Site icon BnBoi.Com

জীবনে সমাজে সাহিত্যে – আহমদ শরীফ

জীবনে সমাজে সাহিত্যে - আহমদ শরীফ

অপ্রেম

তুর্কী-আফগান-মুঘলেরা এদেশে আসে পরাক্রান্ত বিজয়ী শাসকরূপে। বিদেশী বিজাতি, বিধর্মী ও বিভাষী বিজেতার কবলে পড়ার অভিজ্ঞতা এদেশের জনগোষ্ঠীর নতুন ছিল না। দ্রাবিড়, অস্ট্রিক, আর্য, নিগ্রো, শক, হুন, ইউচি, গ্রীক প্রভৃতিও উড়ে এসে জুড়ে বসে এখানে। কিন্তু এদের কারো সুসংবদ্ধ ধর্মদর্শন ছিল না। কেউ ছিল সর্বপ্রাণবাদী, কেউ ছিল জাদুবিশ্বাসী, কেউ ছিল টোটেম-টেবু স্তরে, আবার কেউবা ছিল উঁচুস্তরের প্যাগান-পৌত্তলিক। তাই তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় যত্ন করেনি। সে প্রয়োজনই ছিল না তাদের। এদেশে যা সুন্দর, যা কল্যাণকর ও যা উপযোগসিদ্ধ, তা ই তারা গ্রহণ করেছে অকাতরে। মানুষ তখনই হয় গ্রহণবিমুখ, রক্ষণশীল ও স্বাতন্ত্রকামী, যখন সে নিজের যা-কিছু আছে তাকেই জীবন-জীবিকার পক্ষে যথেষ্ট বলে মনে করে, কোনো প্রয়োজনবোধ কিংবা অভাব অনুভব করে না, বরং প্রাচুর্যের ও শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকায় সে থাকে গর্বিত ও তৃপ্তমন্য। জাতি হিসেবে এরা ছিল গড়ার মুখে এবং তাদের সভ্যতা ছিল কেবল বিকাশোনুখ। এমন মানুষ হয় কৌতূহলী, জিজ্ঞাসু ও গ্রহণে আগ্রহী। তাই এই নবাগতরা এদেশের ধর্ম-সংস্কৃতির উপাদান উপকরণে নিজেদের গড়ে তুলতে ছিল উৎসুক। ব্যবহারিক আচরণে কিংবা মানস-অভিব্যক্তিতে দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে অভিন্ন হয়ে বাস করতে চেয়েছে তারা। অথবা পরিবেষ্টনীর প্রভাবে তা-ই করতে হয়েছে তাদের।

একদা যারা ছিল প্যাগান ও বৌদ্ধ, সেই শক-হুঁন-উইচি-মোঙ্গলের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী-প্রতিবেশী তুর্কী আফগান-মুঘলেরা এল এবার নতুন বৃত ধর্ম, নতুন ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে। এরা একসময়ে ছিল কিরাত, এখন ক্ষত্রিয়। দুটোই বাহুবল সাপেক্ষ। জিগীষাই ছিল তাদের প্রাণের প্রেরণা। বাহুবল আর ধনবল যার আছে, তার মর্যাদাবোধও থাকে। অহঙ্কার, গর্ব কিংবা আত্মসম্মানবোধ লালন ও অভিব্যক্তি পায় স্বাতন্ত্রে। তাই এদের স্বাতন্ত্র্য-চেতনা ছিল তীক্ষ্ণ, স্বধর্ম ও সংস্কৃতিপ্রীতি ছিল তীব্র। তাছাড়া স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্ববোধ, লোকান্তরে প্রসারিত জীবনের সুনির্দিষ্টতা, জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে প্রত্যয়-দৃঢ় ধারণা, ব্যবহারিক জীবনে তার প্রয়োগ-সাফল্য প্রভৃতি তাদেরকে স্বাতন্ত্র্যরক্ষায়ও দেয় প্রবর্তনা। আবার দেশীলোকেরাও ইসলাম বরণ করে শাসকদের ভ তত্বলোভে ও স্বধর্মের স্বাতন্ত্র চেতনায় পূর্বপুরুষের দেশী ঐতিহ্য ও আচার পরিহারে হল উৎসাহী। এসব কারণে আগের মতো এবার শাসক শাসিত অভিন্ন হয়ে উঠল না।

কাজেই হিন্দুর মনে পরাধীনতার গ্লানি ছিলই। আর শাসকের স্বাতন্ত্র্যচেতনা ও উত্তম্মন্যতা সে গ্লানি স্থায়ী ক্ষতে পরিণত করে। ফলে বেদনা, ক্ষোভ ও গ্লানি শাসিত-মনকে অসুস্থ করে রাখে। আর সাতশ বছরের মধ্যে এমন কোনো আবহ তৈরি হয়নি যাতে সুস্থ মনের প্রবর্তনায় সুস্থ হয়ে পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্পর্কে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ সম্ভব হত। অবশ্য চেষ্টা হয়েছে অনেক। এ সূত্রে রামানন্দ, কবির, নানক, দাদু প্রভৃতি সন্তদের প্রয়াস স্মর্তব্য। তবে এতেও কেবল বিচ্ছেদ ও ব্যবধানের প্রাচীরই উঠেছে। এসব মিলন-প্রয়াস বিচ্ছেদের বেদনায় হয়েছে ম্লান, বিভেদের ও স্বাতন্ত্রের অহমিকায় হয়েছে তিক্ত।

এ ব্যর্থতার কারণ আছে। এতকাল মানুষ সে-কারণ জেনে-বুঝেও এড়িয়ে গেছে, উচ্চারণ করতে চায়নি। মনের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর বিড়ম্বনাকেই সে শ্রেয় মনে করেছে। কেননা এ কারণ অপসারণের সাহস ও শক্তি ছিল না তার। তাই বৃথা জেনেও সে মিথ্যা উপায়ে প্রেম-প্রীতি প্রতিষ্ঠায় হয়েছে প্রয়াসী। অপ্রেম দূর করার ছলনায় সে আত্মপ্রতারণাই করেছে চিরকাল। সত্যকে দেখেও সে চোখ বুজে ছিল, তাই ফুটো পাত্রে পানি ঢালার বিড়ম্বনাই পেয়েছে সে। সে-যুগে সে ছিল নিরুপায়। কেননা বিশ্বাসের অঙ্গীকারেই ধর্মের উদ্ভব ও স্থিতি। ধর্ম মানুষের আচার-আচরণ, বিশ্বাস-সংস্কার ও আদর্শের বন্ধনে মানুষের দেহ-মন-আত্মাও নিয়ন্ত্রিত করে। এতে নিয়ম-নীতির ডিকদড়িবদ্ধ মানুষের বিচরণক্ষেত্রের পরিসর হয় সীমিত। ধর্মীয় বিধিনিষেধের বাইরে কিছু করা অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষের পক্ষে পাপ। ধর্মবোধ ও ধর্মাচারের ক্ষেত্রে যুক্তি-বুদ্ধির প্রশ্রয় মারাত্মক বলেই সে জানে। কাজেই চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা সেখানে কার্যত অস্বীকৃত। বিধর্ম ও বিধর্মীর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলাই হচ্ছে সাধারণের পক্ষে নির্দ্বন্দ্ব ও নির্বিঘ্ন জীবনযাত্রার উত্তম নীতি। এই ঋজুবোধের রাজপথ ত্যাগ করা জ্ঞানী-গুণীর পক্ষেও সম্ভব ছিল না। অন্তরের দিকে এইরূপ বাধা ছিল বলেই বাইরে ব্যবহারিক জীবনেও প্রীতির বন্ধন স্বীকার করা সম্ভব হয়নি। হাটে-ঘাটে-মাঠে তারা মিলিত হয়েছে বৈষয়িক কাজে, কিন্তু মনে মেলেনি। তাদের চাঁদ-সূর্য-আকাশ ছিল একক, তাদের নদী নৌকা-হাট-বাট ছিল অভিন্ন, ফসল-পণ্যও তারা দেয়া নেয়া করেছে, কেবল মন ও মত রেখেছিল ভিন্ন। রুদ্ধ রেখেছিল তারা হৃদয়ের প্রীতিপ্রবাহ। এজন্যেই পৃথিবীর সর্বত্রই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মিলন-প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে চিরকাল।

প্রবলপক্ষ তথা শক্তিমান যদিবা আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে আসতে সাহস পায়, দুর্বলপক্ষ আত্মবিলয়ের আশঙ্কায় পিছিয়ে যায়। সে আত্মসংকোচনে ও আত্মগোপনেই খোঁজে স্বস্তি ও নিরাপত্তা। হীনবল শাসিত হিন্দুরও এসেছিল এই স্বাভাবিক আত্মসংশয়। হিন্দুর এই বিকৃতবুদ্ধি ও অসুস্থ মন শাসকের ধর্মে দীক্ষিত জ্ঞাতিদের প্রতিও বিরূপ ও বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিল। অপরদিকে দেশজ মুসলমানরাও বিস্মৃতগোত্র ও শাসকদের জ্ঞতিত্বকামী হয়ে বিধর্মীর প্রতি অবজ্ঞা পোষণ করাই স্বাতন্ত্র ও স্বধর্ম রক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায় বলে জানল। আত্মরতি চিরকালই পরপ্রীতির পরিপন্থী। বিধর্মবিদ্বেষের জন্যে স্বধর্মনিষ্ঠ হবার প্রয়োজন হয় না। এটি জীবনের একটি সাধারণ সংস্কারে পরিণতি পায় বলে বিশ্বাসের মতোই দৃঢ়মূল সংস্কার অধার্মিকের মনেও এ বিদ্বেষ জাগিয়ে রাখে। কাজেই প্রাজ্ঞ ধার্মিকের মনে যদিবা কিছু সহিষ্ণুতা থাকে, আচারনিষ্ঠ ধার্মিক ও অধার্মিকের তাও থাকে না।

কাজেই এই স্বাতন্ত্র্যচেতনা ও স্বধর্মপ্রীতিই তৃতীয়পক্ষ ব্রিটিশের শাসনকালে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক করে তিক্ততর এবং হিন্দু-মুসলমান সমস্যাকে করে তীব্রতর। পূর্ব গ্লানির স্মৃতিতে বিক্ষুব্ধ হিন্দুরা বুঝল না যাকে এড়ানো-সরানো যাবে না, যার সঙ্গে জীবন-জীবিকা একসঙ্গে গ্রথিত; তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করা, তাকে ঘা দেয়া আত্মপীড়নেরই নামান্তর। বিকৃতবুদ্ধি ও অসুস্থ মনের প্রভাবে হিন্দুরা ইংরেজ শাসনের দু-শ বছর ধরে এ আত্মঘাতী চিন্তায় ও আচরণে উৎসাহবোধ করেছে, পেয়েছে ছদ্ম আত্মোন্নয়নের প্রচুর আত্মপ্রসাদ। কার্যত মুসলমানের ক্ষতি করার সামর্থ্য ছিল তাদের সামান্যই, কিন্তু কথায় ও আচরণে লাঞ্ছিত করে মুসলমানদেরকে বিক্ষুব্ধ শত্ন করে তুলল তারা। কে না দেখল, হিন্দুর পক্ষে ভালো হয়নি এর ফল!

শক্তি যার আছে, সে দাপট দেখাবে; সে দাপটের ঘা কোথায় কখন কার গায়ে লাগছে, কেমন করে লাগছে, আর কী পরিমাণ মানস ও ব্যবহারিক ক্ষতি করছে, তা অনেক সময়ে অনেক ক্ষেত্রে থেকে যায় শক্তিমানের অগোচরে। ফলে যে আঘাত হানে সে স্মরণ করতে পারে না বটে, কিন্তু যে পায় সে ভোলে না। এ তত্ত্ব ব্রিটিশ আমলের মুসলমান সম্পর্কে খাঁটি তথ্য ও সত্য।

মুসলমান ছিল শাসক। আর হিন্দু ছিল শাসিত। তাই হিন্দুর মনে ছিল বেদনা ও ক্ষোভ। আর উত্তম্মন্য মুসলিম চিত্তে হিন্দু-বিদ্বেষ ছিল না বরং বিধর্মী বলে ছিল তাচ্ছিল্য। আবার শেষের দিকে মারাঠা ও শিখদের প্রতি উত্তরভারতীয় মুসলিম-মনে বিদ্বেষ-বিরূপতা জাগার কারণ ঘটেছিল। তখন সেখানে মুসলমান শাসিত এবং হিন্দু-শিখ শাসক। কিন্তু আমাদের বাঙলাদেশে সে-প্রতিবেশ ছিল অনুপস্থিত। পরে মুসলমানের সর্বনাশ ঘটে ব্রিটিশের হাতে। তাই ব্রিটিশ ভাগানোর লক্ষ্যে মুসলমানরা হাত মিলাতে চেয়েছিল হিন্দুর সঙ্গে ওহাবী-সিপাহী-কংগ্রেস আন্দোলনে। বৃত্তি বেশাত ও শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান এগিয়ে যাওয়া হিন্দুর কাছে অর্থ-বিত্ত হারিয়ে উনিশ শতকের শেষপাদ থেকে হারানো ধন, বৃত্তি ও চাকরি ফিরে পাবার সাধনায় যত্নবান হয়। তখন তাদের ব্রিটিশ-বিদ্বেষ হিন্দু-বিদ্বেষের রূপ নেয়। জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে তখন তারা প্রতিপক্ষ পেল হিন্দুকে। হিন্দুরা আগেই মুসলিমদের নানাভাবে ঘা দিয়ে বিরূপ করে তুলেছিল। ১৯৪৭ সন অবধি এবং তার পরেও তার জের স্বরূপ দুপক্ষের দ্বন্দ্বের তীব্রতা ও কৌৎসিত্য সবাই দেখছে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর–যদিও তার আগের মতো নীতি ও আদর্শবিরোধী, তবু বাস্তব বুদ্ধি ও শেয়বোধের প্রেরণায় গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ঘোষণা করলেন : হিন্দু ও মুসলমান আর ধর্মীয় পরিচয়ে নয়, সম-নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় জাতি পাকিস্তানী নামেই হবে পরিচিত।

ভারতও ঘোষণা করল নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে। কিন্তু অধিকাংশ হিন্দু যেমন বিকৃত বুদ্ধি ও অসুস্থমনের প্রভাবে পড়ে হিন্দুয়ানির মোহ ও মহিমা প্রচারে উৎসাহী তেমনি কিছুসংখ্যক মুসলমানও ধর্মীয় জাতীয়তা, ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি গ্রহণে-সৃজনে যত্নবান। ভারতে হিন্দিকে করছে সংস্কৃত-ঘেঁঘা আর পাকিস্তানে উর্দু হচ্ছে প্রায়-ফারসি। উভয় রাষ্ট্রেই এভাবে ব্যর্থ হয়েছে দেশনেতা ও রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় ও আবেদন। ফলে জাতীয় জীবনে স্বস্তি ও কল্যাণ আসেনি। গড়ে উঠতে পারেনি স্বস্থ ও সুস্থ জাতি। সফল হল না দেশনেতার আনন্দিত স্বপ্ন। ইংরেজ আমলের সে-আধি এখনো চেপে বসে আছে পাক-ভারতের মানুষের মনে-মগজে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতের পাঠ্যপুস্তক ও বেতার হিন্দু ও হিন্দুয়ানীর মহিমা কীর্তনে প্রযুক্ত। যাকে নিয়ে ঘর করতে হবে তার মন ভাঙলে কেবল যে ঘরের শান্তি নষ্ট হয় তা নয়, বিপদকালে সাহায্য সহানুভূতিও মেলে না। ঘরের শত্রুর মতো ক্ষতিকর শত্রু নেই। কেননা তাকে ঠেকানো যায় না। এ যুগে প্রথম মহাযুদ্ধ কালে জার্মানির ইহুদির ভূমিকা স্মর্তব্য। খ্রীস্টান জার্মানের অবজ্ঞা ও বিদ্বেষই জার্মান ইহুদিদের স্বদেশের স্বার্থের প্রতি উদাসীন করে তুলেছিল।

সংখ্যালঘুর প্রতি অন্যায় ও সংকীর্ণচিত্ততার পরিণাম হিন্দুদের পক্ষে শুভ হয়নি এবং স্বাধীন দেশের সংখ্যাগুরু নাগরিক হয়েও তারা তা ত্যাগ করেনি; এখনো দাঙ্গা বাধায়, অসহায়কে হত্যা করে। স্বাধীন দেশের সংখ্যাগুরু নাগরিক হয়ে সংখ্যালঘুর ধর্ম-সংস্কৃতির প্রভাবে পড়ার ভীতি জিইয়ে রাখা, আর সে-ভয়ে দিশাহারা হয়ে সামাল সামাল রব তোলা, দুর্বল সংখ্যালঘুকে নিশ্চিহ্ন করার ব্যর্থ প্রয়াসে উদ্যোগী হওয়া, তার প্রতি সমকক্ষের হিংসা পোষণ করা প্রভৃতি বিকৃতবুদ্ধির, অসুস্থ মনের ও নিজের প্রতি আস্থাহীনতার পরিচায়ক।

এ যুগে ধর্মমতকে বৈষয়িক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে সম ও অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে যে কোনো দেশের, ধর্মের, ভাষার, সংস্কৃতির ও সমাজের মানুষের সঙ্গে একই মিলন-ময়দানে এসে দাঁড়ানো শুধু সম্ভব নয়, সহজও। পাক-ভারতে আজ এ বোধের অনুশীলনের বড় প্রয়োজন। অবশ্য সঙ্গে প্রীতি ও প্রত্যয় থাকা চাই। কেননা, প্রীতিহীন হৃদয় ও প্রত্যয়হীন কর্ম দুই বন্ধ্যা।

আঁকিয়ে-লিখিয়ে-গাইয়ে

ব্যক্ত ধ্বনির নাম কথা। এই কথা দিয়েই গড়ে ওঠে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রভৃতি। আর অব্যক্ত ধ্বনির নাম চিত্রশিল্প, অস্ফুট ধ্বনিই নৃত্যকলা এবং গান হচ্ছে স্কুটধ্বনি।

যে-ধ্বনি দিয়ে মানুষকে চটানো যায়, কাঁদানো যায়, হাসানো চলে এবং ভীত, চকিত, ত্রস্ত, স্তম্ভিত কিংবা আনন্দিত, অভিভূত, উত্তেজিত ও উৎসাহিত করা সম্ভব, সে-ধ্বনির–সে-কথার চেয়ে বড় শক্তি পৃথিবীতে কিছুই নেই। তাই বাক্যবলই শ্রেষ্ঠ বল।

ওহী কিংবা সূক্ত সবই এ বাক্য। কাজেই মানুষের জীবনে মুখ্য নিয়ন্ত্ৰী শক্তিই হচ্ছে কথা। ভাবতে গেলে মানুষ কথায় বাঁচে, কথায় মরে। এই তাৎপর্যেই বাকব্রহ্ম তত্ত্বের উদ্ভব।

সুচিত শব্দের সুবিন্যাসেই ভাব হয়ে উঠে বাঙময় মন্ত্র ও ইসম। তার সম্মোহনশক্তি অতুল্য। জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্মের অণুত অণুতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকে তার প্রভাব।

সাহিত্য তাই বাকপটুতারই নামান্তর। একের ভাব-চিন্তাকে বহুর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া এবং বহুর প্রকাশোন্মুখ বদ্ধ ভাব-চিন্তাকে একের মধ্যে সংহত করে আবার সর্বহৃদয়ে সঞ্চারিত করে দেয়াই সাহিত্যিকের কাজ। চিত্রকর, ভাস্কর, নৃত্যশিল্পী ও সঙ্গীতশিল্পীর লক্ষ্যও তা-ই।

অতএব আঁকিয়ে, লিখিয়ে, বাজিয়ে, গাইয়ে-সবারই এক ব্ৰত এক অভীষ্ট–লোকহিতে লোকসেবা। এ ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে যারা এক্ষেত্রে বিচরণ করেন, তাদের সৃষ্টি আবর্জনা এবং আবর্জনা মাত্রেই অসুন্দর ও অস্বাস্থ্যকর। এ ধরনের কলাকৈবল্যবাদী স্রষ্টা ও শিল্পী সবক্ষেত্রে গণশত্রু না হোন, গণবন্ধু যে নন তা বলাই বাহুল্য। অকাজের কাজে পণ্ডশ্রম তো আছেই, তাছাড়া তাদের ফুল-পাখি-প্রেম-প্রকৃতি ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ক রচনা গণমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বলেই তা সুগতি ও প্রগতির অন্তরায়।

আপাতদৃষ্টে সাহিত্য-শিল্পাদি কলার দান দৃশ্য নয়, কিন্তু বাব্রহ্ম তত্ত্বে আস্থা রাখলে দেখতে পাব মূলত জীবনযাত্রীর জীবনের সবক্ষেত্রেই এর প্রভাব প্রকট। মানুষের জীবনযাত্রার এ কেবল পাথেয় নয়, প্রেরণার উৎসও। বাজিয়েরা যেমন গাইয়ে-নাচিয়েদের তাল ঠুকে সুর তুলে সহায়তা করেন, শিল্পী-সাহিত্যিকরাও তেমনি চিন্তায় উদ্দীপনা, কর্মে প্রবর্তনা ও সগ্রামে অনুপ্রাণিত করেন। এ তাৎপর্যে তাঁরা মন্ত্রদাতা, চারণ কবি, বন্দী ও দিশারী। এখানে সাহিত্য-শিল্পের সংজ্ঞা অবশ্যই ব্যাপক করতে হবে। শিক্ষিত কিংবা লোকশিল্পীয় লিখিত কিংবা অলিখিত সব সৃষ্টিকেই এমনকি ছড়া ও স্লোগান, প্রাচীরলিপি ও প্রচারপত্র-ইস্তাহার ও ব্যঙ্গচিত্র সবকিছুকেই এক্ষেত্রে সাহিত্য-শিল্পের অন্তর্ভুক্ত ভাবতে হবে।

কেননা এগুলো মানুষের প্রয়োজন-প্রেরণাজাত চিন্তা ও আবেগের ফলপ্রসূ লেখা ও রেখাচিত্র। মন্ময় বাসনার এই তন্ময় প্রকাশ–ভালো-মন্দ-মাঝারি-ভেদ স্বীকার করেও–অবশ্যই সাহিত্য ও শিল্প। প্রেরণা-উৎসাহ-উত্তেজনা-উদ্দীপনা জাগানো লক্ষ্যে সৃষ্ট এসব লেখন ও অঙ্কন যদি একটি হৃদয়েও প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয় তা হলেই বলতে হবে প্রয়াস সার্থক। কেননা মানসজীবনের বিকাশ সাধনের এবং ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজন মিটানোর সহায়ক হওয়াতেই সাহিত্য-শিল্পাদি কলার সার্থকতা ও সফলতা।

রণে যেমন রণবাদ্য, নৃত্যে-গীতে যেমন যন্ত্রসঙ্গীত, দুর্বহ বোঝা টানায় যেমন বোল, যৌথকর্মে যেমন গান, জাহাজে যেমন পাঞ্জেরী, নৌকায় যেমন হাল; মানুষের ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে সাহিত্য-শিল্পাদি কলাও তেমনি দিশারী ও নিয়ন্তা।

সামাজিক, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক, ধার্মিক কিংবা রাষ্ট্রিক আন্দোলন, বিপ্লব অথবা বিদ্রোহ জাগানোর জন্যে যেমন প্রেরণা-সঞ্চারী সাহিত্য ও শিল্পের প্রয়োজন তেমনি সে-সব সংগ্রাম চালু রাখার জন্যেও সাহিত্য-শিল্প আবশ্যিক। আবার সাহিত্য-শিল্প নতুন ভাব-চিন্তা কর্মের ফসলও। অতএব, সাহিত্য-শিল্পাদি কলা একাধারে বীজ ও ফল দুই-ই। জীবনে জাগরণ আনার জন্যে এবং জাগ্রত জীবনের চাহিদা পূরণের জন্যে সাহিত্য-শিল্পই মুখ্য অবলম্বন। গণজাগরণ যেমন সাহিত্য শিল্পের মাধ্যমেই সহজে সম্ভব, জাগ্রত জনতারও তেমনি সাহিত্যাদি কলাই শক্তির উৎস এবং কর্মোদ্যমের আকর। এসব কলা, বলতে গেলে, জীবনেরই উৎস ও অবলম্বন, শস্য ও স্বাক্ষর। অতএব জীবনের প্রয়োজনেই সাহিত্যাদি কলার এত আয়োজন।

আজকের দিনে আমাদের পরিবর্তমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক জীবনের প্রয়োজন পূরণ লক্ষ্যে আঁকিয়ে-লিখিয়ে-গাইয়েদের ভাব-চিন্তা-কর্ম নিয়োজিত হওয়া আবশ্যিক। ব্যক্তিজীবনে মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র, সামাজিক জীবনে সাম্য ও স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক জীবনে সংস্কারমুক্তি ও গ্রহণশীলতা, আর্থিক জীবনে সমসুযোগ ও সুবিচার রাষ্ট্রিক জীবনে দায়িত্ব-চেতনা ও অধিকারবোধ প্রভৃতি কাম্যবস্তু লাভের সহায়ক হতে হবে আমাদের আঁকিয়ে-লিখিয়ে-গাইয়েদের সাধনা।

একটি অলস-চিন্তা

সুস্থ ও রুগ্ণলোকের মন-মেজাজের পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। এমনকি ভরপেট ও ক্ষুধার্ত লোকের মেজাজেও মাত্রাভেদ লক্ষণীয়। তাহলে মন-মেজাজ ও স্বভাবের সঙ্গে শরীর-স্বাস্থ্যের যোগ ঘনিষ্ঠ ও অবিচ্ছেদ্য। একারণেই মনে হয় বাল্যে-কৈশোরে-যৌবনে-প্রৌঢ়ত্বে ও বার্ধক্যে মানুষের মন-মেজাজের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে।

আবার মানুষের স্বভাবের অভিব্যক্তি পরিবেশ-পরিবেষ্টনী নিরপেক্ষ নয়। অকালে আম খাবার আকাক্ষা যেমন জাগে না, তেমনি সাধ্যাতীত বস্তুতেও মানুষ লুব্ধ হয় না। কাজেই প্রাপ্তি-প্রয়াসে মানুষ যা-কিছু করে তাতে সাফল্যের ক্ষীণ সম্ভাবনা অন্তত থাকে, একেবারে অসম্ভব অস্বাভাবিকতার পিছু ধাওয়া করে না। অতএব মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়াসের পশ্চাতে আত্মপ্রত্যয় ও সাফল্য-বাঞ্ছর ভিত তৈরি থাকে। বিভিন্ন বয়স ও বিভিন্ন শারীরিক অবস্থা এ কাক্ষা ও প্রয়াস নিয়ন্ত্রণ করে। এক বয়সে যা তুচ্ছ, অন্য বয়সে তাই মুখ্য। কেবল তা-ই নয়, এক মুহূর্তে যা প্রাণের প্রেরণা অন্য মুহূর্তে তা ত্রাসের উৎস। যে-সুন্দরীকে কাছে পেয়ে চিত্তে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হল, পরমুহূর্তে তার অঙ্গে কুষ্ঠ কিংবা অন্য ভয়াবহ রোগের লক্ষণ প্রত্যক্ষ করে ত্রস্ত মন ঘৃণায় ও ভয়ে শিউরে উঠল। যে নব অনুরাগী প্রেম-স্বপ্নের মাধুরী উপভোগে রত, বাস্তু-বিকিয়ে যাওয়ার আকস্মিক সংবাদে হতাশার তুলে সে মুহূর্তে বিপর্যস্ত। যাকে না হলে জীবন অচল, সে-প্রেয়সীর মৃত্যুর পরেই নতুন নীড়ের স্বপ্ন ওঠে জেগে।

কাজেই কেবল কাল নয়, পরিবেশও মানুষের মন-মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে। দৈহিক পরিবর্তনও ঘটায় মন-মেজাজের বদল। ষাঁড় বলদ হয়ে কেবল দেহে নয়, স্বভাবেও পায় গাভীর রূপ। পাঠা খাশি হয়ে অবয়বে ও স্বভাবে হয়ে ওঠে ছাগী। খোঁজারাও হয়তো হারাত পুরুষসুলভ মেজাজের অনেকখানি, যদিও মানুষ হিসেবে কৃত্রিম মানস ও সামাজিক অনুশীলনে পুরুষালি বজায় রাখার চেষ্টা ছিল তাদের।

অতএব, স্বভাবের পূর্ণ ও অকৃত্রিম অভিব্যক্তির জন্যে আঙ্গিক সম্পূর্ণতা ও স্বাস্থ্যের পূর্ণতা প্রয়োজন। ভর-যৌবনেই কেবল তা সুস্থ মানুষে লভ্য। কিন্তু মানুষের পূর্ণতার আরো এক গুরুতর বাধা রয়েছে। বিশ্বাস-সংস্কার ও আর্থিক-সামাজিক প্রভাবও কিছু বিকৃতি ঘটায়। তাই মানুষ জীবনে হয়তো কখনো সচেতনভাবে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে না। কর্মে, চিন্তায় ও অনুভবে মানুষের অভিব্যক্ত আচরণ তাই কখনো স্বচ্ছন্দ ও স্বাভাবিক নয়–কৃত্রিম ও আড়ষ্ট। তাই ক্ষোভ, শোক, ক্রোধ, ঘৃণা, প্রতিহিংসা প্রেম-প্রীতি, স্নেহ, শ্রদ্ধা, আনন্দ, উল্লাস, দুঃখ, বেদনা, রিরংসা প্রভৃতি বৃত্তি প্রবৃত্তির প্রকাশ স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে বিভিন্ন। তবু ক্ষণে ক্ষণে অবচেতন মুহূর্তে চিত্তের সাবল্য বা দৌর্বল্যবশে মানুষ স্বরূপে ধরা দেয় বিদ্যুতের মতোই তা ক্ষণস্থায়ী বটে, কিন্তু তা-ই তার স্বরূপ। মানুষকে তা-ই ক্ষণ-প্রভায় বিচার করলেই তাকে যথার্থভাবে চেনা-বোঝা যায়। তার প্রাত্যহিক রূপ একটা সামাজিক সাংস্কারিক মুখোশ মাত্র।

.

০২.

শৈশবে-বাল্যে-কৈশোরে পরনির্ভরতায়, যৌবনে স্বনির্ভরতায়, প্রৌঢ়ত্বে সতর্কতায়, বার্ধক্যে পরমুখাপেক্ষীর অসহায়তায় জীবন হয় অবসিত। অতএব, জীবনে যৌবনই হচ্ছে চরম ও পরম লগ্ন। কিন্তু তার আবির্ভাব সম্বন্ধে সচেতন হতেই মানুষ উত্তর-তিরিশে পা রাখে, আর তার তিরোভাবের অনুশোচনা জাগে চল্লিশে। তাই সচেতনভাবে যৌবনের মর্ম উপলব্ধি ও স্বাদ উপভোগ করতে প্রয়োজন হয় প্রৌঢ়ত্বের কল্পনা ও স্মৃতির রোমন্থন। তখন হৃতযৌবনের কান্নায় ভরে ওঠে বুক। সম্পদ প্রাপ্তির আনন্দকে ম্লান করে দেয় অতীতকে হারানোর বেদনা। ঠিক সময়ে ঠিক কথাটি কখনো মনে জাগে না, যথাসময়ে তাই যথাকৰ্তব্য করাও হয় না; তাই এ বেদনা, সে কারণেই এ ক্রন্দন। তাই We donot know what we are missing today–চিরসত্য ও চিরন্তন Tragedy-র উৎস হয়ে রয়েছে।

যদি চেতনা দিয়ে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ-উপলব্ধি করা যেত, যদি ভ্রান্তির ও অবহেলা-ঔদাসীন্যের অনুশোচনার দংশনমুক্ত হত জীবন, যদি ব্যর্থতার ও হতবার বেদনাবিহীন হত চিত্তলোক, তা হলেই কি জীবন সুখের হত? মনে হয় না। দুঃখ-বেদনা-ব্যর্থতার ছেদ-দাহ-ঘা না থাকলে চেতনার অপমৃত্যু ঘটত; তার বড় প্রমাণ আমরা যখন দিনের পর দিন মাসের পর মাস শারীরিক সুস্থতা ভোগ করি, তখন মুহূর্তের জন্যেও মনে হয় না যে আমি সুস্থ, আঙ্গিক বেদনামুক্ত এবং সেজন্যে সুখী, সে কারণেই আনন্দিত।

দুঃখ-সুখের তরঙ্গায়িত চেতনাই জীবন। তাই দুঃখবিহীন চেতনা দুর্লভ আর সুখবিহীন জীবন অকল্পনীয়। অভাবিক সৌভাগ্য, অযাচিত প্রাপ্তি, অকারণ ব্যর্থতা, অসঙ্গত যন্ত্রণা, অযৌক্তিক বঞ্চনার অসমঞ্জস সমষ্টিই জীবন। একে উপেক্ষা করা যায় না বলেই স্বীকার করে নিতে হয়।

তাই কোনো দুটো জীবনের বোধে, উপভোগে, দুর্ভোগে কিংবা যন্ত্রণায় মিল নেই। অভিন্ন পরিবেশেও সবলে-দুর্বলে, সুস্থে-রুগুণে, যুবকে-প্রৌঢ়ে, বীরে-ভীরুতে, পণ্ডিতে-মূর্থে, ধনীতে-দরিদ্রে, নির্বোধে-বুদ্ধিমানে সুখ-দুঃখের বোধ–স্থান, কাল ও মাত্রা ভেদে বিভিন্ন।

.

