কিন্তু এ প্রসঙ্গ থাক। আমাদের পূর্ব প্রসঙ্গেই ফিরে আসা যাক। তবু একথা বলা যায়, আমাদের আজকের সমাজজীবনেও অনেক ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র ফ্যাশনের খাতিরেই যে নারী হৃদয়ের সহজাত ধর্মকে ত্যাগ করে একটি বিকৃত আদর্শকে ডেকে আনবার প্রবণতা নারীসমাজকে বেশ বিভ্রান্ত করে তুলছে তাতে কি সংশয় আছে?
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আদর্শ কখনোই এক ছিল না। হওয়া সম্ভবও নয়। এই বিপরীত দুই মেরুর দেশের মধ্যে আর্থিক, সামৰ্থিক, ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক এবং মানসিক–সর্ববিধ পরিবেশেরই আকাশ-পাতাল তফাৎ। কাজেই সমাজজীবনেও আদর্শের তফাৎ থাকবেই।
স্বামীজীর উদাত্ত ভাষণে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই বৈপরীত্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা আমাদের সামনে ধরা আছে। অবশ্য সেই তুলনামূলক সমালোচনায় তিনি কখনোই কোন পক্ষের আদর্শকে একমাত্র এবং শেষ আদর্শ বলে ঘোষণা করেন নি। পক্ষপাতশূন্য নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করে দেখিয়েছেন, কোন্ সমাজে কোথায় কি ত্রুটি, কোথায় কি ভুল, আর কোনখানে কাদের শুভবুদ্ধির প্রকাশ। তবে তার পক্ষপাতশূন্য দৃঢ় বলিষ্ঠ বক্তব্যের মধ্যে ঘোষিত হয়েছে, নারীধর্মের পরম আদর্শই হচ্ছে–সেবাধর্ম। যে-ধর্মটি মাতৃধর্ম বলেই বিবেচিত। কারণ মা মানেই তো একটি সর্বংসহা আত্মস্বার্থবোধহীন স্নেহ আর সেবার প্রতিমূর্তি। মা যেন কল্যাণ আর মঙ্গলের একটি ভাবরূপ। সন্তানের কল্যাণই তার ধ্যান, জ্ঞান। তার প্রার্থনার মন্ত্রই হচ্ছে সন্তানের শুভ কামনা। বলা হয়-কুপুত্র যদ্যপি হয়, কুমাতা কখনো নয়। পুত্র শত অন্যায়কারী, শত অত্যাচারী নিষ্ঠুর নির্মায়িক হোক, মা কখনোই তার অনিষ্ট চিন্তা করতে পারেন না। (পুত্র অর্থে এখানে ছেলে নয়, পুত্র অর্থে সন্তান। ছেলেই তোক অথবা মেয়েই হোক–শত অপরাধ করলেও মা কখনোই সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন না।)।
স্বামীজী বলেছেন, ভারতীয় নারীর বিভিন্ন আদর্শের মধ্যে মাতার আদর্শই শ্রেষ্ঠ, স্ত্রী অপেক্ষা তাঁহার স্থান উচ্চে। স্ত্রী-পুত্র হয়তো কখনো পুরুষকে ত্যাগ করিতে পারে, কিন্তু মা কখনো তাহা করিতে পারেন না।…মায়ের ভালবাসায় জোয়ারভাটা নাই, কেনাবেচা নাই, জরা মরণ নাই। ..মাতৃপদই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পদ! কারণ উহাতে সর্বাপেক্ষা অধিক নিঃস্বার্থপর শিক্ষা, নিঃস্বার্থপর কার্য করিবার অবসর প্রাপ্ত হওয়া যায়।
স্বামীজী বলেছেন, আমি বলিতেছি না যে, আমাদের সমাজের নারীগণের বর্তমান অবস্থায় আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট। কিন্তু নারীদিগের সম্বন্ধে আমাদের হস্তক্ষেপের অধিকার কেবলমাত্র তাহাদিগের শিক্ষা দেওয়া পর্যন্ত; নারীগণকে এমন যোগ্যতা অর্জন করিতে হইবে, যাহাতে তাহারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই নিজেদের ভাবে মীমাংসা করিয়া লইতে পারে।
