সপ্তাহের প্রতি রোববারে আমরা এখানে আড্ডা দেই। আড্ডা না বলে এটাকে পাঠচক্র বলাই যুতসই। সপ্তাহান্তে এখানে এসে আমরা পুরো এক সপ্তাহে কে কি পড়েছি, পড়ে কি বুঝেছি, কি বুঝিনি এসব আলোচনা করি। ভারি ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয় ‘বুক রিভিউ’ আরকি।
আজকের আলোচক দু’জন। শাহরিয়ার আর সাজিদ। শাহরিয়ার আলোচনা করবে প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ এর উপর, আর সাজিদ আলোচনা করবে ‘আল কুরানের’ উপর। দু’জনই তুখোড় আলোচক। ‘রিপাবলিক’ নিয়ে শাহরিয়ারের আলোচনা বেশ জম্পেশ ছিল। রিপাবলিকে প্লেটো নীতি নৈতিকতা, মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, রাষ্ট্রের গঠন, উপাদান, পরিবার, নারী-পুরুষের মনস্তত্ব, সমাজে নারী-পুরুষের মূল্যায়ন ইত্যাদির উপর যে সবিস্তর আলোচনা করেছিলেন, শাহরিয়ার খুবই চমৎকার ভাবে তার সারসংক্ষেপ আমাদের সামনে তুলে ধরলো। মনে হচ্ছিল প্লেটোই যেন আমাদের সামনে আঙুল উঁচিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোন জিনিসটার কি ব্যাখ্যা, কি কাজ, কি ধর্ম।
শাহরিয়ারের আলোচনা শেষ হলে সাজিদ তার আলোচনা শুরু করে। সেও আল কুরআন নাযিল হবার কারণ, এতে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার, নারী-পুরুষ এবং এতদসংক্রান্ত যে বিষয়গুলো আছে তার একটি চমৎকার সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরল। আলোচনা শেষ করার আগে সাজিদ এই বলে শেষ করল যে, আল কোরআন নাজিল হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য। এটি যে শুধু মুসলিমদের জন্য, তা নয়। আমাদের সুশীলিয় পরিভাষায় যেটাকে অসাম্প্রদায়িক বলে আর কি।
এতটুকু বলে সাজিদ থেমে গেল।
দুজনের আলোচনায় বেশ প্রফুল্ল ছিল। কিন্তু গন্ডগোল পাকালো রুপম। সাজিদ আল কুরানকে অসাম্প্রদায়িক কিতাব বলছে, এটা সে মেনে নিতে পারেনি।
বলে নিই রুপম সাজিদের ক্লাসমেট। তাই দুজনের মধ্যকার সম্পর্কটি আমি-তুমি বা আমি-আপনি নয়, তুই-তুকারির সম্পর্ক।
রুপম খুবই অবজ্ঞার সুরে সাজিদকে উদ্দেশ্য করে বলল, -‘কোরআন অসম্প্রদায়িক, এইটাও আমাকে শুনতে হলো, হা হা হা হা।’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ। অবশ্যই।’
এরপর রুপাম বলল, -‘কোরআনের সাম্প্রদায়িক আয়াত মনে হয় তুই এখনো পড়িস নি। তাই জানিস না।’
-‘আমি না পড়ে থাকলে, তুই পড়ে আমাকে শোনা।’ সাজিদ বলল।
রুপম ইংরেজিতে সূরা আলে ইমরানের ১১৮ নং আর আল মায়েদার ৫১ নং আয়াতটি পড়ে শোনাল। সাথে অনুবাদ করেও পড়লো। সে বলল-
“O you, who believe ! do not take for intimate friends from among others than your own people”
“হে বিশ্বাসীরা, তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন কর না”
দেখ, কোরআনই তোদের বলছে, আমাদের মানে অমুসলিমদের বন্ধুরূপে না নিতে। আর তুই বসে বসে এখানে কোরআনকে অসাম্প্রদায়িকতার সার্টিফিকেট দিচ্ছিস। হাস্যকর না? এটা অসাম্প্রদায়িকতার নতুন সংজ্ঞা বুঝি? অমুসলিমদের বন্ধু বানাবা না, খবরদার ! হা হা হা।
আমি একটু চিন্তায় পরলাম। অবজ্ঞা সুরে বলেও রুপমের কথা একেবারে ফেলে দেবার মতো নয়।
অপেক্ষা করছি সাজিদের উত্তরের জন্য।
সাজিল একটু ঝেড়ে কেশে নিল। এরপর বলতে শুরু করল-
‘দেখ রুপম ! কোরআন নাজিল হয়েছে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর উপর। এখন কোরানের আয়াতগুলো কি আমাদের বুঝতে হবে ঠিক সেভাবে, যেভাবে মুহাম্মদ সাঃ বুঝিয়েছেন। প্লেটোর রিপাবলিক তুই তোর মন মতো ব্যাখ্যা করতে পারিস না বা বুঝে নিতে পারিস না। তোকে ঠিক সেভাবে বুঝতে হবে যেভাবে প্লেটো বুঝিয়েছে। এইটুকু তো কমন সেন্সের ব্যাপার। তাই না?’
রুপম বলল, ‘হুম’
-‘এখন কুরআনকেও আমরা সেই ভাবেই বুঝবো যে ভাবে মোহাম্মদ সাঃ বুঝিয়েছেন। প্রথমে তুই যে আয়াতের কথা বললি সেই আয়াতে আসি। ঐ আয়াতে আল্লাহ আমাদের বলেছেন -অমুসলিমদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতে। এখানে আল্লাহ তালা ‘বন্ধু’ শব্দটার জন্য যে এরাবিক ওয়ার্ড টি ব্যাবহার করেছেন তাহলো ‘আউলিয়া’ রাইট?
রুপম বলল, -‘হতে পারে। আমি তো আর আরবি বুঝি না।’
রূপম আরবি বুঝার কথাও না। সে হিন্দু ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা। ব্লগে মুক্তমনা তথা নাস্তিকদের লেখা-যোখা পড়ে কোরান নিয়ে যা একটু জানে। সাজিদ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, -‘আরিফ, মোবাইল খুলে কোরআনের অ্যাপস থেকে আয়াতটি তেলোয়াত করে শোনা।’
আমি শোনালাম। রুপম বিশ্বাস করল যে, সেই আয়াতে ‘বন্ধু’ শব্দের জন্য আরবি ‘আউলিয়া’ শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে।
সাজিদ বললো, -‘শুনলি?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘এখন আমরা এটাকে ব্যাখ্যা করব। এর্যাবিকে ‘আউলিয়া’ শব্দটির জন্য দুটি অর্থ করা যায়। এক- বন্ধু, দুই -অভিভাবক। আমরা এখানে সেই অর্থটা নেব, যেটা রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণ হয়ে আসবে । তার আগে দুটি বিষয় ক্লিয়ার করি। আউলিয়া শব্দের জন্য বন্ধু আর অভিভাবক দুই অর্থ করা গেলেও এই দুই শব্দের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। বন্ধু মানে বন্ধু। এই যেমন তুই আমার বন্ধু। আমি তোর সাথে এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছি, খাচ্ছি। অনেক রাত এক সাথে ঘুমিয়েছি। ক্লাস শেষ করি একসাথে ইত্যাদি। আবার আমার বাবা-মাও আমার বন্ধু। কিন্তু তুই আর আমার বাবা-মা কি একই রকম বন্ধু? না পার্থক্য আছে। তারা আমার অভিভাবক বন্ধু। তোর সাথে বন্ধুত্বের যে ডেফিনিশন, তাদের সাথে সামথিং মোর দ্যান দ্যাট, রাইট?’