০৩.

জীবনে হতাশা, ব্যর্থতা ও বেদনা আছে বলেই মানুষ সুখের কাঙাল ও সহানুভূতির প্রত্যাশী। এইজন্যে মানুষ অন্য মানুষকে বিশ্বাস করে, ভালোবেসে তার উপর ভরসা রেখে বাঁচতে চায়। নিশ্চিন্ত হতে চায় এইটুকু জেনে যে তার জন্যে ভাববার, তাকে বিপদে সাহায্য করবার, তার দুঃখে বিচলিত হবার লোক আছে। এরূপে বিশ্বাসে, ভালো বাসায় ও ভরসায় আশ্বস্ত হয়েই মানুষ বাঁচে। সে ভালোবাসে, ভালোবাসা পায়, তাই জীবনের প্রতি সে আসক্ত, জগতের মমতায় মুগ্ধ। তাই পৃথিবী সুন্দর ও আনন্দময়, জীবন মধুময় ও লোকপ্রিয়। কাজেই বেদনা ও ব্যর্থতার অভিঘাত ও আশঙ্কাই মানুষে মানুষে মিলনসূত্র। গোড়াতে জীবনের অবলম্বন মাতাপিতা, ভাইবোন; তারপর স্বামী বা স্ত্রী ও সন্তান; তারও পরে আত্মীয়-বন্ধু। সুখে-শোকে, আনন্দে-বেদনায়, সম্পদে-বিপদে এদের সাহচর্য, সান্নিধ্য, সহায়তা, সহানুভূতি ও সহযোগিতা না হলে কারো চলে না। রুগণমানুষ প্রিয়-পরিজন-পরিচিতের মুখের একটি কথার জন্যে, হাতের একটু স্পর্শের জন্যে, সান্নিধ্যের এতটুকু উষ্ণতার জন্যে, একটু মমতার দৃষ্টির জন্যে কত যে লালায়িত, উৎকণ্ঠ, উনুখ ও আকুল থাকে, তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।

অতএব, মানুষ বিশ্বাস-ভরসা ও ভালোবাসাকে পাথেয় করেই বাঁচে। তাই বিশ্বাস- ভরসা ভালোবাসার পাত্র-পাত্রী থেকে আঘাত পেলে মানুষের জীবন বিষিয়ে ওঠে, বাঁচা অর্থহীন হয়ে পড়ে। পৃথিবী হয়ে ওঠে বাসের অযোগ্য। ম্লান হয়ে ওঠে সমাজ-সংসার। এই বিশ্বাস-ভরসা ও ভালোবাসার বন্ধনেই অনাত্মীয়-অপরিচিত হয় পরমাত্মীয়। তাই স্ত্রী বা স্বামীর মতো আপন আর

আবার গোড়ার কথায় ফিরে আসতে হয়। কেননা এমনি অবস্থায় কেবল দেহে-মনে সুস্থ লোকই বেপরওয়া হয়ে বাঁচতে পারে। এবং বেপরওয়া জীবনেই প্রাণধর্ম পায় তার স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। অতএব, যার জীবনে বিশ্বাস-সংস্কার ও সমাজের প্রভাব যত কম, সে তত বেশি মুক্ত মানুষ। অকৃত্রিম জীবন-চেতনা, অবিমিশ্র জীবন-সত্য লাভ কেবল সর্বপ্রকারের বন্ধনমুক্ত মানুষের পক্ষেই সম্ভব। তার জন্যে চাই দেহ-মনের যৌবন। কেননা সুস্থ যুবক-যুবতীই কেবল বাঁচতে জানে বিরুদ্ধ পরিবেশে আর কেউ নয়।

আর সব হৃত-যৌবনের কান্নায় কাতর। এমনি এক হৃত-যৌবনের কান্না শুনি মোহিতলালের এক কবিতায় :

আমার সকল কামনা ফোটেনি এখনো
ফোটেনি গানের শাখে।
চৈত্র নিশীথে বসন্ত কাঁদে দ্বারে হেরি বৈশাখে ইত্যাদি।

আর সবার কাছে জীবনতত্ত্ব নানা বাহ্যরঙে রঙিন, খণ্ড-চেতনায় খণ্ডিত। তাই আজো তথ্যরূপী তত্ত্ব এত বিচিত্র ও বহুধা। জীবন-সত্যকে এভাবে কোনোদিন সমগ্র সত্তায় পাওয়া যাবে না। তাই মানুষের জীবন সম্পর্কে ধারণ থাকবে বিচিত্র, তার রহস্য থাকবে চিরআবৃত।

একটি আষাঢ়ে চিন্তা

মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি বিকাশের মূলে যৌন সংযমের দান অনেকখানি। বলতে গেলে যৌন নিয়ন্ত্রণই সমাজ সংস্থার ভিত্তি। এই যৌনজীবন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা স্থাপন এবং পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণ ও আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করা সম্ভব ও সহজ হয়েছিল।

এ উদ্দেশ্যেই অপ্রতিরোধ্য ও অপরিহার্য জৈবিক প্রয়োজন ও সৃষ্টিসম্ভব প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের ঘৃণা–সে কারণে লজ্জা-জাগানো আবশ্যিক হয়ে ওঠে।

দেহ-মনের বিকাশ ও স্বাস্থ্যের জন্যেও এর প্রয়োজন ছিল। কেননা, যোগ-সাধনায় এই যৌন সংযমই মূল সাধ্য। পরবর্তীকালে যোগতত্ত্ববিদ বলেছেন, যদি স্বাস্থ্য, দীর্ঘজীবন ও কায়াসাধনায় সিদ্ধি পেতে চাও তাহলে রমণ করবে

মাসে এক বছরে বারো
আরো যত কমাইতে পারো।

আজকের দিনেও কামুকতা ঘৃণ্য এবং লাম্পট্যই মানুষের চরিত্রে মুখ্য দোষ বলে বিবেচিত। এটিরই রূপক রয়েছে শামীয় (Semetic) পুরাণে ও ধর্মগ্রন্থে।

আদম-হাওয়া ছিলেন স্বর্গে। তাদের লজ্জা ছিল না, ছিল না কোনো গ্লানি বা পাপবোধ। তাঁরা নারী-পুরুষ হলেও যৌন-সম্পর্ক তাদের ছিল না। যৌনতা ছিল তাদের অজ্ঞাত। যৌনবোধ তখনো তাঁদের অনুভবের বাইরে। এঁরা একে অপরের সাথীমাত্র। আদমের নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গিনী হিসেবেই হাওয়ার সৃষ্টি–আদমের প্রতি জেহোভার প্রথম অনুগ্রহ তাঁর প্রথম উপহার। বোঝা যাচ্ছে, নারী সৃষ্টির পরিকল্পনা জেহোভার আদৌ ছিল না। আদমের আনন্দ সহচরীরূপেই হাওয়ার উদ্ভব এবং জেহোভার দ্বিতীয় চিন্তার দান।

স্বর্গে আদম-হাওয়া ছিলেন বন্ধ্যা, উলঙ্গ ও লজ্জাহীন। কেননা রতি-রমণ ছিল তাদের অজ্ঞাত। সর্পরূপী শয়তান গিয়ে প্রভাবিত ও প্রলুব্ধ করল হাওয়াকে। উল্লেখ্য যে, সাপ কামবিষের ও প্রজনন শক্তির প্রতীক। শয়তানের সর্পবেশ ধারণ সে-কারণেই। সে খাওয়া নিষিদ্ধ জ্ঞানবৃক্ষের ফল। এ জ্ঞান নিশ্চয়ই যৌনবোধ। কেননা এ ফল ভক্ষণের পর তাদের যে-বোধ জাগল তা দেহ-চেতনা। সে-কারণেই তারা বৃক্ষপত্রে আবৃত করলেন তাঁদের দেহের যৌনাবেগ জাগাতে সমর্থ তেমন স্থানগুলো।

রূপকের আবরণ উন্মোচন করলে বোঝা যায়, এই গল্পে আদি মানব-মানবীতে যৌনবোধের উদয়-রহস্য বিবৃত। কায়িক সান্নিধ্যে ও স্পর্শে যৌনবোধের দীক্ষা হল উভয়ের। তারপর চিত্ত স্থৈর্যের প্রয়োজনে তারা দেহে দেন আবরণ। এই সচেতন সংযম-প্রয়াসই অভ্যস্ত লজ্জা ও সংকোচের রূপ নেয়। জীবজগতে নারীই রজস্বলা হয় সৃষ্টির প্রয়োজনে। কাজেই যৌনাবেগ প্রাকৃতিক নিয়মেই অপ্রতিরোধ্য হয় নারীতে। এজন্যেই হাওয়াই হলেন কামের প্রথম শিকার-কামবিমোহিতা। সেই থেকে নারী দোযখের দ্বার।

যৌনবোধে জাগ্রত নর-নারীকে নবাবিষ্কৃত সুখ-রহস্য ও নবলব্ধ অনুভূতি আকুল করেছিল। সুখ-উল্লাসে তারা তখন আত্মহারা। যৌনতায় নিমগ্ন মুগ্ধ মানব-মানবীর এই অসংযত কামচর্চা জেহোভা সহ্য করেননি। অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত আদি মানব-মানবী বিক্ষিপ্ত হলেন মর্তে। স্বর্গচ্যুত নর-নারী হলেন সৃষ্টিশীল। রমণ ও প্রজননই ছিল তাঁদের অবশিষ্ট জীবনের ব্রত ও কর্তব্য। অতএব তাদের অপরাধ যৌনবোধ আর পরিণাম হচ্ছে মর্তে বাস, রমণ ও প্রজনন। নইলে তারা চিরকাল থাকতেন স্বর্গে এবং থাকতেন বন্ধ্যা ও লজ্জাহীন এবং হতেন অমর। কাজেই স্বর্গ ও মর্ত্যে পার্থক্য যৌনবোধহীনতা ও যৌনতা। স্বর্গ আনন্দ ও আরামের এবং অজরামরতার, মর্ত্য দুঃখ ও যন্ত্রণার এবং জরামৃত্যুর। অতএব, যৌনবোধহীনতাই স্বর্গ-সুখ আর যৌনতাই দুর্ভোগের আকর। যৌনতা তাই ঘৃণার ও লজ্জার। কাম-বিমুক্তিই ব্রহ্মচর্য ও বৈরাগ্য তথা পবিত্রতা, চিত্তশুদ্ধি ও অধ্যাত্মসিদ্ধির সোপান। যে-যৌনতার কারণে আদি মানব-মানবীর স্বর্গচ্যুতি, মর্তে বাস ও মরণশীলতা এবং যে পাপের দুর্ভোগ কেয়ামত অবধি তাঁদের সন্তানদেরও পোহাতে হবে, সে-যৌনতা ঘৃণ্য না হয়ে পারে না। তাই শামীয় ধারণায় লাম্পট্য ও অসতীত্বই সবচেয়ে বড় পাপ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

পার্থিব জীবনেও মানুষের আদি পাপের উৎস এই কামুকতা। কাবিল-জীবনে পাপ এই কাম থেকেই উদ্ভূত। কাম থেকেই কাবিলের ঈর্ষার জন্ম, আর ঈর্ষা থেকেই আসে হাবিল-হত্যার প্রেরণা। সে-থেকেই কামানল আর রূপবহ্নি সংযম-সতর্কতা সত্ত্বেও পোড়াচ্ছে হৃদয়, দগ্ধ করছে গৃহ, পুড়ছে ব্যক্তি, পরিবার, দেশ, রাজ্য ও সমাজ। সে-সব কথা অঙ্গারের অক্ষরে লেখা রয়েছে। রূপকথায়, কাব্যে, উপাখ্যানে ও ইতিহাসে এবং গানে, গাথায়, চিত্রে, নৃত্যে, নাটকে, ভাস্কর্যে ও স্থাপত্যে। এই সর্বভুক অগ্নির দহনের কথা বলে বলেই গাইয়ে-বাজিয়ে-লিখিয়ে-আঁকিয়ে চিরকাল কাঁদিয়েছেন, চিরকাল জ্বালিয়েছেন মানুষকে। আজো মানুষ তেমনি জ্বলছে, তেমনি কাঁদছে এবং . চিরকাল জ্বলবে আর কাঁদবে। মানব সৃষ্টির সঙ্গে তার শুরু আর প্রলয়ে হবে তার শেষ। যৌনবোধ ও যৌনতা জৈবিক বলেই এর নিয়ন্ত্রণ সমস্যাও জটিল এবং দুঃসাধ্য। তাই বলে মানুষ হাল ছেড়ে দিয়ে ভাগ্যের হাতে-প্রকৃতির খেয়ালের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল না। এই জ্বালা ও কান্না, এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত প্রতিরোধ-লক্ষ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে যৌনজীবন। মানুষের এই শুভবাঞ্ছ অনেকখানি সাফল্য পেয়েছে বিবাহ-বন্ধনে। এভাবে মানুষে মানুষে গড়ে উঠেছে দাম্পত্য ও আত্মীয়তা এবং সে-সূত্রে গড়ে উঠেছে পরিবার, পরিজন, গ্রাম, গোত্র ও সমাজ। সমাজ পেয়েছে স্থিতি ও শৃঙখলা। বেশ্যাবৃত্তিও হয়েছে দাম্পত্য সম্পর্কের পরিপূরক এবং সে-সূত্রে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার সহায়ক।

পুরুষ-ভোগ্য নারীর সতীত্বের ধারণাও এর পরোক্ষ ফল। নারীর একনিষ্ঠতাই সতীত্ব। পুরুষের এমন সংযম ও একনিষ্ঠতার প্রয়োজন নেই। তারা বয়েস কালে দোষ যা করে, তা নিন্দনীয় হলেও তেমন ঘৃণ্য ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ নয়। পুরুষ-প্রধান সমাজে পুরুষ নিজেদের জন্যে এ সুবিধেটুকু রেখেছে। নারী তার কাছে সোনা-রুপার মতো মূল্যবান ভোগ্যসম্পদ। সব মূল্যবান সম্পদই অপরের লোলুপতা ও অপহরণ-বৃত্তি জাগায়। তাই নারীকে লোভীর লোলুপ ও লুব্ধ দৃষ্টির আড়ালে রাখতে হয়। তার একনিষ্ঠতা না থাকলে মালিকের স্বার্থে ও চিত্তে ঘা লাগে। এই এক-লগ্নতা তথা মালিক-নিষ্ঠার নাম সতীত্ব।

যৌনজীবনের এই সামাজিক ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণ মানুষের পক্ষে শুভই হয়েছে। দুনিয়াব্যাপী সভ্য ও বর্বর মানুষের হৃদয়-বৃত্তির বিকাশ ও প্রকাশ সম্ভব হয়েছে এই নিয়ন্ত্রণের ফলেই। সাহিত্যে, সঙ্গীতে, নৃত্যে, চিত্রে, ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে মানুষ মূলত তার এই বাধাপ্রাপ্ত যৌন-বৃত্তিরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, স্থূল ও সূক্ষ্ম, অমার্জিত ও পরিশ্রুত অভিব্যক্তি দিয়েছে। এভাবে কামের উন্নয়ন ও উত্তরণ ঘটেছে প্রেমে। এই যৌন অনুভূতি চেতন ও অবচেতন বোধে রূপচেতনা ও অনুরাগরূপে মানুষের চিত্তলোকে মহিমান্বিত বিভায় আত্মপ্রকাশ করেছে।

সহজেই বোঝা যায়, অবাধ কামচর্চা মানুষের অনুভব-উপলব্ধির জগৎ কিছুতেই প্রসারিত করতে পারত না। এ বাধা তাই আশীর্বাদ, এ সংযম তাই কাম্য; এ নিয়ন্ত্রণ তাই সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকাশের মুখ্য মাধ্যম হয়েছে।

বলতে গেলে সর্বপ্রকার কলার আয়োজনই ভালো লাগার ও পেতে চাওয়ার অভিব্যক্তি দানের জন্যে এবং কাম্যজন থেকে ব্যবধানের ও বিচ্ছেদের কিংবা অপ্রাপ্তির যন্ত্রণাকে ধ্বনিত করার জন্যে। তাই দুনিয়ার সব শ্রেষ্ঠ কলাই বিরহজাত-বিরহবোধের দান। বিরহের ও অপ্রাপ্তির বেদনা ও কান্নাই ধ্বনিত হয়েছে সর্বত্র। এজন্যেই শৃঙ্গাররসই আদি, অকৃত্রিম ও সর্বহৃদয়বেদ্য রস।

ফ্রয়েডীয় বিজ্ঞানের অনুসরণে বলা চলে, অবদমিত যৌনবোধ মানুষের চিন্তায়, কর্মে ও অনুভবে রূপ পায়। অন্যকথায় মানুষের জীবনে যা-কিছু অভিব্যক্তি পায়, তার অনেকখানিই যৌনবোধের, যৌনবিকৃতির কিংবা নির্বিঘ্ন যৌনজীবনের দান।

বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে এও হয়তো বলা যায় যে, মানুষের জীবন যতখানি রক্ত-মাংসের তথা দৈহিক বা জৈবিক, ততখানি ভাব-চিন্তা-জ্ঞান ও হিতবোধ লব্ধ নয়। অর্থাৎ মানুষের জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্মের যতখানি প্রাকৃতিক, এতকালের অনুশীলনেও মানুষ তার সিকিভাগও কৃত্রিম তথা স্বসৃষ্ট করতে পারেনি।

একটি প্রত্যয়ের পুনর্বিবেচনা

উনিশ শতকের য়ুরোপে জাতীয়তাবাদ যখন উগ্ররূপ ধারণ করতে থাকে তখন কয়েকটি আনুষঙ্গিক চিন্তাও জাতীয়তাবাদীর মনে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেগুলোর মধ্যে তিনটে প্রধান–স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের সন্ধান ও সৃজন, স্বতন্ত্র সংস্কৃতির রক্ষণ ও উদ্ভাবন, এবং সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র অর্জন।

সাহিত্যের ব্যাপারে সমাজবাদীদের আগ্রহ আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। তারা গণসাহিত্য সৃষ্টির গরজে লোক-সাহিত্যে ও লোক-ঐতিহ্যে অসামান্য গুরুত্ব আরোপ করতে থাকে। নিতান্ত কৌতূহলের আনন্দে যে Folklore-এর চর্চা শুরু হয় শতেক বছর আগে, তা-ই সামাজিক রাজনীতিক মতবাদ দৃঢ়মূল করবার অবলম্বন হয়ে উঠল। আবার সমাজ, সংস্কৃতি ও নীতিবোধের বিবর্তন ধারার ইতিহাসের উপকরণ-উপাদান হিসেবেও Folklore গুরুত্ব পাচ্ছে। আইরিশ, ইসরাইল ও নিগ্রো জাতীয়তা যেমন স্বদেশী ভাষা, ঐতিহ্য ও লোকসাহিত্য অবলম্বন করে বিকাশ কামনা করছে, সমাজ-বিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিকরাও তেমনি Folklore-কে মানব-সভ্যতার ইতিহাস রচনার উপকরণ ও মানব-প্রকৃতি ব্যাখ্যার অবলম্বন করেছেন। কাজেই লোক-ঐতিহ্য ও লোক-সাহিত্য তথা Folklore আজ মানবিক প্রগতির উপকরণ ও উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অতীতকে অতীতের নিরিখে যাচাই করা ও প্রত্যক্ষ করা সদ্বুদ্ধিজাত সদুপায়, সন্দেহ নেই। কিন্তু অতীতকে বর্তমানের ও ভবিষ্যতের পুঁজি করার মধ্যে বুদ্ধিমত্তা কিংবা কল্যাণ নেই–আছে অন্ধ আবেগ যা আপাতদৃষ্টে কেজো বটে, কিন্তু পরিণামে রক্ষণশীলতা ও সংস্কারাচ্ছন্নতার জনক। কেননা, পুরাতনে আসক্তিহীনতা এবং পরিহার-সামর্থ্যই অগ্রগতির স্বাভাবিক সদুপায়। জাতীয় জীবনের জাগরণ মুহূর্তের আবেগ, উৎসাহ ও কর্মোদ্যমকে পুরাতনের প্রেরণা বলে ভুল করার ফলেই পুরাতনকে জীবন-প্রয়াসের মহিমান্বিত উৎস বলে প্রতীতি জন্মায়। পুরাতনের অঙ্গীকারে নতুনের জন্ম-প্রত্যাশা স্ববিরোধী অদ্ভুত চিন্তার প্রসূন। পুরাতনে আস্থাহীনতাই বরং ভবিষ্যতে নতুন প্রত্যয় লাভের সহজ উপায়।

ঐতিহ্য প্রেরণার উৎস বলে চালু কথাটির তাৎপর্য কিন্তু ভিন্ন। যে ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণ অতীতে ব্যক্তিক কিংবা জাতীয় জীবনে কল্যাণ ও সাফল্য এনেছে, তা-ই ঐতিহ্য। দেশকালের প্রেক্ষিতে যা সেদিন মঙ্গলকর ও ফলপ্রসূ ছিল, পরিবর্তিত পরিবেশে তা অহিতকর এবং নিষ্ফলও হতে পারে। কাজেই ঐতিহ্যের অবলম্বন মানে তার অনুকরণ নয়, তার নব রূপায়ণ নয়, তার আশ্রয় গ্রহণ নয়, নয় তার প্রশ্রয় কামনাও, বরং প্রয়োজন ও পরিবেষ্টনীর দিকে দৃষ্টি রেখে হিতকর ও ফলপ্রসূ উপায় গ্রহণ ও রীতি-পদ্ধতির প্রবর্তন। কখন, কী অবস্থায়, কোন্ সঙ্কটে কিংবা সৌভাগ্যে কেমন করে কী করা হয়েছিল তা কিভাবে ব্যক্তিক, পারিবারিক অথবা জাতীয় জীবনকে রক্ষা ও ঋদ্ধ করেছিল, তা স্মরণ করার নামই ঐতিহ্য-চেতনা। অতএব ঐতিহ্যের অনুরণন-অনুসরণ বাঞ্ছনীয় হতে পারে, কিন্তু অনুকরণ কিংবা রূপায়ণ কখনো কাম্য নয়। তাছাড়া অতীতে যারা আমাদের জন্যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন তারাও একে নিত্যকালের জন্যে ধরে রাখেননি। তাঁরা নতুন নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন আমাদের জন্যে তাঁদের প্রাত্যাহিক ভাব-চিন্তা-কর্ম ও আচরণের মাধ্যমে। একবারের সৌভাগ্যের ও সাফল্যের উপায়কে তারাও চিরকালের উপায় বলে গ্রহণ করেননি। তাই ঐতিহ্যমাত্রই অতীতের। সেই পরিত্যক্ত রীতি-পদ্ধতি ও কর্মচিন্তা লোকস্মৃতির প্রশ্রয়ে কিংবদন্তির আশ্রয়ে বেঁচে থাকে কালান্তরে। স্রষ্টারই পরিত্যক্ত সামগ্রীকে তার উত্তর পুরুষেরা মহামূল্যজ্ঞানে যদি পাথেয়রূপে জীবনযাত্রায় প্রয়োগ করে, তাহলে তাদের চলা চক্রের আবর্তন বই কিছুই নয়। ব্যবসায় মূলধন যেমন উপার্জনের ভিত্তি, ঐতিহ্যের পুঁজিও তেমনি অগ্রগতির সহায়। মূলধনে হাত পড়লে ব্যবসা টেকে না, তেমনি ঐতিহ্য আঁকড়ে বসে থাকলেও গতি হয় রুদ্ধ।

আবার উদ্যমহীন নিষ্কর্মার ঐতিহ্যপ্রীতি ও ঐতিহ্যর্গব আরো মারাত্মক। ধনী-সন্তানের সম্পদ চেতনা যেমন, ঐতিহ্যগবীর গৌরব-স্মৃতিও তেমনি তৃপ্তমন্যতা জাগায়, যা প্রয়াসহীন জীবন যাপনে উৎসাহিত করে। তৃপ্তমন্য গৌরব-গী পরিবার কিংবা জাতির পতন অনিবার্য। অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস–দু-ই এই আপ্তবাক্যের যাথার্থ্য সমর্থন করে।

নিজের ভাব-চিন্তা প্রকাশের জন্যে মানুষ যখন তার চারপাশে কোনো আধার বা অবলম্বন খুঁজে পায় না, তখন সে অতীতের দিকে ফিরে তাকায়; অতীতের ঘটনা, চিন্তা বা কাহিনী সে উপস্থাপিত করে বর্তমানের ভাব-চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে এবং উপমা রূপক ও উৎপ্রেক্ষারূপে অথবা কাহিনীরূপে ব্যবহৃত হয়ে তা ভাবকল্প ও চিত্রকল্পের অবয়বে তখন আত্মপ্রকাশ করে। অতীতকে এভাবে বর্তমান করে তোলাতে দোষ নেই। কিন্তু বর্তমানকে স্বকালে, স্বস্থানে ও স্বরূপে খুঁজতে না-জানার অসামর্থ্যের কিংবা বর্তমানকে দিয়ে বর্তমানের ভাব-চিন্তা প্রকাশের অক্ষমতার স্বাক্ষর থাকে। কাজেই ঐতিহ্য-নির্ভরতা বর্তমান অবস্থার পরোক্ষ প্রকাশের বাহন মাত্র–প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তির উপায় নয়। অতএব সাহিত্যশাস্ত্রবিদ যখন বলেন :

An Artist of the first rank accepts tradition and enriches it, an artist of the lower rank accepts tradition and repeats it, and artist of the lowest rank rejects tradition and strives for originality. (Sampson)

তখন কথাগুলো শুনতে চমকপ্রদ বটে; কিন্তু সত্যের বিপরীত। যেমন ঔপন্যাসিক তাঁর চারদিকে কোনো উপকরণ যখন খুঁজে পান না, তখন তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে আনন্দিত হন।

অপরের সৌভাগ্যে ও পীড়নে যারা ঈর্ষ ও ক্ষুব্ধ অথচ অসহায় ও অক্ষম, তাদের চিত্তে জন্ম নেয় Revivalism-এর স্বপ্ন। তাদের বর্তমান অযোগ্যতা তাদেরকে অতীত গৌরবগবী করে তোলে। তাতে তারা বর্তমানের আত্মগ্লানি ও আর্তনাদ গৌরবময় ঐতিহ্যের আস্ফালনে ঢাকা দিতে চায়। বর্তমান দীনতার দুঃখ-লাঞ্ছনা ভুলবার উপায় হিসেবেই ঐতিহ্যের আশ্রয়ে তারা প্রবোধ ও প্রশান্তি খোঁজে। উপার্জনে অক্ষম ব্যক্তির যেমন পিতৃসম্পদেই ভরসা ও নির্ভরতা, Revivalism এ আসক্তিও অনেকটা সেইরূপ। অতএব Revivalism অক্ষমের সান্ত্বনা। পুরাতনকে পুনরুজ্জীবিত করার আগ্রহের মধ্যেই রয়েছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রত্যাশাহীনতা। বর্তমানে কিছু করবার নেই, ভবিষ্যতে কিছু পাবার কিংবা হবার নেই–এমনি প্রতায়হীনতাই মানুষকে করে অতীতমুখী। তাদের চোখে পৃথিবী যেন সহসা এক জায়গায় আকস্মিকভাবে স্তব্ধ ও স্থবির হয়ে যায়। তার গতিপ্রবাহ যেন চিরকালের জন্যে থেমে গেল, যেমন এগুবার আর উপায়ও নেই, প্রয়োজনও নেই। কাজেই বর্তমানে না কুলায় তো অতীতের সঞ্চিত সম্পদ কাজে লাগাও, দুর্দিনের সম্বল কর। কেননা অতীতের সে-পরিবেশে আমাদের পূর্বপুরুষ একদিন স্বগৌরবে, স্বশক্তিতে ও স্বমহিমায় বেঁচেছিলেন–কাজেই অতীতের সেই কোটরই অভয়-শরণ –তখন এমনি অপবুদ্ধি মনে সহজেই জাগে। Revivalism-এ মনের বিকাশবিস্তার হওয়া তাই অসম্ভব।

মানুষের চোখ দুটো যখন সম্মুখেই স্থাপিত আর পায়ের পাতাও সামনের দিকেই প্রসারিত তখন বুঝতে হবে–মানুষের সম্মুখদৃষ্টি আর অগ্রগতিই ছিল বিধাতার অভিপ্রেত। কাজেই পিছুহঠা বিকলাঙ্গ অন্ধের অনাচার মাত্র।

বর্তমানে উৎকৃষ্টতর কিংবা যোগ্যতর কিছু না পেলে অথবা ভবিষ্যতে পাবার আশা বা বিশ্বাস না জাগলে কেউ অতীতকে পরিহার করে না। কাজেই পরিত্যক্ত অতীতের ভাব-চিন্তার সামগ্রীমাত্রই বর্তমান ভাব, চিন্তা ও কর্ম থেকে নিকৃষ্ট কিংবা অপূর্ণ। কেননা মানুষের অভিজ্ঞতা ও প্রয়াস মানুষের নৈপুণ্য বৃদ্ধি করছে–সামগ্রিকভাবে তার মানসিক ও বৈষয়িক জীবন প্রতি মুহূর্তে উৎকর্ষ লাভ করছে। এজন্যেই তো বলা হয়েছে অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভালো হবে রে ভবিষ্যৎ। পুরোনো জীবনযাত্রার কোনো অবলম্বনই আমাদের শ্রদ্ধা জাগায় না, চরম তাচ্ছিল্যে পরিহার করি সেসব, কেননা সেগুলো উপযোগ হারিয়েছে। অথচ পুরোনো কালের ভাব-চিন্তা-আদর্শ-বিশ্বাস সংস্কারেরই কেবল উপযোগ রয়ে গেল, নিরাসক্ত মনে এ বোধ ঠাই পায় না। কিন্তু আবেগপ্রবণ মনে এ বোধের প্রভাব অশেষ ও অনড়। তবু যুক্তিপ্রবণ বুদ্ধিজীবীর কাছে আবেদন করা চলে এই বলে যে,

ছিন্নমালার ভ্রষ্ট কুসুম ফিরে যাসনে কো কুড়াতে
ফুরায় যা–দে রে ফুরাতে

কেননা ওতে কল্যাণ নেই।

এখানে আইরিশ Revivalism-এর কথা কারো কারো মনে জাগতে পারে। ইংরেজের সৌভাগ্য ও পীড়নই আইরিশদের স্বাতন্ত্রকামী করেছিল। দুর্বলের স্বাতন্ত্র কামনা হীনমন্যতার এক পরোক্ষ প্রকাশ। যারা আত্মশক্তিতে আস্থাহীন অথচ মুক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যকামী তাদের মনেই স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রবল হতে থাকে। এবং যেহেতু নিজে সামর্থ্যহীন তাই অতীত সামর্থ্যের সঞ্চয়কে সম্বল করে সে নিজেকে ভাবে ঋদ্ধ ও সম্মানিত। এখন আমার কিছু নেই বটে, কিন্তু কী না ছিল আমার এককালে–এমনি একটা বোধের আশ্রয়ে সে আত্মস্থ হতে চায়, জাগ্রত করতে চায় আত্মসম্মানবোধ। আসলে সে মনকেই চোখ ঠাওরায় এভাবে। কেননা তার মধ্যে সদাজাগ্রত আকাঙ ক্ষা ও উদ্যমই তাকে শক্তি দান করে মুক্তিলাভের–প্রেরণা দেয় সংগ্রামের। সে মনে করে–বুঝি এসব ঐতিহ্য-চেতনা ও স্বাতন্ত্র-বুদ্ধির দান। কিন্তু তা যে নয়, তার প্রমাণ আজকের প্রগতিশীল বিজ্ঞান ও যন্ত্রজীবনের সঙ্গে সম্পর্ক বিরহিত হয়ে সেও টিকতে পারে না–পারে না এগুতে। সে বেঁচে আছে বর্তমানকে বরণ করেই, অতীতকে ধরে নয়।

স্বাতন্ত্রকেও তার স্বরূপে গ্রহণ করা উচিত। যোগ্যের উৎকর্ষই তার স্বাতন্ত্র। কেবল অযোগ্যরাই আত্মসংকোচনকে স্বাতন্ত্র মনে করে আত্মপ্রবোধ ও আত্মপ্রসাদ লাভ করে। সবলের স্বাতন্ত্র আত্মপ্রসারে ও আত্মপ্রভাব বিস্তারে প্রবর্তনা দেয়। আর দুর্বলের স্বাতন্ত্র্যবোধ ছোঁয়া ও প্রভাব এড়িয়ে চলার আগ্রহ জাগায়। দুর্বলের এ পদ্ধতি কেবল হীন ও নির্বোধের কাজেই প্রশংসনীয়।

কেউ কেউ য়ুরোপীয় রেনেসাঁসে রিভাইভেলিজমের লক্ষণ খুঁজে পান। রেনেসাঁস কোনো একদিনের ব্যাপার ছিল না। আড়াইশ বছরের পরিসরে তার উন্মেষ, বিকাশ ও পরিণতি ঘটেছে। ইতিমধ্যে য়ুরোপে ভাঙা-গড়ার বহু ও বিচিত্র আন্দোলন ও ঘটনা ঘটে গেছে, ফ্লোরেন্সের লিও নার্ডো দা-ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) কেবল সৌন্দর্যপিপাসু চিত্রশিল্পী ছিলেন না; মনীষী, বিজ্ঞানী এবং ভাস্করও ছিলেন। মাইকেল এ্যাঞ্জেলো ছিলেন ভাস্কর ও স্থপতি। রাফেলও কেবল শিল্পী ছিলেন না, জীবন-জিজ্ঞাসুও ছিলেন। এই ফ্লোরেন্সেই জন্মেছিলেন তেরো শতকে কবি দান্তে ও চৌদ্ধ শতকে কবি পেত্রার্ক। পনেরো, ষোলো ও সতেরো শতকে নেদারল্যান্ডের মুক্তিসংগ্রাম কলম্বাস-ভাস্কো-ডা গামার সমুদ্রপথে নতুন দেশ আবিষ্কার ও অপরিমেয় ধনাগম, ফলে সামন্তসমাজে বেনে-বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব, কৃষক-বিদ্রোহ, মুদ্রারীতির প্রসার; যাজক ও শাসকের, সামন্ত ও বুর্জোয়ার বিরোধ, Inquisition-এর বিরুদ্ধে Huss ও মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে গণবিদ্রোহ, কোপারনিকাস-ব্রুনো গ্যালিলিওর উচ্চারিত তথ্য, ছাপাখানার প্রবর্তনে বিদ্যার বিস্তার, বাইজেনটাইন গ্রীক বিদ্বানদের য়ুরোপে পুনর্বাসন প্রভৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই ছিল রেনেসাঁসের মূলে।

এসব আর্থনতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনীতিক ও কলা-বিদ্যা-জ্ঞান-চিন্তাবিষয়ক আন্দোলন বিদ্রোহ-বিপ্লব –রেনেসাঁস, রিফরমেশন ও রেভলিউশন –এ তিন শাখায় সংহত রূপ নিয়েছে ঐতিহাসিকের চোখে। এই পুনরুজ্জীবন, সংস্কার ও বিপ্লবের মূলে যে-প্রেরণা যে-উদ্যম ক্রিয়াশীল ছিল তা ছিল এক কথায় মুক্তি-অন্বেষা। পীড়ন থেকে, কুসংস্কার থেকে, বদ্ধচিত্ততা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, অজ্ঞতা থেকে, দুর্বলতা থেকে, ভীরুতা থেকে মুক্তির অভিব্যক্ত উল্লাসের নাম রেনেসাস। সুতরাং এখানে রিভাইভেলিজমের দান কোথায়!

