লোকটা আমার চেহারার অস্থিরতা ধরে ফেলেছে। মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করলো। আমি ভাবছি তো, ভাবছিই।
এর একটু পরে সাজিদ এলো। সে আসার পরে লোকটার সাথে তার প্রাথমিক আলাপ শেষ হলো। এর মাঝে লোকটা সাজিদকে বলে দিয়েছে যে, আমি প্রশ্নটার প্যাঁচে কিরকম নাকানী-চুবানী খেলাম, সেটা। সাজিদ আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ হেসে নিল।
এরপর সাজিদ তার খাটে বসলো। হাতে কি কাগজের ঠোঙার মধ্যে বুট ভাজা। বাইরে থেকে কিনে এনেছে। সে বুটের ঠোঙ্গাটা লোকটার দিকে ধরে বলল, -‘নিন, এখনও গরম আছে।’
লোকটা প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েও করল না। কেন করলো না কে জানে।
লোকটি সাজিদকে এবার তার প্রশ্ন সম্পর্কে বলল। প্রশ্নটি হল-
‘স্রষ্টা কি এমন কিছু বানাতে পারবে, যেটা স্রষ্টা নিজেই তুলতে পারবে না?’
এই বলে লোকটা এবার প্রশ্নটিকে ভেঙ্গে বুঝিয়ে দিল। বলল, -‘দেখ, এই প্রশ্নের উত্তরে যদি ‘হ্যাঁ’ বলো, তাহলে তুমি ধরে নিচ্ছ যে, স্রষ্টা জিনিসটি বানাতে পারলেও তুলতে পারবে না। কিন্তু আমরা জানি স্রষ্টা সর্বশক্তিমান। কিন্তু, যদি স্রষ্টা জিনিসটি তুলতে না পারে, তিনি কি আর সর্বশক্তিমান থাকেন? থাকেন না।
যদি এই প্রশ্নের উত্তরে তুমি ‘না’ বলো, তাহলে তুমি স্বীকার করছ যে, সেরকম কোন জিনিস স্রষ্টা বানাতে পারবেন না যেটা তিনি তুলতে পারবেন। এখানেও স্রষ্টার ‘সর্বশক্তিমান’ গুণটি প্রশ্নবিদ্ধ। এই অবস্থায় তোমার উত্তর কি হবে?’
সাজিদ লোকটির প্রশ্নটি মন দিয়ে শুনল। প্রশ্ন শুনে তার মধ্যে তেমন কোন ভাব লক্ষ্য করিনি। নর্মাল।
সে বলল, -‘দেখুন সজীব ভাই, আমরা কথা বলবো লজিক দিয়ে, বুঝতে পেরেছেন?’
এরমধ্যে সাজিদ লোকটির নামও জেনে গেছে। কিন্তু এই বৃদ্ধ লোকটিকে সে ‘আঙ্কেল’ কিংবা ঢাকা শহরের নতুন রীতি অনুযায়ী ‘মামা’ না ডেকে ‘ভাই’ কেন ডাকলো? বুঝলাম না।
লোকটি মাথা নাড়ালো। সাজিদ বলল, -‘যে মুহূর্তে আমার যুক্তির শর্ত ভাঙবো, ঠিক সেই মুহূর্তে যুক্তি আর যুক্তি থাকবে না। যেটা তখন হবে কু যুক্তি। ইংরেজিতে বলে Logical Fallacy সেটা তখন আত্মবিরোধের জন্ম দিবে, বুঝেছেন?’
-‘হ্যাঁ’-লোকটা বলল।
-‘আপনি প্রশ্ন করেছেন স্রষ্টার শক্তি নিয়ে। তার মানে, প্রাথমিকভাবে আপনি ধরে নিলেন যে, একজন স্রষ্টা আছেন, রাইট?’
-‘হ্যাঁ’
-‘এখন স্রষ্টার একটি অন্যতম গুন হলো- তিনি অসীম, ঠিক না?’
-‘হ্যাঁ, ঠিক।’
-‘এখন আপনি বলছেন, স্রষ্টা এমন কিছু বানাতে পারবে কিনা, যেটা স্রষ্টা তুলতে পারবে না। দেখুন, আপনি নিজেই বলেছেন, এমনকিছু আই মিন Something, রাইট?’
