নিপুন দা বলল, -‘আরে, কোরআন বলছে পৃথিবীকে বিছানার মত বিছানো হয়েছে। এর মানে কি এই নয় যে, পৃথিবীটাকে সমতল বলা হয়েছে?’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, প্রথমেই বলে রাখি, অনুবাদ দিয়ে কোরআনকে জাস্টিফাই করাটা ভুল। দেখো, সমতল শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘সাবি’ ‘আল মুস্তাবি’ এসব। কোরান যদি সত্যিই পৃথিবীকে সমতল বলতো, তাহলে কোরআন নিশ্চয়ই এই শব্দগুলো ব্যবহার করত। কিন্তু কোরআন এখানে এসব শব্দ ব্যবহার করে নি।
কোরআন এখানে ব্যবহার করেছে ‘ফারাশ’ ‘বাস্বাত’ ‘দাহাহা’ এই জাতীয় শব্দ, যার অর্থ সমতল নয়। এগুলোর অর্থ ‘কার্পেট বা বিছানার মত করে বিছানো’ Spread Out। এগুলো দিয়ে কোনভাবেই বুঝা যায় না যে, পৃথিবী সমতল।
নিপুন দা অনেকটাই বিদ্রূপ করে বলল, -‘তাহলে কি বুঝায় এগুলো দিয়ে স্যার সাজিদ?’
সাজিদ বলল, -‘Let me finish…….
আমরা কোরানের সে আয়াতে চলে যাই, যেটাকে নিয়ে তোমাদের আপত্তি। যেটাতে নাকি বলা হচ্ছে, পৃথিবী সমতল। আয়াতটি হলো, -‘তিনি তোমাদের জন্য জমিনকে করেছেন বিছানা স্বরূপ। আর তাতে তোমাদের জন্য করেছেন চলার পথ।’
দেখো দাদা, আল্লাহ বলছেন, তিনি আমাদের জন্য জমিনকে করেছেন বিছানা স্বরূপ, কার্পেটের মতো করে। আচ্ছা দাদা, বিছানা বলতে আমরা কি বুঝি? আমরা বুঝি, বিছানা এমন একটি জিনিস, যা নরম, আরামদায়ক। যাতে বিশ্রাম নেওয়া যায়। যদি এটাকে রূপক হিসাবে ধরি, তাহলে এটা এমন কিছু যাতে স্বচ্ছন্দ বেঁচে থাকা যায়, চলাফেরা করা যায়। আজকের বিজ্ঞানও আমাদের সেটা বলছে।
বিজ্ঞান আমাদের বলছে, আমাদের পৃথিবীর ভূত্বক মোট সাতটি স্তরে বিভক্ত। এই স্তরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উপরের স্তরের নাম হল Crust। এই স্তরের পুরুত্ব ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত। এটিই সেই স্তর, যে স্তরে আমরা বসবাস করি, চলাফেরা করি। এরপরে আসে Mentle।
এই স্তরের পুরুত্ব ২৯০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হল ৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় মানুষ তো দূরের কথা, একটি ক্ষুদ্র জীবও মুহূর্তে ভস্ম হয়ে যাবে। চিন্তা করো তো, পৃথিবীর যে আমরা বাস করছি, হাঁটছি, চলছি, তার থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার গভীরে এই ভয়াল স্তর অবস্থিত।
এটা তো মাত্র দ্বিতীয় স্তরের কথা। এরপরের স্তরের নাম হলো Outer Core। উইকিপিডিয়া মতে, এর পুরুত্ব ২৮৯০ কিলোমিটার এবং এই স্তরের তাপমাত্রা হলো ৩৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চিন্তা কর, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ এইসব স্তরে কি ঘটে?
