গলদ নাম্বার – ২
হকিং তার বইতে বলেছেন, মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে একদম শূন্য থেকে, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে। তখন ‘সময়’ (Time) এর আচরন আজকের সময়ের মতো ছিল না। তখন সময়ের আচরন ছিল ‘স্থান’ (Space) এর মতো। কারন, এই ফ্ল্যাকচুয়েশন হবার জন্য প্রাথমিকভাবে সময়ের দরকার ছিল না, স্থানের দরকার ছিল। কিন্তু হকিং তার বইতে এই কথা বলেন নি যে, যে সময় মহাবিশ্বের একদম শুরুতে ‘স্থান’ এর মতো আচরন করেছে, সেই ‘সময়’ পরবর্তীতে ঠিক কবে আর কখন থেকে আবার Time এর মতো আচরন শুরু করলো এবং কেন?’
আমি বিপ্লব দা’র মুখের দিকে তাকালাম। তার চেহারার উৎফুল্ল ভাবটা চলে গেছে।
সাজিদ বলে যাচ্ছে,
‘গলদ নাম্বার – ৩
পদার্থ বিদ্যার যে সুত্র মেনে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন হয়ে মহাবিশ্ব তৈরি হল, তখন শূন্যবস্থায় পদার্থবিদ্যার এই সুত্রগুলো বলবত থাকে কি করে? এটার ব্যাখ্যা হকিং দেয় নি।
গলদ নাম্বার – ৪
আপনি বলেছেন, প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই, শূন্যস্থান পুরন করতে আপনা আপনি কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন হয়ে মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে। আমার প্রশ্ন হল – যেখানে আপনি শূন্যস্থান নিয়ে কথা বলছেন, যখন সময় ছিল না, স্থান ছিল না, তখন আপনি প্রকৃতি কোথায় পেলেন?’
সাজিদ হকিংয়ের বইয়ের পাচ নাম্বার গলদের কথা বলতে যাচ্ছিলো। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিপ্লব দা বললেন, ‘ওকে ওকে। বুঝলাম। আমি বলছি না যে এই জিনিসটা একেবারে সত্যি। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবে। আলোচনা-সমালোচনা হবে। আরো পরিক্ষা নিরিক্ষা হবে। তারপর ডিসাইড হবে যে এটা ঠিক না ভুল।’
সাজিদের কাছে বিপ্লব দা’র এরকম মৌন পরাজয় আমাকে খুব তৃপ্তি দিল। মনে মনে বললাম, ‘ইয়েস সাজিদ, ইউ ক্যান।’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ, সে পরিক্ষা চলতে থাকুক। যদি কোন দিন এই থিওরি সত্যিও হয়ে যায়, তাহলে আমাকে ডাক দিয়েন না দাদা। কারন, আমি কোরআন দিয়েই প্রমান করে দিতে পারব।’
সাজিদের এ কথা শুনে আমার হেঁচকি উঠে গেল। কি বলে রে? এতক্ষন যেটাকে গলদপূর্ণ বলেছে, সেটাকে আবার কোরআন দিয়ে প্রমান করবে বলছে? ক্যামনে কি?
বিপ্লব দা’ও বুঝলোনা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রকম?’
সাজিদ হাসল। বলল, -‘শূন্য থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টির কথা আল কোরআনে বলা আছে দাদা।’
আমি আরো অবাক। কি বলে এই ছেলে?
সে বলল, ‘আমি বলছি না যে কোরআন কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের কথাই বলছে। কোরআন যার কাছ থেকে এসেছে, তিনি তার সৃষ্টি জগতের সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখন সেটা বিগ ব্যাং আসলেও পাল্টাবে না, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন থিওরি আসলেও পাল্টাবে না। একই থাকবে।’
বিপ্লব দা বলল, ‘কোরআনে কি আছে বললে যেন?’