-‘হ্যাঁ’
-‘আপনি ‘এমনকিছু’ বলে আসলে জিনিসটার একটা আকৃতি, শেইপ, আকার বুঝিয়েছেন, তাই না? যখনই Something ব্যবহার করেছেন, তখন মনে মনে সেটার একটা শেইপ আমরা চিন্তা করি, করি না?’
-‘হ্যাঁ, করি।’
-‘আমরা তো এমন কিছুকেই শেইপ বা আকার দিতে পারি, যেটা আসলে সসীম, ঠিক?’
-‘হ্যাঁ, ঠিক।’
-‘তাহলে এবার আপনার প্রশ্নে ফিরে যান। আপনি ধরে নিলেন যে স্রষ্টা আছে। স্রষ্টা থাকলে তিনি অবশ্যই অসীম। এরপর আপনি তাকে এমন কিছু বানাতে বলছেন, যেটা সসীম। যেটার নির্দিষ্ট একটা মাত্রা আছে, আকার আছে, আয়তন আছে। ঠিক না?’
-‘হ্যাঁ’
-‘পরে শর্ত দিলেন, তিনি সেটা তুলতে পারবে না। দেখুন, আপনার প্রশ্নের লজিকটাই ঠিক নেই। একজন অসীম সত্ত্বা একটি সসীম জিনিস তুলতে পারবে না, এটা তো পুরোটাই লজিকের বাইরে প্রশ্ন। খুবই হাস্যকর না? আমি যদি বলি, উইসান বোল্ট কোনদিনও দৌড়ে ৩ মিটার অতিক্রম করতে পারবেনা। সেটা কি হাস্যকর ধরনের যুক্তি নয়?’
সজিব নামের লোকটা এবার কিছু বললেন না। চুপ করে আছেন।
সাজিদ উঠে দাঁড়ালো। এরমধ্যেই বুট ভাঁজা শেষ হয়ে গেছে। সে বইয়ের তাকে কিছু বই রেখে আবার এসে নিজের জায়গায় বসল। এরপর আবার বলতে শুরু করল-
‘এর প্রশ্নটি করে মূলত আপনি স্রষ্টার ‘সর্বশক্তিমান’ গুণটাকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করে প্রমাণ করতে চাইছেন যে, আসলে স্রষ্টা নেই।
আপনি ‘সর্বশক্তিমান’ টার্মটি দিয়ে বুঝাচ্ছেন, যে স্রষ্টা মানে এমন এক সত্ত্বা, যিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন, রাইট?’
লোকটি বলল, -‘হ্যাঁ, স্রষ্টা মানেই তো এমন কেউ, কেউ যিনি যখন ইচ্ছা, তাই করতে পারেন।’
সাজিদ মুচকি হাসলো। বললো, -‘আসলে সর্বশক্তিমান মানে এই না যে, তিনি যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। সর্বশক্তিমান মানে হল- তিনি নিয়মের মধ্যে থেকেই সবকিছু করতে পারেন। নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি কিছু করতে পারেন না। করতে পারেন না বলাটা ঠিক নয়, বলা উচিত তিনি করেন না। এর মানে এই না যে, তিনি সর্বশক্তিমান নন বা তিনি স্রষ্টা নন। এর মানে হল এই -কিছু জিনিস তিনি করেন না, এটাও কিন্তু তার স্রষ্টা হবার গুণাবলী। স্রষ্টা হচ্ছেন সকল নিয়মের নিয়ন্ত্রক। এখন তিনি নিজেই যদি নিয়মের বাইরের হন -ব্যাপারটি তখন ডাবলস্ট্যান্ড হয়ে যায়। স্রষ্টা এরকম নন। তার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তিনি সেই বৈশিষ্ট্যগুলো অতিক্রম করেন না। সেগুলো হলো তার মোরালিটি। এগুলো আছে বলেই তিনি স্রষ্টা, নাহলে তিনি স্রষ্টা থাকতেন না।
সাজিদের কথায় এবার আমি কিছুটা অবাক হলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম। -‘স্রষ্টা পারে না, এমন কি কাজ থাকতে পারে?’