এরপরের স্তরের নাম হলো Inner Core। এটা তো আরো ভয়াবহ। এভাবে যত নিচে নামা হয়, স্তরগুলো ততই ভয়ানক। আমরা যে আগ্নেয়গিরি লাভা দেখি, এটা এই সব স্তরের ছোট একটি বিস্ফোরণ মাত্র। কিন্তু আমরা যে স্তরে থাকি, সেই Crust স্তরের তাপমাত্রা অন্য ৬ স্তরের তাপমাত্রার তুলনায় মাত্র ১%, যা আমাদের বসবাসের উপযোগী।
এখন, এই দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ যদি বলেন, আমি তোমাদের জন্য ভূমিকে করেছি বিছানা স্বরূপ, তাতে কি বোঝা যায়, এটা দ্বারা পৃথিবীর শেইপ বুঝিয়েছেন? একদম না। এটা দিয়ে যে আল্লাহর ভূত্বকের স্তর এর কথাই মিন করেছেন যা, আমাদের বসবাসের উপযোগী, তা আয়াতের পরের অংশ থেকেই বোঝা যায়। এর পরের অংশেই আছে ‘আর’, তাতে তোমাদের জন্য করেছেন চলার পথ।’
এটা তো একদম ক্লিয়ার আছে যে এটা পৃথিবীর আকার নয়, ভূমির ব্যাপারে বলা হয়েছে। এবং, ভূমির সে অংশের ব্যাপারে, যে অংশে আমরা মানুষেরা বসবাস করছি। যেটা আমাদের বসবাসের জন্য উপযোগী। তাহলে এটা দিয়ে পৃথিবীকে সমতল বানিয়ে দেওয়া যায় কি করে? স্রেফ মনগড়া ব্যাখ্যা।’
নিপুন দা চুপ করে আছে। বিপুল বলে উঠল, -‘আচ্ছা সাজিদ ভাই, আপনার কথা মানলাম যে এখানে পৃথিবীর আকার নয়, ভূমির স্তরের কথা বলা হয়েছে আর সেটাকে বিছানার সাথে উপমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আপনি কি কোরআনের এমন একটি আয়াত দেখাতে পারবেন যে, যেখানে বলা হচ্ছে পৃথিবী গোল? সমতল নয়?’
বিপুলের কথা শুনে সাজিদ হেসে উঠলো। বলল, -‘বিপুল, তার আগে তুমি বলোতো, কুরআন কি মানুষকে পৃথিবীর শেইপ কিরকম, পদার্থবিদ্যায় কি কি খাটে, রসায়নে কোন যৌগের সাথে কোন যৌগের বিক্রিয়া ঘটে এসব শেখানোর জন্য নাজিল হয়েছে?
-‘না।’ -বিপুল বলল।
-‘তাহলে তুমি কি করে এক্সপোর্ট করো যে কোরআন পৃথিবীর আকার, আয়তন নিয়ে বলবে?’
এবার বিপুলও চুপ। কিন্তু সাজিদ আর চুপ হল না। সে বলে যেতে লাগলো, -‘ঠিক আছে বিপুল। তুমি যখন আশা করছ, সোনা আমি প্রমাণ করে দেখাতে পারি যে কোরআন পৃথিবীর আকার নিয়ে বলছে, এবং, সেটা গোলাকার।’
এবার আমি, নিপুন দা, বিপুল আর সৌরভ চোখ বড় বড় করে সাজিদের দিকে তাকালাম। বলে কি বেট্যা !!! কোরান পৃথিবীকে গোলাকার যদি বলেই থাকে, তাহলে এতক্ষণ এত কাহিনী বলার কি দরকার ছিল?
নিপুন দা হো হো করে হেসে উঠল। বলল, -‘এবার কি নতুন তত্ত্ব শেখানো হবে নাকি? হা হা হা।
নিপুন দা’র সাথে সাথে বিপুল আর সৌরভও হেসে উঠল। তাদের সাথে সাজিদ হাসছে। আমার তখন সাজিদের উপর খুব রাগ হচ্ছে।
সাজিদ বলল, -‘নিপুন দা, একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবে প্লিজ। কোরআন সরাসরি পৃথিবীকে গোলাকার বলেনি। বলার দরকার ছিলো না। কারণ, কোরআন জিওগ্রাফির কোন বই নয় যে, এখানে পৃথিবীর আকার আকৃতি নিয়ে বলাই লাগবে। তবে, কোরআন কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে। জ্ঞানীদের উচিত তা বুঝে নেওয়া।