অথচ, সে ভাবে ভাবলে, নেই দুই আয়াত এরকম কথা বলা হচ্ছে। একবার মেরে ফেলতে বলছে, একবার বলছে, মারলে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করার মত চরম পাপ হবে। কিন্তু নাস্তিকরা এই দুটোকে এক পাল্লায় এনে কথা বলেনা। কেন বলেনা, কারন তারাও জানে দুটো আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই দুটোকে এক করে বলতে গেলেই নাস্তিকরা ধরা পড়বে তাই বলে না। নিলু দা সব শুনে বললেন, -‘এর জন্যই বুঝি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে এসেছিলি?’
-না দাদা, শুধু ডাবল স্ট্যান্ডবাজিটা উপলব্ধি করতে এসেছি। হা হা হা।’
নেহাত ভালো সম্পর্ক বলেই নীলুদা সেদিন রাগ করেন নি হয়তো।
ভেলকিবাজির সাতকাহন
আমাদের আড্ডাটির কথাটা তো আগেই বলেছি। সাপ্তাহিক আড্ডা। শিক্ষামূলক বটে। একেক সপ্তাহে একেক টপিকের উপর আলোচনা চলে।
আমি আর সাজিদ মাগরিবের নামাজ পড়ে এগুচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য-আড্ডাস্থল। আজ আড্ডা হচ্ছে সেন্ট্রাল মসজিদের পেছনে। ওই দিকটা একটা মাঝারি সাইজের বটগাছ আছে। বটতলাতেই আজ আসর বসার কথা।
খানিকটা দূর থেকে দেখলাম আড্ডাস্থলে বেশ অনেক জনের উপস্থিতি। কেউ একজন যেন দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে।
তাকে দেখে শামসুর রহমানের কবিতার দুটি লাইন মনে পড়ে গেল-
‘স্বাধীনতা তুমি-
বট ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ ’
আড্ডাস্থলে পৌঁছে দেখি হুলস্থুল কান্ড। আলোচনা তখন আর আলোচনায় নেই, বাড়াবাড়িতে রূপ লাভ করেছে।
দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে যে কথা বলছিল, সে হলো রূপম। ঢাবির ফিলোসফির স্টুডেন্ট। অ্যাথেইজমে বিশ্বাসী। তাঁর মতে, ধর্ম কিছু রুপকথার গল্প বৈ কিছু নয়। সে তর্ক করছিলো হাসনাতের সাথে। হাসনাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্থ্রোলজিতে পড়ে।
রুপমের দাবি- একমাত্র নাস্তিকতাই স্বচ্ছ, সৎ আর বিজ্ঞানভিত্তিক কথা বলে। কোন প্যাচ গোচ নেই, কোনো দুই নম্বরি নেই, কেন ফ্রডফিরি নেই। যা বাস্তব, যা বিজ্ঞান সমর্থন করে- তাই নাস্তিকতা।
মোদ্দাকথা, নাস্তিকতা মানে প্রমাণিত সত্য আর স্বচ্ছতার দিশা।
হাসনাতের দাবি- ধর্ম হলো বিশ্বাসের ব্যাপার। আর বিশ্বাসের ব্যাপার বলেই যে একে একেবারে রূপকথা বলে চালিয়ে দিতে হবে, তা কেন?
ধর্ম ধর্মের জায়গায়, বিজ্ঞান বিজ্ঞানের জায়গায়। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সামঞ্জস্যতা দেখাতে গিয়ে যে আলবার্ট আইনস্টাইন সহ বড় বড় কিছু বিজ্ঞানী আর দার্শনিকদের মন্তব্য কোট করতে লাগলো।
আমি গিয়ে সাকিবের পাশে বসলাম। তার হাতে বাদাম ছিল। একটি বাদাম ছিলে মুখে দিলাম।
সাজিদ বসলো না।
সে রুপমের পাশে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। বলল, -‘এতো উত্তেজনার কি আছে রে?’
-‘উত্তেজনা হবে কেন?’ -রুপম বলল।
-‘তোকে দেখেই মনে হচ্ছে, অনেক রেগে আসিস। এনিথিং রং?’