সে-যুগে যখন দেশে সনাতনপন্থীরা স্ত্রীশিক্ষাকে আদৌ সুনজরে দেখতেন না এবং প্রয়োজনীয় বোধ করতেন না (অনেক পণ্ডিতজনও না), তখন স্বামীজীর হৃদয়ের একান্ত চিন্তা-মেয়েদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা। উচ্চশিক্ষা। উপযুক্ত শিক্ষা। স্বাবলম্বী হবার শিক্ষা। মেয়েরা শিক্ষায় দীক্ষায় অগ্রসর হতে না পারলে যে জাতির অনগ্রসরতা ঘুচবে না, এ চিন্তার প্রতিফলন দেখা যেত স্বামীজীর নারীজাতি সম্পর্কে সকল উপদেশের মধ্যেই। মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পাক। সত্যকার শিক্ষা পাক।
আজকের সমাজ অবশ্যই নারীজাতিকে সে সুযোগ দিয়েছে। ঢালাও সুযোগই দিয়েছে। দেশের দারিদ্র্য, অসামর্থ্য, অসুবিধা ইত্যাদি প্রতিবন্ধকে যার ভাগ্যে যতটুকু জুটুক, অধিকার হীনতার প্রতিবন্ধকতা কোথাও নেই। আইন এবং সমাজ আজকের নারীকে বেঁধে রাখে নি কোথাও।
কিন্তু স্বামীজীর সেই স্বপ্ন কি সফল হয়েছে? নিজেদের সমস্যা কি তারা নিজেরা একটুও সমাধান করে উঠতে পেরেছে বা পারছে?
সমাজ এখনো পুরুষশাসিত বলে আক্ষেপই দেখতে পাওয়া যায়। সেই শাসনটি যদি নিতান্তই অপশাসন হয় তো তা থেকে মুক্ত হবার চেষ্টার শক্তি দেখা যায় কই? কিছু আধুনিক চিন্তাসম্পন্ন মেয়ের তো মুখের ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ বুলিই হচ্ছে–মনু বলে গেছেন–মেয়েরা বাল্যে পিতার, যৌবনে পতির এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে থাকুক। এসব মেয়েদের পায়ে দলার ষড়যন্ত্র। এই নিয়ে সেই কোন্ আদ্যিকালের বুড়ো ভদ্রলোকের ওপর আক্রোশের শেষ নেই এঁদের। অথচ কেন কী সূত্রে আর কোন্ পরিবেশে এই অনুশাসন রচিত হয়েছিল তা ভেবে দেখবার ধৈর্য নেই। আর এ চিন্তারও খেয়াল নেই, এখনো সেই অনুশাসন মেনেই বা চলছি কেন আমরা? না মানলে কি সেই মনু এসে শাস্তিবিধান করতে বসবেন?
আসলে, মূলে একটু ভুল রয়ে গেছে। শিক্ষা এসে গেছে। কিন্তু নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করবার চিন্তায় দীক্ষা আসে নি! তার বদলে প্রবল দীক্ষা এসে যাচ্ছে পশ্চিমী সমাজ থেকে! সেটি শুভকারী কি অশুভকারী তা ভেবে দেখা হচ্ছে না। পুরো দেশটাই যে আমাদের শত সমস্যায় দীর্ণ, কোটি কোটি জন যে বঞ্চনা, অবিচার আর অবহেলার শিকার। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সে কথাটি মাথায় না রেখে নিজেদেরকে পৃথক একটা সমস্যার বোঝা করে তোলা হয়ে চলেছে শিক্ষিত নারীসমাজের ভ্রান্ত চিন্তার ফলে।
সেদিন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ক্ষুব্ধচিত্তে আক্ষেপ জানাচ্ছিলেন : সমান অধিকার! সমান অধিকার! তো সমানটা কোথায়? তোমরা মেয়েরা যেখানে ইচ্ছা সেখানে জায়গা দখল করতে পার। কারুর কিছু বলার নেই। কিন্তু একটা বুড়ো মানুষ নিরুপায় হয়ে রেলগাড়িতে একটা লেডিস কামরায় উঠে পড়ায় একপাল মেয়ে ঝাঁপিয়ে এসে বুড়োকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে নামিয়ে দিলে! এটা কি সমান অধিকারের নমুনা? নেহাত কপাল জোর ছিল তাই পৈতৃক প্রাণটা বেঁচে গেছে। অন্য কোন সভ্যদেশে এমনটা হতে পারবে?