মুখ্যত মুসলিমদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর বাজেন্টাইন গ্রীকবিদ্বানেরা যখন য়ুরোপে ছড়িয়ে পড়েন, এবং টোল খুলে তারা যখন মুদ্রিত গ্রন্থের মাধ্যমে বিদ্যাবিতরণ করতে থাকেন তখন শিক্ষার আলোপ্রাপ্ত চিত্তে যে জীবন-চেতনা জাগে, সে-চেতনায় তারা জগতের ও জীবনের নতুন রহস্য আবিষ্কার করে। নতুন দৃষ্টিতে খুঁজে পায় জগৎ ও জীবনের নতুন তাৎপর্য। জানার ও পাওয়ার সে-উল্লাসই তাদেরকে নতুন ভাব-চিন্তা-কর্মে প্রবর্তনা দেয়। উপকরণ ও মাধ্যম হিসেবে তারা প্রথমে গ্রীক পুরাণকেই গ্রহণ করে এবং এভাবে তারা জীবনের সৌন্দর্য ও আনন্দকে অভিব্যক্তি দান করতে থাকে। তাদের অনুভবে তখন তাদের সমকালীন পরিবেষ্টনী তুচ্ছ ও সাময়িক। তাই তাঁদের স্বপ্নের, কল্পনার ও আর্দশের জগৎ রচনার উপকরণ হয়েছে প্যাগান ও খ্রীস্টীয় পুরাণ। এই রোমান্টিক জগৎ ও জীবন-দৃষ্টিতে যে-কৌতূহল, যে-জিজ্ঞাসা, যে-সৌন্দর্য-চেতনা, যে-শিল্পবোধ, যে-রূপানুরাগ ও যে-আত্মসচেতনতা সুপ্রকট তা নবলব্ধ চেতনা, নতুন-জাগা আকাঙ্ক্ষা, নতুন পাওয়া উদ্যম ও মুক্তি-অন্বেষারই অভিব্যক্তি। কাজেই তা প্যাগান-পুরাণ-প্রীতির ফল নয়। গ্রীক পুরাণের অপরিমেয় ও অনবরত ব্যবহার দৃষ্টিকে এতই বিভ্রান্ত করে যে আমরা অবলম্বনকে কারণ ও উপকরণকে প্রেরণার উৎস ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এভাবে উপায়কে মনে করেছি কারণ বলে আর অবলম্বনকে জেনেছি লক্ষ্য বলে। প্রাণের প্রেরণা ও চেতনার দান রইল অস্বীকৃত ও অগোচর।

দেশী দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথে পুরাণের ব্যবহার প্রাচীন ভারতকে ফিরে পাবার অভিপ্রায়প্রসূত যে নয়, নতুন-জাগা চেতনা প্রকাশের মাধ্যম মাত্র, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই রিভাইভাল নয়, নবচেতনাই জীয়নকাঠি।

কারো কারো চিন্তায় রেনেসাঁস ও রিভাইভাল সমার্থক হয়ে গেছে। যেন একটির সঙ্গে অপরটির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। যেন রিভাইভালিজমই রেনেসাঁসের প্রসূতি অথবা রেনেসাঁসই রিভাইভালিজমের জনক কিংবা অগ্রজ; অর্থাৎ একটি অপরটির কখনো কারণ এবং কখনো ফলরূপে প্রতীয়মান। এমনকি বাঙলা তর্জমায় পার্থক্য প্রায় দুর্লক্ষ্য। শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য, স্থাপত্যাদি কলা কিংবা চিন্তার ক্ষেত্রে নবজন্ম, নবজাগরণ, পুনরুজ্জীবন, পুনর্জীবন, পুনর্জাগরণ, পুনরভ্যুদয়, পুনরুদ্দীপন, পুনরুদ্যম, পুনরুদ্বোধন প্রভৃতি অর্থেই শব্দদুটো ব্যবহৃত হয়। সাধারণ অভিধা হচ্ছে রিভাইটালাইজেশন। যে-ঐতিহ্য যে-অতীত ভরে তুলে না, কেবলই ধরে রাখে; যে tradition অগ্রগতির অন্তরায় তা পরিহার করবার, তার প্রতি নির্মম ও বীতরাগ হবার শক্তি থাকা চাই– নইলে আবেগের ঘূর্ণিপাকে অপচিত হবে জাতীয় সব প্রয়াস।

কাজেই প্রাণে প্রেরণা, চিত্তে চেতনা এবং মনে স্বতঃউৎসারিত উদ্যম না জাগলে, কেবল ইতিহাস পাঠের ফলশ্রুতির অনুসরণে কিংবা অনুকরণে revivalism-এর চর‍্যা গ্রহণ করলেই রেনেসাঁস আসবে না অথবা রেনেসাঁস এসেছে কল্পনা করে revival-এর উৎসাহ-বোধ করলেই প্রয়াস সফল ও সার্থক হবে না। মনে রাখা দরকার, যাত্রা অভিন্ন হলেও ফল ভিন্ন হতে বাধা নেই। বস্তুত প্রায়ই ভিন্ন হয়। তাছাড়া অনুকৃতিতে নির্বোধ পায় আনন্দ, বুদ্ধিমানে পায় লজ্জা।

ঐক্যসূত্র

প্রাণী হিসেবে মানুষ একটা Species বা প্রজাতি। এ কারণে মানুষ মাত্রেরই জীবন- চেতনায় কতগুলো মৌলিক ঐক্য রয়েছে। ঘৃণায় ও ভালোবাসায়, লোভে ও ত্যাগে, ক্ষমায় ও প্রতিহিংসায়, সমাজবোধে ও সহযোগিতায়, দায়িত্বচেতনায় ও কর্তব্যবোধে, দ্বন্দ্বে ও সংগ্রামে মানুষ প্রায় সর্বত্রই অভিন্ন। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বোধের তারতম্য বা মাত্রাভেদ আছে মাত্র।

আবার প্রাচীন গোত্রীয় সমাজভুক্ত মানুষে কিংবা পরবর্তীকালের ধর্মীয় মতভুক্ত সমাজেও একপ্রকার আচারিক ঐক্য মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেছে।

তাছাড়া, ভৌগোলিক পরিবেষ্টনীগত অভিন্নতাও মানুষের জীবনযাত্রায় ঐক্যদান করে।

কাজেই মানবিক ঐক্য, গোত্রীয় ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, ভৌগোলিক ঐক্য ও ভাষিক ঐক্য মানুষের মনে, মননে ও ব্যবহারিক জীবনযাত্রায় তাদের স্ব স্ব প্রভাব রাখে।

এদের প্রত্যেকটিরই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। কখনো অভিন্ন ভাষার প্রভাবে কখনো অভিন্ন ধর্মের প্রেরণায়, কখনো ভৌগোলিক জীবনের প্রয়োজনে, কখনো গোত্রীয় আকর্ষণে অতীতে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনে ও জীবিকায় বিকাশ, প্রসার ও সমৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। এখনো যে তা একেবারে অবলুপ্ত তা বলা যাবে না।

অতএব দেখা যাচ্ছে চিন্তার ও জীবিকার অভিন্নতা তথা মতের ও স্বার্থের ঐক্যই মানুষকে দিয়েছে সজ্ঞাবদ্ধতা, দিয়েছে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে যৌথ প্রয়াসের প্রেরণা। কেননা সাধারণ মানুষের জীবনচেতনা ও অধিকারবোধ তখনো সূক্ষ্ম হয়ে ওঠেনি। স্বাতন্ত্র্যবোধ ও আত্মপ্রত্যয়প্রসূ জ্ঞানের ও সামর্থ্যের অভাবে তারা তখনো সর্দার বা গোত্রপতি-নির্ভর জীবনে স্বস্তি খুঁজেছে। বৈষয়িক জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য তখনো নিজের হাতে নেবার উপায় ছিল না পরিবেশ ও পরিবেষ্টনীগত কারণেই। তাই গ্রীক City state থেকে অত্যাধুনিক কাল অবধি প্রবল দুরাত্মারাই জনগণের জীবন-জীবিকা নিয়ন্ত্রণের তথা শাসন-শোষণের নির্বিঘ্ন অধিকার পেয়ে এসেছে। তারাই অজ্ঞ ও দুর্বল জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছিল যে রাজার সুখেই প্রজার সুখ, রাজার গৌরবেই রাজ্যের গৌরব, রাজার ঐশ্বর্যই জাতির সম্পদ, রাজার যশই দেশের যশ, রাজার বিলাসেই গণ-সংস্কৃতির বিকাশ। বসুন্ধরা বীরভোগ্যা, রাজা ও রাজপার্ষদ–দু-ই দেশ ও জাতির প্রতিভূ এবং তাঁদের যশ-মান-সম্পদই জাতীয় সমৃদ্ধি ও গৌরবের প্রতীক। আর মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগ তার নিয়তি-নির্ধারিত। রাজার কেবল শাসন-শোষণের বিধিদত্ত অধিকারই আছে, পোষণের দায়িত্ব কিংবা দুঃখমোচনের কর্তব্য তার নয়। তাই কোনো রাজা যদি দীঘি-সড়ক-সরাই দিতেন, তিনি হতেন মহানুভব, মহামতি বদান্য রাজর্ষি।

.

০২.

সে-দিন ও সে-মন আর নেই। আবিষ্কৃত যন্ত্রের প্রয়োগে আজকের দিনে মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠেছে। ভাব-চিন্তা-কর্মেও এসেছে বক্রতা ও বৈচিত্র্য। পণ্য উৎপাদনের সহজতা, জনসংখ্যাবৃদ্ধি, জনসংখ্যার অসম সংস্থিতি এবং যন্ত্রবিজ্ঞানে অধিকারের রাষ্ট্রিক তারতম্য প্রভৃতি অসামান্যরূপে জটিলতর করেছে মানুষের জীবিকার সমস্যা। ফলে মানুষ মরিয়া হয়ে খুঁজেছে বাঁচার পথ। সে-বাঁচার পথ এক-এক জনের চোখে এক-এক রকম। মেরে বাঁচা, কেড়ে বাঁচা কিংবা বন্টনে বাঁচা যেমন, তেমনি সহযোগিতায়, সহ-অবস্থানে ও সমদর্শিতায় বাঁচাও সম্ভব। কাজেই নানা বিরুদ্ধ-পথের বিভ্রান্তি ও বিবিধ বিপরীত মতের সংঘর্ষে মানুষের বৈষয়িক ও মানসিক তথা জৈবিক ও মানবিক সমস্যা জটিল ও বিপুল হচ্ছে। আর আনুপাতিক হারে মানুষ কখনো স্বাতন্ত্রে, কখনো সহযোগিতায়, কখনোবা জাতীয়তায়, কখনো মানবতার আদর্শে, কখনো আত্মরক্ষার নামে এসবের সমাধান খুঁজেছে। তাই দুনিয়াব্যাপী সমস্যা-পীড়িত দুর্বলরাষ্ট্রে নানা আনুষঙ্গিক উপসর্গও দেখা দিয়েছে। ফলে আজকের পৃথিবীতে সর্বত্র মতাদর্শের হট্টগোল উঠেছে। গরজ ও সুবিধেমতো গলাবাজি করেই জয়ী হতে চায় সবাই।

কোনো কোনো রাষ্ট্র যেমন ধর্মীয় ঐক্য, ভাষার ঐক্য, রাজনীতিক মতবাদের ঐক্য, গোত্রীয় ঐক্য কিংবা ভৌগোলিক ঐক্যের নামে জন-সংহতি রক্ষণে ও গণ-বিদ্রোহ ঠেকাতে ব্যস্ত; তেমনি কোথাও আবার আর্থিক, ভৌগোলিক কিংবা গোত্রীয় স্বাতন্ত্রের নামে বা মতবাদের অনৈক্যের অজুহাতে একরাষ্ট্র ভেঙে একাধিক রাষ্ট্র গড়ে উঠছে।

উভয়ক্ষেত্রেই বিবেকহীন বড় শক্তিগুলো নির্লজ্জভাবে–এমনকি U NO-ও–নিজেদের স্বার্থানুসারে পরস্পর বিপরীত যুক্তিপ্রয়োগে কখনো সমর্থন, কখনো বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য, জার্মানি, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি ভাঙতে যেমন তারা উৎসাহী ছিল, কঙ্গো-কাশ্মীর-বায়াফ্রা কিংবা নাগাভূমের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করতে তারা তেমনি কুণ্ঠিত। কিংবা তিব্বত-সাবাহ-বর্ণিও-সাইপ্রাস ব্যাপারে তাদের অন্যনীতি। আবার দক্ষিণ আফ্রিকা, রোডেশিয়া কিংবা আরব-ইসরাইল সমস্যা সম্পর্কে তারা দার্শনিক।

রাজনীতিক খেল ও আর্থনীতিক চাল গোপন রেখে তারা দেশ বা রাষ্ট্র ভাঙাগড়ার ব্যাপারে তিনটে আদর্শের স্লোগান আওড়ায়–সাংস্কৃতিক ঐক্য বা স্বাতন্ত্র, অভিন্ন বা ভিন্ন জাতীয়তা এবং মতবাদের ঐক্য বা পার্থক্য। স্বাৰ্থিক গরজে কখনো ঐক্যের কথা বলে তারা মিলন ঘটায়, কখনোবা স্বাতন্ত্রে গুরুত্ব দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে। সংহতি ও বিচ্ছেদ দুটোই তাদের সমান প্রিয়। এবং প্রয়োজনমতো প্রয়োগে তারা রীতিমতো সব্যসাচী।

ম্যাকিয়াভেলীই এ যুগের রাষ্ট্রপতি ও দেশনায়কদের গুরু। ছলনা, প্রতারণা ও বাকচাতুরীই তাদের পুঁজিশক্তির উৎস ও ভিত্তি এবং নীতি ও অস্ত্র। এই নীতি ও অস্ত্র প্রয়োগে তাদের আপন পর, ঘর-বাহির ভেদ নেই। এই শাস্ত্র ও শস্ত্রের ব্যবহারে তাদের সমদর্শিতা অতুল্য। নতুন ও পুরোনো, ছোট ও বড় সব রাষ্ট্রেরই একরূপ।

.

০৩.

সংস্কৃতিতেও থাকে স্থান-কাল-পাত্রভেদ। সংস্কৃতি তাই কোনো রাষ্ট্রভুক্ত মানুষের ব্যক্তিক বা সামষ্টিক জীবনে অবিমিশ্র ও অভিন্ন হতে পারে না। কেননা ভৌগোলিক আবহাওয়া, জীবিকা, শিক্ষা, আর্থিক অবস্থা, ধর্মমত, গোত্রীয় সংস্কার, ভাষিক প্রভাব, নৈতিক চেতনা, আচারিক প্রথা এবং উন্নততর বিদেশী ভাব-চিন্তা-আচার প্রভৃতির প্রত্যেকটির প্রভাবে রূপ পায় সংস্কৃতি। এজন্যেই একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও জার্মান-ফরাসি-ইংরেজের কিংবা আরব-ইরান-তুরস্কের সংস্কৃতি এক নয়, জাতীয়তাও নয় অভিন্ন।

গোত্রীয় ঐক্য বা নৃতাত্ত্বিক অভিন্নতাও এক সংস্কৃতি কিংবা এক জাতি গড়ে তোলে না– যেমন আর্য, সামীয় অথবা মঙ্গোলীয় মাত্রই এক জাতি ও এক সংস্কৃতিভুক্ত থাকেনি। আবার গোত্র, ভাষা, দেশ, ধর্ম, ঐতিহ্য প্রভৃতি অভিন্ন হলেও এক সংস্কৃতি ও এক জাতি থাকে না–শিক্ষা সম্পদ, মত, আদর্শ ও স্বার্থভেদে সংস্কৃতি ও জাতি-চেতনায় স্বাতন্ত্র্য আসে–যেমন আরব রাষ্ট্রগুলো, যেমন কোরিয়া, জার্মানি ও ভিয়েতনাম। বস্তুত জাতীয়তাবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যচেতনা আধুনিক উপসর্গ এবং তাই কৃত্রিম। রাজনীতিক ও আর্থনীতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার রূপেই এ দুটোর উদ্ভব, প্রসার ও স্থিতি এবং রাষ্ট্রগঠন ও রক্ষণকর্মেই কেবল এগুলো প্রযুক্ত। তা ছাড়া আজকের বিশ্বে ও-দুটোর আর কোনো উপযোগ নেই। প্রাগ্রসর বিবেকবান মানবকল্যাণকামী মানুষ যখন আন্তর্জাতিকতায় ও বিশ্বমানবতাবোধের স্বপ্নে আনন্দিত ও আশ্বস্ত, তখন এ দুটো আদর্শ প্রতিক্রিয়াশীলতারই নামান্তর। তা ছাড়া রাষ্ট্র গঠন ও রক্ষণ ব্যাপারে জাতীয়তা ও সাংস্কৃতিক অভিন্নতাও যে কেজো নয়– হৃতউপযোগ, তা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। আসলে সমস্বার্থের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে রাষ্ট্র আর সমস্বার্থের স্বীকৃতিতে সহযোগিতায় ও সমদর্শিতায় টিকে থাকবে রাষ্ট্র। এর থেকে দৃঢ় ঐক্যসূত্র, এর থেকে বড় বন্ধন দুনিয়াতে কখনো ছিল না, কখনো হবেও না। পরিবারে-গোত্রে সমাজে-রাষ্ট্রে সর্বত্রই মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিই হচ্ছে স্বার্থ। এজন্যেই দস্যু-তস্করের মতো দুশ্চরিত্র লোকও সমস্বার্থের ভিত্তিতে দলীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে। এরা দায়িত্ব-চেতনা, কর্তব্য-বুদ্ধি, সততা, আনুগত্য ও পারস্পরিক আস্থার প্রমূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রচলিত অর্থে অমানুষ এই দস্যু-তস্করের চরিত্রে এক অর্থে সুনাগরিকের সবগুণই বর্তমান। তাঁদের স্বাদল্য, কমরেডীভাব ও নীতিনিষ্ঠা তথা অঙ্গীকারনিষ্ঠতা অনুকরণীয়। মূলত স্বার্থবুদ্ধির সঙ্গে সৌজন্য ও সহৃদয়তার মিশ্রণ ঘটিয়ে, পরিবারে ও সমাজে পারস্পরিক ব্যবহারে প্রীতির মাধুর্য ও শোভনতার লাবণ্য দান করেই সভ্য ও সংস্কৃতিবান হয়েছে মানুষ। এরই নাম ন্যায়-নীতি-আদর্শ তথা সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবতা। অতএব সমস্বার্থের ভিত্তিতে সহ-অবস্থান, সহযোগিতা ও সমদর্শিতাই এ যুগে রাষ্ট্ৰান্তৰ্গত মানুষের ঐক্যের ও সংহতির একমাত্র সূত্র। ঠকাঠকিতে বাপ ভাইয়ের সঙ্গেও ঠোকাঠুকি অনিবার্য।

ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাস

ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাস

এ বছর দেখছি কোথাও কোথাও পলাশী দিবস উদযাপিত হচ্ছে। উদ্দেশ্য বোধ হয় পরাধীনতার গ্লানি স্মরণ করে স্বাধীনতা ও স্বাজাত্যের মহিমা কীর্তন করা। ইতিহাস পাঠকের দৃষ্টি আবেগে আচ্ছন্ন হওয়া অবাঞ্ছিত। নিরপেক্ষ বিচারেই ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। কেননা তেমন শিক্ষাই কেবল ব্যক্তিক কিংবা জাতিক জীবনে ফলপ্রসূ হওয়া সম্ভব।

আগের যুগে রাজার রাজ্য ছিল, জনগণের রাষ্ট্র ছিল না। কাজেই জমিদারের চর দখলের মতোই দেশ কাড়াকাড়ি চলত রাজায় রাজায়। দেশের জনগণের তাতে কোনো ভূমিকা ছিল না। ভাড়াটে লেঠেলের মতোই ভাড়াটে সৈন্যেরা পয়সার বিনিময়ে ও ফাউস্বরূপ লুটের মালের লোভে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করত মনিবের পক্ষে। এসব যুদ্ধ-ব্যবসায়ীর দেশ-জাত চেতনা ছিল না। যে কড়ি দেবে, তার কাজে জান কবুল –এই ছিল তাদের নীতি। তাই ব্রিটিশেরা দেশী সৈন্য দিয়েই ভারত দখল করেছিল। সেই যে কথায় আছে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে, উলুখড়ের প্রাণ যায় তা প্রায় আক্ষরিকভাবেই সত্য ছিল। রাজা বদল হলে প্রজার মনে কোনো ভাবান্তর হত না। কেবল প্রশাসনিক নীতি পরিবর্তনের ফলে প্রজার আর্থিক ও বৈষয়িক ক্ষতিবৃদ্ধির কারণ ঘটত। শাসকের চরিত্র-ভেদে শাসন-শোষণের মাত্রাভেদ অবশ্যই হত।

বাঙলাদেশ চিরকালই বিদেশী শাসিত। মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন-তুর্কী-আফগান-মুঘল কিংবা ইংরেজ–ওদের কেউ বাঙালি ছিল না। শশাঙ্ক-নরেন্দ্র গুপ্ত কিংবা যদু-জালাল উদ্দীন বাঙালি হয়েও বাঙালির স্বাজাত্যবোধের অভাবে বেশি দিন টিকতে পারেননি। রাজা-প্রজার সম্পর্ক বান্দা-মনিবের কিংবা শাসক-শাসিতের ছিল বলেই রাজকীয় ব্যাপারে তথা রাজনীতিতে জনগণের স্বাদেশিক বা স্বাজাতিক চেতনা ছিল অনুপস্থিত। কাজেই মধ্যযুগের কোনো যুদ্ধকে কিংবা হার-জিৎকে জাতীয় সংগ্রাম বা জাতীয় জয়-পরাজয় বলে চিহ্নিত করা চলে না। এ ছিল শাসকগোষ্ঠীর গোত্রীয় লজ্জা গৌরবের ও শ্রেণীগত লাভ-ক্ষতির বিষয়।

পলাশীর পটভূমিকা আলোচনা করলেও আমরা এ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াব। ১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দ থেকেই বাঙলাদেশ নামত মুঘল শাসনে আসে। ১৬১৭ খ্রীস্টাব্দ অবধি এখানকার ভূঁইয়াদের সাথে দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের মাধ্যমে মুঘল অধিকার টিকিয়ে রাখার প্রয়াস চলে।

তার পরেও মীর জুমলা-শায়েস্তাখানের সুবাদারি (১৬৮৮ খ্রী.) অবধি বাঙলা দেশ মোটামুটিভাবে সেনানী-শাসক (Military Governor) দ্বারা শাসিত হয় এবং অধিকাংশ সময়ে বিহার-উড়িষ্যাও বাঙলা-সুবাভুক্ত থাকে। মুঘল আমলে বাঙলা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ, অনেকটা ঔপনিবেশিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। দিল্লী ছিল সাত সমুদ্রের না হলেও তেরো নদীর ওপারে। মুঘলেরা এ অঞ্চলে শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, স্বাদেশিক রাজার মতো পোষণের দায়িত্ব কিংবা প্রজার কল্যাণ সাধনের কর্তব্য গ্রহণ করেনি। এ ছিল খাজনা আদায়ের জমিদারি ও শুল্ক উসুলের বন্দর। . ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে আওরঙজীবের মৃত্যুর পরে মুঘল সাম্রাজ্য দ্রুত ভাঙতে থাকে। ফররুখ শিয়রের ঢাকা ত্যাগের পর ১৭১২ খ্রীস্টাব্দ থেকে পূর্বতন দিওয়ান এবং আওরঙজীবের বিশ্বস্ত কর্মচারী মুর্শিদকুলি খাঁ এখানে জেঁকে বসেন। তাঁর সময় থেকেই স্বল্পমেয়াদী সুবাদারি দিল্লীর সম্রাটের প্রতি নামমাত্র আনুগত্যে পুরুষানুক্রমিক নওয়াবীতে অবসিত হল।

এই মুর্শিদকুলি খাঁর জামাতা ও উড়িষ্যার নায়েব নাজিম সুজাউদ্দিনের দরবারেই ধর্না দেন বেকার আলিবর্দী। আলিবর্দীর পিতামহ ছিলেন আওরঙজীবের ধাত্রীপুত্র। তাঁর পিতা মোহাম্মদ আলী ছিলেন আওরঙজীবের পুত্র আজম শাহর পানপাত্র বাহক। আজমের বিপর্যয় ও মৃত্যুতে (১৭০৭ খ্রী.) তাঁর পরিবারে দুর্দিন দেখা দেয়। পিতৃহীন আলিবর্দী ভাগ্যান্বেষণে সপরিজন চলে আসেন উড়িষ্যায়। উড়িষ্যায় তিনি তাঁর আত্মীয় নায়েব-সুবাদার সুজাউদ্দিনের অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেন। নিজের যোগ্যতায় এবং মুর্শিদকুলি খাঁর ও মাতুল বংশীয় সুজাউদ্দিনের কৃপায় তিনি ক্রমে বিহারের নায়েব সুবাদার পদে উন্নীত হন।– মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর জামাতা নওয়াব সুজাউদ্দিনের সময়ে আলীবর্দীর প্রতিষ্ঠা আরো বাড়তে থাকে। তাঁর ভ্রাতা হাজী আহমদও দরবারে আমীর পদে উন্নীত হন। সুজাউদ্দিন-পুত্র সরফরাজ খাঁর আমলে আলিবর্দী ছিলেন বিহারের নায়েব সুবাদার। উৎকোচে দিল্লী-দরবারের আমীরদের বশ করে তিনি বাঙলার সুবাদারি সনদ লাভ করেন এবং তাঁর ভাই হাজী আহমদের মধ্যস্থতায় মুর্শিদাবাদ-দরবারে ষড়যন্ত্র করে আমীরদের স্বপক্ষে এনে গিরিয়ার প্রান্তরে নামমাত্র যুদ্ধে সরফরাজ খাঁকে পরাজিত ও নিহত করে তিনি বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবাদারি মসনদ তথা নওয়াবী লাভ করেন।

আলিবর্দীর পনেরো বছর নওয়াবীকালে বারোটি যুদ্ধ ঘটে। মুর্শিদকুলির জামাতাদি আত্মীয়েরা, বিহারের বিদ্রোহী সামন্তরা এবং মারাঠারা তাঁকে তাঁর ষড়যন্ত্র-লব্ধ রাজ্য সুখে ভোগ করতে দেননি। ফলে যুদ্ধ-সংক্রান্ত ব্যয়বাহুল্য তো ছিলই, তাছাড়া প্রশাসনিক শৃঙ্খলা রক্ষা করাও যুদ্ধকালে সম্ভব ছিল না। তার রাজ্যের প্রায় অর্ধেক বগীর লুটতরাজে ছিল বিধ্বস্ত। এখানেই শেষ নয়, উড়িষ্যার আয় চৌথরূপে ছেড়ে দিতে হল এবং অধিকন্তু নগদ বারো লক্ষ টাকা বার্ষিক কর ভোসলাকে দিতে হত। সিরাজউদ্দৌলা যখন নওয়াব হলেন তখন দিল্লীর সনদ যোগাড়ের পয়সা ছিল না তার। আবদালী ও দিল্লীর সম্রাটের হুমকিতে বিচলিত সিরাজউদ্দৌলা কলকাতার ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করলেন, যাতে বিপদকালে ইংরেজদের সাহায্যে দিল্লী-প্রেরিত বাহিনী ঠেকানো যায় এই ভরসায়। আহমদ শাহ আবদালী-লুণ্ঠিত দিল্লীর রাজার তখন অভিযান করার মতো অবস্থা ছিল না। কাজেই সে দিক থেকে কোনো বিপদ ঘটেনি।

গিরিয়ার যুদ্ধে ও পলাশীর যুদ্ধে আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও পরিণামগত কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। বাঙালির এতে জানবার, বুঝবার ও ভাববার কিছুই ছিল না। কেবল রাজ্য কাড়াকাড়ির চিরকালীন তামাশাই দেখবার ছিল এবং তারা রসিক-দৃষ্টি দিয়ে দেখেওছে। সে যুগে দেশ ছিল রাজার রাজ্য। রাজ্য রক্ষার গরজ, প্রজা শাসনের দায়িত্ব এবং রাজ্য হারানোর দুর্ভাগ্য সবই ছিল রাজার। প্রজার কাছে এসব ছিল মনিব ও মালিক পরিবর্তনের একটি সাময়িক দুর্ভাগ্য মাত্র। সে মালিক স্বদেশী কিংবা বিদেশী, স্বজাতি কিংবা বিজাতি –এ বিচার তারা কোনো দিনই করেনি। এ বিচারে কেউ কখনো অভ্যস্তও ছিল না। এমনকি আঠারো শতক থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি এ চেতনা–এ দৃষ্টি ভারতের রাজন্যবর্গের মধ্যে অনুপস্থিত দেখি। ষোলো শতক থেকেই। পর্তুগীজদের মাধ্যমে য়ুরোপীয় শক্তির প্রভাব ও অধিকার এদেশে দৃঢ়মূল ও বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। কিন্তু বিদেশী-বিজাতি বলে তাদের কেউ ঠেকানোর চেষ্টা করেনি। কেবল প্রতিষ্ঠাকামী প্রবল প্রতাপ উঠতি শক্তিরূপে সমীহ-ই করেছে। এবং স্বস্বার্থে এদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বদলে সহযোগিতাই করেছে এদেশের রাজন্যবর্গ। কর্নাটে ফরাসির ও বাঙলায় ইংরেজের ভূমিকা, মুঘল বাদশাহ কর্তৃক ইংরেজকে বাঙলা-বিহারের দেওয়ানী দান, টিপুসুলতানকে সাহায্যদানে নিজাম মারাঠার অস্বীকৃতি, সিপাহী বিপ্লবকালে রাজন্যবর্গের ব্রিটিশ-প্রীতি প্রভৃতি এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। অতএব স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক চেতনা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেও ছিল না। তাদের ছিল-দেশ-জাত মানুষ নিরপেক্ষ রাজ্য-চেতনা। কাজেই দেশী-বিদেশী যে-কোনো রাজশক্তিকে তারা সুবিধা ও প্রয়োজনমতো কখনো মিত্ররূপে, কখনোবা প্রতিদ্বন্দ্বীরূপেই ভেবেছেন। অবশ্য এরই নাম রাজনীতি।

মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজউদ্দৌলা অবধি সবাই দুর্বল প্রভুর স্বৈরাচারী সুবাদার মাত্র। আঠারো উনিশ শতকে কখনো কখনো কোনো কোনো রাজা-বাদশা, সামন্ত ও ধর্মনেতা স্বস্বার্থে স্বাধর্মিক জাতীয়তার বুলি আওড়িয়েছেন বটে, কিন্তু তাদের সে-প্রয়াস মুঘল-মারাঠা কিংবা ইংরেজ-সাম্রাজ্যে তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। নাদির শাহ কিংবা আহমদ শাহ আবদালীর ভারত অভিযানে মারাঠা শক্তি ঘা খেয়েছে বটে, কিন্তু মুঘল শক্তিই হয়েছে বিলুপ্ত, যার ফলে ইংরেজ-শক্তি হল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আবার শিখ-হিন্দু-মুসলমান প্রতিবেশীসুলভ ঈর্ষা-বিদ্বেষ বশে যতটা সাম্প্রদায়িক হতে পেরেছিল, ওহাবী আন্দোলন ততটা ইংরেজদ্রোহী হতে পারেনি।

অতএব আমাদের দেশের রাজনীতিতে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পূর্বে স্বাদেশিক, স্বাজাতিক কিংবা স্বাধর্মিক জাতীয়তার কোনো ভূমিকা ছিল না। কাজেই ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে আলিবর্দী, কিংবা মীর জাফর আলী খাঁর ভূমিকা অভিন্ন। এবং সরফরাজ, সিরাজউদ্দৌলা কিংবা মীর কাসিমের দুর্ভাগ্যও নিত্যঘটিত ব্যক্তিগত ঘটনা। বস্তুত পলাশীর বিজয়ে নয়, দিল্লীর সম্রাট কর্তৃক ইংরেজকে দিওয়ান নিযুক্তির ফলেই বাঙলায় তথা ভারতে ইংরেজ-রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। কেননা ওটাই ছিল তাদের Locus standi, ওতেই দেশের রাজনীতিতে ওদের দৌরাত্ম্যের দাবী ও অধিকার স্বীকৃতি পেল।

আধুনিক স্বাদেশিক বোধ ও স্বাজাতিক চেতনা নিয়ে মুঘল সুবাদার অবাঙালি সিরাজউদ্দৌলাকে জাতীয় বীর ও বাঙলার স্বাধীনতার প্রতীকরূপে গ্রহণ করলে ইতিহাসের তথ্য ও মর্যাদা লঙ্ন করাই হবে। বস্তুত পলাশীর যুদ্ধের গ্লানি বা লজ্জা কোনোটাই বাঙালিকে স্পর্শ করার কথা নয়। যেমন মৌর্যযুগ থেকে সুন্দর শ্যামল স্বর্ণ-প্রসূ বাঙলাকে নিয়ে যত লড়াই হয়েছে বিদেশী প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে, তার কোনো জয়-পরাজয়ই বাঙালির গৌরব কিংবা গ্লানির বিষয় নয়।

বাঙালারি স্থায়ী কলঙ্কের কথা এই যে, ইদানীং পূর্বযুগে বাঙালি কৃচিৎ স্বদেশ স্বশাসনে রাখবার চেষ্টা করেছে। দেশের মানুষ দ্বারা শাসিত না হলে রাজনৈতিক অর্থে মানুষ কখনো স্বাধীন হয় না। এই তাৎপর্যে পাল কিংবা স্বাধীন সুলতানী আমলও (১৩৩৯-১৫৩৮ খ্র.) বাঙলা বা বাঙালির পক্ষে গৌরবের ও গর্বের নয়।

কবি মুহম্মদ খান ও তাঁর কাব্য

০১.

