আমি মুচকি হেসে বললাম, -‘খামোখা বুয়া রেখে এতগুলো টাকা অপচয় করি প্রতি মাসে। অথচ ভুবনবিখ্যাত বুয়া আবার রুমেই আছে। হা হা হা।
সাজিদ আমার দিকে ফিরে আমার কান মলে দিয়ে বলল, -‘সাহস তো কম না তোর। আমাকে বুয়া বলিস?’
আমি বললাম, -‘ওই দেখ পুড়ে যাচ্ছে।’
সাজিদ সেদিকে ফিরতেই আমি দিলাম এক ভোঁ দৌড় !
–গোসল সেরে, নামাজ পড়ে, খেয়ে দেয়ে উঠলাম। রুটিন অনুযায়ী সাজিদ এখন ঘুমোবে। রাতে যে বাড়তি অংশটা সে বই পড়ে কাটায়, সেটা দুপুর বেলা ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেয়।
আমার আজকে কাজ নাই। চাইলেই ঘুরতে বেড়তে পারি। কিন্তু বাইরে যা রোদ ! সাহস হচ্ছিলো না।
এরই মধ্যে সাজিদ ঘুমিয়ে পড়েছে।
কিন্তু আমার মনের একটি কচকচানি রয়ে গেলো। সাজিদকে এরকম মন খারাপ অবস্থায় আমি আগে কখনো দেখি নি। কেন তার মন খারাপ সে ব্যাপারে জানতে না পারলে শান্তি পাচ্ছি না। কিন্তু সাজিদকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সে কোনদিনও বলবে না। ভাবছি কি করা যায়?
তখন মনে পরলো তার সেই বিখ্যাত (আমার মতে) ডায়েরীটার কথা, যেটাতে তার জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গুলো হুবহু লিখে রাখে। আজকে তার মন খারাপের ব্যাপারটিও নিশ্চয় সে তুলে রেখেছে।
তার টেবিলের ড্রয়ার খুলে তার ডায়েরীটা নিয়ে উল্টাতে লাগলাম।
মাঝামাঝিতে এসে পেয়ে গেলাম মূল ঘটনাটা। যেরকম লেখা আছে, সেভাবেই তুলে ধরছি-
০৭/০৫/১৪
‘মফিজুর রহমান স্যার। এই ভদ্রলোক ক্লাসে আমাকে ওনার শত্রু মনে করেন। ঠিক শত্রু না, প্রতিদ্বন্দ্বী বলা যায়।
আমাকে নিয়ে উনার সমস্যা হলো, উনি উল্টাপাল্টা কথা বার্তা বলে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের মনে ধর্ম, ধর্মীয় কিতাব, আল্লাহ রাসুল ইত্যাদি নিয়ে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি প্রতিবারই উনার এহেন কাজের প্রতিবাদ করি। উনার যুক্তির বিপরীতে যুক্তি দিই। এমনও হয়েছে, যুক্তিতে আমার কাছে পরাজিত হয়ে উনি ক্লাস থেকেও চলে গিয়েছিলেন কয়েকবার।
এই কারণে এই বামপন্থী লোকটা আমাকে উনার চক্ষুশূল মনে করেন।
সে যাক গে ! আজকের কথা বলি।
আজকে ক্লাসে এসেই ভদ্রলোক আমাকে খুঁজে বের করলেন। বুঝতে পেরেছি, নতুন কোন উছিলা খুঁজে পেয়েছে আমাকে ঘায়েল করার।
ক্লাসে আসার আগে মনে হয় পান খেয়েছিলেন। ঠোঁটের এক কোণে চুন লেগে আছে।
আমাকে দাঁড় করিয়ে বড় বড় চোখ করে বললেন, -‘বাবা আইনস্টাইন, কি খবর?’
ভদ্রলোক আমাকে তাচ্ছিল্য করে ‘আইনস্টাইন’ বলে ডাকে। আমাকে আইনস্টাইন ডাকতে উনার অন্য শাগরেদবৃন্দগন হাসাহাসি শুরু করল।
আমি কিছু না বলে চুপ করে আছি। তিনি আবার বললেন, -‘শোন, বাবা আইনস্টাইন, তুমি তো অনেক বিজ্ঞান জানো। বলো তো দেখি সূর্য কি পানিতে ডুবে যায়?’
