নীলাঞ্জন দা মনে-প্রাণে একজন খাঁটি বাংলাদেশী।
বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তিসংগ্রামকে তিনি কোন কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নন।
সাজিদের সাথে নীলাঞ্জন দার খুবই ভালো সম্পর্ক। নীলাঞ্জন দা’কে আমরা ভালোবেসে নীলুদা বলেই ডাকি। ঊনি একাধারে কবি, রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক।
আজকে সাজিদের সাথে নিলু দা’র একটি বিষয়ে আলাপ হবে। কয়েকদিন আগে নীলুদা ব্লগে আল কোরআনের একটি আয়াতকে ‘সন্ত্রাসবাদি আয়াত’ বলে কটাক্ষ করে একটি পোস্ট করেছে। এ ব্যাপারে সুরাহা করতে নিজ থেকেই নিলু দার বাসায় যাচ্ছি আমরা। আমরা বিকেলে চারটায় নীলু দা’র বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। উনার বাসায় এর আগে কখনো আসিনি। উনার সাথে দেখা হতো প্রেসক্লাব আর বিভিন্ন প্রোগ্রামে। তবে, উনি যে নীলক্ষেতে থাকেন সেটা জানি।
নীলক্ষেতে এসে হাজির নীলু দা’কে ফোন দিলো।
নিলু দা’কে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে সুন্দর একটি রিংটোন বেজে উঠল।
রিংটনে সেট করা ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ ই মার্চের বিখ্যাত ভাষণ। সাজিদ ফোনের লাউড স্পিকার অন করে দিলো। আমরা আবার শুনলাম বঙ্গবন্ধুর সেই চিরচেনা ভাষণটি।
বঙ্গবন্ধু বলছে, -‘আমরা তাদের ভাতে মারবো, আমরা তাদের পানিতে মারব। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
পরপর দুইবার রিং হওয়ার পর তৃতীয়বারের নীলু দা ফোন রিসিভ করলেন।
সাজিদকে নীলুদা ভালোমতো বাসার ঠিকানা বুঝিয়ে দিলেন।
বাইরে থেকে কলিংবেল বাজতেই বুড়ো মত এক ভদ্রলোক দরজা খুলে দিল।
আমরা ভিতরে গেলাম।
বলে নিই, আমরা যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি, সেটা নীলুদা কে জানানো হয়নি।
নীলু দা’র একটি গুণের কথা বলা হয়নি। কবিতা লেখা, সাংবাদিকতার পাশাপাশি নীলুদা খুব ভালো ছবি আঁকে।
আমরা ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই বুড়ো লোকটি আমাদের সোজা নীলু দা’র রুমে নিয়ে গেল। মনে হয়, উনার উপর এই নির্দেশটাই ছিল।
আমরা নীলুদার রুমে এসে দেখি উনি ছবি আঁকছেন। মুক্তিযুদ্ধের ছবি। প্রায়ই আঁকা হয়ে গেছে।
জলপাইরঙা পোশাকের একজন মিলিটারি। মিলিটারির বাম হাতে একটি রাইফেল। একজন অর্ধনগ্ন মহিলা। মহিলার চুল খোলা। মহিলা বেঁচে নেই। মিলিটারিটা মহিলাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ভাগাড়ে নিক্ষেপ করবে-এরকম কিছু। পাশে একটি ডাস্টবিন টাইপ কিছু। চারটে কাক বসে আছে সেটার উপর। জয়নুলের ‘দুর্ভিক্ষ’ ছবিটার মতোই।
আমাদের দিকে না ফিরেই নীলু দা বললেন, -‘কিরে এত ঘটা করে দেখা করতে এসছিস যে?’
সাজিদ বলল, -‘ওমা তোমার সাথে দেখা হয়না কদ্দিন, দেখতে মন চাইলে বলে চলে এলাম। ডিস্টার্ব করেছি বুঝি?’
-‘আরে না না, তা বলিনি।’ এইটুকু বলে নীলুদা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমাকে দেখে নিল দা বলে উঠলো, ‘আরিফ না?’
-‘হু’ সাজিদ বলল।
-‘আরেব্বাস! আজ দেখি আমার বাসা চাঁদের হাট। তুমিতো জম্পেশ কবিতা লিখ ভাই আরিফ। বিচিত্রায় তোমার কবিতা আমি প্রায়ই পড়ি।’
নীলু দা’র মুখে এরকম কথা শুনে আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। সাজিদ বললো, -‘জানো দাদা, তাকে কত করে বলি, কবিতার একটা পাণ্ডুলিপি রেডি কর বইমেলার জন্যে। কিন্তু সে বলে, ওর নাকি ভয় করে। দেখো তো দাদা।’
নীলু দা বলল, -‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। পান্ডুলিপি তৈরি করো। একবার বই বের হয়ে গেলে দেখবে ভয়-টয় তো সব দৌড়ে পালাবে। তোমার লেখার তার হাত দারুন। আমি পড়ি তো। বেশ ভালো লিখো।’
সাজিদ বললো, -‘দাদা, ওটা কী মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ছবি? যেটা আকছো?’
-‘হু’ নিলু দা’র উত্তর।
-‘আচ্ছা দাদা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বিশেষ পড়াশোনা নেই। তুমি তো আবার এই লাইনের। আজ তোমার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনবো।’
নীলুদা মুচকি হাসলেন। তুলির শেষ আঁচড় খানা দিয়ে খাটের উপর উঠে বসলেন । আমরা দুজন ততক্ষণে দুটি চেয়ারে বসে পড়েছি।
বুড়ো ভদ্রলোকটা ট্রেতে করে কফি নিয়ে এসেছেন।
নীলুদা কফিতে চুমুক দিতে দিতে মুক্তিযুদ্ধ গল্প বলতে শুরু করলেন, -‘১৯৭১ সাল। পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত বাঙালিরা। যখনই তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হয়েছে, তখনই পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের উপর চালিয়েছে অত্যাচার-নির্যাতন।’
নিলুদা’র কন্ঠ ভারি হয়ে এলো। মুক্তিযুদ্ধের আলাপ উঠলেই উনি এরকম আবেগকেন্দ্রিক হয়ে যান।
তিনি বলে যাচ্ছেন, -‘এই অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা এতই ভয়াবহ হয়ে উঠল যে, বাঙালিরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের এবং নিজেদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হল।
তখন চলছে উত্তপ্ত মার্চ মাস। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলা ও বাঙালি জাতির কর্ণধার, ইতিহাসের বরপুত্র, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিলেন।’
সাজিদ বলল, -‘দাদা তোমার ফোনের রিংটোনে শুনি তো। আমরা তাদের ভাতে মারবো, আমরা তাদের পানিতে মারবো।
বাবারে ! কি সাংঘাতিক কথা।’
নীলুদা কপালের ভাঁজ দীর্ঘ করে বললেন, -‘সাংঘাতিক বলছিস কেন? বরং বল, এটিই হলো বাঙালির মহাকাব্য। সেদিন এরকম ভাবে বাঙ্গালীদের অনুপ্রাণিত না করলে আমরা কি স্বাধীনতার স্বাদ পেতাম?’