মুহম্মদ খান আমাদের সাহিত্যে একটি জনপ্রিয় নাম। তিনি প্রখ্যাত মঞ্জুল হোসেন তথা হোসেন বধ কাব্যের রচয়িতা।

কারবালা কাহিনী নিয়ে অনেক যুদ্ধকাব্য ও মর্সিয়া-সাহিত্য রচিত হয়েছে। কাব্যগুলো সাধারণত জঙ্গনামা এবং গান-গাথাগুলো জারি নামে পরিচিত। যুদ্ধকাব্যের ফারসি নাম জঙ্গনামা। কিন্তু বাঙলায় নামটি যোগরূঢ় হয়ে কেবল কারবালা যুদ্ধ বিষয়ক কাব্যই নির্দেশ করে।

কারবালার যুদ্ধে প্রতারিত ইমাম হোসেনের শোচনীয় পরাজয় ও নিধনের করুণ বৃত্তান্তই এ কাব্যে বর্ণিত। দুর্ভাগ্য লাঞ্ছনা পীড়ন পরাজয় ও হত্যার এমনি অগুণতি ঘটনা দুনিয়াব্যাপী ঘটেছে, আজো ঘটছে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে সে সবের বীভৎস কিংবা করুণ বিবরণ। লোকে সব কথা মনে রাখে না, সব ঘটনায় গুরুত্বও দেয় না। মুসলমানের হোসেন প্রীতি রসুল ও আলী-প্রীতির প্রতিচ্ছায়া। কারুণ্য বেদনা উত্তেজনা ও উচ্ছ্বাসের অপ্রতিরোধ্য উৎস ঐটিই। তাই বছরে একবার অন্তত মুসলমানেরা প্রিয়জন নিধনের সদ্যশোক অনুভব করে। বিশেষ করে পাকপঞ্চতন-ভক্ত শিয়া সম্প্রদায় সে শোকের অভিঘাতে বক্ষবিদারী রক্তক্ষরা বেদনায় অভিভূত হয়ে পড়ে। এমনি করে হোসেন বিষয়ক কাব্য ও গানগাথা রচন, পঠন ও শ্রবণ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মীয় নিষ্ঠা ও জাতীয় প্রবণতায় রূপ পায়।

মুঘল আমলে বিশেষ করে জাহাগীরের আমল থেকে এদেশে ইরানি প্রভাব প্রবল হতে থাকে। ইরানের সাফাভী বংশীয় শাসনের অবসান ঘটলে বহু শিয়া মুর্শিদাবাদেও আশ্রয় পায়। তার ফলে এদেশে কারবালা মহরমের পার্বণিক বিকাশ ও প্রসার ত্বরান্বিত হয়। সুন্নীদের মানস-প্রশ্রয়ে তা শহরে শহরে সর্বজনীন জাতীয় পার্বণের রূপ নেয়। এদেশের এমনি আবহে লোকের কৌতূহল মিটানোর প্রয়োজনে অনেক জঙ্গনামা রচিত হয়েছে।

বাঙলায় মক্তুল হোসেন বা জঙ্গনামা কিংবা শহীদ-ই-কারাবালার আদি কবি দৌলত উজির বাহরাম খান (ষোলো শতক), দ্বিতীয় কবি মীর বা শেখ ফয়জুল্লাহ- র (ষোলো শতক) রচিত চৌতিশায় যয়নবের বিলাপ পাওয়া গেছে। তৃতীয় কবি আমাদের আলোচ্য মুহম্মদ খান। এর পরে যারা জঙ্গনামা রচনা করেছেন তাদের মধ্যে হায়াত মাহমুদ, জাফর, জিন্নত আলী, আলী মুহম্মদ, আবদুল ওহাব, হামিদুল্লাহ খান, ফকির গরীবউল্লাহ, ইয়াকুব (?), সাদ আলী, রাধাচরণ গোপ, মুহম্মদ মুনশী, জনাব আলি ও আবদুল হামিদের নাম উল্লেখ্য।

.

০২.

মুহম্মদ খানের মক্তুল হোসেন ঐতিহাসিক উপাদানের আধার হিসেবেও মূল্যবান গ্রন্থ। তিনি মঞ্জুল হোসেন কাব্যে তাঁর সমকাল অবধি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসের আভাস দিয়েছেন। কবির মাতৃকুল ছিল পীর পরিবার, আর পিতৃকুল ছিল শাসক পরিবার। কবির পীর ছিলেন নবীবংশ-এর কবি পীর মীর সৈয়দ সুলতান। সৈয়দ সুলতান মোলো শতকের সাহিত্য, ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একজন দিকপাল। অতএব কবি মুহম্মদ খান ছিলেন সতেরো শতকের চট্টগ্রামের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুখ্য ব্যক্তিদের অন্যতম। তাঁর মাতৃকুল ও পিতৃপুরুষের বংশ-তালিকা এরূপ :

কবির মাতামহ সদরজাহার পিতৃদত্ত নাম আবদুল ওহাব। গরিব-দুঃখীর প্রতি সদয় ছিলেন বলে তিনি শাহ ভিখারী তথা ভিখারীর বাদশা [ভিক্ষুকজনের পতি যাহাকে বুলিলা] রূপে জনপ্রিয় হন। আর পীর-ই-মুলক অর্থে তিনি সদরজাহ খেতাব কিংবা পদ বা খ্যাতি লাভ করেন পীর ই-মুলুক যারে বোলে সর্বজন]। এই আবদুল ওহাব সদরজাহাঁ গৌড়সুলতান ও আরাকান রাজের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন, এবং তিনজন ঐতিহাসিক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত রয়েছে। ইতি রাস্তিখানের বংশধর নসরত খানের জামাতা, ভূঁইয়া-প্রমুখ ঈসা খান ও রামু-চকরিয়ার সামন্ত শাসক আদমের প্রিয় কিংবা পীর ছিলেন।

কবির পূর্বপুরুষ রাস্তিখান গৌড়সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর অধীনে চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন। তারপর চট্টগ্রাম কখনো গৌড়শাসনে কখনো আরাকান অধিকারে থাকলেও এঁরা বংশপরম্পরায় শাসক পদে নিযুক্তি পেয়েছেন। মিনা খান সম্ভবত পরাগল খানের ছোটভাই ও ছুটি খানের পিতৃব্য। মুহম্মদ খান মিনা খানের বংশধর বলেই পরাগল খানের নামোল্লেখ করেননি। লক্ষণীয় যে, পিতা ও পিতৃব্য এবং মাতামহ ও মাতামহের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছাড়া কবি সর্বত্র একক বংশধরেরই পরিচয় দিয়েছেন।

মুহম্মদ খানের পিতৃব্য ইব্রাহিম খান ছিলেন আরাকান রাজ্যের চট্টগ্রামস্থ অধিকারের শাসক বা উজির। মুহম্মদ খানও সম্ভবত শখ ও মাতামুহুরী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে নায়েব-উজির ছিলেন। আঠারো-উনিশ শতকের কবি মুহম্মদ চুহর কবিপ্রণামে মুহম্মদ খানকে পীর-কবি বলে উল্লেখ করেছেন :

আদ্য গুরু কল্পতরু ছৈদ সুলতান
কবি আলাওল পীর মোহাম্মদ খান।

.

০৩.

কবি সৈয়দ সুলতানের ইচ্ছে ছিল সৃষ্টিপত্তন থেকে শুরু করে কেয়ামত অবধি ইসলামী ধারার একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিকথা রচনা করবেন। সৃষ্টি-পত্তন থেকে ওফাত-ই-রসুল ত রচনা করে কোনো কারণে তিনি লেখনী ত্যাগ করেন। মঞ্জুল হোসেন-এ তাঁর আরব্ধ কর্মে সমাপ্তি দান করে, তার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেন তাঁর প্রিয় শিষ্য কবি মুহম্মদ খান।

পীরের পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান-গভীরতা শিষ্যের ছিল না সত্য, কিন্তু কবিত্বে, সহৃদয়তায়, সংবেদনশীলতায়, ভাষার লালিত্য ও বর্ণনভঙ্গির নিপুণতায় শিষ্য পীরকে অতিক্রম করেছেন। এখন পীর-সাগরেদ সংবাদ মুহম্মদ খানের মুখেই শোনা যাক :

ইমাম হোসেন বংশে জন্ম গুণনিধি।
সর্বশাস্ত্রে বিশারদ নবরস দধি
শ্যাম নবজলধর সুন্দর শরীর
দানে কল্পতরু পৃথিবী সম স্থির।
অসীম মহিমা পীর শাহ্ সুলতান।…
উদরেত বৈসে তান জগতের গুণ
বিজয় করিলা শাস্ত্র পৃথিবী ত্রিকোণ।
হৃদয় মুকুর তান নাশে আন্ধিয়ার।
বহু যত্নে এহি রত্নে কৈলা করতার।
নবীবংশ রচিছিলা পুরুষ প্রধান
আদ্যের উৎপন্ন যত করিলা বাখান।
রসুলের ওফাত রচি আর না রচিলা
অবশেষে রচিবারে মোক আজ্ঞা দিলা।
তান আজ্ঞা শিরে ধরি মনে আকলি।
চারি সাবার কথা কৈলু পদাবলী।
দুই ভাই বিবরণ সমাপ্ত করিয়া
প্রলয়ের কথা সব দিলু প্রচারিয়া
অন্তে পুনি বিরচিলু প্রভু দরশন
এহা হন্তে, ধিক কথা নাহি কদাচন।
দুই পঞ্চালিকা যদি একত্র করএ
আদ্যের অন্তের কথা সন্ধিযুক্ত হএ।

মঞ্জুল হোসেন এগারো পর্বে সমাপ্ত। কবির ভাষায় এর বিষয়সূচি এই :

১. আদিপর্বে ফাতেমার বিবাহ কহিব
দুই ভাইর জন্ম তবে পাছে বিরচিব।

২. কহিব দ্বিতীয় পর্বে শুন দিয়া মন
চারি আসহাবের কথা শাস্ত্রের নিদান।

৩ কহিব তৃতীয় পর্বে হাসনের বাণী
যয়নবকে বিবাহ করিলা মনে গুণি।

৪. চতুর্থ মুসলিম পর্ব শুন দিয়া মন

৫. কহিব পঞ্চম পর্বে যুদ্ধ অবশেষে পাছে

৬. ষষ্টমে হোসেন পর্ব কহিবাম পাছে

৭. সপ্তমে স্ত্রীপর্ব কহিবাম পুনি

৮. অষ্টমেত দূতপর্ব শুন দিয়া মন

৯. নবমে ওলিদ পর্ব শুন গুণিগণ।

১০. দশমে এজিম পর্ব কহিবাম এবে

১১. একাদশ পর্ব তার পশ্চাতে কহিব
প্রলয় হইতে যথ অনর্থ হইব।
যেন মতে দজ্জাল পাপী ভুলাইব নর।
যেন মতে আসিয়া পুনি ঈসা পয়গাম্বর।
মোহাম্মদ হানিফা ইমাম সঙ্গে করি
যেমতে পালিবা নোক দজ্জাল সংহারি।
এআজুজ মাজুজ সেই দুই বাহিনী।
যেনমতে হেসাব দিবেক সর্বজনি।

একাদশ পর্বটি কেয়ামতনামা ও দজ্জালনামা নামে পৃথক দুখানি পুস্তিকা হিসেবেও চালু ছিল। এজিদ পর্বও হানিফার লড়াই নামে জনপ্রিয় হয়। এভাবে মুহম্মদ খান একটিমাত্র গ্রন্থে কেয়ামত অবধি বর্ণন করে পীরের অভিলাষ পূর্ণ করেন। মক্তুল হোসেন কাব্যের রচনাকাল মিলেছে :

মুসলমানি তারিখের দশ শত ভেল
শতের অর্ধেক পাছে ঋতু বহি গেল।
হিন্দুয়ানি তারিখের শুন কহি কত
বাণ বাহু শত অব্দ আর বাণ শত।
বিংশ তিন পূর্ণ করি চাহ দিয়া দধি।
পঞ্চালিকা পূর্ণ হৈল সে অব্দ
মাধবী মাসের সপ্ত দিবস গইল
সেই রাত্রি পঞ্চলিকা সমাপ্ত হইল।

[এত হিজরী ১০০০+৫০+৬=১৬৪৫-৪৬ খ্রীস্টাব্দ; এবং শক ৫ x ২ = ১০০০ +৫০০ + ২০ X ৩+৭= ১৫৬৭ + ৭৮ = ১৬৪৬ খ্রীস্টাব্দ মেলে।

.

০৪.

সব দেশের কাহিনী-কাব্যই ঐতিহ্য-নির্ভর। আমাদের বাঙালি মুসলিম রচিত সাহিত্যের উপজীব্যও ছিল মুসলিম ইতিকথা। তার মধ্যে ইসলামের উন্মেষ যুগের বীরত্ব-মহত্ত্বজ্ঞাপক গৌরবময় কাহিনীই বিশেষ করে তাঁদের কাব্য-সৌধ নির্মাণের উপকরণ যোগায়।

আরব দেশ, রূপকথার ভাষায়, সাত সাগরের ওপারে। সেকালে যানবাহনের সুবিধে ছিল না। আজকের মতো পৃথিবী তখনো মানুষের পদচারণের ক্ষুদ্র ক্ষেত্রে পরিণত হয়নি। তাই সত্যিকথাও কল্পনাপ্রিয় অজ্ঞ মানুষের মুখে মুখে রূপকথার মতো অবাস্তব, অস্বাভাবিক ও রোমান্টিক হয়ে উঠত। তাছাড়া মানুষের মনোজগতে–সাহিত্যের আনন্দ-মেলায়, আদর্শায়িত জীবন স্বপ্নে বাস্তবের মূল্য চিরকালই নগণ্য। যুক্তি-বুদ্ধির প্রভাব সেখানে সামান্যই। তাই ইসলামের উদ্ভবকালের জাতীয় বীরদের নানা যুদ্ধকাহিনী মনোময় কল্পনার অবাধ প্রশ্রয়ে রূপে-রসে, সত্য-মিথ্যায়, সম্ভব-অসম্ভবে, বাস্তবে-কল্পনায় আকর্ষণীয় অবয়ব পেয়েছে। মুহম্মদ খানের মঞ্জুল হোসেনও এমনি একটি করুণ মধুর, জ্বালা-বেদনা, হর্ষ-বিষাদ মিশ্রিত সুন্দর রচনা। এ কাব্য মৌলিক রচনা নয়, ফারসি কাব্যের অনুসৃতিমূলক। আবার এর আংশিক অনুকৃতি মেলে মীর মুশাররফ হোসেনের গ্রন্থে। জঙ্গনামা-র চরম ও সুন্দরতম রূপায়ণ হচ্ছে মীর মুশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু। কিন্তু মধ্যযুগীয় কাব্য হিসেবে মঞ্জুল হোসেন এ জাতীয় কাব্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। মুহম্মদ খান নিজেই বলেছেন :

মুহম্মদ খানে কহে শুনিতে মরম দহে।
পাষাণ হইয়া যায় জল।

এই দাবীতে অত্যুক্তি নেই। তাঁর কাব্য সত্যি কারুণ্যের নিঝর। তাই বলে বীররস-বিহীন নয়। যে যুগের, যে সমাজের, যে মানুষের কথা এতে বর্ণিত তা আজ ধূসর কল্পনার বিষয়। কিন্তু আজো সেই ক্রুরতা মানুষের ঘৃণা উদ্রেক করে; হোসেনের আত্মসম্মান বোধ, সত্যনিষ্ঠা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, নির্ভীকতা, আত্মত্যাগ আজো মানুষকে তার প্রতি শ্রদ্ধান্বিত করে; আজো তার বীরত্ব, মহত্ত্ব ও স্বাধীনতা-প্রীতি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।

শির দেগা সের দেগা, নেহি দেগা আমামা –এই ছিল হোসেনের বক্তব্য। অন্যায় ও জুলুমের কাছে আত্মসমর্পণ করে অনুগৃহীতের সুখ তার কাম্য ছিলো না। জানের চেয়ে মান বড়, তার চেয়েও বড় স্বাধীনতা। সে-স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে এজিদের কৃপাজীবীর নিশ্চিন্ত জীবন তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। তাই মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি তাঁর মর্যাদা ও আদর্শ রক্ষা করলেন। সংগ্রামের ভেতরেই জীবনের সার্থকতা খুঁজলেন, মুযাহীদের জীবন এবং শহীদের মৃত্যুই তাঁর লক্ষ্য হল। শহীদ হয়েও যিনি মনুষ্যস্মৃতিতে অমর গাজীর গৌরব নিয়ে বেঁচে রইলেন। সেই হোসেনের সংগ্রামের কথা, শাহাদাঁতের কথা আজো এবং চিরকাল স্মরণীয় থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! বিশেষ করে, রসুলের দৌহিত্রের হৃদয়বিদারক কাহিনী সাড়ে তেরো শ বছর ধরে মুসলমানের চক্ষু অশ্রুসিক্ত রাখছে, কেয়ামত তক্ এমনি অশু ঝরবে তাদের দু-চোখের কোণ বেয়ে, যখন মুহম্মদ খানের লেখা-চিত্র তারা মানসচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে :

স্বর্গ মর্ত্য পাতালে উঠিল হাহাকার
কান্দস্ত ফিরিস্তা সব গগন মাঝার।
বিলাপন্ত যথেক গন্ধর্ব বিদ্যাধর।
আর্শ কুর্সি লওহ্ আদি কাঁপে থরথর।
অষ্ট স্বর্গবাসী যথ করন্ত
ধিক ধিক কুফি সৈন্য অধার্মিক পাপ।
এ সপ্ত আকাশ হৈল লোহিত বরণ
কম্পমান সূর্য দেখি হোসেন নিধন।
ক্ষীণ হৈল নিশাপতি আমীরের শোকে
মঙ্গল অরুণ বর্ণ রক্ত মাখি মুখে।
বুধে বুদ্ধি হারাইল গুরু এড়ে জ্ঞান
শনি কালা বস্ত্র পিন্দে পাই অপমান।
জোহরা নক্ষত্র কান্দে ত্যাজি নাট গীত
ফাতেমা জোহরা কান্দে শোকে বিষাদিত।
সমুদ্রে উঠিল ঢেউ পরশি আকাশ
পর্বত ছাড়ে সঘন নিশ্বাস।
কম্পমান পৃথিবী যতেক চরাচর
হইল শোণিত বর্ণ দিগদিগন্তর।
জল ত্যাজে মীনগণে পক্ষী ত্যাজে বাসা
সব কান্দে হাসএ ইব্লিস অনা-আশা।

.

০৫.

মুহম্মদ খান সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ নামে নীতিশিক্ষামূলক একখানি রূপককাব্যও রচনা করেছিলেন। এটিই তার প্রথম গ্রন্থ। এ কাব্যে সত্য ও কলির তথা ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, পাপ-পুণ্য আর সুমতি-কুমতির দ্বন্দ্ব ও সংঘাত একটি সরস উপাখ্যানের মাধ্যমে সার্থকভাবে চিত্রিত। এ কাব্যের বিষয়সূচি কবির জবানিতে এরূপ :

ক. প্রথমে সত্যক সত্যবতী দুই মিলি
যেন মতে কলির দুঃশীলা সঙ্গে কেলি।
সত্য সঙ্গে যুঝিতে কলির আগমন
মিত্র কণ্ঠ দূত গেলা নিষেধিতে রণ।
না করিল সন্ধিপত্র আইল পুরোহিত
নারদের স্থলে যুদ্ধ হৈল অতুলিত।

খ. দ্বিতীয় অধ্যায়ে দুই সৈন্যের সংগ্রাম
সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ অনুপাম।
কপটে জিনিল সত্যে কলি ধনুর্ধর
মুহুশ্চিত সত্য লই পুনি গেল ঘর।

গ. তৃতীয় অধ্যায়ে তবে কহিলু কথন
কাঞ্চলি মুখেত শুনি সত্য অচেতন।
যেন মতে বিলাপিলা সত্যবতী নারী।
সুবুদ্ধি আনিলা গিয়া যোগী ধন্বন্তরী।
জ্ঞান-বড়ি দিয়া যোগী সত্যে চেতাইল
যোগী-সত্যবতী যেন সম্বাদ ঘুচিল।

ঘ. চতুর্থ অধ্যায়ে পুনি সত্য পাইল জয়
পুনি মুহুশ্চিত হৈল কলি পাপাশয়।
মৃতবৎ কলি লৈয়া দুঃশীলা কান্দিল
ভোগী-ধন্বন্তরী আসি কলি চেতাইল।
ভোগী সঙ্গে দুঃশীলার আছিল সম্বাদ

ঙ. পঞ্চম অধ্যায়ে পুনি যুদ্ধের বিবাদ
তৃতীয় [ ত্রেতা] দ্বাপরে যেন নিবারিল রণ
লাজ পাই ঘরে গেল কলীন্দ্র দুর্জন।

তত্ত্বকথা যেন গুরুভার হয়ে না পড়ে, সেদিকে কবির সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তাই কবি চন্দ্ৰদৰ্প ইন্দুমতী, সূর্যবীর্য-চন্দ্ররেখা প্রভৃতি প্রণয়োপাখ্যানও প্রাসঙ্গিক করে সুকৌশলে এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। সত্য ও পুণ্যের জয় এবং মিথ্যা ও পাপের পরিণামে ক্ষয় প্রদর্শনই কবির লক্ষ্য হলেও কবি শিল্পীসুলভ সংযম রক্ষা করেছেন এবং বাস্তবজীবনে উপলব্ধ সত্যে তার তাচ্ছিল্য ছিল না। বাস্তবজীবনে পাপ ও মিথ্যা যে সত্যের ও পুণ্যের উপরে জয়ী হয় (তা যত সাময়িকই হোক না কেন) এবং সত্য ও পুণ্যের পথ যে বন্ধুর, দুঃখ-দুষ্ট এবং বর্থতাকীর্ণ তাও কবি নিপুণতার সঙ্গেই চিত্রিত করেছেন।

কবির প্রতীকী চরিত্রগুলোও জড়প্রতীক নয়, একান্তভাবে রক্তমাংসের মানুষ। আমাদেরই ঘরের ও সমাজের লোক। চিনতে একটুও কষ্ট হয় না, বরং মনে হয় নিত্য-দেখা অতি পরিচিত জন। কোথাও রহস্যের কিংবা অজানার আড়াল নেই।

পাত্র-পাত্রীর নামগুলো যেমনি গুণপ্রতীক, তেমনি সুন্দর : সত্য, কলি, দুঃশীলা, পাপসেন, ভীতসেন, দুঃশল, মিথ্যাসেতু, কৃপণ, ভোগী, নারদ, মিত্ৰকণ্ঠ, সত্যকেতু, সত্যবতী, বীর্যশালী, ধর্মকেতু, সুখ, সুদাতা, যোগী প্রভৃতি।

সত্যের ধ্বজা সূর্য, কলির পতাকা চন্দ্র–এ দুটোও গভীরতর তাৎপর্যপূর্ণ। সূর্য অগ্নিময়– সত্যে দাহ আছে; চন্দ্র স্নিগ্ধ ও সুন্দর–পাপ আপাতমধুর ও লোভনীয়।

যোগী-সত্যবতী ও ভোগী-দুঃশীলা সম্বাদে ব্যবহারবিধি, নিয়ম-নীতি, পাপ-পুণ্য ও সংযম অসংযমের যে তত্ত্ব ব্যক্ত হয়েছে তা মানবজীবনের চিরন্তন সমস্যার ইতিকথা।

কবি প্রসঙ্গক্রমে তার সমকালীন লোকচরিত্রের যে আভাস দিয়েছেন, তাতেই বোঝা যায়। সতেরো শতকে বিশ শতকে তফাৎ নেই কিছুই। অধিকাংশ মানুষের অমানুষিকতা আজো তেমনি রয়েছে।

মুহম্মদ খান পীরের দৌহিত্র, সূফীপীরের মুরীদ ও নিজে পীর ছিলেন। আবার দুর্লভ কবিত্বও তাঁর ছিল, সর্বোপরি তিনি প্রশাসনিক বিভাগে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অতএব তাঁকে আমরা সতেরো শতকের ধার্মিক ও ধর্মপ্রবক্তা, কবি ও সংস্কৃতিবিদ, রাজনীতিক ও অভিজাত নাগরিক হিসেবেই গ্রহণ করব। তিনি সতেরো শতকের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী মানুষের একজন। কাজেই তাঁর রচনা সে-শতকের সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মচিন্তার এবং নীতিবোধের প্রতীক ও প্রতিভূ।

[দশ শত বাণ শত বাণ দশ ধিক সনে তথা ১০০০ + ৫০০ + ৫ X ১০ + ৭ = ১৫৫৭ শকে-১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে এ গ্রন্থ রচিত।]

গবেষণা-সাহিত্য ও প্রবন্ধ-সাহিত্য

০১.

সাহিত্য ও শিল্প কিংবা ইতিহাস ও দর্শন সম্পর্ক এ-যুগে বিদ্বানদের ধারণা বদলে গেছে। আগেকার যুগে যে- কিছু সুন্দর করে আঁকলে-শিখলেই শিল্প বা সাহিত্যরূপে গৃহীত হত। তেমনি তথ্যের সমাবেশে হত ইতিহাস এবং তত্ত্বের উপস্থাপনায় হত দর্শন।

এখনকার যুগে ঘনিষ্ঠ জীবন-প্রতিবেশের নিরিখেই এগুলোর গুণাগুণ ও উপযোগ নির্ধারিত হয়। যেহেতু মানুষ তার সমকালীন স্বদেশে আনন্দ ও যন্ত্রণা এবং সম্পদ ও সমস্যা নিয়েই বাঁচে সেজন্যে তার সাহিত্যে ও শিল্পে কিংবা ইতিহাসে ও দর্শনে দেশ-কাল-সমাজ-প্রতিবেশপ্রসূত চেতনার স্বরূপ বিধৃত হবে–পাঠক-দর্শক এই প্রত্যাশাই রাখে। যদি সে প্রত্যাশা পূরণ না হয়, তাহলে রচিত শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাস-দর্শন উপযোগ হারায়। কেননা উপযোগই সব সাধনার ও গুরুত্ব নিরূপণের মাপকাঠি।

গবেষণাও আজ আর তথ্যের উদঘাটনে ও সমাবেশে সমাপ্ত নয়। দেশগত কালিক জীবন প্রতিবেশের উন্মোচন ও বিশ্লেষণই গবেষকের লক্ষ্য। তাই ইতিহাসের ক্ষেত্রে কেবল বাহ্য ঘটনা কিংবা আচরণ ও তার ফলাফলই শুধু জ্ঞাতব্য নয়। স্থানিক ও কালিক পরিবেশ, নৈতিক চেতনা, আর্থিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক মান, ধার্মিক প্রত্যয় ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রভৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সামষ্টিক প্রভাব জন- চৈতন্যে কীভাবে প্রতিফলিত এবং ভাব-চিন্তা-কর্মে কিরূপে অভিব্যক্ত তা দেখা-জানা-বোঝার জন্যেই ইতিহাস চর্চায় আজকের মানুষ আগ্রহী। দর্শনও আজ জীবন-নিরপেক্ষ তত্ত্বসর্বস্ব চিন্তার প্রসূন নয়–জগৎ প্রতিবেশে জীবন-চেতনার গভীরতর স্বরূপ যাচাইয়ের উপায় মাত্র।

.

০২.