ক্লাস স্তিমিত হয়ে গেল। সবাই চুপচাপ।
আমি মাথা তুলে স্যারের দিকে তাকালাম। বললাম, -‘জি না স্যার। সূর্য কখনোই পানিতে ডুবে না।’
স্যার অবাক হবার ভঙ্গিতে বললেন, -‘ডুবে না ঠিক তো?’
-‘জি স্যার’
-‘তাহলে, সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় কেন হয় বাবা? বিজ্ঞান কি বলে?’
আমি বললাম, -‘স্যার, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরে। সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরার সময়, পৃথিবী গোলার্ধের যে অংশটা সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, সে অংশে তখন সূর্যোদয় হয়, দিন থাকে। ঠিক একইভাবে পৃথিবীর গোলার্ধের যে অংশটা তখন সূর্যের বিপরীত দিকে মুখ করে থাকে, তাতে তখন সুর্যাস্ত হয়, রাত নামে। আদতে, সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয় বলে কিছুই নেই। সূর্য অস্ত যায় না। উদিত হয় না। পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারনে আমাদের এমনটি মনে হয়।’
স্যার বললেন, -‘বাহ ! সুন্দর ব্যাখ্যা।’
উনি আমার দিকে ঝুকে এসে বললেন, -‘তা বাবা, এই ব্যাপারটার উপর তোমার আস্থা আছেতো? সূর্য পানিতে ডুবে-টুবে যাওয়তে বিশ্বাস কর কি?’
পুরো ক্লাসে তখনও পিনপতন নিরবতা।
আমি বললাম, -‘না স্যার। সূর্যের পানিতে ডুবে যাওয়া টাওয়াতে আমি বিশ্বাস করি না।’
এরপর স্যার বললেন, -‘বেশ ! তাহলে ধরে নিলাম, আজ থেকে তুমি আল কোরআনে বিশ্বাস করো না।’
স্যারের কথা শুনে আমি খানিকটা অবাক হলাম। পুরো ক্লাসও সম্ভবত আমার মতই হতবাক। স্যার মুচকি হেসে বললেন, -‘তোমাদের ধর্মীয় কিতাব, যেটাকে আবার বিজ্ঞানময় বলে দাবি করো তোমরা, সেই কোরআনে আছে, সূর্য নাকি পানিতে ডুবে যায়। হা হা হা।’
এইটুকু বলে স্যার কোরআনের সূরা কাহাফের ৮৬ নাম্বার আয়াতটি পড়ে শোনালেন- ‘(চলতে চলতে) এমননি ভাবে তিনি (জুলকারনাইন) সূর্যের অস্তগমনের জায়গায় গিয়ে পৌঁছলেন, সেখানে গিয়ে তিনি সুর্যকে (সাগরের) কালো পানিতে ডুবে যেতে দেখলেন। তার পাশে তিনি একটি জাতিকেও (বাস করতে) দেখলেন, আমি বললাম, হে যুলকারনাইন ! (এরা আপনার অধীনস্থ), আপনি ইচ্ছা করলেই তাদের শাস্তি দিতে পারেন, অথবা তাদের আপনি সদয় ভাবেও গ্রহণ করতে পারেন।’
এবার বললেন, -‘দেখো, তোমাদের বিজ্ঞানময় ধর্মীয় কিতাব বলছে যে, সূর্য নাকি সাগরের কালো পানিতে ডুবে যায়। হা হা হা। বিজ্ঞানময় কিতাব বলে কথা।’
ক্লাসের কেউ কেউ, স্যার এর মতই নাস্তিক, তারা হো হো করে হেসে উঠল। আমি কিছু বললাম না, চুপ করে ছিলাম।’
-এই টুকুই লেখা। আশ্চর্য ! সাজিদ মফিজুর রহমান নামের ভদ্রলোকের কথার কোন প্রতিবাদ করলোনা? সে তো এরকম করে না সাধারণত। তাহলে কি……..?