-‘সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতে আছে –
“যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনায়ন করেন (এখানে মূল শব্দ ‘বাদ্যিয়ূ’ Originator- সেখান থেকেই অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের ধারণা) এবং যখন তিনি কিছু করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন তখন শুধু বলেন হও, আর তা হয়ে যায়। ”
‘Creator of heavens and earth from nothingness, He has only to say when he is wills a thing, “Be” and it is’…
দেখুন আমি আবার বলছি, আমি এটা বলছি না যে, আল্লাহ তায়ালা এখানে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের কথাই বলছেন। তিনি তার সৃষ্টির কথা বলেছেন। তিনি ‘অনস্তিত্ব’ (Nothing) থেকে ‘অস্তিত্বে’ (something) এ এনেছেন। এমন না যে, আল্লাহ তার হাত দিয়ে প্রথম মহাবিশ্বের ছাদ বানালেন। তারপর তাতে সূর্য, চাঁদ, গ্যালাক্সি এগুলো একটা একটা বসিয়ে দিয়েছেন। তিনি কেবল নির্দেশ দিয়েছেন।
হকিংও একই কথা বলেছে। কিন্তু তারা বলছে বলছে, এটা এমনি এমনি হয়ে গেছে, শূন্য থেকেই। আল্লাহ বলছেন, নাহ এমনি হয় নি। আমি যখন নির্দেশ করেছি ‘হও’ (কুন), তখন তা হয়ে গেল।
হকিং ব্যাখ্যা দিতে পারছে না এই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের জন্য মহাকর্ষ বল কোথা থেকে এল, ‘সময়’ কেন, কিভাবে ‘স্থান’ হল, পরে আবার সেটা ‘সময়’ হল।
কিন্তু আমাদের স্রষ্টা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘হতে’ আর তা হয়ে গেল।
ধরুন, একটা ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ম্যাজিশিয়ান বসে আছে স্টেজের এক কোনায়। কিন্তু সে তার চোখের ইশারায় ম্যাজিক দেখাচ্ছে। দর্শক দেখছে, খালি টেবিলের উপর হঠাত একটা কবতর তৈরি হয়ে গেল, এবং সেটা উড়েও গেল।
দর্শক কি বলবে এটা কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে হয়ে গেছে? না, বলবে না। এর পিছনে ম্যাজিশিয়ানের কারসাজি আছে। সে স্টেজের এক কোনা থেকে চোখ দিয়ে ইশারা করেছে বলেই এটা হয়েছে।
স্রষ্টাও সেরকম। তিনি শুধু বলেছেন, ‘হও’, আর মহাবিশ্ব আপনা আপনি হয়ে গেলো। ….
আপনাদের সেই শূন্যস্থান থেকে স্রষ্টার দূরত্ব কেবল ওই ‘হও’ পর্যন্তই।’
মাগরিবের আজান পড়তে শুরু করেছে। বিপ্লব দা’কে অনেকটাই হতাশ দেখলাম।
আমরা বললাম, ‘আজ তাহলে উঠি।’
উনি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এসো।’
আমরা বেরিয়ে পরলাম। আমি অবাক হয়ে সাজিদের দিকে তাকিয়ে আছি। কে বলবে এই ছেলেটা গত ছ’মাস আগেও নাস্তিক ছিল। নিজের গুরুকেই কিরকম কুপোকাত করে দিয়ে আসলো। কোরআনের সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতটি কত হাজার বার পড়েছি, কিন্তু এভাবে কোনদিন ভাবিনি। আজকে এটা সাজিদ যখন বিপ্লব দা কে বুঝাচ্ছে, মনে হচ্ছে আজকেই নতুন শুনছি এই আয়াতের কথা। গর্ব হতে লাগলো আমার।
স্রষ্টা কি এমন কিছু বানাতে পারবে যেটা স্রষ্টা নিজে তুলতে পারবে না
স্রষ্টা কি এমন কিছু বানাতে পারবে যেটা স্রষ্টা নিজে তুলতে পারবে না