গবেষণার ক্ষেত্রে যারা বিচরণ করেন, সঙ্গত কারণেই তারা হয় অধ্যাপক নয়তো হবু অধ্যাপক। তাই গবেষণা আজো বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রী। এবং অপ্রিয় হলেও এ-কথা সত্য যে গবেষণা আমাদের দেশে আজো বিশ্ববিদ্যালয়ী উচ্চতম উপাধি পরীক্ষার স্তর অতিক্রম করেনি। অর্থাৎ জ্ঞানের ক্ষেত্র প্রসারের জন্যে গবেষণার অঙ্গনে আজো কেউ তেমন বিচরণ করেন না। পেশার ক্ষেত্রে পদোন্নতি লক্ষ্যেই গবেষণার জগতে তাদের পদচারণা সীমিত। অতএব ব্যক্তিগত প্রেরণার সংকীর্ণ পরিসরেই আমাদের জ্ঞান-চর্চা পরিমিতি মানে, জ্ঞান-লোভীর অভিযাত্রার উদ্যম তাতে অনুপস্থিত। পেশাগত প্রয়াস নেশাগত না হলে আমাদের গবেষণার ক্ষেত্র অভীষ্ট ফসল-প্রসূ হবে না। তাছাড়া বিভিন্ন বিদ্যা আজো ইংরেজির মাধ্যমে অর্জন সাপেক্ষ বলেই গবেষণালব্ধ জ্ঞান, তথ্য ও তত্ত্ব পরিবেশিত হয়। ইংরেজি গ্রন্থেই এবং কিছু অসুবিধে ও কতকাংশে আমাদের হীনমন্যতার দরুন গবেষণা-স্থানও য়ুরোপ-আমেরিকা। তাই বাঙলাভাষা আজো গবেষণা-সাহিত্যে সমৃদ্ধ নয়। তবু ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস সম্পর্কিত কিছু কিছু গবেষণা গ্রন্থ গত বিশ বছরের মধ্যে বাঙলা ভাষায় রচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অধ্যাপকরাই প্রধানত এ কৃতিত্বের দাবীদার। এসব গবেষণামূলক রচনা তথ্যে ও তত্ত্বে ঋদ্ধ বটে,কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বহু প্রত্যাশিত স্থানিক ও কালিক জীবন-প্রতিবেশ নিরপেক্ষ। ফলে এসব গবেষণার উপযোগগত গুরুত্ব সামান্য। দেশগত ও কালগত জীবনের পটে উপস্থাপিত না হলে কোনো জ্ঞানই পূর্ণ জ্ঞানের মর্যাদা লাভ করে না।

.

০৩.

আমাদের প্রবন্ধ-সাহিত্যের দৈন্য ঘুচতে মনে হয় আরো দেরি আছে। অবশ্য পত্র-পত্রিকার প্রয়োজনে প্রবন্ধও প্রায় গল্প-কবিতার মতোই অজস্র লিখিত হয়। বিশেষ বিশেষ সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক উৎসব পার্বণ উপলক্ষে স্কুলের ছাত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অবধি সবাই প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু এদের প্রবন্ধ কৃচিৎ রচনার স্তর অতিক্রম করে। তার কারণ প্রবন্ধ যে প্রতিবেশ সচেতন লেখকের জ্ঞান, মন,প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের সমন্বিত অভিব্যক্তির ধারক তা তারা বোঝেন না। তাই বক্তব্যহীন বাঁচালতা কেবলই আবর্তিত হয়; চিন্তা রুচি কিংবা দৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন ঘোষণা করে না। সাময়িক আনন্দ কিংবা যন্ত্রণাজাত নতুন চিন্তা, রুচি ও অনুভব প্রসুত কোনো নতুন বক্তব্য না থাকলে প্রবন্ধ লিখবার অধিকার জন্মায় না। পুরোনো কথার রোমন্থনে আবশ্যক কী। যেমন ধরা যাক রবীন্দ্র-নজরুল পাকিস্তান-ইসলাম সম্বন্ধীয় একগাদা রচনা প্রতি বছরেই পার্বণিক প্রয়োজনে লিখিত হয়। কারো কোনো নতুন বক্তব্য নেই, অথচ ম্যাগাজিন ও পত্রিকার প্রয়োজনে কিংবা রেডিয়ো-টেলিভিশনের তাগিদে তারা লেখেন। ফলে সব লেখাই হয় নিবর্ণ ও নির্বিশেষ। প্রবন্ধে যদি লেখকের ব্যক্তিত্বের ছাপ না রইল অর্থাৎ কে বলছে ও কী বলছে–এ দুটোর সমন্বয় না হল তাহলে পাঠক মনে সে লেখার কোনো প্রভাবই পড়ে না। যে-কথা কেজো নয়, সে কথা পাগলে ছাড়া কেউ বলে না। বক্তব্য মাত্রেরই উদ্দিষ্ট থাকে শ্রোতা, যে-বক্তব্য বিভিন্ন মুখে বহুশ্রুত তা তাৎপর্যহীন ও আটপৌরে। বহু মনের স্পর্শ তা মলিন ও তুচ্ছ।

প্রবন্ধ যে সবসময় সাহিত্য হবে তা নয়, কিন্তু শোনার মতো বক্তব্য হবে তার প্রাণ। স্বদেশের ও স্বকালের জীবন-প্রতিবেশের আনন্দ ও যন্ত্রণার, সম্পদ ও সমস্যার অভিঘাত যদি মন-বুদ্ধিকে বিচলিত করে, প্রাগ্রসর চেতনায় উল্লাস কিংবা যন্ত্রণা এনে দেয় অথবা কোনো পুরোনো ভাব-চিন্তা কর্ম বা তত্ত্ব, তথ্য ও বস্তু নতুন তাৎপর্যে চমকপ্রদ হয়ে ওঠে অথবা চেতনায় নতুন দৃষ্টি দান করে তখনই কেবল বলবার মতো বক্তব্য প্রকাশের আবেগ সৃষ্টি হয়। এবং তেমন প্রবন্ধই কেবল পাঠকের প্রত্যাশা পূরণ করে।

গত বিশ বছর ধরে কয়েককুড়ি লেখক যে-কয়েক শ প্রবন্ধ লিখেছেন, তার মধ্যে থেকে শতখানিক ভালো প্রবন্ধ হয়তো পাওয়া যেতে পারে। মানবশক্তির এ-ও একপ্রকার অপচয়।

স্বদেশের স্বকালীন মানুষের জীবন ও জীবিকার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির, মত ও পথের, ধর্ম ও সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের সমস্যা ও সংকট যাদের চেতনায় জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে যন্ত্রণা জাগিয়েছে অথবা গভীর উল্লাস ও আবেগ সৃষ্টি করেছে, তারাই কেবল সার্থক প্রবন্ধ রচনা করতে পেরেছেন। তেমন প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রবন্ধকারেরা দেশে চিন্তা- নায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেন, অতুল জ্ঞান-প্রজ্ঞা তত্ত্বের-ভাব-চিন্তা–কর্মের ও মত-পথের দিশা দিয়ে তারা জাতিকে যুগোপযোগী ও কল্যাণাভিসারী করে তোলেন।

প্রবন্ধ-সাহিত্যে আমাদের দৈন্যের মধ্যেও আশ্বস্ত হই যখন দেখি আমাদের সমাজ-সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমস্যা ও সঙ্কট-সচেতন অন্তত কয়েকজন প্রবন্ধকার আমরা পেয়েছি, যারা শোষিত পীড়িত নির্যাতিত ও মূঢ় দেশবাসীর জন্যে বেদনা-ক্লিষ্ট হৃদয়ে উদ্বিগ্ন চিত্তে প্রতিকার-পন্থা সন্ধানে সদানিরত।

তারা অজ্ঞের অজ্ঞতা, অন্ধের অন্ধতা, মূঢ়ের মোহ, পথভ্রষ্টের যন্ত্রণা ঘুচানোর কাজে তাদের মন-মনন নিয়োজিত করেছেন। অবশ্য পিছুটান দেবার লোকেরও অভাব নেই। তাদের সর্বপ্রযত্নও যে প্রায়ই অসাফল্যে বিড়ম্বিতোর মূলে রয়েছে তাদের প্রতিক্রিয়াশীলতা ও পশ্চাৎমুখিতা।

প্রবন্ধ সুচিন্তিত, সুযৌক্তিক ও সুলিখিত হবে বটে, কিন্তু সাহিত্য হওয়া জরুরি নয়। কেননা প্রবন্ধ হচ্ছে চিন্তার ও যুক্তির প্রসূন-গরজের সৃষ্টি। তাই সমকালীন সমাজজীবনের ও জীবিকার যে- কোনো বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচিত হতে পারে এবং হয়ও। জ্ঞানগর্ভ ও নৈতিক-তাত্ত্বিক প্রবন্ধই কেবল দীর্ঘায়ুর দাবীদার। অবশ্য জ্ঞান পূর্ণসাপেক্ষ আর নীতিচেতনা এবং তত্ত্ববোধও আপেক্ষিক এবং সে কারণে পরিবর্তনশীল। যেমন চুরি করা অপরাধ; তার শাস্তি হস্ত কর্তন। কিন্তু আজকের মানববাদীর চোখে বুভুক্ষুর ভাতচুরি নিঃস্বর পয়সা চুরি–অপরাধ হতে পারে না। অভাবজাত চুরি অপরাধ নয়, স্বভাবজাত চৌর্যই অপরাধ। কাজেই হস্ত কর্তন করতে হবে ঘুসখোর পদস্থকর্মচারীর, গরিব চোরের নয়। অর্থাৎ যে-অভাবের ও যে-বেকারত্বের কারণে মানুষ চৌর্যবৃত্তি গ্রহণ করে, সমাজ-পরিবেশে সেই আর্থিক অসাচ্ছল্যের অনুপস্থিতির পরও যদি কেউ চোর হয়, তাহলেই হস্ত কর্তন ন্যায়সিদ্ধ। অন্যথায় তা হবে অমানুষিক অযৌক্তিক বর্বরতা। আবার ভূগর্ভ সমুদ্র আকাশ নক্ষত্র চন্দ্র জল বায়ু নীতি রাষ্ট্র প্রভৃতি সম্পর্কিত পূর্বজ্ঞানের তথ্যগত অপূর্ণতাই এ সম্বন্ধীয় পূর্ববর্তী রচনাকে পরিত্যাজ্য করে। অতএব কোনো বিষয়ক প্রবন্ধই স্থায়ী সাহিত্যের মর্যাদা পাবে না। অবশ্য কালান্তরে মানুষের ভাষা, ভঙ্গি ও চেতনা বদলায় বলে সৃজনশীল সাহিত্যও অবিনশ্বর হয় না। যদি সাহিত্যগুণও থাকে তাহলেও বক্তব্যের সাময়িকতা তাকে স্বল্পায়ু করবে। শিল্পগুণের ও বক্তব্যের চিরন্তনত্বের সহ-স্থিতি সুদুর্লভ মহামুহূর্তের দান। তেমন প্রবন্ধ অবশ্যই স্থায়ী সাহিত্য।

জিজ্ঞাসা

০১.

জিজ্ঞাসা জৈবিক বৃত্তি কিনা জানিনে, কিন্তু মানবিক যে তাতে সন্দেহ নেই। বলতে গেলে বিশেষ অর্থে ওটাই মানুষের RATIONALITY-র ভিত্তি, প্রাণিজগতে মানুষের Differentia. কেননা জিজ্ঞাসা থেকেই জ্ঞানের উদয়, চিন্তার উদ্ভব, অনুশীলন তথা বিকাশ। জিজ্ঞাসাই মানুষের সংস্কৃতি সভ্যতা বিকাশের মূল প্রেরণা। জিজ্ঞাসার অশেষ আকুতিই চিন্তা ও কর্মে প্রবর্তনা দেয়। এই জিজ্ঞাসাই কল্পনাজগতের উপর মানুষের আধিপত্যের কারণ এবং বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য-শিল্পাদি কলার জন্মদাতা। এক কথায় মানুষের যা-কিছু স্বকীয় তা জিজ্ঞাসার দান।

কার্যকারণ জানবার ইচ্ছাই জিজ্ঞাসা। কার্যের কারণ আবিষ্কারের কৌতূহল মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি। বলা চলে যে-কোনো ঘটনার পশ্চাতে অন্তত যেমন-তেমন একটা কারণ অনুমান করতে না পারলে বা না করে সে স্বস্তিবোধ করে না। যেমন পৃথিবী কখনো কখনো কেঁপে ওঠে নড়ে ওঠে। কিন্তু কেন? ভেবে ভেবে সে বের করল পৃথিবীটা সহস্রমুণ্ড নাগের মাথায় কিংবা গরুর শৃঙ্গে স্থাপিত। ভার যখন অসহ্য হয়ে ওঠে তখন নাগ বদলায় মাথা, গরু বদলায় শিঙ। এই স্থানান্তরের সময় কেঁপে ওঠে পৃথিবী, নড়ে ওঠে বিশ্বসংসার। এদের অসাবধানতার কিংবা বিরক্তির ফলে প্রলয়কাণ্ড ঘটে যায় কখনো কখনো। আরো পরে বিজ্ঞ মানুষ বুঝল ওরা ধর্মের অনুগত ও ধর্মের দাস। পাপাসক্ত মানুষের পাপের ভারই ওদের বিরক্তির কারণ।

আকাশে চাঁদ-সূর্য কেবল ঘোরে না, রাহু-কেতুর গ্রাসেও পড়ে। হয় তারা কোনো প্রবল দুরাত্মার কবলে পড়ে দুঃখ পায়, অথবা স্বকৃত অন্যায়ের শাস্তি ভোগ করে। স্বর্গলোক নিশ্চয়ই পায়ের তলায় থাকার কথা নয়; কাজেই আকাশে তার স্থিতি। অবশ্য স্বর্গ মানেও আকাশ। রাত্রে নির্জন প্রান্তরে আগুনের শিখা থাকবে কেন; নিশ্চয়ই এ ভূতের চেরাগ–আলেয়া। শূন্যতা তো ব্যর্থতারই লক্ষণ। পূর্ণতা যেমন সাফল্যের প্রতীক। অতএব শূন্য ঘট কিংবা কলসি দেখার পরে অভিষ্ট সিদ্ধ না-হওয়ারই কথা। তেমনি হাঁচি, কাশি, টিকটিকি, ডিম, ঝাটা, হোঁচট ও পিছুডাকা দুর্লক্ষণ বলে পরিচিত। কেননা কারো কারো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও এই কাকতালীয় ন্যায়ের যাথার্থ্য প্রমাণের নিশ্চয়ই সহায়কও ছিল। প্রয়োজনের তাগিদ ও বাঞ্ছর তীব্রতা মানুষকে গুরুত্ব চেতনা দেয়, তখন অভীষ্টে অসিদ্ধি, প্রয়াসে ব্যর্থতা ও কর্মে অসাফল্য, দৈবিক কারণ সন্ধানে প্রবর্তনা দেয় মানুষকে। তখন প্রকৃতি ও পরিবেষ্টনী, বস্তু ও প্রাণী তার সাফল্য-ব্যর্থতার দৈব প্রতীক হয়ে ওঠে। উদ্দেশ্যবিহীন যাত্রায় কিংবা গুরুত্বহীন কর্মে অর্থাৎ লাভক্ষতির ভয়-ভরসা যেখানে নেই, সেখানে মানুষ শুভাশুভ সম্বন্ধে কিংবা দৈবানুকূল্য বা বিরূপতা সম্বন্ধে সচেতন থাকে না। যেমন গ্লাস থেকে যদি পানি পড়ে যায় তখন মানুষ তাতে অশুভ কিছু দেখে না। কিন্তু বহুতে আনা পড়া-পানি পড়ে যাওয়া নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্যজ্ঞাপক। কিংবা পয়সার জিনিস একবাটি দুধ পড়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে দুর্লক্ষণ। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সব সন্ধিস্থলেই অসংখ্য রেখা রয়েছে কিন্তু কোনো রেখারই কোনো তাৎপর্য নেই–কোনো রেখাই নিয়তি প্রতীক নয়–কেবল হাতের তালুর রেখারই আছে গুরুত্ব।

এমনি করে মানুষ তার জীবনের ও ভুবনের সবকিছুর কার্যকারণ সম্বন্ধ আবিষ্কার করে হয়েছে আশ্বস্ত ও নিশ্চিত।

.

০২.

জিজ্ঞাসাবৃত্তি মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি হলেও, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন মানুষ পরমুখাপেক্ষী, পরশ্রমনির্ভর ও পরান্নজীবী, এক্ষেত্রেও তেমনি সাধারণত তারা অবহেলাপরায়ণ। কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যে তারা অপরের বুদ্ধি, চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। পরের মুখে শুনেই তারা সন্তুষ্ট। নিজেরা ভেবেচিন্তে বিচার-বিশ্লেষণ করে কিছু যে বের করবে সে-ধৈর্য ও অধ্যবসায় তাদের নেই। এ ব্যাপারে তারা আশুতোষ। প্রয়াসবিহীন প্রাপ্তিতেই তাদের আনন্দ ও সন্তোষ। এই আলস্য ও অবহেলা মানুষের পক্ষে শুভ হয়নি। মানুষের মন্থর অগ্রগতির এ-ই মূল কারণ। বস্তুত পূর্বোক্ত স্তরেই রয়ে গেছে পৃথিবীর পনেরো আনা মানুষ। তারা চিরকালের জন্যে নিশ্চিত হয়েছে তাদের জিজ্ঞসার আপাত যৌক্তিক জবাব পেয়ে ও আপাত রম্য সমাধান নিয়ে। এজন্যে আদিম আরণ্য জীবন যেমন সুলভ, তেমনি যান্ত্রিক জীবন-চিন্তাও সভ্য-শহুরে মানুষে দুর্লভ নয়। ফলে অধিকাংশ মানুষ রয়ে গেছে মানবিকতার শৈশবে-বাল্যে। এবং তাদের মনে নতুন করে জিজ্ঞাসা না জাগলে আর সে-জিজ্ঞাসার জবাব নিজেরা মন-বুদ্ধি-জ্ঞান দিয়ে সন্ধান না করলে তাদের–মানুষের বাল্যাবস্থা কখনো ঘুচবে না। যে-দেশে বা যে-গোত্রে জিজ্ঞাসু মানুষের সংখ্যা বেশি সে-দেশে ও সে-গোত্রের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মননের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে।

অতৃপ্তি ও কৌতূহল এবং শোনা-কথায় সন্দেহ ও অনাস্থাই জিজ্ঞাসার জনক। এজন্যে উদ্যমশীলতার প্রয়োজন। আবার সে-উদ্যম আসে নতুন আকাঙ্ক্ষা আর বিরুদ্ধ শক্তির প্রতিরোধ প্রয়োজন, সুখবাঞ্ছ ও জীবনস্বপ্ন থেকে। যে বাহীন, স্বপ্নহীন তার পক্ষে জিজ্ঞাসা জিইয়ে রাখা ও জবাব খোঁজার প্রয়াসী হওয়া অসম্ভব। তাই সে প্রশ্নহীন, গতানুগতিকতায় সে অভ্যস্ত ও নিশ্চিন্ত এবং বিশ্বাসে আশ্বস্ত। এরা বদ্ধজীব, এদের মন-আত্মা বন্ধক রয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আজন্ম লালিত বিশ্বাস-সংস্কারে। এরা পুরোনো ধর্মে, জীর্ণসমাজে, হৃতউপযোগ আদর্শে ও বাড় বৈচিত্র্যহীন জীবনযাত্রায় স্বস্তি খোঁজে পরমনির্ভরতায়। এগুলোকে বিপদে-সম্পদে জীবনের নিরাপদ আশ্রয় বলেই তারা জানে। দুর্বল ও জিজ্ঞাসাহীন মনের প্রশ্রয়ে বিশ্বাস-সংস্কার বুনোলতা কিংবা অশ্বথ-শিকড়ের মতো মানুষের মন-বুদ্ধি-আত্মাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে জীনতা আনে জীবনে, এমন মানুষ কেবলই প্রাণী–নিয়তিবাদী পোষমানা প্রাণী, তার না আছে জিজ্ঞাসা, না আছে বিদ্রোহ করবার মতো মন। সব মানুষে জিজ্ঞাসার তীব্রতা নেই বটে, কিন্তু সব মানুষই ভোগলি ও আরামপ্রিয়। উদ্যমহীন মানুষ সুখের ও ভোগের স্বপ্ন দেখে এবং তারা যে-কোনো স্বপ্নের বাস্তবায়ন চায় কৃত্রিম ও অলৌকিক উপায়ে। তাই সে দৈব-নির্ভর, কল্পনাপ্রিয় এবং নিষ্ক্রিয়। সে আধিদৈবিক কিংবা আধ্যাত্মিক শক্তিবলে সাধের ও স্বপ্নের ভোগ্যবস্তু হাতের মুঠোয় পেতে অভিলাষী। এক্ষেত্রেও সে পরনির্ভরশীল এবং পরসম্পদজীবী।

কেননা সে দৈবশক্তি অর্জনে কিংবা অধ্যাত্মবিদ্যায় ও সাধনায় সিদ্ধিলাভে প্রয়াসী নয়। সে পীর-ফকির, সাধু-সন্ন্যাসীর অনুগ্রহ, তুকতাক, দারুটোনা, তাবিজ-কবচ অথবা ঝাড়-ফুঁকের বদৌলতে ও কেরামতিপ্রভাবে বাঞ্ছসিদ্ধি কামনা করে। এই নিষ্ক্রিয় দলের জীবন-স্বপ্ন মানুষকে করেছে কল্পনাবিলাসী-ভূত-প্রেত-দেও-দানব-গন্ধর্ব-পরী অঙ্গরা তাদেরই কল্পনোক সহচর। মন্ত্রবলে আকাশে উড়তে কিংবা পাতালে প্রবেশ করতে, নদ-নদী উল্লম্বনে অথবা মরু-কান্তার উত্তরণে বাধা নেই কোথাও সেই কল্পনা ও বাসনার জগতে। রূপকথা, উপকথা, ধর্মকথা, পুরাণকথা প্রভৃতি এদেরই সৃষ্টি।

যারা উদ্যমশীল তারা জ্ঞান, বুদ্ধি ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসে বাস্তবক্ষেত্রে বাঞ্ছসিদ্ধির উপায় উদ্ভাবনে। তারা আকাশে উড়বার যন্ত্র, পাতালের খবর জানার কৌশল, সাগরতলা দেখবার দৃষ্টি, রোগ নিরাময়ের নিদান, কর্মে সাফল্যের কল এবং অন্যান্য বাঞ্ছসিদ্ধির সামর্থ্য অর্জনে হয় ব্রতী। এই মানুষের দ্বারাই বৈষয়িক জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দান সম্ভব হয়েছে। এরাই করেছে প্রয়োজনীয় সব বস্তু আবিষ্কার ও নির্মাণ। শস্য-উৎপাদন অথবা মৃতে প্রাণসঞ্চার থেকে আণবিক শক্তি সন্ধান কিংবা গ্রহলোকে গমন অবধি সবকিছুই উদ্যমশীল আত্মপ্রত্যয়ী মানুষের দান। এরাই মিটিয়েছে অলস মানুষের সুখ-স্বপ্ন ও সাধ।

আজ উদ্যমশীলতা ও আত্মপ্রত্যয় প্রতীচ্যের সম্পদ আর উদ্যমহীনতা ও দৈব নির্ভরতায় প্রাচ্য মানবের পরিচয়। প্রাচ্যে যা কল্পনা, পাশ্চাত্যে তা-ই বাস্তব; প্রাচ্যে যা আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য, প্রতীচ্যে তা-ই যান্ত্রিক সম্পদ। এ পার্থক্যের মূলে রয়েছে প্রতীচ্য মানুষের শোনা-কথায় সন্দেহ ও অনাস্থা এবং কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, আত্মবিশ্বাস, উদ্যম ও অবিরাম প্রয়াস; আর প্রাচ্য-মানবের প্রয়াসহীন প্রাপ্তি-লিপ্সা, আজন্ম লালিত বিশ্বাস- সংস্কারে নিষ্ঠা, প্রশ্নহীন প্রত্যয় এবং আত্মসামর্থ্যে অনাস্থা। জিজ্ঞাসার ও আকাক্ষার, আত্মপ্রত্যয়ের ও উদ্যমের মেলবন্ধন না হলে জীবনে ও জীবিকায়, মনে ও মানসে যে- জীর্ণতা আসে তা থেকে হাজার হাজার বছরেও যে ব্যক্তির বা সমাজের মুক্তি ঘটে না, তার সাক্ষ্য আফ্রো-এশিয়ায় অনুন্নত ও আরণ্য সমাজ।

অতৃপ্তি, কৌতূহল, অনবরত নতুন নতুন জিজ্ঞাসা ও উত্তর সন্ধানের অক্লান্ত উদ্যমই মানুষকে প্রগতি দান করে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসারের মূলে রয়েছে এ জিজ্ঞাসা ও উদ্যম। অতএব পুরানো-প্রীতি পরিহার করে নতুনের স্বপ্নে ও আকাঙ্ক্ষায় মন ও মননকে জাগিয়ে তুলতে না পারলে সন্ধানী ও সৃজনশীল হওয়া, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না কারো পক্ষে।

গোড়াতেই বলেছি, জিজ্ঞাসা একটি মানবিক বৃত্তি। এর জাগর আছে, সুপ্তি আছে, মৃত্যু নেই। আমাদের জিজ্ঞাসাবৃত্তি অনেক অনেক কাল ধরে সুপ্ত। তাই আমরা আজ অনুকারক ও প্রতীচ্য-নির্ভর। আমাদের জিজ্ঞাসা-বৃত্তি উদ্দীপিত না করলে আমরা কখনো সুস্থ ও সুস্থ হয়ে স্বকীয়তার ঔজ্জ্বল্যে ও মহিমায় আত্মনির্ভর ও আত্মসম্মানসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে পারব না।

এ অসাধ্য-দুঃসাধ্য কোনো সাধনা নয়। অভিপ্রায় সাংকল্পিক দৃঢ়তা পেলেই আমরা সফল হব। কেননা মানুষের সামর্থ্য হচ্ছে কচুগাছের মতোই, সে সুপ্তিতে অদৃশ্য হয় বটে কিন্তু জাগরে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। প্রাণশক্তির অজস্রতায় সে দেহে পায় পুষ্টি ও লাবণ্য।

জাতির জীবনে এমনি নধর-কান্তি নিয়ে আসে জিজ্ঞাসা ও উদ্যম। তৃপ্তমন্য ও কাক্ষাহীন, নিরুদ্যম ও প্রশ্নহীন জাতিও মরে না, জীর্ণ জীবনের দুর্ভোগই তার নিয়তি হয়ে ঘাড়ে চাপে মাত্র। কার্য-কারণ সচেতন হলেই জাতির দুর্ভোগ ঘোচে। নতুন চেতনার প্রসাদ পেয়ে সে আবার প্রাণের পূর্ণতা অনুভব করে, ধন্য হয় নিজে, ধন্য করে তার প্রতিবেশকে।

জীবনের নিয়ামক

আদিকাল থেকে মানুষ দৈবশক্তির অস্তিত্বে আস্থা রেখেছে এবং নিজের ভাগ্যকে সে- শক্তির সঙ্গে করেছে যুক্ত। যে যত বেশি দুর্বল, অসহায় ও অসমর্থ; তার জীবনে দৈব-শক্তির প্রভাবও তত অধিক। জীবনে রয়েছে নানা প্রয়োজন, নানা অভাব এবং তা বাঞ্ছ বা আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপে মনের কোণে জেগে থাকে। যা চাওয়া হয় তা পাওয়া যায় না। চাওয়া-পাওয়ার মধ্যেকার ব্যবধান ঘোচানো যখন সাধ্যাতীত বলে নিশ্চিত ধারণা জন্মায় অথচ প্রাপ্তির বা কোনোমতেই মন থেকে মুছে ফেলা যায় না, তখন বাঞ্ছর তীব্রতা মনের মধ্যে জাগায় একপ্রকার স্বপ্ন কিংবা কল্পনা –যা যুক্তি, বুদ্ধি অথবা দৃষ্টিগ্রাহ্য উপায়বোধের অতীত। কোনো অলৌকিক উপায়ে কোনো অদৃশ্য শক্তির সাহায্যে যদি আমার বাঞ্ছ সিদ্ধি হত –এমনি মানস অবস্থা থেকে দৈবশক্তির উদ্ভব। যেখানে সাধ্য-সামর্থ্যের শেষ, সেখান থেকেই কামনার উদ্ভব, আর এই কামনার আশ্রয়েই দৈবশক্তির উদ্ভব ও বিকাশ। অতএব সাধ্যাতীত লিপ্সর প্রশ্রয়ে কামনার জন্ম, এবং কামনা-পূর্তির সহায় হিসেবে অলৌকিক অদৃশ্য সত্তার আবির্ভাব ও স্থিতি। জীবনের মৌল বাঞ্ছ দুটো–আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসার, জীবনের নিরাপত্তা ও জীবিকার সংস্থান। দুটোর কোনোটাই নির্বিঘ্ন নয়। তাই অদৃশ্য শক্তির সহায়তা আবশ্যক। আদিম মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি ও কল্পনা ছিল কম; তাই সর্বপ্রাণবাদ, জাদুবিশ্বাস প্রভৃতি দিয়ে তার জীবনযাত্রার শুরু।

ক্রমে ক্রমে তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির বিকাশ হয়েছে এবং জীবন ও জীবিকার নিয়ন্ত্ৰীশক্তির ধারণাও সে-অনুপাতে প্রসার লাভ করেছে। সে দৈবশক্তির শ্রেণীভাগ করেছে–অরি ও মিত্র শক্তিরূপে। ঐ শক্তিতে সে আরোপ করেছে ব্যক্তিত্ব। আবার শক্তির তারতম্য ও কর্তব্য নিরূপণ করে সে অসংখ্য দেবতা, উপদেবতা ও অপদেবতার কল্পনা করেছে। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে প্রসারিত জগৎ সম্বন্ধে তার ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছে, কল্পনার যৌক্তিকতা এবং সৌন্দর্যও ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে–মনুষ্য সমাজের বিকাশ ও সম্ভাবনার আদলে সৃষ্টি হয়েছে তার সেই শক্তির ও সম্ভাবনার, সৌন্দর্যের ও ঐশ্বর্যের, আনন্দের ও যৌবনের দেবনোক। সে জগৎ অমরত্বের, চিরবসন্তের, চিরযৌবনের ও চির-আনন্দের। আদি মানবের অবোধ বাসনায় যার জন্ম, ক্রমে তার বিস্ময়কর বিকাশবিস্তার হয়েছে। মানুষের দেহ-মন-আত্মাকে আচ্ছন্ন করে বট-অশ্বথের মতোই বিপুল হয়েছে সে জড়ে ও কলেবরে। অক্টোপাস ও অশ্বথের ধর্ম অভিন্ন। যাকে জড়িয়ে ধরে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে; তাদের প্রীতির বন্ধন-মমতার আলিঙ্গন মৃত্যুর আগে আর শিথিল হয় না। তাই আজ দৈবশক্তির সম্পর্ক, প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণবিহীন জীবন কল্পনা করাও মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য।

মনুষ্য-চেতনার শৈশবে এ অদৃশ্য সত্তার জন্ম। তারপর তার চেতনার বাল্যের, কৈশোরের, যৌবনের ও প্রবীণ বয়সের জ্ঞান, বুদ্ধি ও কল্পনার অনুপাতে এই বোধের বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেছে। এতে তার বোধ ও কল্পনার আমূল রূপান্তর হয়েছে কখনো কখনো। ফলে জগতের বিভিন্ন অঞ্চলে এ বোধের জন্ম আর মৃত্যুও কম হয়নি। এ বোধের ও তৎসংক্রান্ত যাবতীয় ভাব-চিন্তা, আচার আচরণ ও বিধি-নিষেধের নাম ধর্ম। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি, যুক্তি, কল্পনা প্রভৃতির প্রয়োগে ধর্মতত্ত্ব, তথ্য, যুক্তি, মনন ও আবেগের আধার হয়েও উঠেছে। এভাবে সর্বপ্রাণবাদ, দেববাদ, সর্বেশ্বরবাদ ও একেশ্বরবাদে উত্তরণ ঘটেছে মনুষ্যচিন্তার ও বোধের। এমনকি নাস্তিক্যও এ বোধের ও চিন্তার প্রসূন–বিদ্রোহী সন্তান। জ্ঞানবাদে, ভক্তিবাদে, কর্মবাদে, ভাববাদে ও লীলাবাদে এর বিচিত্র বিকাশও লক্ষণীয়। এটি আর কেবল বাঞ্ছ-সিদ্ধির সহায় থাকেনি। সমাজ-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকল্পে ন্যায়-নীতিবোধ, প্রীতি-করুণা-মৈত্রী, দয়া-মা-সহিষ্ণুতা প্রভৃতি মানবিক গুণ জাগানো লক্ষ্যে ধর্মবোধ হয়েছে নিয়োজিত। বাঞ্ছা-সিদ্ধিকামী অসহায় মানুষের কামনার প্রসূন যে এমনি করে জন্ম-মৃত্যুর পরিসরে সীমিত মানব-জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্ম, রোগ-শোক-যন্ত্রণা, আরাম-আনন্দ আকাক্ষার অবলম্বন ও নিয়ন্তা হবে তা কে জানত!

