আমার মনে নানা ধরনের প্রশ্ন উকিঝুঁকি দিতে লাগল সেদিন।
-এর চার মাস পরের কথা।
হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় সাজিদ আমাকে এসে বলল, -‘আগামীকাল ডিপার্টমেন্ট থেকে ট্যুরে যাচ্ছি। তুই ও সাথে যাচ্ছিস।’
আমি বললাম, -‘আমি? পাগল নাকি? তোদের ডিপার্টমেন্ট ট্যুরে আমি কিভাবে যাব?
-‘ভাবনাটা আমার। তোকে যা বললাম জাস্ট তা শুনে যা।’
পরদিন সকালবেলা বের হলাম। তার ফ্রেন্ডদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো সাজিদ। স্যারেরাও আছেন। মফিজুর রহমান নামের ভদ্রলোকের সাথেও দেখা হল। বিরাট গোঁফওয়ালা। এই লোকের পূর্বপুরুষ সম্ভবত ব্রিটিশদের পিয়নের কাজ করত।
যাহোক আমরা যাচ্ছি বরিশালের কুয়াকাটা। পৌছাতে পাক্কা চার ঘন্টা লাগল।
সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি করলাম। স্যারগুলোকেও বেশ বন্ধু বৎসল মনে হল। ঘড়িতে তখন সময় পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। আমি সমুদ্রের কাছাকাছি হোটেলে আছি। আমাদের সাথে মফিজুর রহমান স্যারও আছেন। সে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘গাইজ, বি রেডি ! আমরা এখন কুয়াকাটার বিখ্যাত সূর্যাস্ত দেখব। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, এটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সমুদ্র সৈকত, যেখান থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।
আমরা সবাই প্রস্তুত ছিলাম আগে থেকেই। বেরোতে যাব, ঠিক তখনই সাজিদ বলে বসলো, -‘স্যার, আপনি সূর্যাস্ত দেখবেন?’
স্যার বললেন, -‘Why not? How can I miss such an amazing moment?’
সাজিদ বলল, -‘স্যার আপনি বিজ্ঞানের মানুষ হয়ে খুব অবৈজ্ঞানিক কথা বলেছেন। এমন একটি জিনিস আপনি কি করে দেখবেন বলছেন, যেটা আদতে ঘটেই না।’
এবার আমরা সবাই অবাক হলাম। যে যার চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। সাজিদ দাঁড়িয়ে আছে।
স্যার কপালের ভাঁজ দীর্ঘ করে বললেন, -‘What do you want to mean?’
সাজিদ হাসল। হেসে বলল, ‘স্যার, খুবই সোজা। আপনি বলেছেন- আপনি আমাদের নিয়ে সূর্যাস্ত দেখবেন। কিন্তু স্যার দেখুন, বিজ্ঞান বুঝে এমন লোক মাত্রই জানে, সূর্য আসলে অস্ত যায় না। পৃথিবী গোলার্ধের যে অংশ সূর্যের বিপরীতে মুখে অবস্থান করতে শুরু করে, সে অংশটা আস্তে আস্তে অন্ধকারে ছেয়ে যায়। কিন্তু সূর্য তার কক্ষপথেই থাকে। উঠেও না, ডুবেও না। তাহলে স্যার, সূর্যাস্ত কথাটা তো ভুল, তাই না?’
