-‘তাই বলে মেরে ফেলার কথা? এটা তো আইন হাতে তুলে নেবার মতো’- সজিদ বলল।
নিলু দা বলল, -‘যেখানে নিজেদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হবার পথে, সেখানে তুই আইন বানাচ্ছিস? যুদ্ধের ময়দানে কোন আইন চলে না।’
-‘তারপর?’
-‘শেখ মুজিবরের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙ্গালীরা ঝাঁপিয়ে পড়লো যুদ্ধে।’
আমি বললাম, -‘তারা পাকিস্তানিদের মারল, এবং মরলো তাই না?’
-‘হ্যাঁ’
-‘যুদ্ধের পরে ‘আমরা তাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো।’ অথবা, ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো’ এরকম কথার জন্য কি শেখ মুজিবরকে কি জেল-টেল খাটতে হয়েছে? বাঁ কেউ তাকে সন্ত্রাসে উস্কানিদাতা কিংবা খুন মদদদাতা বলে ব্লেইম করেছে?’ – সাজিদ জিজ্ঞেস করলো।
-‘তোর মাথায় কি গোবর নাকি রে সাজিদ? এটা কোন কথা বললি? শেখ মুজিবকে এটার জন্য ব্লেইম করবে কেন? যুদ্ধের ময়দানে এটা ছিল একজন কমান্ডারের কমান্ড। এটা অপরাধ নয়। বরং, এটার জন্য তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। নির্যাতিত বাঙ্গালিদের মুক্তির দিশারি, মহান এ নেতা। এভাবে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেলাম একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। একটা স্বাধীন পতাকা।’
-‘আচ্ছা দাদা, ঠিক একই কাজ যদি পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে অন্য কেউ করে, ধরুন, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, দলিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য পৃথিবীর অন্য কোথাও যদি অন্যকোন নেতা এরকম কথা বলে, -যদি বলে শত্রুদের যেখানেই পাও, হত্যা করো। আর, এই কমান্ড পেয়ে যদি নির্যাতিত মানুষগুলো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে- আপনি সেটাকে কোন চোখে দেখবেন?’
-‘অবশ্যই আমি ওই নেতার পক্ষে থাকবো এবং তার এই কথার, এই কাজের প্রশংসা করবো।’ – নিলু দা বললেন।
-‘যেমন?’
-‘যেমন আমি চে গুয়েভারার সংগ্রামকে স্বাগত জানাই। আমি জোসেফ ষ্ট্যালিন, মাও সে তুং এর সংগ্রামকে স্বাগত জানাই। এরা সবাই নির্যাতিতদের অধিকারের জন্য লড়েছেন।’
এবার সাজিদ বলল, -‘দাদা, আপনি আরবদের ইতিহাস জানেন?’
-‘কি রকম?’
-‘চোদ্দশত বছর আগের কথা। আরবদের প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের বিপরিতে একটি নতুন ধর্মবিশ্বাস সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।’
-‘হু’
-‘কিছু মানুষ স্বেচ্ছায়, কোন রকম জোর-জবরদস্তি ছাড়াই এই ধর্মের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়ে। তারা দলে দলে এই ধর্মবিশ্বাস মেনে নিতে শুরু করে। কিন্তু সমাজপতিদের এটা সহ্য হয়নি। যারা যারা এই ধর্মটিকে মেনে নিচ্ছিলো – তাদের উপরই নেমে আসছিলো অকথ্য নির্যাতন। বুকের উপর পাথর তুলে দেওয়া, উঠের পেছনে রশি দিয়ে বেঁধে মরুভূমিতে ঘুরানো, গর্দান নিয়ে নেওয়া কতো কি। একপর্যায়ে, এই ধর্মের প্রচারক, এবং তার সঙ্গী-সাথীদের দেশ ছাড়া করা হল। এমন কোন নির্যাতন নেই, যা তাদের উপর নেমে আসে নি।
স্বদেশ হারা, স্বজন হারা হয়ে তারা তখন বিধ্বস্ত।
৭১ এ আমাদের শত্রু যেমন ছিল পাকিস্তান, ১৪০০ বছর আগের সে সময়টায় মুসলমানদের শত্রু ছিল মুশরিকরা। তাহলে, এই অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে, তাদের নেতা যদি ঘোষণা দেয়, -‘তোমারা মুশরিকদের যেখানেই পাও, হত্যা কর’, তাহলে দাদা এতে কি কোন অপরাধ, কোন সন্ত্রাসবাদ প্রকাশ পায়?’