ধর্ম মানব-প্রতিভার এক আশ্চর্য উদ্ভাবন। ধর্ম মানুষের প্রাণের উচ্ছলতা, কামনার উদ্দামতা, অভিলাষের অদম্যতা, আচরণের অবাধতা, চিন্তার স্বাধীনতা সম্ভাবনার বিচিত্রতা প্রভৃতি এক নিয়মিত খাতে পরিচালিত করে যান্ত্রিক পরিমিতিতে সীমিত রাখে। ধর্ম দুরাত্মাকে করে নিয়ন্ত্রিত, সু-আত্মাকে রাখে আড়ষ্ট, আনন্দকে করে দুর্লভ, অতৃপ্তিকে করে চিরন্তন, আকাঙ্ক্ষাকে করে বোবা, বেদনাকে করে অন্ধ, অনুভূতি হয় নিরবয়ব আর গতি হয় সীমিত। সবল ও দুর্বল, জ্ঞানী ও মূর্খ, সাধু ও দুষ্ট সমভাবেই থাকে কাবু। ধর্মবোধ মানুষের অন্তরে এমন এক জীর্ণতা এনে দেয়, প্রাণশক্তির উৎসমুখে এমন এক বাঁধ নির্মাণ করে, এমন এক প্রত্যয় ও নিশ্চিত ভাব জাগায় যার কবলমুক্ত হওয়া সম্ভব হয় না কারো পক্ষে। এর প্রভাবের বুঝি সীমা শেষ নেই। তাত্ত্বিকের ভাষায় একে মায়া কিংবা বিষয়ীর ভাষায় একে আফিম বলা চলে বটে, কিন্তু সবটা বলা হয় না। কারণ বোধাতীত এ নেশার স্বরূপ ধরা ভার। মানুষের মর্মমূলে এর বাস। জীবনের সঙ্গে নিঃশেষে জড়িয়ে যায় এ বিশ্বাস।

অনেক মনীষীর মতে এই যুক্তি ও বিজ্ঞানের যুগে বিশ্বাসের অঙ্গীকারে ও কল্পনার প্রশ্রয়ে রচিত পুরোনো ধর্মের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। যে পরিবেশে ও প্রয়োজনে ধর্মগুলো প্রবর্তিত হয়েছিল, সে-পরিবেশ আজ আর নেই বলেই তার উপযোগও শেষ হয়েছে। বর্বর মানুষের মনুষ্যত্ব জাগানো লক্ষ্যে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকল্পে ধর্মের উদ্ভব। ধর্ম তার ঐতিহাসিক ভূমিকা কৃতিত্বের সঙ্গে সুষ্ঠুভাবেই পালন করেছে। তাই সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তন ধারায় ধর্মের ভূমিকা ও তার গুরুত্ব আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব। তার ঐতিহাসিক মর্যাদা স্বীকার করব অকুণ্ঠ চিত্তে।

আজ বহু মানুষের আশ্চর্য আত্মিক উন্নতি হয়েছে। তাদের সামাজিক ও মানস সঙ্গ পেয়ে অন্যরা হয়ে উঠেছে মনুষ্যত্ব-সচেতন। মানবিক তথা সামাজিক দায়িত্ব কর্তব্য প্রকাশ্যত অস্বীকার করে না তারা। কাজেই অলৌকিক চেতনা-লব্ধ পুরোনো ধর্মের প্রয়োজন নেই আর।

ধর্মও মানুষের সমাজ-সভ্যতার শৈশব-বাল্যের ধাত্রী। স্বীকার না করে উপায় নেই যে মনুষ্য সভ্যতা আজ কৈশোরও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। লোকে বলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের প্রতিভা এখন বিকাশের ও প্রকাশের মধ্যগগনে স্থিত এবং এখন মানব-সভ্যতার মধ্যাহ্ন। তাই যদি হয় তাহলে শৈশবের ধাত্রী ধর্মের পরিচর্যার আর প্রয়োজন নেই।

শৈশব-স্বভাব যতদিন থাকবে ততদিন তো সাবালেগ হওয়া যাবে না। বয়স্ক মানুষের শিশু স্বভাব নিন্দনীয়, আত্মীয়ের পক্ষে বেদনাদায়ক। তাহলে আজকের পরিবর্তিত পরিবেশে সমাজ সভ্যতার প্রায় পূর্ণাবয়ব প্রাপ্তির পরও শৈশবের সে-ধর্ম ধরে থাকা কল্যাণকর নয়।

ধর্মের মূল লক্ষ্য সমাজ-প্রেক্ষিতে দায়িত্ব-চেতনা ও কর্তব্যবুদ্ধি জাগানো। দায়িত্ব-চেতনা ও কর্তববুদ্ধি জোর করে জাগানো যায় না। তার সাথে ব্যক্তি-মনের সায় থাকা চাই। মনের এই সম্মতি আসে সুরুচি ও আত্মসম্মানবোধ থেকে। অতএব আত্মমর্যাদাবোধই দায়িত্বজ্ঞানের ও কর্তব্য চেতনার উৎস। মর্যাদা সচেতন মানুষই কেবল দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যত্ন করে। আত্মসম্মানজ্ঞান আবার পরিবেশ ও শিক্ষার দান। শিক্ষার গুরুত্ব যে অধিক তার প্রমাণ দুষ্ট শিক্ষিত লোকের অপকর্মের সাধারণত মাত্রা ও সীমা আছে, দুষ্ট অশিক্ষিত লোকের নেই। তাছাড়া মর্যাদাকামী লোক জীবনে ও সমাজে অধিকার ভেদ মেনে চলে।

বিশেষ করে দেখা গেছে অধার্মিক আস্তিক মানুষও করে না হেন অপকর্ম নেই। কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস কাউকে সৎ ও উন্নত করে না, যদি না সে দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবুদ্ধি ও মর্যাদাজ্ঞানসম্পন্ন হয়।

জানামি ধর্ম ন-চ প্রবৃত্তি। জানামি অধর্ম ন-চ নিবৃত্তি।–এই পুরোনো আপ্তবাক্য অপকর্মাসক্ত, লিলু আস্তিক মানুষেরই খেদোক্তি।

গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সভ্য ও আস্তিক যিশুর প্রেমবাদী খ্রীস্টান জার্মানেরা প্রায় এক লাখ ইহুদি হত্যা করেছে, আমেরিকানরা মেরেছে অসংখ্য জাপানি। অতগুলো পিঁপড়ে হত্যা করতেও বিবেকবান নাস্তিক মানুষের প্রাণে লাগে। খ্রীস্টান ও মুসলমান নাইজেরিয়া আজ ইবো গোত্রীয় আশি লক্ষ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার বর্বর উল্লাসে মত্ত। দুনিয়ার ইতিহাসে বড় ছোট এমনি হাজার হাজার অমানুষিক দানবীয় নিষ্ঠুরতার ও অপকর্মের সাক্ষ্য রয়েছে। আজো এমনি বর্বরতার অবধি নেই। সবটাই প্রায় আস্তিক ও উন্নত ধর্মাবলম্বী মানুষের একক ও যৌথ স্বার্থে কৃত। গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও জাতি-চেতনা ছাড়াও ধর্মচেতনাও বহু বর্বরতার জন্যে দায়ী। অবশ্য রাজনৈতিক মতও এমনি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়-চেতনা জাগায় আর বর্বরতায় উৎসাহিত করে। ধর্মমতবাদ কিংবা রাজনৈতিক মতবাদ যে-কোনো মতবাদ পরিণামে অসহিষ্ণুতা জাগায় মতবাদীর মনে। হাঙ্গেরী (১৯৫৬) ও চেকোশ্লোভাকিয়ায় (১৯৬৮) রুশ বর্বরতা, চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অমানুষিকতা, ভিয়েৎনামে আমেরিকার দানবিক দৌরাত্ম্য প্রভৃতি এ সূত্রে উল্লেখ্য।

অতএব ধর্মমত অথবা তার দার্শনিক ও রাজনৈতিক মতবাদ কোনোটাই মানুষের কল্যাণ আনেনি। কোনোটাই সংহত ও সংযত করতে পারেনি প্রবলের দৌরাত্ম্য, পারেনি দুর্বলকে প্রবলের পীড়ন থেকে রক্ষা করতে। ব্যষ্টির হৃদয়ে বিবেকের প্রতিষ্ঠা না হলে নীতিকথা, ধর্মকথা কিংবা তত্ত্বকথা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

কাজেই সমাজে-সংসারে পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যে-শান্তি ও স্বস্তি, যে-সুযোগ ও সুবিধা মেলে, তার জন্যে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রিক বিধিবিধানই যথেষ্ট।

অতএব আজকের দিনে মানুষের ধর্মগ্রন্থ হবে শাসনতন্ত্রের পুস্তক, হাদিস হবে দেশের আইন-কানুন আর লক্ষ্য হবে দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকার-বুদ্ধিসম্পন্ন সুনাগরিকতা। এতেই মানুষের পার্থিব জীবনের মনুষ্য-রচিত সমস্যা মিটবে। অপার্থিব সুখলিলুরা বৈরাগ্যে-সন্ন্যাসে অভীষ্ট খুঁজুক- দীন-দুনিয়া জড়িয়ে ব্যবহারিক জীবনে ঝামেলা বাড়ানোর দুর্বুদ্ধি না-রাখাই শ্রেয়।

মনীষীরা যাই বলুন ধর্ম কিন্তু থাকবে। কেননা মানুষের অসহায়তায় ও দুর্বলতায় তার জন্ম ও স্থিতি। এবং ধর্মবিশ্বাস দুর্বল মানুষের দুর্যোগ-দুর্দিনে বল-ভরসার আকর– অভয় ও নিশ্চিত আশ্রয়। তাই ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কার অধিকাংশ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে নিয়ামকরূপে পাবে চিরায়ু এবং হবে চিরঞ্জীব। যদিও সামাজিক শক্তি হিসেবে ধর্ম রাজতন্ত্রের মতোই বিলীয়মান।

তত্ত্ব-সাহিত্যের গোড়ার কথা

শোনা যায় আর্যরা ঋগ্বেদ সঙ্গে নিয়ে ভারতে এসেছিল। কিন্তু ভারতে প্রবেশ করে আর্যরা স্বধর্মে স্থির থাকতে পারেনি। দৈশিক ও কালিক প্রভাবে, ও অনার্য সংশ্রবে আর্যধর্ম বিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়েছে। অগ্নি, বরুণ, ইন্দ্রাদি দেবতার স্থানে শিব, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতার পূজা চালু হতে লাগল। এরূপে আর্যধর্মে প্রচুর অনার্য সংস্কার এবং বহু অনার্য দেবতা প্রবেশ করে তাকে এতই বিকৃত করেছেন যে, বৈদিক ধর্ম বলতে যা বুঝায়, তার আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট রইল না। বৈদিক ধর্ম বলে যে কথাটি আছে তা নাম সার, কথার কথা মাত্র। মূল আর্যধর্মের অনার্য উপাদানে পুষ্টি ও রূপান্তরের ইতিহাস অতি জটিল ও বহুবিস্তৃত। সে বিচার করতে গেলে লোেম তুলতে কম্বল উজাড় হবার কথা। ধর্ম-দর্শনের বহুধা বিস্তৃতি, সংস্কারের কলেবর বৃদ্ধি ও তেত্রিশ কোটি দেবতার উদ্ভবে দিশাহারা জনগণের পক্ষে ধর্মের পূর্ণরূপ হৃদয়ঙ্গম করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। তাই উপায়ান্তর না দেখে তারা যে কোনো একক দেবতার পূজা-প্রথা প্রচলন করতে বাধ্য হল। এভাবে শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এই ধর্মশাস্ত্রের বিকাশে ও প্রসারে মুসলমান-পূর্ব যুগে কোনো বিদেশী প্রভাব ছিল না। অনার্য মানস-সংস্কার আর্য-মানসের উপর জয়ী হল। অনার্য-সভ্যতা যে আর্য-সভ্যতার চেয়ে উন্নত ছিল তার প্রমাণ মেলে আর্যদের এই সাংস্কৃতিক পরাজয়ে। তবু আর্যগণ বিজেতা এবং শাসক, তাই তারা গায়ের জোরেই সমাজে প্রধান রয়ে গেল। এ অনার্য অবদান আর্য- সংস্কৃতি নামে প্রচারিত ও প্রচলিত হল। শাসক ও অভিজাতশ্রেণী চিরকাল বিষয়-বুদ্ধি সম্পন্ন, তারা উচ্ছ্বাস বা হুজুগের বশে কিছু একটা করে বসে না। গরজ ও সুযোগ বুঝে তারা এমনিভাবে চলে যে, অন্যের কৃতির দ্বারা নিজেরাই লাভবান হয়, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বও বজায় থাকে। কিন্তু মানুষের অন্ধ ধর্মানুগত্যের সুযোগে আর্যগণ যখন শাসন-শোষণ ও ভয়ঙ্কর উৎপীড়ন শুরু করল, তখন বর্ধমান মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধের নেতৃত্বে অনার্য অধ্যুষিত পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রবল বিদ্রোহ দেখা দেয়। বেদ-ব্রাহ্মণদ্বেষী জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন একান্তভাবে অনার্য সংস্কার-প্রসূত। বুদ্ধের নির্বাণবাদ ও অহিংসবাদ বলিপ্রিয় ও ত্রিলোকে বিশ্বাসী আর্য-মানসের সম্পূর্ণ বিপরীত। শঙ্করের মায়াবাদ ও অনার্য–মানস সম্ভুত। কৃষ্ণ মিত্রের (১০ শতক) প্রবোধ চন্দ্রোদয়ের দ্বিতীয় অঙ্কে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ অহঙ্কার কাশীতে বেদান্ত চর্চার বাহুল্য দেখে অবজ্ঞা করে বলেছে : প্রত্যক্ষাদিপ্রমাসিদ্ধাথিরুদ্ধর্থববেধিনঃ। বেদান্তাঃ যদি শাস্ত্রনি বৌদ্ধে কিমপরাধ্যতে।

বাঙলা দেশে বৌদ্ধধর্মের বিকৃতি যে প্রাচীন বিশ্বাস-সংস্কারগ্রস্ত অশিক্ষিত অনার্য মানসের প্রভাববশত ঘটেছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। শিব ও নারীদেবতাগুলো একান্তভাবে অনার্যদের দ্বারা পরিকল্পিত। শিবের সম্ভ, আদিনাথ, মহাদেব প্রভৃতি গুণ-নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে–তিনি অনার্য দেবতা। পুরাণ বর্ণিত দক্ষযজ্ঞ কাহিনীটি আর্যগণ কর্তৃক অনার্য দেবতা শিবের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার প্রচেষ্টার আভাস দিচ্ছে। বাঙলার বৌদ্ধধর্মে শিবের স্থান হয়েছিল। ধর্মপালের প্রপৌত্র নারায়ণ পাল শিবভক্ত ছিলেন। শিব সম্বন্ধে অনেক গল্প আছে। এই শিব হচ্ছেন আদিনাথ, তারও আগে পরমাপ্রকৃতি আদ্যা। এর থেকেই সৃষ্টি পত্তন। এ শিব ও তাঁর পত্নী শিবানীকে (তৃতীয় জন্মে আদ্যা শক্তিই শিবপত্নী) কেন্দ্র করেই বিকৃত বৌদ্ধধর্মে যোগশাস্ত্র, দেহত্ত্ব (কায়াসাধন) সহজ সাধন, গুরুবাদ প্রভৃতির উদ্ভব হয়। এসব যোগতান্ত্রিক বৌদ্ধমতকে নাথপন্থ ও সহজিয়ামার্গ বলা হয়। এর অপর একটি শাখা ধর্মপূজা। এ সবই বৌদ্ধ-হিন্দু প্রভাবিত অনার্য ধর্ম। তন্ত্রমতও শিবেপ্রাক্ত। ভক্তিবাদটা আসলে অনার্য-মানস প্রসূত। গোটা ভারতবর্ষে ভক্তিধর্মের উন্মেষ ও বিকাশ অনার্যদের মধ্যেই হয়েছিল। এর উদ্ভবক্ষেত্র দাক্ষিণাত্য-অনার্য অধ্যুষিত উত্তরভারতের নিম্নশ্রেণীর (অনার্যদের) মধ্যে ভক্তিভাব প্রথম বিকশিত হয় এবং বাঙলাদেশেতো বটেই। ইতিহাস-পূর্ব যুগেও নারদ, প্রলোদ, শুক প্রভৃতি যারা ভক্তিবাদী ছিলেন, তাঁরা হয় অনার্য অথবা অনার্য রক্ত সম্পর্কিত ছিলেন। মাংসাশী আর্যগণের নিরামিষাশী হওয়াও অনার্য আচারের ব্যাপক প্রভাবের ফল।

এবার বাঙলার কথায় আসা যাক। বাঙলা দেশে ভক্তিধর্মের উদ্ভব সম্বন্ধে ডক্টর সুকুমার সেন বলেন, মহাযানের উপাস্য নরদেবতা অবলোকিতেশ্বর বাংলা দেশে লোকনাথ নাম নিয়ে বিষ্ণুর রূপান্তরে পরিণত হয়েছিলেন। এবং উত্তরাপথে বাসুদেব কৃষ্ণকে অবলম্বন করে যেমন ভক্তিপরায়ণ ভাগবত মত উদ্ভূত হয়েছিল, বাংলা দেশে তেমনি লোকনাথকে আশ্রয় করে ভক্তিধর্মের অঙ্কুর উদ্গত হয়েছিল। বাংলা দেশে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী বহুকাল থেকে প্রচলিত থাকলেও এই কাহিনীকে অবলম্বন করে অত সহজে ভক্তিধর্মের বিকাশ হয়নি, যত হয়েছিল অবলোকিতেশ্বর লোকনাথকে আশ্রয় করে।–বৌদ্ধ মতের ভক্তিভাবের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের কথাশিত বৈষ্ণব ভক্তিভাবের একটু তফাৎ আছে। বৈষ্ণব মতে ভক্তি জ্ঞানশূন্য এবং লীলাস্মরণ সাধনার একটা প্রধান অঙ্গ, কিন্তু বৌদ্ধমতে ভক্তি জ্ঞানেরই অঙ্গ। এখানে নাথ ও সহজপন্থ স্মরণীয়। সদগুরু থেকে জ্ঞান (মহাজ্ঞান) না পেলে সাধনায় সিদ্ধি নেই। বৌদ্ধভক্তিবাদ চৈতন্য ও তার আগের যুগে জয়দেব মিশ, চণ্ডীদাস, মাধবেন্দ্র পুরি প্রভৃতিকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে। (প্রত্যক্ষ প্রভাব এসেছিল সুফী মত থেকে এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভারত থেকে)। তেরো শতকের বৌদ্ধ রামচন্দ্র কবিভারতীর ভক্তিশতক ও বৃত্রমালার প্রভাবও হয়তো চৈতন্যদেবের উপর পড়েছিল।

সুতরাং বাঙলার বৈষ্ণব, সহজিয়া, বাউল, মুর্শিদা, নাথপন্থ ও বৌদ্ধ সহজিয়া মত প্রভৃতি অনার্য মনোভঙ্গিরই প্রকাশ। ডক্টর সুকুমার সেন (প্রাচীন বাংলা ও বাঙালি) বলেন : বাংলা দেশে শাস্ত্রীয় বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে যেমন পূর্বেকার ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ভক্তিবাদের যুক্তবেণী প্রবাহিত হয়ে এসেছে, তান্ত্রিক বৈষ্ণব অর্থাৎ বাউল সহজিয়া ইত্যাদি মতের মধ্যে তেমনি পূর্ব যুগের শৈব ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতবাদের পরিণতি দেখা যায়। অষ্টম শতাব্দী কিংবা তারও পরে থেকে বাঙলা দেশে অনুন্নত শ্রেণীর মধ্যে তান্ত্রিক ভাবের দুটি ধর্মমত চলিত ছিল–শৈব-নাথ মত এবং বৌদ্ধ সহজিয়া মত (নাথ পন্থ ও চর্যাপদের সহজিয়া)। এই দুই মতের সাধনায় ও দর্শনে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। নাথ সন্ন্যাসীরা নিজেদের যোগী বা কাঁপালিক বলত। এরা কানে নরাস্থি কুণ্ডল, কণ্ঠে নরাস্থি মালা, পায়ে নূপুর ও হাতে নরকপাল ধারণ করত এবং গায়ে ছাই মাখত। এদের আহার বিহার ছিল কদর্য, তাই গ্রামের বাইরে ছিল এদের কুঁড়েঘর। যোগীদের নামের শেষে শব্দ হত নাথ। বর্তমান সময়ে যুগী জাতির (তাঁতি) মধ্যে নাথ পদবি ও পূর্বেকার আচার-অনুষ্ঠান কিছু কিছু চলিত আছে। শৈব ও বৌদ্ধ সহজ সাধকেরা দেহতত্ত্বের সাধনা করত এবং আবশ্যক হলে যোগিনী বা অবধূতী অর্থাৎ সাধন-সঙ্গিনী গ্রহণ করত। এদের সাধনার সঙ্কেত নিহিত আছে চর্যাপদে। চর্যাপদগুলো বাঙলা পদাবলীর আদিরূপ। ধর্মপূজাকেও আমরা হিন্দু-বৌদ্ধ প্রভাবিত অনার্য ধর্ম বলেছি। সমাজের নিম্নস্তরে তখন অনার্য প্রথামতো স্থানীয় দেবদেবী প্রভৃতি উপ-দেবতার পূজা বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। জাঙ্গুল, বাসুকী বজ্রতারা চণ্ডিকা মনসা ক্ষেত্রপাল শিব ষষ্ঠী যক্ষ (মদ্য-মাংস দিয়া কেহ যক্ষ পূজা করে–চৈ, ভা.) শীতলা ওলা ধর্মঠাকুর প্রভৃতি সে-কালীন দেবতা। অধিকাংশ দেবতার উদ্ভব ও প্রভাবক্ষেত্র রাঢ় অঞ্চলেই ছিল বলে মনে হয়। চণ্ডীমঙ্গলে তাই দেখতে পাই—-ব্যাধ গোহিংসক জাতিতে চোয়ার। কেহ না পরশ করে লোকে বলে রাঢ়। এ ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুর কথা। সদুক্তি কর্ণামৃতের একটি শ্লোকে এইরকম গ্রাম্যপূজার বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে :

তৈস্তের্জীবোপহারৈর্গিরিকুহরশিলাসংশয়ামচয়িত্ব
দেবীং কান্তার দুর্গা রুধিরমুপতরু ক্ষেত্র পালায় দত্ত্বা।
তম্বীবীণা বিনোদব্যবহৃতসরকামচিহ্ন জীর্ণে পুরাণীং
হালাং মালুরকোষৈষু বতিনাহচরা বর্বঃ শীলয়ন্তি।

অনেকগুলো আর্য ও অনার্য দেবতা মিলে ধর্মঠাকুর হয়েছেন। বৈদিক বরুণ ও রথারোহী সূর্য, অবৈদিক কূর্মাবতার, ঈরাণীয় বুটপরা ঘোড়াচড়া সিপাহী মিহির, ভবিষ্য বা পৌরাণিক কল্কি অবতার ও অনার্য পাষাণ, তাম্রধাতু ও বৃক্ষদেবতা–এই সব মিলে ধর্মঠাকুরের উদ্ভব।

ধর্মঠাকুরের ধ্যানে তাঁকে শূন্যমূর্তি বলা হয়েছে। এই শূন্য বৌদ্ধ মহাযান মতের শূন্য নয়। এখানে শূন্য মানে নিষ্কলঙ্ক শুভ্র। ধর্মদেবতা নিষ্কলঙ্ক সবশ্বেত তাঁর বাহন উলুক বা উল্লুক হচ্ছে পেঁচা বা শাদা কাক। রূপকচ্ছলে ধর্মঠাকুরকে শাদা হাঁস কল্পনা করা হয়েছে। সিপাহী মূর্তিতেও তাঁর বাহন শ্বেত-অশ্ব। ধর্মপূজার মন্ত্রে সূর্যকে নিরঞ্জন শূন্য দেহ বলা হয়েছে। ধর্মঠাকুরের প্রতীক যা পূজা করা হত, তা হচ্ছে কূর্মাকৃতি পাষাণ খণ্ড অথবা পাষাণ নির্মিত কূর্মবিগ্রহ। কূর্ম-প্রতিমার পৃষ্ঠে সাধারণত ধর্মঠাকুরের পাদুকাচিহ্ন আঁকা থাকত। এই পাদুকাচিহ্নই ধর্মঠাকুরের আসল প্রতীক। ধর্মপণ্ডিত অর্থাৎ ধর্মপূজার যারা পুরোহিত তারা সর্বদা গলায় ধর্মঠাকুরের পাদুকা ঝুলিয়ে রাখতেন। ধর্ম ছিলেন আদিতে যোদ্ধা ডোম জাতির দেবতা, তাই ডোমেরাই ধর্মপূজার প্রধান অধিকারী ছিল। এখন কৈবর্ত, বার্মাদ, ধোপা, পুঁড়ি ইত্যাদি নানাজাতির ধর্মপণ্ডিত দেখা যায়। যেখানে ধর্মঠাকুর শিব বা বিষ্ণু হয়ে গেছেন সেখানে পৌরোহিত্য ব্রাহ্মণে গ্রহণ করেছে (সুকুমার সেন–প্রাচীন বাংলা ও বাঙ্গালী)।

উপরের মন্তব্যগুলি বোধ হয় বিশদ করবার প্রয়োজন আছে। আমাদের মৌল বক্তব্য ভারতীয় আর্যদের উপর অনার্যদের প্রভাব। এ এত বেশি এবং সুদূরপ্রসারী যে, তা সহজে হৃদয়ঙ্গম করা একরূপ অসম্ভব। আর্যগণ শুধু ঋগ্বেদ সম্বল করে ভারতে এসেছিলেন এবং সংখ্যায়ও খুব বেশি এসেছিলেন বলে মনে করবার কোনো কারণ নেই। সুতরাং বৈদিক ধর্মশাস্ত্রের যে ক্রমপরিণতি ও প্রসার ঘটেছে তাতে অনার্য অবদান তুচ্ছ নয়। অথর্ব বেদ পুরো এবং সাম বেদের কোনো কোনো সূক্ত এদেশেই রচিত হয়। ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক দুটোও এখানেই রচিত। আরণ্যক বিধিতে যে ভাববাদী দ্রাবিড় প্রভাব পড়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা ক্রিয়াসর্বস্ব বৈদিক ধর্মের সহসা কল্পনাশ্রয়ী হবার অন্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

বৈদিক ধর্ম একান্তভাবে অনুষ্ঠান-প্রধান। এ ধর্মের আদি দেবতা প্রকৃতি-প্রতীক। যেমন বরুণ, অগ্নি, ইন্দ্র প্রভৃতি। যাগযজ্ঞই ধর্মাচরণে একমাত্র পন্থা। এক কথায় বেদের কর্মকাণ্ড অবিমিশ্র আর্যধর্ম। ব্রাহ্মণ এবং জৈমিনির পূর্ব-মীমাংসাও আর্যসৃষ্টি। সাংখ্য ও যোগ কিন্তু অনার্যদর্শন।

বেদান্ত আর্য-অনার্য উপাদানে রচিত। এগুলোর রচনাকাল খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ থেকে খ্রীস্টীয় বৌদ্ধ শতক অবধি। কতগুলো উপনিষদের তাৎপর্য নিয়ে ব্রহ্মসূত্র ও গীতা কবে রচিত হয়, তা কেউ বলতে পারে না। ব্ৰহ্মসূত্রের আদি রচয়িতা বলে কথিত ব্যাসদেবের সূত্র পাওয়া যায়নি। আবার সব সূত্রই ব্যাসদেব রচনা করেছিলেন কিনা তাও নিঃসংশয়ে বলা যাবে না। গীতা ও মহাভারত দুটোই ব্যাসের নামে চলে, সুতরাং মনে করা যেতে পারে খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকে এগুলো রচিত হয়। বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র থেকেই বেদান্ত দর্শনের উৎপত্তি। এটা সম্ভবত খ্রীস্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত হয়। আর্যগণ কবে থেকে তাঁদের আদিম ইষ্টদেবতাগুলোকে পরিত্যাগ করে এদেশের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি দেবতার আরাধনা শুরু করেন ইতিহাস তা বলতে পারে না। কবে থেকে পূর্ব-মীমাংসা ও তৎসংপৃক্ত স্মৃতিতে অর্বাচীন দেবতাগণের স্থান হল তাও অজ্ঞাত।

সুতরাং আমাদের সিদ্ধান্ত দাঁড়াচ্ছে এই : কর্মকাণ্ড-সর্বস্ব ঋগ্বেদ নিয়ে যখন আর্যগণ ভারতে আসেন তখনো তাদের ধর্ম পরিণত রূপ গ্রহণ করেনি। প্রকৃতি-প্রতীক দেবতাগণের তুষ্টিবিধান করে ঐহিক অভিষ্ট সিদ্ধি করাই তাদের ধর্মাচরণের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। আবার তা-ও ভক্তি ও জ্ঞানসাপেক্ষ নয়, কর্মসর্বস্ব। অপৌরুষেয় অর্থাৎ ঈশ্বর বা অন্য কোনো ব্যক্তি বেদ রচনা করেন নাই। বেদ অনাদিকাল হইতে আকাশে নিত্য হইয়া রহিয়াছে। বিভিন্ন ঋষিদের মনে আবির্ভূত হইয়াছে মাত্র।–মীমাংসকেরা জগৎকে সত্য বলিয়া মানেন এবং তাহারা কোনো ঈশ্বর মানেন না এবং জগৎ যে কোনো সময়ে সৃষ্ট হইয়াছিল এবং কোনো সময়ে যে ইহা ধ্বংস হইবে তাহাও তাহারা জানেন না। কাজেই ঈশ্বর সম্বন্ধে কোনো আলোচনা মীমাংসার বিষয় নহে। যাগযজ্ঞে নানা দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু মীমাংসকেরা সেই সমস্ত দেবতার স্বতন্ত্র সত্তা মানেন না। উচ্চারিত মন্ত্রের মধ্যে তাঁহাদের সত্তা; যথাযথভাবে মন্ত্র উচ্চারিত হইলে এবং যথাযথভাবে যজ্ঞীয় অনুষ্ঠান সম্পাদিত হইলে সেই অনুষ্ঠানের ফলে যজ্ঞফল–যথা স্বর্গলাভ, পুত্রলাভ ইত্যাদি লাভ করা যায়। কোনো দেবতার অনুগ্রহে ও বিদ্বেষে কোনো সুফল বা কুফল হয় না। কাজেই স্বতন্ত্র দেবতা মানিবার কোনো প্রয়োজন নাই। (ভারতীয় দর্শনের ভূমিকা–ড. সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত)

এখানে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য; (১) বৈদিক সাধন-ভজন যজ্ঞের মারফতই চলত। (২) কোনো বিশেষ দেবতার প্রতি আনুগত্য বা ভক্তি প্রদর্শন আবশ্যিক ছিল না, যেমন দেবতাগণ যজ্ঞ মারফত ভোগ পেলেই মূল-স্বরূপ অভিষ্ট বরদানে বাধ্য হতেন (৩) ভক্তিমার্গ ও জ্ঞানমার্গ তখনো প্রচলিত হয়নি, শুধু কর্মমার্গই ছিল। (৪) সৃষ্টি ও স্রষ্টা, জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে গভীরতর জিজ্ঞাসা তখনো প্রবল হয়নি। (৫) তখনো পৌত্তলিকতা প্রশ্রয় পায়নি। এর পরের স্তরে বৈদিক আর্যধর্মের মিশ্র বিকাশ হয় অনার্য সাংখ্য ও যোগদর্শন অবলম্বন করে। পরবর্তী যোগশাস্ত্রে সম্ভবত আর্যপ্রভাবই বেশি। এবং কালিক বিকাশের ধারায় তা জটিল ও বিভিন্নমুখী হয়ে উঠেছে, কপিল সাংখ্য বা পাতঞ্জল যোগের কিছুই এখন অবশিষ্ট রয়েছে বলে মনে হয় না। কপিল-সাংখ্যসূত্র বোধ হয় খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ-তৃতীয় শতকে রচিত হয় আর খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পতঞ্জলি যোগসূত্র রচনা করেন। খ্রীস্টীয় প্রথম শতকের চরক ও আড়াঢ় ঋষি সাংখ্যমত নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আধুনিক স্যাংখ্যমতের ভিত্তি হচ্ছে খ্রীস্টীয় তৃতীয় শতকে রচিত ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্য-কারিকা। সুতরাং সাংখ্য ও যোগ যে বৌদ্ধ-জৈন প্রভাবিত তাতে সন্দেহ নেই। কাজেই আলোচনা নিরর্থক। সাংখ্য সিদ্ধান্ত প্রকৃতি ও পুরুষ তত্ত্ব-ভিত্তিক। যোগ ঈশ্বরবাদী, সাংখ্য নিরীশ্বর।