এবার আমি বুঝে গেছি আসল ব্যাপার। মজা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।
মফিজুর রহমান নামের লোকটা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো, -‘দেখো সাজিদ, সূর্য উদিত হয় না আর অস্ত যায় না, আমি তা জানি। কিন্তু এখান থেকে দাঁড়ালে আমাদের কি মনে হয়? মনে হয়, সূর্যটা যেন আস্তে আস্তে পানির নিচে ডুবে যাচ্ছে। এটাই আমাদের চর্মচক্ষুর সাধারন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। তাই, আমরা এটাকে সিম্পলি ‘সূর্যাস্ত’ নাম দিয়েছি। বলার সুবিধের জন্য এটা কে ‘সূর্যাস্ত’ বলাটা যুক্তিযুক্ত। দেখো, যদি আমি বলতাম, -‘ছেলেরা, একটুপর পৃথিবী গোলার্ধের যে অংশে বাংলাদেশের অবস্থান, সে অংশটা সূর্যের ঠিক বিপরীত দিকে মুখ নিতে চলেছে। তার মানে, এখানে এক্ষুনি আঁধার ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামবে। আমাদের সামনে থেকে সূর্যটা লুকিয়ে যাবে। চলো, আমরা সেই দৃশ্য অবলোকন করে আসি।
আমি যদি এরকম বলতাম, ব্যাপারটা খুবই বিদঘুটে শোনাতো। ভাষা তার মাধুর্য হারতো। শ্রুতিমধুরতা হারাতো। এখন আমি এক শব্দেই বুঝিয়ে দিতে পারছি আমি কি বলতে চাচ্ছি, সেটা।’
সাজিদ মুচকি হাসল। সে বলল, -‘স্যার, আপনি একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। বিজ্ঞান পড়েন, বিজ্ঞান পড়ান। আপনি আপনার সাধারন চর্ম চক্ষু দিয়ে দেখতে পান যে, সূর্যটা পানিতে ডুবে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটাকে আপনি সুন্দর করে বোঝানোর জন্য যদি ‘সূর্যাস্ত’ নাম দিতে পারেন, তাহলে সূরা কাহাফের জুলকারনাইন নামের লোকটি এরকম একটি সাগর পাড়ে এসে যখন দেখল- সূর্যটা পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে, সেই ঘটনাকে যদি আল্লাহতালা সবাইকে সহজে বোঝানোর জন্য সহজবোধ্য করার জন্য ভাষার শ্রুতিমধুরতা ধরে রাখার জন্য, কুলি থেকে মজুর, মাঝি থেকে কাজী, ব্লগার থেকে বিজ্ঞানী, ডাক্তার থেকে ইঞ্জিনিয়ার, ছাত্র থেকে শিক্ষক সবাইকে সহজে বোঝানোর জন্য যদি বলেন-
‘( চলতে চলতে) এমনিভাবে তিনি (জুলকারনাইন) যখন সূর্যের অস্ত গমনের জায়গায় গিয়ে পৌঁছলেন, সেখানে গিয়ে তিনি সুর্যকে (সাগরের) কালো পানিতে ডুবে যেতে দেখলেন’,
তখন কেন স্যার ব্যাপারটা অবৈজ্ঞানিক হবে? কোরান বলে না যে, সূর্য পানির নিচে ডুবে গেছে। কোরআন এখানে ঠিক সেটাই বলছে, যেটা জুলকারনাইন দেখেছিল এবং বুঝেছে। আপনি আমাদের সূর্যাস্ত দেখাবেন বলছেন মানে এই না যে, আপনি বলতে চাচ্ছেন সূর্যটা আসলে ডুবে যায়। আপনি সেটাই বোঝাতে চাচ্ছেন, যেটা আমরা বাহ্যিকভাবে দেখি। তাহলে, একই ব্যাপার আপনি পারলে, কোরআন কেন পারবে না স্যার?
আপনারা কথায় কথায় বলেন, ‘The sun rises in the east & sets in the west’ এগুলো নাকি Universal truth …
কিভাবে এইগুলো চিরন্তন সত্য হয় স্যার, যেখানে সূর্যের সাথে উঠা ডুবার কোন সম্পর্কই নাই?
কিন্তু এগুলো আপনাদের কাছে অবৈজ্ঞানিক নয়। আপনারা কথায় কথায় সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের কথা বলেন। অথচ, সেইম কথা কোরআন বললেই আপনারা চিৎকার করে বলে ওঠেন কুরআন অবৈজ্ঞানিক। কেন স্যার?’