হাসনাত বলে উঠল, -‘উনি নাস্তিকতাকে ডিফেন্ড করতে এসেছেন। উনার নাস্তিকতা কত সাধু লেভেলের, তা প্রমাণ করার জন্যই ভাষণ দেওয়া শুরু করেছেন।’
সাজিদ হাসনাতকে ধমক দেওয়া সুরে বলল, -‘তুই চুপ কর ব্যাটা। তোর কাছে জানতে চেয়েছে আমি?’
হাসনাতকে সাজিদের এইভাবে ঝারি দিতে দেখে আমি পুরো হাঁ করে রইলাম। হাসমত সাজিদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের একজন। আর এই রুপমের সাথে সাজিদের পরিচয় ক’দিনের? মনে হয় এক বছর হবে। রূপমের জন্যে তার এতো দরদ কিসের? মাঝে মাঝে সাজিদের এসব ব্যাপার আমার এত বিদঘুটে লাগে যে, ইচ্ছে করে তার কানের নিচে দু চারটা লাগিয়ে দিই।
সাজিদের ধমক খেয়ে বেচারা হাসনাতের মনটা খারাপ হয়ে গেল। হবারই তো কথা।
সাজিদ আবার রুপমকে বলল, -‘বল কি হয়েছে?’
-‘আমি বলতে চাইছি, ধর্ম হলো গোঁজামিলপূর্ণ একটা জিনিস। সেই তুলনায় নাস্তিকতাই স্বচ্ছ, সত্য আর বাস্তবতাপূর্ণ। কোন দুই নাম্বারি তাতে নেই।
সাজিদ বলল, ‘তাই?’
-‘হুম, Any Doubt?’
সাজিদ হাসলো। হাসতে হাসতে সে এসে মিজবাহ’র পাশে বসলো। রুপম বসলো আমার পাশে। বটগাছের নিচের এই জায়গাটা গোলাকার করে বানানো হয়েছে। সাজিদ আর রুপম এখন মুখোমুখি বসা।
সাজিদ বলল, -‘বন্ধু, তুই যতটা স্বচ্ছ, সত্য আর সততার সার্টিফিকেট তোর বিশ্বাসকে দিচ্ছিস, সেটা এতটা স্বচ্ছ, সত্য আর সৎ মোটেও নয়।
রুপম বলল, -‘মানে? কি বলতে চাস তুই? নাস্তিকরা ভুয়া ব্যাপারে বিশ্বাস করে? দুই নাম্বারি করে?’
-‘হুম। করে তো বটেই। এটাকে জোর করে বিশ্বাসও করায়।’
-‘মানে?’
সাজিদ নড়েচড়ে বসলো। বললো, -‘খুলে বলছি।’
এরপরে সাজিদ বলতে শুরু করল-
‘বিজ্ঞানীরা যখন DNA আবিষ্কার করল, তখন দেখা গেল আমাদের শরীরের প্রায় ৯৬-৯৮% DNA হল নন কোডিং। অর্থাৎ, এরা প্রোটিনে কোন প্রকার তথ্য সরবরাহ করে না। ২-৪% DNA ছাড়া বাকি সব DNA-ই নন কোডিং। এগুলোর তখন নাম দেয়া হলো- Junk DNA। Junk শব্দের মানে তো জানিস, তাই না? Junk শব্দের অর্থ হলো ‘আবর্জনা’। অর্থাৎ, এই 98% DNA-র কাজ কোন কাজ নেই বলে এগুলোকে ‘বাতুল DNA’ বা ‘Junk DNA’ বলা হল।
ব্যস, এটা আবিষ্কারের পরে বিবর্তনবাদী নাস্তিকরা তো খুশি তে লম্ফঝম্ফ শুরু করে দিলো। তারা ফলাও করে প্রচার করতে লাগল যে, আমাদের শরীরের যে ৯৮% DNA আছে সেগুলো হলো, Junk, অর্থাৎ, এদের কোন কাজ নেই। এই ৯৮% DNA ডারউইনের বিবর্তনবাদের পক্ষে অনেক বড় প্রমান। তারা বলতে লাগলো- মিউটেশনের মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতিতে রূপান্তরিত হবার সময় এই বিশাল সংখ্যক DNA আমাদের শরীরে রয়ে গেছে।