বেদান্ত দর্শনের ভাস্কর বা শঙ্কর সিন্ধুদেশে মুসলমান বিজয়ের পরে আবির্ভূত হন। জ্ঞানমার্গ শঙ্করেরই সৃষ্টি। প্রজ্ঞা দ্বারাই মুক্তি বা মোক্ষলাভ ঘটে। তজ্জন্য কোনো প্রকার যাগযজ্ঞ, সন্ধ্যা বন্দনাদি নিত্য কর্ম; গ্রহণ প্রভৃতিতে স্নান, দান প্রভৃতি নৈমিত্তিক কর্ম; কিম্বা নানা পূজা-অর্চনাদি কার্যকর্ম করিবার প্রয়োজন নাই। যাহারা বেদবিধি নিষেধাদি মানিয়া চলিবেন তাহারা তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী নন।১ শঙ্করের মায়াবাদ ভাববাদী বৈরাগ্যপ্রবণ দ্রাবিড় প্রভাবের ফল। আনুষ্ঠানিক ধর্মে অস্বীকৃতি বৈদিক প্রভাবমুক্তির পরিচায়ক। জীব ও জগৎ প্রাতিভাসিক সত্যমাত্র–পূর্ণজ্ঞানে অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের উন্মেষের সঙ্গে এর বিলুপ্তি–এই মায়াবাদ বৈরাগ্যবাদের জন্ম দেয়। শঙ্করের মতবাদকে অদ্বৈতবাদ বলে-ব্ৰহ্ম ছাড়া কিছুই নেই; আর সব মিথ্যে; অবিদ্যা বা অজ্ঞানতার দরুন জীব বা জগৎ সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে মাত্র। কাছেই ব্ৰহ্ম ছাড়া আর সব মিথ্যে—-একেম মেবা দ্বিতীয়ম শঙ্কর জ্ঞান-প্রজ্ঞালাভের সাধনা ছাড়া অন্য আরাধনা স্বীকার করেন না। শঙ্করের অদ্বৈতবাদ ও জ্ঞানমার্গ প্রবর্তনের মূলে যে ইসলামের প্রভাব রয়েছে–আজকাল তা আর অস্বীকৃত হয় না।

গীতায় ঋগ্বেদের কর্মবাদ স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে অদৃষ্টবাদ–যা বেদে ছিল না, যুক্ত হয়েছ। ফলে ধর্মের সঙ্গে শ্রদ্ধা ও ভক্তির রেশ মিশ্রিত হয়েছে। কর্মণ্যে বাদিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন-এ নিশ্চিতভাবে অবৈদিক। স্মরণ রাখা দরকার যে, গীতা অনার‍্যা মেছুনীর গর্ভজাত সন্তানের রচিত।

তারপর মুসলমান বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং তার আগেও ইরানী সূফীতত্ত্বের প্রভাবে ভারতে ভক্তিবাদের উদ্ভব হয়। বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদী রামনুজ, দ্বৈতবাদী মাধ্ব ভেদাভেদবাদী নিৰ্ষাকচার্য, শঙ্করের মায়াবাদবর্জিত অদ্বৈতবাদ, চৈতন্যদেবের অচিন্ত্য দ্বৈতাদ্বৈতবাদ এর প্রভাবেই উদ্ভূত হয়। এই ভক্তিবাদের মধ্যে অন্তঃ সলিলা ফন্ধুর মতো বৈরাগ্যবাদই জয়ী হল–মূলত শঙ্করের মায়াবাদে ব্যবহারিক জীবনের অর্থাৎ পার্থিব জীবনের যে অসারতা ঘোষিত হয়েছে, তাই ভক্তিবাদের আবরণে স্বীকৃত হল– জগৎ সত্য হলেও নিত্য নয়, সুখময় নয়। কাজেই যা নিত্য, যা চরম, যা পরম, যা হলে নিশ্চিন্ত হওয়া চলে, নির্ঘ হওয়া সম্ভব হয়–তাকে পাওয়ার সাধনাই জীবনের চরম ও পরম ব্রত হওয়া উচিত। কাজেই অনিত্য সংসারের প্রতি ঔদাসীন্য প্রদর্শন করাই হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞাবানের লক্ষণ।

গীতায় কর্মের কথা আছে, শঙ্করে জ্ঞানের কথা রয়েছে। এই কর্মবাদের সঙ্গে আর্যদের মানস সম্পর্ক গভীরতম, জ্ঞানমার্গের সঙ্গেও যোগ সুদৃঢ়। তাই বর্ণহিন্দুগণ গীতা ও অদ্বৈতবাদ সহজে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ভক্তিবাদের প্রসার অনার্যদের মধ্যেই বেশি। প্রজ্ঞালব্ধ মুক্তি সবার পক্ষে সম্ভব নয়, কর্মলব্ধ মুক্তিও কি সহজ! তাই ভক্তিবাদ আভিজাত্যহীন জনসমাজে সাদরে গৃহীত হল। মানস বৈরাগ্যজাত এই ভক্তিবাদ। নয় শতক থেকেই রাধাবাদের তথা রাধাকৃষ্ণ লীলাতত্ত্বের উদ্ভব। রাধাকৃষ্ণ সম্ভবত দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণ নাপ্পিনাই লীলার প্রভাবে পরিকল্পিত। আর চৈতন্য সমকালে (মুখ্যত চৈতন্যের দান) ভক্তিবাদ প্রেমবাদে পরিণতি পায়।

এদিকে যোগ ও সাংখ্যের প্রভাবে তান্ত্রিক ও যোগ সাধনার বহুল প্রচলন হল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মধ্যে গীতার কর্মবাদ ও শঙ্করের জ্ঞানবাদ উচ্চশ্রেণী অনার্যদের মধ্যে ভক্তিবাদ এবং নিম্নশ্রেণীর জনসাধারণের মধ্যে যোগ ও তন্ত্র প্রাধান্য লাভ করেছিল। বৌদ্ধ বজ্রযানীদের থেকেই নাথ-সহজিয়া মতের বিকাশ। এর জের রয়েছে বাউল মতে ও বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্বে এবং শৈব সাধনায়।

অধিকাংশ মুসলমান এদেশী জনগণেরই বংশধর। এসব ধর্ম ও দর্শন সংস্কার তাদের অস্থিমজ্জার সঙ্গে মিশে রয়েছে। তাতে আবার শরীয়তের সঙ্গে সাক্ষাৎ-সম্পর্ক রাখা সম্ভব হয়নি অশিক্ষা ও সূফীমতের প্রবাল্যের দরুন। কাজেই সূফীতত্ত্বের সঙ্গে যেখানেই সাদৃশ্য-সামঞ্জস্য দেখা গেছে সেখানেই মুসলমানেরা অংশগ্রহণ করেছে। এভাবে বৌদ্ধ নাথপন্থ সহজিয়ার তান্ত্রিক-সাধনা শাক্ততন্ত্র, যোগ, ইউনানী-দর্শন প্রভৃতি তাদের আকর্ষণ করেছে এবং এভাবে তারা মিশ্র-দর্শনও খাড়া করেছে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেন, আধ্যাত্মিক বা মারফতী সাহিত্যে ইরানের সূফী প্রভাব, বাঙলার বৈষ্ণব প্রভাব এবং হিন্দুর যোগশাস্ত্র ও দেহতত্ত্ব প্রভৃতির প্রভাব পড়েছে। বৌদ্ধ নাথ ও সহজিয়া পন্থের প্রভাবও রয়েছে এবং বাউল-মুর্শিদা সাহিত্য ছাড়াও নিছক দার্শনিক তত্ত্ব এখানে কম মেলে না। এসব বিভিন্ন ধারার সমন্বয়ের কারণ বোধ হয় এই যে, মানুষের হৃদয়ানুভূতিতে ও মননে এমন একটি স্তর আছে যেখানে সব ভেদাভেদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। আমাদের দেশের সাধকগণ অতিমাত্রায় আচারবর্জিত ও মর্মনিষ্ঠ। তাই এমন নির্বিচার সমন্বয় সম্ভব হয়েছে। হরগৌরী সম্বাদ, সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ, জ্ঞান-প্রদীপ, যোগকলন্দর, আগম, জ্ঞানসাগর, আবদুল্লাহর সাওয়াল, মুসার সওয়াল মল্লিকার সওয়াল, ইউনান দেশের পুথি, গোরক্ষ বিজয়, সিরাজ সবিল, নুরজামাল প্রভৃতি গ্রন্থ এ শ্রেণীর। ১

সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাঙালি মুসলমান মরমীয়ারা যে সাধনপন্থ আবিষ্কার করেছেন তা একান্তভাবে ইসলামী নয়। বস্তুত ভারতীয় সূফীমতবাদও একান্তভাবে আরব্য-পারসিক নয়। এতে যেমন ভারতীয় দর্শনের প্রচুর প্রভাব পড়েছে তেমনি বাঙালি মরমীয়াদের দর্শনে ও ধর্মে প্রচুর দেশজ তথা ভারতীয় উপাদান রয়েছে। ফলে এদেশে চিরকাল হিন্দু-মুসলমান হাতে হাত মিলিয়ে ও মনে মন মিশিয়ে অধ্যাত্মসাধনা করেছে। এভাবেই বাঙলা দেশে হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত সাধনায় মরমীয়াদের উপমতগুলো সৃষ্ট হয়েছে। অবশ্য নিরক্ষর জনগণের ধর্ম ও দর্শন বলে এগুলো আশানুরূপ পুষ্ট হয়নি। এবং এ-কথাও স্বীকার্য যে বৈষ্ণব মতই প্রথম হিন্দু-মুসলমানকে একই সাধন-ক্ষেত্রে আনয়ন করে। অতএব এগুলো কোনো বিশেষ ধর্মবিশ্বাস বা সংস্কারের পরিচয় বহন করে না। জগৎ ও জীবনের রহস্য সম্বন্ধে মানুষের চিরন্তন জিজ্ঞাসা এবং তার রহস্য-উদঘাটনের চির কৌতূহল থেকেই এর জন্ম। এ প্রয়াস তাই ধর্মনিরপেক্ষ। যে স্তরের অনুভূতিতে মানবমনে দেশ-কাল, পাত্র ও বিশ্বাসের ভেদাভেদ ঘুচে যায়-এগুলো সে স্তরের অনুভূতি ও উপলব্ধির অভিব্যক্তি। তাই সৈয়দ সুলতান, মোহাম্মদ খাঁ, শেখচান্দ প্রভৃতি ইসলাম ও নবীকাহিনী যেমন শুনিয়েছেন, তেমনি আবার এসব মরমীয়াবাদও প্রচার করেছেন।

দূর্বা

আমাদের দেশে বরণডালায় ধান ও দূর্বা রাখার রেওয়াজ আছে। দুটোই আদিম অস্ট্রিক সংস্কার। একটি প্রাণের প্রতীক, অপরটি জীবিকার। দূর্বার প্রাণশক্তি দুর্বারই বটে। যতই দলিত হোক, যতই তাপদগ্ধ হোক, একবার পানির স্পর্শ পেলেই জেগে ওঠে। বাসন্তী হাওয়া, বিশেষ করে বৃষ্টির পানি পেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মরা দূর্বা সবুজের সমারোহ নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়। এক ধান জন্ম দেয় শত ধানের। তাই দূর্বা ও ধান হয়েছে আয়ুষ্কামী ও প্রাচুর্য-প্রত্যাশী মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রতীক।

সর্বপ্রাণবাদী ও জাদুবিশ্বাসী মানুষের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় থেকেই এ প্রতাঁকের উদ্ভব। প্রকৃতিই মানুষের আদি ও অকৃত্রিম শিক্ষক এবং চিরন্তন জ্ঞানের উৎস। জীবনের মৌল প্রয়োজনবাঞ্ছা কেমন আশ্চর্য ঋজুতায় অভিব্যক্তি পেয়েছে ধানে ও দূর্বায়। এর মধ্যে রয়েছে অভিজ্ঞতা জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মনন ও কবিত্বের অনন্য সমন্বয় ও অপরূপ মাধুর্য।

এজন্যে প্রকৃতির মতো শিক্ষক নেই–প্রকৃতির মতো গ্রন্থ নেই। দুনিয়ার বহু মহামানব প্রকৃতি থেকে পাঠগ্রহণ করেই হয়েছেন লোক-শিক্ষক। প্রকৃতির পাঠের আদি অন্ত নেই। এ গ্রন্থ চিরনতুন ও চিরন্তন জ্ঞানের আধার। উৎসুক দৃষ্টিতে কৌতূহল নিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকালেই নব নব তাৎপর্যে প্রকৃতি নতুন হয়ে ধরা দেয়। তার বিচিত্র রহস্য-চেতনা মানুষকে করে জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ।

দূর্বার সুপ্তি আছে–আত্মগুপ্তি আছে কিন্তু মৃত্যু নেই। মানুষেরও প্রয়োজন-চেতনার শেষ নেই। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে মানুষের যে-চিন্তা তারও ক্ষয় নেই, নেই মৃত্যু। অন্ন ও আনন্দের অন্বেষা মানুষকেও দূর্বার মতোই দেয় দুর্বারশক্তি। তাই মানুষের চিন্তার উন্মেষ কখনো রোধ করা যায় না। তার বিকাশ প্রবলতর শক্তি সাময়িকভাবে হয়তো ঠেকিয়ে রাখতে পারে; কিন্তু নির্মূল করবার শক্তি নেই কোনো মর্তমানবের। শোনা যায়, চারাগাছের ডগা ছাগলে চিবোলে তা বাড়ে না। তেমনি সমাজের কিংবা শাসকের বিরূপতায় চিন্তাও স্বাভাবিক বিকাশ পায় না। ছাগলের মুখ-লাগা চারার মতোই তা রুদ্ধ-বাড় হয়েই বেঁচে থাকে। আবার উদ্ভিদ জগতে এমন অনেক বৃক্ষ দেখা যায় যাদের গোড়া কেটে দিলেও প্রাণ হারায় না। বরং রক্তবীজের মতোই অসংখ্য হয়ে নব নব কিশলয়ের ধ্বজা নিয়ে আকাশের দিকে মাথা বাড়ায়। সামাজিক-রাষ্ট্রিক পীড়নও তেমনি চিন্তার প্রসার ঘটায়। কেননা নির্ধ-নির্বিঘ্ন পরিবেশে চিন্তার জন্ম নেই। সব প্রয়াসের পশ্চাতেই থাকে অভাববোধ। প্রাপ্তির প্রয়োজন-চেতনা না জাগলে প্রয়াসের প্রেরণা জন্মায় না। কাজেই বাধাই বাধা ছিন্ন করার প্রেরণা যোগায়, বন্দিত্বই জাগায় মুক্তির কামনা, পরাধীনের স্বাধীনতাবাঞ্ছাই যোগায় সংগ্রামের শক্তি। তেমনি চিন্তার স্বাধীনতা যেখানে অস্বীকৃত, চিন্তার প্রয়োজন ও প্রেরণা সেখানেই প্রবল।

জীবন-প্রতিবেশে যখন অসঙ্গতি, অন্যায়, পীড়ন ও অভাব দেখা দেয়, অর্থাৎ যখন জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তা নেমে আসে, তখনই তার কারণ নিরূপণ ও কারণ আপসারণের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এবং তখন মননশীল, দায়িত্বসচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ মানুষ প্রতিকারের উপায় খোঁজে। এতেই নতুন চিন্তার জন্ম হয় এবং মতরূপে, ধর্মরূপে, নীতিরূপে ও আদর্শরূপে তা কর্মে ও আচরণে অভিব্যক্তি পেতে থাকে। যারা বর্তমান পরিবেশের সুযোগে বড় হয়েছে কিংবা বড় রয়েছে, তারা এ পরিবেশের পরিবর্তনে আতঙ্কিত হয়। কেননা পরিবর্তিত পরিবেশে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কাজেই স্থিতিতে তাদের মঙ্গল, গতিতে অকল্যাণের আশঙ্কাই প্রবল। তাই তারা সর্বপ্রকার নতুন ভাব-চিন্তা-আচার ও রীতিনীতি-পদ্ধতির প্রতিরোধকল্পে মরিয়া হয়ে দাঁড়ায়। তারা ইতিহাসে রক্ষণশীল কিংবা গোড়া অভিধা পায়। তারা সংখ্যায়ও থাকে গরিষ্ঠ। তবু তাদের আপাতপ্রাবল্য পরিণামে তাদের পরাজয়ের পথই মুক্ত করে দেয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য তারা স্বার্থবশে অস্বীকার করে। ফলে নতুনের জয় যে অবশ্যম্ভাবী তা তারা। মানতে চায় না। তারা যতই আঘাত হানে, আহত ততই প্রবল হয়। আপাত পরাজয়ের ছলে জয়ের নিশানই হাতে পায় আহত। হযরত ইব্রাহীম, হযরত মুসা, হযরত মুহম্মদকে পালাতে হয়েছিল, মরতে হয়েছিল হযরত ঈসাকে। এর আগে-পরেও এমনি কত কত ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু জয়ী হয়েছেন পলাতক-পরাজিত-নিহতরাই। কাজেই কোনো প্রতিকূল প্রতিবেশেই নতুন চিন্তার মৃত্যু নেই। সে চিন্তা বরং দূর্বার মতোই হয় দুর্বার–কাটাগাছের অঙ্কুরের মতো জেগে ওঠে স্পর্ধায়, ঔদ্ধত্যে ও প্রাণপ্রাচুর্যে।

যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, প্রতিযোগিতা নেই, সেখানে জীবনের বিকাশ নেই, উল্লাস নেই, প্রেরণা নেই, নেই কোনো প্রয়াস। জীবনের জাগরণের জন্য চাই দ্বন্দ্ব, চাই সংঘাত। আর দ্বন্দ্ব সগ্রামের পূর্বগামী হচ্ছে স্বপ্ন-ভাব-চিন্তা-পরিকল্পনা, সহচর হচ্ছে কর্ম। এ দ্বন্দ্বে-সংঘাতে যারা ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে পাপী-অপরাধী-আসামী–পরিণামে জয়ী হয় তারাই। এমনি নতুন চিন্তা আঘাতেই জাগে। তাই এ চিন্তা আঘাতেরই সন্তান। এই অর্থেই আঘাত সে যে পরশ তব সেই তো পুরস্কার।

দূর্বা ক্ষুদ্র ও কোমল। পায়ে দলিত হওয়াই তার নিয়তি। তবু সে অমর ও চিন্ময়–সবুজ ও প্রাণময়। তেমনি মানবদরদী ও মানবতাবাদী মনীষীরা সংখ্যায় নগণ্য বাহুবলে তুচ্ছ। নির্যাতনই তাদের ললাটলিপি। তবু তারাই মানবভাগ্যের নিয়ন্তা। তাঁরা ভাঙেন কিন্তু মচকান না। নিজেরা মরেন কিন্তু দিয়ে যান আবেহায়াত। চিন্তাবিদ বাহ্যত একক ব্যক্তি, কিন্তু আসলে রক্তবীজ। দূর্বার মতোই চিন্তা ও চিন্তাবিদের ধ্বংস নেই। সে মরে মরেই বাঁচে।

নজরুল সমীক্ষা : অন্য নিরিখে

০১.

কাজী নজরুল ইসলাম পূর্ব বাঙলার সবচেয়ে প্রিয় নাম। দুই বঙ্গেই এই নাম নিত্য উচ্চারিত এবং পূর্ববাঙলায় নিত্য আলোচিতও। এ প্রিয়তা যতখানি আবেগ সঞ্জাত, ততখানি বিচারসিদ্ধ যে নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে বাঙালি মাত্রেই ছিল তাঁর কাব্যের রসমুগ্ধ, এবং অনুরাগপ্রসূত আবেগ-বশে তাঁকে বিদ্রোহী, বিপ্লবী, গণসংগ্রামী, সাম্যবাদী, এবং মানবতার, যৌবনের, তারুণ্যের ও স্বাধীনতার কবি প্রভৃতি নানা আখ্যায় বিভূষিত করে কৃতজ্ঞ মানুষ তাদের আকৃতির অভিব্যক্তি দিয়েছে।

তিনি বাঙালিকে চমকে দিয়েছিলেন, মাতিয়ে তুলেছিলেন ঠিকই। এবং এও সত্য যে রবীন্দ্রনাথ যে-দেশে অর্ধজীবন নিন্দা ও তাচ্ছিল্য পেয়েছেন, নজরুল প্রথম দর্শনেই পেয়েছেন বরণডালা। এটি তার প্রথম জয়।

যুদ্ধোত্তর য়ুরোপীয় বিপর্যয়, রুশবিপ্লব, বেঙ্গল প্যাক্ট, অসহযোগ, জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড, সাইমন কমিশন, নেহেরু রিপোর্ট, কোলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শ্রমিক ধর্মঘট, স্বরাজবাদী প্রভৃতির উত্তেজনাকর পরিবেশে নজরুলের কবিকর্মের শুরু ও চরম বিকাশ। গণসমাজের সব মতবাদীরই ঠিক মনের কথাটি প্রকাশ পাচ্ছিল তার রচনায়। কেননা তিনি কোনো একক মতে নিষ্ঠ ছিলেন না। বারোয়ারি দাবী মিটিয়েই তার আনন্দ। তাঁর বাণীও নতুন ছিল না, কারণ এক্ষেত্রে পূর্বসূরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও যতীন্দ্রনাথ। অবশ্য পাঠক-সমাজে তাদের প্রভাব ছিল সামান্য। তার মুখ্য কারণ তাঁদের বাণী যতটা তাত্ত্বিক, ততটা বাস্তব ছিল না। কিন্তু নজরুলের দৃষ্টি ছিল বাস্তব এবং ভঙ্গি ছিল অভিনব। ফলে তাকে মনের কথার মুখপাত্ররূপে পেয়ে দেশের শিক্ষিত মানুষ হল প্রীত। এভাবে গণহৃদয়ে আসন হল তার অনায়াসলব্ধ। তখন মানুষের ঔৎসুক্য ছিল উত্তেজনার ইন্ধন সন্ধানে এবং নজরুল তা না চাইতেই দিলেন অঢেল অজস্র। কাজেই নজরুল হলেন তাদেরই একজন। এই চারণ কবিকে আশ্রয় করেই তাদের যন্ত্রণা পেল অভিব্যক্তি, উত্তেজনা পেল প্রকাশ-পথ এবং তারুণ্য ও বাহুবল হল মহিমান্বিত। নজরুল হলেন গণকবি, তারুণ্যের কবি, যৌবনের কবি, জীবনের কবি, মুক্তির দিশারী কবি। এটি তাঁর দ্বিতীয় সাফল্য।

তাঁর তৃতীয় সাফল্য আসে সঙ্গীতকার রূপে। গণমানসে এই নতুন সুরের আবেদনও ছিল তীব্র ও দ্রুত। প্রথম দুটো স্বীকৃতি এসেছে শিক্ষিত সাহিত্য-পাঠক থেকে। তৃতীয়টি এল গণমানুষ থেকে। অতএব নজরুলের জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠাকেও। এতে অবশ্য বিস্ময়ের কিছু নেই। কেননা বিশেষ স্তরের বিদ্যা, বুদ্ধি ও রুচি অর্জিত না হলে রবীন্দ্রনাথ থাকেন নাগালের বাইরে। আসলে তো এবার ফিরাও মোরে, দীনের সঙ্গী, ধূলা মন্দির, অপমানিত, সবুজের অভিযান, নববর্ষ, শঙখ প্রভৃতি কবিতায় ও গানে বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ বাঙলার তরুণদের যে আহ্বান জানিয়েছেলেন, তাতেই সাড়া দিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। নজরুলের আবেদন ছিল কানের কাছে–যা দৈহিক উত্তেজনা আনে ও লড়তে পাঠায় এবং যা স্বল্পপ্রাণ ও ক্ষণজীবী। আর রবীন্দ্রনাথের আর্জি ছিল বিবেক ও বুদ্ধির কাছে যা দায়িত্ববোধে প্রবুদ্ধ করে, যার ফল পরোক্ষ কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী।

.

০২.

যে পরিবেশে নজরুলের প্রতিষ্ঠা, তা আজ অপগত। এখন নজরুলকে কোনো দৃষ্টিতে দেখব, যাচাই করব কোনো নিরিখে, দৃষ্টি হবে কি ঐতিহাসিকের, নিরিখ হবে কি সাহিত্যের?

ঐতিহাসিকের বিচারে নজরুল যুগের দান ও যুগধর। তাঁর ভূমিকা ও সাফল্য সময়োচিত। তাঁর প্রয়াস ও প্রভাব উত্তেজনার মুহূর্তে গণমানসের চাহিদার আনুপাতিক। তাঁর চেতনা ও জীবনদর্শন পুরোনো ও স্থূল। সে কারণে তাঁর আহ্বান মর্মস্পর্শী ও গণ- বুদ্ধিগ্রাহ্য। কাজেই নজরুল Heor–জনমন অধিনায়ক।

উত্তেজনা জিনিসটি একমুখো বিশেষ চেতনার প্রসূন। কাজেই তা কেবল উদ্দীপক চায়, হিতাহিত পরখ করে না। অতএব নজরুলকে দিয়ে সমকালীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়েছে, তাঁর মাধ্যমে গণবিক্ষোভ পেয়েছে অভিব্যক্তি। তাই নজরুল সফল ও সার্থক। গণমানসও কৃতার্থ এবং কৃতজ্ঞ। সুতরাং তার ভূমিকা কালিক, তাঁর সাফল্য স্থানিক এবং তাঁর প্রয়াস সাহিত্যিক।২ সদর্থেই বলা চলে, তিনি হুজুগ মিটানো যুগের কবি। তাঁর হালকা বক্রোক্তিই নিয়তি নির্দেশের মতো তাঁর সম্বন্ধে সত্য ভাষণের রূপ নিয়েছে :

বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবি।

ইতিহাস হচ্ছে মুখ্যত কাল-চেতনার স্বাক্ষর। এবং Literature-ও is a journalism that lasts, কাজেই নজরুল-সাহিত্য এ তত্ত্বের স্বীকৃতি অনুসারে সাময়িক নয়, চিরন্তন। এক বিশেষ দেশ-কালে মানুষের জীবন-প্রতিবেশ ও জীবন-চেতনার অক্ষয় শৈল্পিক সাক্ষ্য।

.

০৩.

কিন্তু সাহিত্যশিল্পের দাবী অন্যতর। শিল্প- নিরিখে যাচাই করলে নজরুলের ঠাই কোথায়, দেখা যাক। যাঁরা ঐতিহাসিক দৃষ্টির পক্ষপাতী, তাঁদের সঙ্গে আমাদের এখানেই ছাড়াছাড়ি। কেননা আমরা ভিন্নযুগের মানুষ। আমাদের কাছে নজরুল কেবল কবি-শিল্পী। তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও সম্পর্ক সাহিত্যের হাটে। এখানে বক্তব্যের মূল্য কানাকড়ি, ভঙ্গির দাম অপরিমেয়, আদর্শের মূল্য গুরুতর, লক্ষ্যের প্রয়োজন স্বীকৃত, দর্শনের মিশ্রণ অভিপ্রেত। নজরুলের রচনায় আমরা কী পাই, এ তৌলে নজরুল কোথায় দাঁড়ান, খুঁটিয়ে দেখা যাক।

নজরুলের প্রথমদিককার সগ্রামী কবিতায় রয়েছে কোরান-হাদিস ও গীতা-পুরাণের বাণীর। ছান্দসিক রূপায়ণ। আস্তিক কবি ধর্মীয় চেতনার আশ্রয়ে, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও বাণীর আবরণে তার বক্তব্য পেশ করেছেন। পুরোনো কথাই পাঠকের সুপ্ত চেতনায় তীক্ষ্ণ করে তুলবার এ এক সুপ্রয়াস মাত্র। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, ভাঙ্গার গান স্মর্তব্য। এক্ষেত্রে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের কবির জীবন-চেতনা কালোচিত নয়। কেননা তাঁর শাস্ত্রীয় মানবতা ন্যায় ও করুণাভিত্তিক, জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে সম-অধিকারের অঙ্গীকারপ্রসূত নয়। তবু কবিচিত্তে অতীতের বন্ধনমুক্তির একটি লক্ষণ ছিল সুস্পষ্টতা তার গোঁড়ামিমুক্ত উদার দৃষ্টি, যে দৃষ্টি সম্প্রদায়-ভেদ মিথ্যা বলে জেনেছিল। এখানেই তাঁর আত্মশক্তির পরিচয়, তাঁর সৃষ্টির সৌন্দর্যের উৎস, এবং তাঁর কাব্য হৃদয়ভেদ্য হবার কারণ। এ পর্বে কবি মুখ্যত ন্যায়-নীতি ও আদর্শবাদের প্রেরণা সঞ্চারে প্রয়াসী। সে-প্রেরণা প্রধানত নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা এবং চেতনাপ্রসূত। তাই সর্বত্র তাঁর বাণীর বাহন ও সহগামী হয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য ও হিন্দু পুরাণ।

দ্বিতীয় পর্বে পাচ্ছি! সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণিমনসা, জিঞ্জির, সন্ধ্যা ও প্রলয় শিখা। এ সময়ে কবি মানবিক আবেদনের ফলপ্রসূতায় আস্থাবান। এবার তাঁর যুক্তি দ্বিমুখো–শাস্ত্রীয় ও মানবীয়। ধর্মের দোহাই, বিবেকের দিব্যি ও মানবতার যুক্তি প্রয়োগে মানুষকে দায়িত্ব-সচেতন, কর্তব্যপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ ও সংবেদনশীল করে তুলতে কবির প্রযত্ন লক্ষণীয়। এ পর্বে কবির শাস্ত্র-চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার সাম্য ও সমাজবাদের পরোক্ষ প্রভাব। এ স্তরে কবি তাই দ্বৈতসত্তায় দিশাহারা। আসলে ইসলামী সাম্য ও সমাজবাদের ধন বণ্টননীতির সমন্বয়ে তিনি দুকূল রক্ষায় প্রয়াসী। কেননা তার যুগে সমাজতন্ত্রে দীক্ষার পূর্বশর্ত ছিল নাস্তিক্য, তা তিনি গ্রহণ করেননি। কাজেই তিনি মার্কসীয় সমাজতত্ত্বে কিংবা লেনিনীয় সমাজ বিন্যাসে আস্থা রাখতে পারেননি। অতএব তার শ্রেণী-চেতনা তখনো ধর্মীয় সংস্কার প্রভাবিত। তাই তিনি যখন বলেন :

গাহি সাম্যের গান।
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নাহি কিছু মহীয়ান।

তখন তা মার্কসীয় শ্রেণীবিরোেধতত্ত্বের স্বীকৃতি নয়, বরং তার শাস্ত্রীয় মানুষ যে নুর-ই-ইলাহি ও আশরাফুল মখলুকাত কিংবা নরনারায়ণ ও জীব্ৰহ্ম—এ তথ্যের অঙ্গীকার মাত্র। কাজেই তিনি ধার্মিকের ন্যায় শাসিত প্রীতি-সুন্দর সমাজ কামনা করেছিলেন, নাস্তিকের ধন নিয়ন্ত্রণ ভিত্তিক সমাজ তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। এক্ষেত্রে নজরুলের ভূমিকা কতকটা এ যুগের স্বধর্মপ্রিয় বুদ্ধিজীবীর মতো, যাঁরা ক্যুনিজমকে গ্রহণ করতে নারাজ, কিন্তু তার সুব্যবস্থায় ও প্রভাবে বিচলিত এবং স্বধর্মে ক্যুনিজমের ব্যবস্থাবলী সন্ধানে উৎসুক এবং স্বধর্মে কমুনিজমের নীতি ও আদর্শের মিল আবিষ্কার করে তৃপ্ত ও নিশ্চিন্ত। কাজেই মুক্তপ্রাণ হলেও নজরুল ছিলেন বদ্ধচিত্ত। তাই তিনি লড়িয়ে সৈনিক হয়েই রইলেন, জিগীষু সেনাপতি হয়ে উঠেননি। তাঁর কাব্যে তাই সমাজ ভাঙার গান আছে, গড়ার পরিকল্পনা নেই।

.

০৪.

