ছুটির দিনে সারা দিন রুমে বসে থাকা ছাড়া আমার আর কোন কাজ থাকেনা। সপ্তাহের এই দিনটি অন্য সবার কাছে ঈদের মতো মনে হলেও আমার কাছে এই দিনটি খুবই বিরক্তিকর। ক্লাশ, ক্যাম্পাস, আড্ডা এসব স্তিমিত হয়ে যায়।
এই দিনটি আমি রুমে শুয়ে-বসে, ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলেও, সাজিদ এই দিনের পুরোটা সময় লাইব্রেরীতে কাটিয়ে দেয়। লাইব্রেরীতে ঘুরে ঘুরে নানান বিষয়ের উপর বই নিয়ে আসে।
আজ সকালেও সে বেরিয়ে গেছে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে। ফিরবে জুমার আগে। হাতে থাকবে একগাদা মোটা মোটা বই।
বাসায় আমি একা ভাবলাম একটু ঘুমাব। অনেক রাত পর্যন্ত বসে বসে অ্যাসাইনমেন্ট রেডি করেছি। চোখদুটো জবা ফুলের মতো টকটকে লাল হয়ে আছে। আমি হাই তুলতে তুলতে যেই ঘুমোতে যাবো, অমনি দরজার দিকে থেকে কেউ একজনের কাশির শব্দ কানে এলো।
ঘাড় ঘুরিয়ে সে দিকে তাকাতেই দেখলাম, একজন বড় বড় চোখ চশমার ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আগাগোড়া চোখ বুলিয়ে নিলাম। পরনে শার্ট-প্যান্ট, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। লোকটার চেহারায় সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ‘ফেলুদা’ চরিত্রের কিছুটা ভাব আছে। লোকটা আমার চোখাচোখি হতেই পিক করে হেসে দিল। এরপর বললো, -‘এটা কি সাজিদের বাসা?’
প্রশ্নটা আমার গায়ে লাগলো। সাজিদ কি বাইরের সবাইকে এটাকে নিজের একার বাসা বলে বেড়ায় নাকি? এই বাসার যা ভাড়া, তা সাজিদ আর আমি সমান ভাগ করে পরিশোধ করি। তাহলে চুক্তি মতে বাসাটা তো আমারও।
লোকটা যতটা উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করেছে, তার দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে আমি বললাম, -‘এটা সাজিদ আর আমার দু জনেরই বাসা।’
লোকটা আমার উত্তর শুনে আবারো পিক করে হেসে দিল। ততক্ষনে লোকটা ভিতরে চলে এসেছে।
সাজিদকে খুঁজতে এরকম প্র্যায়ই অনেকেই আসে। সাজিদ রাজনীতি না করলেও, নানারকম স্বেচ্ছাসেবী মূলক সংগঠনের সাথে যুক্ত আছে।
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, -‘সাজিদ মনে হয় ঘরে নেই, না?’
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, -‘জি না। বই আনতে গেছে। অপেক্ষা করুন, চলে আসবে।’
লোকটাকে সাজিদের চেয়ারটা টেনে বসতে দিলাম। তিনি বললেন, -‘তোমার নাম?’
-‘আরিফ।’
-‘কোথায় পড়ো?’
-‘ঢাবি তে।’
-‘কোন ডিপার্টমেন্ট?’
-‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’
লোকটা খুব করে আমার প্রশংসা করলো। এরপর বলল, -‘আমি প্রথম ভেবেছিলাম তুমিই সাজিদ।’
লোকটার কথা শুনে আমার ছ নম্বার হাঁইটা মুহূর্তেই মুখ থেকে গায়েব হয়ে গেল। ব্যাপারটা কি? এই লোক কি সাজিদ কে চিনে না?
আমি বললাম, -‘আপনি সাজিদের পরিচিত নন?’
-‘না।’
-‘তাহলে?’