নিলু দা চুপ করে আছে।
সাজিদ বলে যেতে লাগলো, -‘শেখ মুজিবের, ‘আমরা তাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো’ যদি বাঙ্গালির মহাকাব্য হয়, এটা যদি সন্ত্রাসবাদে উস্কানি না হয়, তাহলে আরেকটি যুদ্ধের ঘোষণা স্বরূপ বলা- ‘তোমরা মুশরিকদের যেখানেই পাও, হত্যা করো’ এই কথাটা কেন সন্ত্রাসবাদি কথা হবে? এটি কেন জঙ্গিবাদে উস্কানি হবে?’
কিন্তু, হত্যার নির্দেশ দেবার পরের আয়াতে আছে, ‘মুশরিকদের কেউ যদি তোমাদের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দেও’
শেখ মুজিব কি বলেছিলেন, ‘আমরা তাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। কিন্তু তাদের কেউ এসে আমাদের আছে আশ্রয় চাইলে, আমরা তাদের নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় দেবো, বলেছিলেন? বলেন নি। পৃথিবীর কোন কমান্ডার শত্রুদের এরকম নিরাপদ দেবার কথা বলে নি। বরং, নির্দেশ দেয় দেখা মাত্রই গুলি করার।’
আমি বললাম, -‘হু’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, কোরআনে আরো আছে, – ‘কেউ যদি বিনা অপরাধে কোন ব্যক্তিকে খুন করলো, সে যেন পুরো মানবজাতিকেই খুন করলো’ এরকম একটি কথা, পৃথিবীর কোন মানুষ, কোন নেতা, কোন গ্রন্থে কি আছে? নেই।
৭১ এর পাকিস্তানিদের মারার ঘোষণা দিয়েও শেখ মুজিব যদি আপনার কাছে মহানায়ক হন, তাহলে ১৪০০ বছর আগে, এরকম ঘোষণা আরেকজন দিয়ে থাকলে, তিনি কেন আপনার চোখে খলনায়ক হবেন? অপরাধী হবেন? একই কথা, একই নির্দেশের জন্য আপনি একজনকে মহামানব মনে করেন, অন্য জনকে মনে করেন সন্ত্রাসী কেন দাদা? স্রেফ কি ধর্মবিরোধীতার জন্য?
একজন এরকম ঘোষণাকে ফোনের রিংটোন করে রেখেছেন, অন্য জনের এরকম ঘোষণাকে সন্ত্রাসবাদি কথাবার্তা, জঙ্গিবাদী কথাবার্তা বলে কটাক্ষ করে লেখা লেখেন, কেন? এটা কি ফেয়ার, দাদা?’
-‘হুম’ -নীলুদা কিছুটা একমত।
সাজিদ বলল, -‘দাদা, অনেক নাস্তিককে কোরআনের একটি আয়াতকে অন্য আয়াতের সাথে কন্ট্রাডিক্টরী বলতে দেখেছি। অথচ তারা কোনদিনও সূরা তওবার ‘তোমরা মুশরিকদের যেখানে পাও, হত্যা কর’ এটাকে সূরা মায়েদার ‘কেউ যদি নিরাপরাধ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল’ এটার সাথে কন্ট্রাডিক্টরী বলতে দেখি না।