজিদ দাঁড়ালো। স্যারের কথার মাঝে সে বললো, -’স্যার, সৃষ্টিকর্তা একচোখা নন। তিনি মানুষের ভালো কাজের ক্রেডিট নেন না। তিনি ততোটুকুই নেন, যতোটুকু তিনি পাবেন। ইশ্বর আছেন।’
স্যার সাজিদের দিকে একটু ভালোমতো তাকালেন। বললেন, -’শিওর?’
-’জ্বি।’
-’তাহলে মানুষের মন্দ কাজের জন্য কে দায়ী?’
-’মানুষই দায়ী। – সাজিদ বললো।
-’ভালো কাজের জন্য?’
-’তাও মানুষ।’
স্যার এবার চিৎকার করে বললেন, -’এক্সাক্টলি, এটাই বলতে চাচ্ছি। ভালো/মন্দ এসব মানুষেরই কাজ। সো, এর সব ক্রেডিটই মানুষের। এখানে স্রষ্টার কোন হাত নেই। সো, তিনি এখান থেকে না প্রশংসা পেতে পারেন, না তিরস্কার। সোজা কথায়, স্রষ্টা বলতে কেউই নেই।’
ক্লাশে পিনপতন নিরবতা। সাজিদ বললো, -’মানুষের ভালো কাজের জন্য স্রষ্টা অবশ্যই প্রশংসা পাবেন, কারন, মানুষকে স্রষ্টা ভালো কাজ করার জন্য দুটি হাত দিয়েছেন, ভালো জিনিস দেখার জন্য দুটি চোখ দিয়েছেন, চিন্তা করার জন্য মস্তিষ্ক দিয়েছেন, দুটি পা দিয়েছেন। এসবকিছুই স্রষ্টার দান। তাই ভালো কাজের জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসা পাবেন।’
স্যার বললেন, -’এই গুলো দিয়ে তো মানুষ খারাপ কাজও করে, তখন?’
-’এর দায় স্রষ্টার নয়।’
-’হা হা হা হা। তুমি খুব মজার মানুষ দেখছি। হা হা হা হা।’
সাজিদ বললো, -’স্যার, স্রষ্টা মানুষকে একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। এটা দিয়ে সে নিজেই নিজের কাজ ঠিক করে নেয়। সে কি ভালো করবে, না মন্দ।’
স্যার তিরস্কারের সুরে বললেন, -’ধর্মীয় কিতাবাদির কথা বাদ দাও, ম্যান। কাম টু দ্য পয়েণ্ট এন্ড বি লজিক্যাল।’
সাজিদ বললো, -’স্যার, আমি কি উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারি ব্যাপারটা?’
-’অবশ্যই।’- স্যার বললেন।
সাজিদ বলতে শুরু করলো-
‘ধরুন, খুব গভীর সাগরে একটি জাহাজ ডুবে গেলো। ধরুন, সেটা বার্মুডা ট্রায়াঙ্গাল। এখন কোন ডুবুরিই সেখানে ডুব দিয়ে জাহাজের মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে পারছে না। বার্মুডা ট্রায়াঙ্গালে তো নয়ই। এই মূহুর্তে ধরুন সেখানে আপনার আবির্ভাব ঘটলো। আপনি সবাইকে বললেন, -’আমি এমন একটি যন্ত্র বানিয়ে দিতে পারি, যেটা গায়ে লাগিয়ে যেকোন মানুষ খুব সহজেই ডুবে যাওয়া জাহাজের মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে পারবে। ডুবুরির কোনরকম ক্ষতি হবে না।’