লোকটা একটু ইতঃস্তত বোধ করলো মনে হচ্ছে। এরপর বলল, -‘আসলে আমি একটি প্রশ্ন নিয়ে এসেছি সাজিদের কাছে। প্রশ্নটি আমাকে করেছিল একজন নাস্তিক। আমি আসলে কারো কাছে এটার কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাইনি, তাই।’
আমি মনে মনে বললাম, -‘বাবা সাজিদ, তুমি তো দেখি এখন সক্রেটিস বনে গেছো।
পাবলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তোমার দ্বারস্থ হয়।’
লোকটার চেহারায় একটি গম্ভীর ভাব আছে। দেখলেই মনে হয় এই লোক অনেক কিছু জানে, বোঝে। কিন্তু কি এমন প্রশ্ন, যেটার জন্য কোন ফেয়ার এন্সার উনি পাচ্ছেন না?
কৌতুহল বাড়লো।
আমি মুখে এমন একটি ভাব আনলাম, যেন আমিও সাজিদের চেয়ে কোনো অংশে কম নযই। বরং তার চেয়ে কয়েক কাঠি সরেশ। এরপর বললাম, -‘আচ্ছা, কি সেই প্রশ্ন?’
লোকটা আমার অভিনয়ে বিভ্রান্ত হলো। হয়তো ভাবলো, আমি সত্যিই ভালো কোন উত্তর দিতে পারবো।
বললো, -‘খুবই ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন। স্রষ্টা সম্পর্কিত।’
আমি মনে মনে তখনি প্রায় লেজেগোবরে অবস্থা। কিন্তু মুখে বললাম, -‘প্রশ্ন যে খুবই ক্রিটিক্যাল, সেটা তো বুঝেছি। নইলে ঢাকা শহরে এই জ্যাম-ট্যাম মাড়িয়ে কেউ এত কষ্ট করে এখানে আসে?’
আমার কথায় লোকটা আবারো বিভ্রান্ত হল এবং আমাকে ভরসা করলো। এরপর আমাকে বলল, -‘আগেই বলে নিই, প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ/না’ হতে হবে।’
-‘আপনি আগে প্রশ্ন করুন, তারপর উত্তর কি হবে দেখা যাবে’ -আমি বললাম।
-‘প্রশ্নটা হচ্ছে- স্রষ্টা কী এমন কোন কিছু বানাতে পারবে, যেটা স্রষ্টা উঠাতে পারবে না?’
আমি বললাম, -‘আরে, এ তো খুবই সহজ প্রশ্ন। হ্যাঁ বলে দিলেই তো হয়। ল্যাটা চুকে যায়।’
লোকটা হাসল। মনে হল, আমার সম্পর্কে ওনার ধারনা পাল্টে গেছে। এই মুহূর্তে উনি আমাকে গবেট, মাথামোটা টাইপ কিছু ভাবছেন হয়তো।
আমি বললাম, -‘হাসলেন কেন? ভুল বলেছি?’
লোকটা কিছু না বলে আবার হাসল। এবার লোকটা হাসি দেখে আমি নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। প্রশ্নটা আবার মনে করতে লাগলাম।
স্রষ্টা কি এমন কোনো কিছু বানাতে পারবে, যেটা স্রষ্টা উঠাতে পারবে না।
আবার চিন্তা করতে লাগলাম। উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে ধরে নিচ্ছি যে, জিনিসটা বানাতে পারলেও সেটা তুলতে পারবে না। আরে এটা কিভাবে সম্ভব? স্রষ্টা পারেনা এমন কোন কাজ আছে নাকি আবার? আর, একটা জিনিস উঠানো কি এমন কঠিন কাজ যে স্রষ্টা সেটা পারবে না?
আবার চিন্তা করতে লাগলাম। উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে ধরে নিচ্ছি যে- স্রষ্টা জিনিসটা উঠাতে পারলেও বানাতে পারবে না।
ও আল্লাহ ! কি বিপদ ! স্রষ্টা বানাতে পারবে না এটা কিভাবে সম্ভব? হ্যাঁ বললেও আটকে যাচ্ছি, না বললেও আটকে যাচ্ছি।