শুনে সত্যিই বড় দুঃখ আর লজ্জাবোধ হয়েছিল।
সমান অধিকারের সীমানা নির্ণয় হবে কোন মাপকাঠিতে? এই যে সমান অধিকারের দাবিতে সোচ্চার বেশ কিছু মেয়ে দাবি তুলছেন–ঘর-সংসারের গৃহস্থালীর কাজটাজ ভাগাভাগি করে পুরুষরাও করুক। সেই ক্ষেত্রে বিদেশের নজির দেখিয়ে দাবি জোরালো করতে যান এঁরা। আর সেই ছাঁচে ঢালাই হতে চেয়ে নিজেরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন, সেবা মানে দাস্যবৃত্তি। সংসারে স্বামী-পুত্র পরিজনের সেবা মানে দাসীত্ব! এই নিয়ে আন্দোলনে নামারও পরিকল্পনা চলে সম-চিন্তাধারিণী বান্ধবীমহলে।
এও কিন্তু সেই ফ্যাশনের খাতিরে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার ভ্রান্ত চেষ্টা! প্রিয়জন আপনজনকে সেবা করা, যত্ন করা নারীর সহজাত প্রকৃতি। তাই হয়তো খোঁজ নিলে দেখা যাবে, পুরুষরা তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ঘরকন্নার কাজ করতে এলেই বরং তারা দারুণ অস্বস্তিবোধ করবেন এবং স্বামীকে প্রায় তাড়া দিয়েই রান্নাঘর ছাড়া করে ছাড়বেন।
স্বামী এবং স্ত্রী দুজনে একই সময় অফিস থেকে ফিরেছেন, দুজনেই সমান ক্লান্ত। তবু যে মহিলাটি তৎপর হয়ে খাবার বানানোর ব্যবস্থায় হাত লাগাতে ছোটেন, সে কি পুরুষের শাসনে? তার নিজের ভিতরকার মমতা আর সহজাত দায়িত্ববোধই তাকে ঠেলে পাঠায়।
মুখে যতই দাসীত্ব বাঁদীত্ব বলে তারা রাগারাগি দেখান, কখনোই দেখা যায় না যে এমন ক্ষেত্রে মেয়েটি নিজ বিছানায় এলিয়ে পড়ে (পুরুষের মতো) প্রত্যাশা করছেন ঐ কর্মভারটি সম্পন্ন করতে স্বামীই এগিয়ে যাবেন (ব্যতিক্রম বাদে)।
আমাদের মেয়েরা মুখে যতই ঐসব প্রগতিমার্কা কথা বলুক বা কাগজে কলমে ঝাঁজালো ভাষায় লিখুক, ভিতরে কিন্তু সেই সাবেকি ভারতীয় নারী! যার মধ্যে এই সংস্কারটি বদ্ধমূল– পরিবার-পরিজনের যত্ন, তদ্বির, সেবা, পরিচর্যা তারই করণীয়।
ছেলেমেয়ের অসুখ করলে মা-ই দেখাশোনা করেন, বাবা নয়। তার জন্যে কর্মস্থলে ছুটি নিতে হলে, নেহাত অন্য পরিস্থিতি না ঘটলে, ছুটি নেন মা-ই, বাবা নন। অসুস্থ সন্তানের সেবা পরিচর্যার ভারটি নিজে না নিতে পারলে স্বস্তি আছে নাকি?
যদিও বাইরের জগতে মুক্তি আন্দোলনের শরিক সখীদের কাছে খুব উত্তেজিত আলোচনা হয় এই নিয়ে। সংসারজীবনে নারী-পুরুষের এই বৈষম্যের ব্যবস্থাকেও দাসীত্ব বাঁদীত্ব বলেই অভিহিত করা হয়। আসলে কিন্তু নারী যা-কিছু করে আপন হৃদয়ের অনুশাসনেই করে। তবে যেহেতু পুরুষের বিরুদ্ধে একটি জেহাদ জিইয়ে রাখা আধুনিকতা, তাই মুখে এসব বলতেই হয়। না বললে মানায় না। শত কাজের মধ্যে রান্নায় এত পরিপাট্য কেন? প্রশ্ন করলে মহিলা অবশ্যই ঝঙ্কার দিয়ে উঠবেন–না হলে বাবুর মুখে রুচবে? না রুচলে তোমার কী বয়ে গেল?–এ প্রশ্নের উত্তর কি?
