তোমরা জান কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ধারনা কোথা হতে এসেছে?’
আমি বললাম, ‘না।’
বিপ্লব দা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এই ধারণা এসেছে হাইজেনবার্গের বিখ্যাত ‘অনিশ্চয়তা নীতি’ থেকে। হাইজেনবার্গের সেই বিখ্যাত সূত্রটা তোমরা জানো নিশ্চয়ই?’ সাজিদ বলল, ‘হ্যাঁ, হাইজেনবার্গ বলেছেন, আমরা কখনও একটি কনার অবস্থান এবং এর ভরবেগের সঠিক পরিমান একসাথে একুরেইটলি জানতে পারব না। যদি অবস্থান সঠিকভাবে জানতে পারি, তাহলে এর ভরবেগের মধ্যে গলদ থাকবে। আবার যদি ভরবেগ সঠিকভাবে জানতে পারি, তাহলে এর অবস্থানের মধ্যে গলদ থাকবে। দুটো একসাথেই সঠিকভাবে জানা কখনই সম্ভব না। এইটা যে সম্ভব না, এটা বিজ্ঞানের অসারতা না, আসলে এটা হল কনার ধর্ম বাঁ বৈশিষ্ট্য।’
বিপ্লব দা বললেন, ‘এক্সাক্টলি। একদম তাই। হাইজেনবার্গের এই নীতিকে শক্তি আর সময়ের ক্ষেত্রে ব্যাবহার করা যায়। হাইজেনবার্গের এই নীতি যদি সত্যি হয়, তাহলে মহাবিশ্বে ‘শূন্যস্থান’ বলে কিছু থাকতে পারেনা। যদি থাকে, তাহলে তার অবস্থান ও ভরবেগ দুটোই শূন্য চলে আসে, যা হাইজেনবার্গের নীতি বিরুদ্ধ।’
এইটুকু বলে বিপ্লব দা একটু থামল। কফির পট থেকে কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘বুঝতেছ তোমরা?’
সাজিদ বুঝেছে কিনা জানিনা, তবে আমার কাছে ব্যাপারটি দুর্বোধ্য মনে হলেও, বিপ্লব দা’র উপস্থাপন ভঙ্গিমা সেটাকে অনেকটাই প্রাঞ্জল করে তুলেছে। ভালো লাগছে।
বিপ্লব দা কফিতে চুমুক দিলেন। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘তাহলে তোমারা বলো না, যে বিগ ব্যাং এর আগে তো কিছুই ছিল না। না সময়, না শক্তি, না অন্যকিছু। তাহলে বিগ ব্যাং এর বিস্ফোরণটি হল কিভাবে? এর জন্য নিশ্চয়ই কোন শক্তি দরকার? কোন বাহ্যিক বল দরকার, তাই না? এটাই বলে তোমরা স্রষ্টার ধারণাকে জায়েজ করতে। তোমরা বলতে, এই বাহ্যিক বলটি এসেছে স্রষ্টার কাছ থেকে। কিন্তু দেখ, বিজ্ঞান বলছে, এইখানে স্রষ্টার কোন হাত নেই। বিগ ব্যাং হবার জন্য যে শক্তি দরকার ছিল, সেটা এসেছে এই কোয়ান্টাম ফ্লায়েকচুয়েশন থেকে। সুতরাং, মহাবিশ্ব তৈরিতে স্রষ্টার অস্তিত্বকে বিজ্ঞান ডাইরেক্ট না বলে দিয়েছে। আর, তোমরা এখন স্রষ্টা স্রষ্টা করে কোথায় যে পরে আছ।’
এতটুকু বলে বিপ্লব দা’র চোখ মুখ ঝলমলিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে, উনি যে উদ্দেশ্যে আমাদেরকে এখানে ডেকেছেন তা সফল হয়ে গেছে। আমরা হয়তো উনার বিজ্ঞানের উপর এই জ্ঞান গর্ভ লেকচার শুনে এক্ষুনি নাস্তিকতার উপর ঈমান নিয়ে আসব।
যাহোক, ইতিমধ্যে সাজিদ দু কাপ কফি গিলে ফেলেছে। নতুন এক কাপ ঢালতে ঢালতে বলল, ‘এই ব্যাপারে স্টিফেন হকিংয়ের বই আছে। নাম -‘The grand design’। এটা আমি পরেছি।’
সাজিদের কথা শুনে বিপ্লব দা’কে খুব খুশি মনে হল। তিনি বললেন, ‘বাহ, তুমি তাহলে পড়াশুনা স্টপ করনি? বেশ বেশ। পড়াশুনা করবে। বেশি বেশি পড়বে।’
সাজিদ হাসল। হেসে সে বলল, ‘কিন্তু দাদা, এই ব্যাপারে আমার কনফিউশান আছে।’
-‘কোন ব্যাপারে?’
-‘ষ্টিফেন হকিং আর লিওনার্ড ম্লোদিনোর বই The grand design এর ব্যাপারে।’
বিপ্লব দা একটু থতমত খেলো বলে মনে হল। মনে হয় উনি মনে মনে বলছে – এই ছেলে দেখি খোদার উপর খোদাগিরি করছে।
তিনি বলল, -‘ক্লিয়ার করো।’
সাজিদ বলল, -‘আমি দুইটা দিক থেকেই এটার ব্যাখ্যা করবো। বিজ্ঞান এবং ধর্ম।
যদি অনুমতি দেন।’
-‘অবশ্যই।’ বিপ্লব দা বললেন।
আমি মুগ্ধ শ্রোতা। গুরু এবং এক্স-শিষ্যের তর্ক জমে উঠেছে।
সাজিদ বলল, ‘প্রথমে কথা হচ্ছে, ষ্টিফেন হকিং এর এই থিওরিটা এখনো ‘থিওরি’, সেটা ফ্যাক্ট নয়। এই ব্যাপারে প্রথম কথা বলেন বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস। তিনি এইটা নিয়ে বিশাল সাইজের বই লিখেছেন। বইটার নাম ছিল ‘A universe from nothing’
অনেক পরে, এখন ষ্টিফেন এটা নিয়ে উনার The grand design এ কথা বলেছেন। উনার এই বইটি প্রকাশ হবার পর সি এন এনের এক সাংবাদিক হকিংকে জিজ্ঞেস করেছিলো, -‘আপনি কি ইসসরে বিশ্বাস করেন?’
হকিং বলেছিল, -‘ঈশ্বর থাকলেও থাকতে পারে, তবে, মহাবিশ্ব তৈরিতে তার প্রয়োজন নেই।’
বিপ্লব দা বলল, ‘সেটাই, উনি বুঝালেন যে, ঈশ্বর মূলত ধার্মিকদের একটি অকার্যকর বিশ্বাস।’
-‘হকিং কি বুঝিয়েছেন জানি না, কিন্তু হকিংয়ের ওই বইটি অসম্পূর্ণ। কিছু গলদ আছে।’
বিপ্লব দা কফির কাপটি রাখতে রাখতে বললেন, ‘গলদ? মানে?’
– ‘দাঁড়ান, বলছি। গলদ মানে, উনি কিছু বিষয় বইতে ক্লিয়ার করেন নি। যেহেতু এটা বিজ্ঞান মহলে প্রমানিত সত্য নয়, তাই এটা বিজ্ঞান মহলে প্রচুর বিতর্কিত হয়েছে।
উনার বইতে যে গলদগুলো আছে তা সিরিয়ালি বলছি।
গলদ নাম্বার ১ –
হকিং বলছেন, শূন্য থেকেই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে বস্তু কনা তৈরি হয়েছে, এবং সেটা মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে নিউট্রালাইজ হয়েছে।
এখানে প্রশ্ন হল, শূন্য বলতে হকিং কি একদম Nothing (কোন কিছুই নেই) বুঝিয়েছেন, নাকি Quantum vaccum (বস্তুর অনুপস্থিতি) বুঝিয়েছেন সেটা ক্লিয়ার করেন নি। হকিং বলেছেন, শূন্যস্থানের বস্তু কনার মাঝে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন হতে হলে সেখানে মহাকর্ষ বল প্রয়োজন। কিন্তু ওই শূন্যস্থানে (যখন সময় আর স্থানও তৈরি হয় নি) ঠিক কোথা থেকে এবং কিভাবে মহাকর্ষ বল এলো, তার কোন ব্যাখ্যা হকিং দেয় নি।