শুধু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই নয়, শুধু মাতাপুত্রের সম্পর্কই নয়, সকল ক্ষেত্রেই নারী আত্মশাসনেই সংসারের সেবা-পরিচর্যা করে মরে। এখনো দেখা যায়, হয়তো সংসারে আর দ্বিতীয় কেউ নেই–পুরুষটি ও তার কোন একটি বৃদ্ধা বিধবা পিসি বা মাসি ছাড়া। সেই বৃদ্ধাই বকুনি খেয়েও যাকে বলে মরে মরে সেই ছেলেটার খাওয়া-শোওয়ার তদ্বির তদারক না করে ছাড়ছেন না-গঞ্জনা খেয়েও না। মনোভাব এই–আহা এটুকুতে আর আমার এত কী কষ্ট? অভ্যাসের হাত। কিন্তু নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নিতে হলে বাছার কষ্টের একশেষ।
এই মমতা নারী-হৃদয়ের চিরন্তন ধর্ম। বাল্য থেকেই যার বিকাশ। কিন্তু এই চিরন্তন নারী-হৃদয়ের সহজ প্রবণতাকে পাথর চাপিয়ে রুদ্ধ করে ফেলতে হবে কেবলমাত্র একটি বিভ্রান্তিকর মতবাদে আক্রান্ত হয়ে? একান্ত আপনজনের প্রিয়জনের সেবা পরিচর্যাও দাসত্ব বলে গণ্য করতে হবে?
তাই যদি হয় তো ব্যক্তিগত জীবনের অপরিসর ক্ষেত্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে জীবনকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেবার, নিজেকে সমগ্র বিশ্বের কল্যাণকর্মের শরিক হতে পারার উদার চেতনা আসবে কোথা থেকে?
অথচ আজকের মেয়েদের কাছে সে-প্রত্যাশা ছিল। প্রত্যাশা ছিল–আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার পাওয়া নারী নিজেকে বিস্তৃত করতে শিখবে, বিকশিত করতে শিখবে সেবায় কর্মে মহত্ত্বে উদারতায়। সে-প্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার কোথায়? কতটুকু?
শুভবোধহীন বিশেষ কোন একটি মতবাদের অন্ধ অনুসরণও কি একরকম দাসত্ব নয়?
সেবাকর্মের মধ্যেই তো আসে হৃদয়ের শুদ্ধতা। সেবার মধ্য দিয়েই আসে ভালবাসা।
সামান্য একটি গাছকেও যদি নিত্য পরিচর্যা করা যায়, সেই গাছটির প্রতি পরম ভালবাসা এসে যায়। একটি পাখি, জীব-জন্তুকেও যদি শখের ছলে নিত্য একটু আহার দেওয়া হয়, তাদের ওপর মমতা ভালবাসা আসবেই। হয়তো অর্থের বিনিময়েও, কেবলমাত্র করণীয় কাজ হিসাবেও যদি নিত্য একটি বিগ্রহ সেবা করতে হয়, কি একটি মন্দির মার্জনা করতে হয়, তাহলে সেই জড়বস্তুর ওপরও একটি বিশেষ ভালবাসা জন্মে যায়। সেবা এমনই পবিত্র সুন্দর কাজ যে, ক্রমশই কর্ম থেকে তা ধর্মে উন্নীত হয়ে ওঠে।
অবশ্যই কেবলমাত্র নারীজীবনের জন্যই নয়। সেবাধর্ম নারী-পুরুষ সকল জীবনের জন্যই মনুষ্যজীবনমাত্রেই।
কিন্তু সেই সেবাধর্মটি কেবলমাত্র কিছু মার্কামারা সমাজসেবামূলক সঙ্-সমিতি, প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং মানবধর্ম-চেতনাশ্রয়ী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমেই অনুশীলিত হয়ে চলবে? আর কারও কোন দায় নেই?