অতএব নজরুল প্রথম পর্বে কামালপন্থী ছিলেন না, দ্বিতীয় পর্বেও ছিলেন না সমাজবাদী কিংবা ডেমোক্র্যটিক সোসিয়ালিস্ট। তিনি ছিলেন মূলত ধার্মিক। তিনি চেয়েছিলেন আল্লাহ ও বিবেকের দোহাই দিয়ে পীড়নপ্রবণ লোভী মানুষকে সংযত রাখতে, যা যে-কোনো ধর্মবাদী ও ধার্মিকের লক্ষ্য।

নজরুল ছিলেন সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক আকাক্ষার প্রচারক কোনো সূক্ষ্মতত্ত্ব বা অভাবিতপূর্ণ মহৎ আদর্শের উদ্ভাবক নন। মানুষের স্থূল চেতনায় ব্যবহারিক প্রয়োজনের তাকিদ সৃষ্টিই ছিল তাঁর সাহিত্য সাধনার লক্ষ্য। অর্থাৎ তিনি দেশের মানুষের দ্বিবিধ মুক্তি কামনা করেছিলেন–রাজনীতিক পরাধীনতার ও অর্থনীতিক পরবশ্যতার বিরুদ্ধেই ছিল তার সংগ্রাম। এ সংগ্রামে তাঁর কোনো নির্দিষ্ট অস্ত্র ছিল না, কিন্তু লক্ষ্য ছিল স্থির।

স্বদেশের স্বাধীনতাই তাঁর কাম্য ছিল বলে তিনি হিন্দু-মুসলমানের মিলন সাধনা করেছেন। এজন্যে তিনি তাঁদের কুসংস্কারমুক্ত করতে চেয়েছেন, ধর্মের অবিকৃত সারবাণী স্মরণ ও অনুসরণ করতে আহ্বান জানিয়েছেন, আচারিক ধর্মের নিন্দা করেছেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকার মূলে রয়েছে এ আদর্শ। কবিতায় মুসলিম ঐতিহ্য এবং হিন্দু পুরাণের মিশ্রণও এ উদ্দেশ্য ও আদর্শ প্রণোদিত। হিন্দু-মুসলিম মিলন না হলে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম হবে অসম্ভব। ফলে স্বাধীনতা থাকবে অনায়ত্ত। মুসলিম ঐতিহ্য ও হিন্দু পুরাণের নির্বিচার বহুল ব্যবহার তাঁর কাব্যকে করেছে হিন্দু মুসলমানের হৃদয়গ্রাহী। তাঁর উদাত্ত আহ্বান তাই সাড়া দিয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের সমধর্মী মানুষের মন।

স্বদেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবার জন্যে তিনি আরো এক পন্থা গ্রহণ করেছিলেন–আফ্রো-এশিয়ার পরাধীন জাতির মুক্তিসংগ্রামী নেতাদের প্রশস্তি গান রচনা করেছিলেন। আকস্মিক যোগাযোগে (accidental coincidence) তাঁরা ছিলেন মুসলিম অধ্যুষিত দেশের মুসলিম নেতা। কাকতালীয় ন্যায় প্রয়োগে নজরুল হলেন মুসলিম জাগরণের চারণ কবি Pan Islamist যারা তাকে বিশ্বমুসলিম জাতীয়তাবাদী ঠাওরিয়ে উল্লসিত হলেন, সেই শিক্ষিত মুসলিম বাঙালিরাও স্বস্থ ছিলেন না, তাঁরা তখনো জামালুদ্দীন আফগানীর প্রভাবে অভিভূত। এবং নিজেরা নিঃস্ব ও অসমর্থ বলে জ্ঞাতির সৌভাগ্যস্বপ্নে আনন্দিত। তাই কোনো কৃতীপুরুষ আরবি-ফারসি নামধারী হলেই, তার গৌরব-গর্বে তাঁরা হতেন স্ফীত। এজন্যেই যে কামাল আতাতুর্ক কোরান পুড়িয়ে, মসজিদ ভেঙে এবং আরবি ছাড়িয়ে তুর্কীজাতিকে নবজীবন দানে হলেন প্রয়াসী অর্থাৎ ইসলামের কবলমুক্ত করেই বাঁচাতে চাইলেন স্বজাতিকে, তিনিই এদেশী মুসলমানদের চোখে হলেন মুসলিমদের জাতীয় বীর ও ইসলামের ত্রাণকর্তা। স্বয়ং নজরুল ইসলাম এঁদের অন্যতম।

যদিও নজরুল pan Islamist ছিলেন না, তবু স্বধর্মীপ্রীতির সংস্কার তাঁরও ছিল। এখানেও তাঁর দ্বৈতসত্তা। Pan Islamist নন অথচ একপ্রকার ধর্মীয় জাতীয়তায় আস্থা রাখেন। ফলে তিনি কখনো দেশগত জাতি নির্মাণে ব্রতী, কখনোবা ধর্মীয় স্বজাতির কীর্তি ও কর্ম থেকে প্রেরণা সঞ্চয়ে উদ্যোগী। অবশ্য তিনি হিন্দু-মুসলমানের স্বাতন্ত্রের মধ্যেই ঐক্যকামনা করেছেন, অভিন্ন জাতিরূপে গড়ে তোলা সম্ভব, ভাবেননি। অর্থাৎ পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্কে নয়–সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে সমস্বার্থে সমবেত হতে আহ্বান জানিয়েছেন মাত্র। এটি বাস্তব পন্থার কাছাকাছি কিন্তু বাস্তব নয়। কেননা সমস্বার্থে মিলনের আগে স্বার্থ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বোঝাঁপড়া দরকার। এটি রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, নজরুল নয়।

নিপীড়িত জনতার দারিদ্র্যমুক্তির ব্যাপারেও তিনি কোনো নতুন মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন না। ধর্মীয় চেতনার মাধ্যমে তিনি শোষক-পীড়কদের ন্যায়নিষ্ঠ ও কৃপাবান করতে চেয়েছিলেন। সামন্ত সমাজের অশোভন অসঙ্গতি থেকে বিবেকবান সমাজে উত্তরণই যেন তাঁর কাম্য ছিল। তাই তিনি কুলি-মজুর-চাষীর প্রতি সুবিচার দাবী করেছেন। মার্কসীয়তত্ত্বের অনুসরণে কিংবা লেনিনীয় সমাজের অনুকরণে ধন বণ্টনভিত্তিক শ্রেণীহীন সমাজ নির্মাণ তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। এখানেও তিনি শাস্ত্রানুমোদিত অথচ কিছুটা মার্কসবাদ সমর্থিত আদর্শ সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। এ একপ্রকার গোঁজামিলে দুকূল রক্ষার প্রয়াস। তাই তিনি যন্ত্রের পরিবর্তন চাননি–যন্ত্রজ পদার্থকে প্রতিপক্ষ ভেবে গাল দিয়েছেন জমিদার, মহাজন, সওদাগর ও কল মালিককে। এখানেও তার সেই দ্বৈতসত্তা প্রত্যক্ষ করি। এর কারণ নজরুলের চেতনায় কোনো সংস্কার-মুক্তি ছিল না। পরিবেশ থেকে পাওয়া নতুন ভাব-চিন্তা তার অন্তরের রক্ষণশীলতার ও সংস্কারাচ্ছন্নতার মূলোচ্ছেদ করতে পারেনি। ফলে তাঁর প্রগতিবাদিতা তথা নতুন চিন্তানুরাগ বাহ্যাড়ম্বর ও বাগাড়ম্বররূপে ত্বকে প্রলিপ্ত চন্দনের মতো আভরণ হয়ে কিংবা অঙ্গে মর্দিত তৈলের মতো লাবণ্য হয়েই রইল, তাঁর কাব্যে এটি মর্মবাণী হয়ে উঠল না।

.

০৫.

প্রতিভা কেন, কোনো মানুষেরই মত-পথ ধ্রুবতায় অবসিত হয় না। কেননা অভিজ্ঞতার আলোকে মত বদলাতে হয়, পাল্টাতে হয় পথ। এ অসঙ্গতি সব প্রতিভারই চেতনায় ও কর্মে সুলভ। এটি বরং চলমানতার ও গতিশীলতার লক্ষণ, অগ্রগতির ও উত্তরণের পরিমাপক। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে স্ববিরোধ–দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতারই সাক্ষ্য। নজরুলে এই স্ববিরোধ অত্যন্ত প্রকট। স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে সন্ত্রাসবাদ এবং শোষণ মুক্তির জন্যে সাম্যবাদ তাঁর প্রিয় হলেও তিনি একাধারে নিয়মতান্ত্রিক, গান্ধীপন্থী, কামালপন্থী, গণবিপ্লবী, সমাজ-সংস্কারক, চরকা-মাহাত্ম প্রচারক, লীলাবাদী আধ্যাত্মিক ও মরমী, সর্বসংস্কারমুক্ত, ভৌতিক বিশ্বাসে অভিভূত, স্বধর্মনিষ্ঠ ও নাতে আসক্ত এবং শ্যাম-শ্যামা সঙ্গীতে আগ্রহী।

এমনকি তিনি কোরআনের মুমীন অনুবাদক এবং রসুলজীবনের ভাষ্যকারও। কোরআনে আল্লাহ বলেন, আমি যাকে ঐশ্বর্য দিই, তাকে বেহিসাব অপরিমেয় দিই। আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি। এবং রসুল ন্যায়নিষ্ঠায়, অনুকম্পায় ও দানে দীক্ষা দিয়েছেন, ধনবৈষমের নিন্দা করেননি। শাস্ত্র ও সাম্যবাদের মহিমা একই সঙ্গে উচ্চারণ নীতি-নিষ্ঠার অভাবপ্রসূত।

কোনো একক প্রত্যয় তাকে একনিষ্ঠ করেনি বলেই যা-কিছু তার কল্পনা-উদ্দীপিত করেছে, যা-কিছু তার বক্তব্যের অনুকূল, তা তিনি নির্বিচারে গ্রহণ করলেন এবং মত-পথের বিচার না করেই স্বাধীনতার সংগ্রামী মাত্রকেই সমান আগ্রহে করেছেন অভিনন্দিত। আবার কার্যকারণ বিচার না করেই ধনীকে জেনেছেন অপরাধী, ভেবেছেন শত্রু। নিজে নিঃস্ব ও দুঃস্ব বলেই তিনি নিপীড়িত মানবতার প্রতি সহানুভূতিশীল, নির্যাতিত মানবতার বিক্ষুব্ধ নায়ক। কিন্তু তার অবচেতন লক্ষ্য ছিল বুর্জোয়া ঐশ্বর্য ও বুর্জোয়া বিলাস। তাই ধনিক-বণিকদের হত্যা করে ধ্বংস করে তাদের ঐশ্বর্য ভোগ করতে চেয়েছেন তিনিঃ

এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়।
—কৃষাণের গান

সংবেদশীলের যে মানবতাবোধ বুর্জোয়াকে স্বস্বার্থবিরোধী গণসংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে, নিঃস্ব নির্যাতিত মানুষের দুঃখ মোচনে উদ্বুদ্ধ করে, নিজের কায়েমী স্বার্থ ও নিশ্চিত আরামের জীবন ত্যাগের তাকিদ দান করে, নজরুলের মানবতাবাদ সে শ্ৰেণীর নয়। এ অনেকটা স্বস্বার্থে সংগ্রাম এবং জৈবিক উত্তেজনা প্রসূত, তাই এ তমঃগুণজাত। এ কারণে এত দূরদৃষ্টি নেই–স্থায়ী সমাধান পন্থার নির্দেশ এতে অনুপস্থিত। শ্ৰেণীহীন সমাজ গড়ে তাতে নির্বিশেষ মানুষের কল্যাণ তিনি চাননি। কেননা ধনবৈষম্য তাঁর অনভিপ্রেত নয়। কেবল বুভুক্ষা-নগ্নতা-নিরাশ্রয় মুক্ত সমাজই তার। কাম্য যা ঐশ্বর্যশালী পুঁজিবাদী সমাজে দুর্লভ নয়। অতএব কুলি-মজুর-চাষীর জন্যে অন্ন, বস্ত্র, গৃহ সংস্থানই তাঁর লক্ষ্য, তা যেভাবেই হোক–দয়ায় বা দাবীতে।

এখানে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কলি মনে পড়ছে :

চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।

নজরুলেরও মনটি ছিল ঠিক চোখের কোলেই। তিনি যা দেখেছেন, তাই বলেছেন, ভাবেননি কিছুই। তিনি চোখের আনুগত্যে চলেছেন, অন্তরের নির্দেশ পাননি। এর একাধিক গূঢ় কারণ আছে নিশ্চয়ই। সেগুলোর একটি শিক্ষাগত আর একটি আবেগসঞ্জাত।

.

০৬.

নজরুল দুটো বিষয়ে ব্যুৎপন্ন ছিলেন। একটি পাঁচশ বছর আগেকার ফারসি সাহিত্য এবং অন্যটি দুই-আড়াই হাজার বছর পূর্বেকার হিন্দু-পুরাণ। অথচ আমাদের আজকের জীবনবোধ ও শিল্পচেতনা পাশ্চাত্য শিক্ষায় লব্ধ। আধুনিক বাঙলা সাহিত্য তো ইংরেজি সাহিত্যেরই প্রতিরূপ। সেই কারণেই মোহিতলাল নজরুলকে একটি সৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁকে ইংরেজি সাহিত্য পাঠ করতে বলেছিলেন। তিনি তা গ্রহণ করেননি। আধুনিক জীবনবোধ বিকাশের জন্যে সমকালীন সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন পাঠ আবশ্যক ছিল। নজরুল সে শিক্ষা গ্রহণ করেননি। নজরুলের জন্মের পূর্বেই ডারুইন, মার্কস ও ফ্রয়েড মানুষের জগতে ও জীবনে কালান্তর ঘোষণা করেছেন। এই তিনজনকে অবহেলা করে আধুনিক মানুষ হওয়া চলে না। নজরুলের কাছে ডারুইন ও ফ্রয়েড অজ্ঞাত আর মার্কস অবহেলিত। কাজেই তার বন্ধুরা তাঁর সম্বন্ধে সত্য কথাই বলেছিলেন :

পড়ে না কো বই, বয়ে গেছে ওটা।–কবির কৈফিয়ৎ

ফলে কাব্যের ক্ষেত্রে তিনি কেবল লাটিমের মতো ঘুরেছেন, অগ্রসর হননি মোটেই। ভাব ভাষা ছন্দ কিংবা ভঙ্গির ক্ষেত্রে তাঁর কাব্যে আবর্তন আছে, বিবর্তন নেই। কোনো নতুন অভিজ্ঞতার আনন্দে, কোনো নতুন প্রত্যয়ের ঐশ্বর্যে, কোনো নতুন সৃষ্টির সাফল্যে, কোনো নবলব্ধ চেতনার চাঞ্চল্যে, কোনো নবাবিষ্কৃত সত্যের প্রসঙ্গে তার জীবন কিংবা সাহিত্য উত্তরণের পথ খুঁজে পায়নি। জীবনে, সমাজে ও সাহিত্যে তিনি অন্ধের মতো কেবলই ছুটোছুটি করেছেন–বিপ্লবীরূপে, ধার্মিকরূপে, মরমীরূপে, প্রেমিকরূপে। শ্রান্ত হয়েছেন, সফল হননি।

নব নব কিশলয় মাধ্যমে বৃক্ষ বেড়ে ওঠে, আত্মবিস্তার করে। নজরুল-প্রতিভাকে বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। তাঁর প্রতিভা গুল্ম-জাতীয়–সহজে স্বপ্রতিষ্ঠ, নাতিবৃদ্ধি ও স্বল্পজীবী। ১৯২২ থেকে ১৯৩২ সনের মধ্যেই তার আকস্মিক উন্মেষ, বৈদ্যুতিক বিকাশ ও বেলুনীয় পরিণতি! এ সময়ের মধ্যে আম-জাম-বেগুন-বরইর মতোই তাঁর সৃষ্টি অঢেল অজস্র! বাকি বারো বছরের ফসল সামান্য, বৈশিষ্ট্য বর্জিত, নিস্পন্দ ও ম্লান। অথচ তখনো তিনি প্রৌঢ় নন, যৌবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে মাত্র।

.

০৭.

নজরুল তাঁর মন ও মস্তিষ্কের অদ্বয় সহযোগিতা পাননি কোনোদিন। হৃদয়বৃত্তিই ছিল তাঁর সম্বল। তাই তিনি সর্বত্র আবেগ চালিত। আবেগ পরিমিতি মানে না। তাই তাঁর রচনায় পরিমিতি দুর্লভ। অতিকথন তাঁর গল্পে উপন্যাসে নাটকে প্রবন্ধে এবং গানে কবিতায় সর্বত্র দৃশ্যমান। এই আবেগ বিহ্বলতা, এই উচ্ছ্বাসের অপ্রতিরোধ্যতা তার গল্প উপন্যাস নাটক প্রবন্ধ মাটি করেছে। গান ও কবিতা দুঃসহ হয়নি অন্য কারণেএস কথা পরে হবে। এমকি সামান উৎসর্গপত্র কিংবা মুখবন্ধও উচ্ছ্বাসের আত্যন্তিকতায় ফেনিল। আবেগ উচ্ছ্বাস স্থানকাল বিশেষে ভালোই, এমনকি প্রয়োজনীয়ও। কিন্তু সার্বত্রিক প্রয়োগে তা শিল্পকলাকে নষ্ট করে, বক্তব্যকে করে লঘু ও নিষ্ফল। উচ্ছ্বাস মুখ্য হলেও গল্পে উপন্যাসে নাটকে রূপক-রচনায় নজরুল ইসলামের ব্যর্থতার অন্য কারণও রয়েছে। গল্প উপন্যাস নাটক লেখার প্রতিভা নজরুলের সামান্যই ছিল। এতে মস্তিষ্কের প্রয়োজন বেশি, হৃদয়বৃত্তির স্থান সামান্য। ভূয়োদর্শন, পরিবেষ্টনী চেতনা, মানবিক বৃত্তি-প্রবৃত্তির গতি-প্রকৃতি জ্ঞান, ব্যক্তির পারস্পরিক আচরণের ও বাহ্য ঘটনার আন্তর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, মনস্তত্ত্বের ধারণা এবং প্রজ্ঞা প্রভৃতির সমন্বিত সামর্থ্যেই সম্ভব গল্প উপন্যাস নাটক সৃজন। নজরুলে এগুলো সুলভ ছিল না। তাই তাঁর পরিকল্পিত কাহিনী শিথিলগ্রন্থি, তাঁর অঙ্কিত চরিত্র নির্বণ ও বৈশিষ্ট্য বর্জিত। তার বক্তব্য তাৎপর্যহীন। সংলাপ প্রায় অপ্রতিরোধ্য প্রলাপ ও জীবনবোধ সংকীর্ণ। অবশ্য খণ্ডচিত্র দুর্লভ নয়, মনোহর বাণীমূর্তিও সুলভ। এবং কোনো কোনো প্রবন্ধ সুখপাঠ্য। ভাষাও স্থানে স্থানে হৃদয়গ্রাহী, কিন্তু সামগ্রিক সৌন্দর্য দুর্লক্ষ্য।

.

০৮.

আরো দুটো বিষয়ে তার প্রবল আগ্রহ ছিল-ছন্দে ও শব্দে। ছন্দের ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথের প্রবল প্রভাব অনুকৃতি ও অনুসৃতির পথে তাকে ছন্দো-স্রষ্টার মর্যাদায় উন্নীত করে। আরবি-ফারসি ছন্দের আদলে বাঙলা ছন্দ সৃষ্টি করে তিনি বাঙলা ছন্দে বৈচিত্র্য ও বিস্তার দান করেছেন, তেমনি সুরের ক্ষেত্রেও তিনি অনেক নতুন ও মিশ্র রাগ-রাগিণীর স্রষ্টা।

রবীন্দ্রনাথের ভাষার প্রভাবও নজরুলে ছিল গভীর। রবীন্দ্র-কাব্যের ও গানের বহু Phrase নজরুল হুবহু গ্রহণ করেছেন, তাঁর অনেক বাক্যাংশ কিংবা চরণাংশও দুর্লভ নয় নজরুলের কাব্যে। নজরুল আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগের প্রেরণা পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ও মোহিতলাল থেকে। এ বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন মোহিতলালেরও গুরু।

দেশী মুসলমানরা দৈশিক ও ভাষিক পরিচয়ে বাঙালি। এবং আরব-উদ্ভূত ধর্মে বিশ্বাসী। বাঙালি হিসেবে সব মুসলমানেরই দৈশিক ঐতিহ্য ও পুরাণের–যা নামান্তরে হিন্দুর ও হিন্দুয়ানীর সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচয় ঘটে এবং ধর্মীয় সূত্রে আরব-ইরানি ঐতিহ্য ও পুরাণেরও কিছু কিছু জানাশোনা থাকে। ফলে মুসলমান মাত্রেই হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য ও পুরাণের সঙ্গে পরিচিত। এবং যেহেতু হিন্দুর দৈশিক ও ধার্মিক ঐতিহ্য ও পুরাণ অভিন্ন, তাই হিন্দু মাত্রই কেবল দৈশিক নামান্তরে হিন্দুর–ঐতিহ্য ও পুরাণই জানে। এরই অপব্যাখ্যায় নজরুল বা মুসলিম লেখক উদার বলে প্রশংসিত, আর রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি হিন্দু লিখিয়েরা নিন্দিত হয়েছেন গ্রহণ-বিমুখ সংকীর্ণচিত্ত বলে।

বলেছি নজরুল অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই দ্বিবিধ ঐতিহ্য ও পুরাণ আয়ত্ত করেছিলেন। এবং মুসলিম ঐতিহ্যের ও হিন্দু পুরাণের সার্বত্রিক সুপ্রয়োগে নতুন রস ও লাবণ্য লাভ করেছে তার কবিতা ও গান। এজন্যেই তাঁর কবিতা ও গানে অতিকথন দোষ, আবেগপ্রাধান্য, চটুল ছন্দের বহুল প্রয়োগ, শিথিল বাকৃবিন্যাস, ভাবগত স্ববিরোধ ও অসংলগ্নতা এবং পৌনপুনিকতা দোষ সহসা দৃষ্টিগোচর হয় না। নইলে এমনও দেখা যায় পৌরাণিক রূপ-প্রতীকাদি কিংবা তাঁর প্রিয় শব্দগুলো প্রয়োগ করবার লোভে বক্তব্য শেষ হওয়ার পরেও তিনি কবিতা দীর্ঘ করেছেন। এতে কবিতায় ভাবগত স্ববিরোধ ও অসঙ্গতি প্রশ্রয় পেয়েছে, ফলে কাব্যে রসাভাস ঘটেছে। বিদ্রোহী, দারিদ্র্য, পূজারিণী, সিন্ধু প্রভৃতি বহু শ্রেষ্ঠ কবিতায় এ দোষ লক্ষণীয়। আর এই ঐতিহ্য ও পুরাণ সংপৃক্ত উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষার বহুল প্রয়োগ নেই বলেই তাঁর উচ্ছ্বাসপূর্ণ গদ্য রুচিবান পাঠকের পক্ষে প্রায় অসহ্য।

আসলে ভঙ্গিও নয়, বক্তব্যও নয়, মুসলিম ঐতিহ্যের ও হিন্দু পুরাণের সুষম দেদার অঢেল অজস্র ব্যবহারই নজরুলের কবিতা ও গানকে লোকপ্রিয় করেছে। তাঁর কবিগৌরব এতেই লব্ধ, তার জনপ্রিয়তা এতেই প্রতিষ্ঠিত, তাঁর বৈশিষ্ট্য এতেই সুপ্রকাশিত।

.

০৯.

নজরুলের প্রেমের কবিতা ও গান সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য সামান্য। নজরুল বলেছেন বটে : মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ তুর্য কিন্তু তাঁর অন্তরলোকেও দেখছি দুটো আলাদা কোঠা। একটি অপরটি থেকে পাকা দেয়ালে বিচ্ছিন্ন। এ-কক্ষ ও-কক্ষ দুটো সদর-অন্দরের মতো একেবারে ভিন্ন জগৎ, ভিন্ন আলো আকাশ, বিপরীত আবহাওয়া। এক কক্ষে আগুন, অপর কক্ষে অশ্রু। এখানেও কবির দ্বৈতসত্তা প্রকট।

একই কালে তিনি শোষণ, পীড়ন, ভণ্ডামি, পরাধীনতা, কুসংস্কার প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ চিত্তে সংগ্রামী কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনি নারীপ্রেমের কোমলকান্ত পদও রচনা করেছেন, তেমনি লিখেছেন নাত কিংবা শ্যাম-শ্যামাসঙ্গীত। অথচ একভাব কোনো ক্রমেই অন্যভাবকে প্রভাবিত করেনি, লজ্ঞান করেনি, করেনি আচ্ছন্ন। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার, কবির আশ্চর্য দক্ষতার স্বাক্ষর, এবং আমাদের কাছে বিস্ময়কর সংবাদ। এ কি গভীর বোধ, প্রত্যয় ও নিষ্ঠার অভাবপ্রসূত! এ কি চঞ্চল চিত্তের অস্থির প্রকাশ সঞ্জাত অথবা এ ধীরচিত্ত প্রতিভার এক আশ্চর্য প্রকাশ! না কি একটা মিটিংকা বাত, অপরটা অন্তরঙ্গ আলাপ! এর হদিসের জন্যে কবির ব্যক্তিক জীবনের অনুষঙ্গ জ্ঞান আবশ্যক।

অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশীর সঙ্গেই পাচ্ছি দোলন চাঁপা, ছায়ানট, পুবের হাওয়া; আবার ভাঙার গান, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণিমনসা ও জিঞ্জিরের পাশে পাই বুলবুল, চোখের চাতক, চক্রবাক; পুনরায় পাচ্ছি সন্ধ্যা ও প্রলয় শিখার সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু। কিন্তু যতই অবাক হই, এও নজরুলের পক্ষে সম্ভব এবং সত্য ছিল।

নজরুলের প্রেমের গান ও কবিতা বৈচিত্র্যবিহীন। Pangs of separation and disappointment-ই তার প্রেমের কবিতা ও গানের প্রধান সুর। তার পত্রোপন্যাস বাঁধনহারায় এর প্রথম উন্মেষ। না-পাওয়ার বেদনা, পেয়ে হারানোর জ্বালা, অবহেলা প্রাপ্তির ক্ষোভ, ভুলতে না-পারার যন্ত্রণা, সাধাসাধির ব্যর্থতায় হতাশা, পাওয়া-না পাওয়ার অবমাননা, প্রিয়ার স্মৃতির সঞ্চয়ে ঠাই না-পাওয়ার ব্যথা, মিলনোক্কণ্ঠা, বিচ্ছেদ শঙ্কা, আনন্দিত স্মৃতির বিষাদ, বিরহ বিধুরতা, অতৃপ্তির অস্থিরতা, প্রতিদান না-পাওয়ার দাহ প্রভৃতিই তাঁর প্রেমবিষয়ক বিভিন্ন কবিতায় ও গানে অভিব্যক্ত।

এ প্রেমে সূক্ষ্ম ও মহৎ দর্শন নেই। এ নিতান্ত শারীর ও নির্লক্ষ্য। একনিষ্ঠতাও নেই। কবি বহুবল্লভ। আছে কেবল হৃদয়ের আকৃতি ও প্রণয়-বিহ্বলতা। একটা অসহ্য আবেগ, একটা অদম্য আকর্ষণ, একটা অসীম উৎকণ্ঠ, একটা অশেষ বাসনা, একটা অসহ্য অতৃপ্তি কবিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কাঁদিয়ে মারছে। বৈষ্ণব পদাবলীর রাধাও এমনি বিচলিতা, এমনি হতভাগিনী। তবু বিপ্রলব্ধ পর্বে-পূর্বাগে প্রেমবৈচিত্র্যে মানে প্রবাসে উপলক্ষ্য ও অনুভূতির বৈচিত্র্য আছে। নজরুলের কাব্যে তা দুর্লভ। তাই একই অনুভূতির পৌনপুনিকতা পীড়াদায়ক। মনে হয় একটা অকারণ ক্ষোভ, একটা অহেতুক বেদনা, একটা অগভীর অতৃপ্তি ও একটা কৃত্রিম বিরহ বাঞ্ছ বা বিলাস যেন কবিকে পেয়ে বসেছে। নজরুলের প্রেমের কবিতায় ও গানে তাই ক্ষোভ, কান্না ও বিলাপই মুখ্যত দৃশ্যমান। বহু-বল্লভের এই শারীর-প্রেম কবিকে কোনো বোধের তথা উপলব্ধির জগতে উত্তীর্ণ করেনি। তাই এ প্রেম নজরুলের চৈতন্যস্বরূপ হয়ে ফোটেনি।

.

১০.

এবার গানের কথা বলি। সত্য বটে নজরুল অজস্র গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের সংখ্যা কেউ বলেন দু-হাজার, কেউ বলেন তিন হাজার। সুরস্রষ্টা হিসেবেও তিনি প্রখ্যাত। বিদেশের ও বিভাষার নানা সুর বাঙলা গানে সংযোজিত করে এবং অনেক মিশ্ররাগ নির্মাণ করে তিনি গানের আকাশ করেছেন বিস্তৃত, সঙ্গীতশাস্ত্রকে করেছেন ঋদ্ধ। তাঁর গানের কথা ও সুর সঙ্গীতরসিকদের মুগ্ধ করেছে। তাঁর গানের স্বীকৃত বিশিষ্টতা রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো নজরুলগীতিরও গর্বিত স্থূল বা খান্দান গড়ে তুলেছে। গানের জগতে নজরুলের দিগ্বিজয়ী জনপ্রিয়তা-মুগ্ধ কোনো কোনো গুণী ও বিদ্বান এমনও মনে করেন যে, কাজের ক্ষেত্রে যাই হোক, গানের ভুবনে নজরুল অমর এবং তাঁর গান ও সুর থাকবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অবিনশ্বর। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, দুনিয়ায় অক্ষয় অবিনাশী কিছুই নেই। রবীন্দ্রনাথের গান যেমন কাব্য হিসেবেও সুন্দর ও ভাবগর্ভ অর্থাৎ তাতে ভাব, ভাষা, ছন্দ যেমন আছে, তেমনি আছে সূক্ষ্ম গভীর বাণীও। নজরুলেরও অনেক গান তেমন সব গুণে ঋদ্ধ। কিন্তু আধুনিক গানের তোড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতই পিছিয়ে পড়ছে, নজরুল গীতই বা কি টিকবে! কালান্তরে পুরোনো সুর টেকে না বলেই গান নশ্বর। যুগে যুগে যুগোপযোগী সুরই যুগের চাহিদা মিটায় এবং কালান্তরে তা বিলীন হয় কালগর্ভে। মানুষ চিরকালই সুখে দুঃখে, কাজে অকাজে, ভয়ে ভক্তিতে, দ্বন্দ্বে সগ্রামে গান গেয়েছে বটে, কিন্তু তা কখনো অপরিবর্তিত থাকেনি। বৈদিক বন্দি গন্ধর্বের গায়ত্রী বন্দনা থেকে আজকের আধুনিক গান অবধি সঙ্গীতের এদেশী বিবর্তন ধারাই আমাদের এ ধারণার সমর্থক। কালে কালে মানুষের মন বদলায়, বদলায় রুচি। তাছাড়া ভাষা আর সুরও বদলায়। কাজেই মনের সঙ্গে কথা এবং ভাষার সঙ্গে সুরের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাই তো আমাদের কীর্তন, গাজন, গম্ভীরা, রামপ্রসাদী যেমন সাধন-ভজন সংপৃক্ত হয়েও লুপ্তপ্রায়, তেমনি মানবিক সুখ দুঃখের গানও অতিক্রান্তকালে চিরদিনই হয়েছে বিলুপ্ত। বাউলগান, ব্রহ্মসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্র-রজনী-অতুল-মুকুন্দের গানই বা আজ আর কে গায়! কাজেই মর্মান্তিক হলেও এ সত্য অস্বীকার করা চলবে না যে রবীন্দ্র-নজরুলসঙ্গীতও আগামী পঞ্চাশ বছরও টিকবে না।

.

১১.

নজরুলের অনেক অপূর্ণতার কথাই বলা হল বটে, কিন্তু তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়। গীতিকবি তো দার্শনিক কিংবা সমাজকর্মী নন, তাঁকে নানা দায়ে দায়ী করার সার্থকতা কী? স্বেচ্ছায় যা দিয়েছেন বা দিতে পেরেছেন, এবং আমরা যতটুকু আনন্দ ও প্রেরণা পেয়েছি বা পাচ্ছি তা তো যথালাভ। তাছাড়া সাধারণ পাঠকের কাছে তিনি আজকের পরিবেশেও অম্লান সূর্য, প্রাণময়তার উৎস। তার ছিল তাজা, তরুণ ও উচ্ছল প্রাণ। সেই প্রাণের স্পর্শে দেশে জেগে উঠেছিল লক্ষ প্রাণ। আজো তেমনি জাগে, কেননা তিনি যে-পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করেছিলেন, তা আজো অবিলুপ্ত। তাই আজ বাঙলার সবকিছু ভাগ হয়েছে। ভাগ হননি কেবল নজরুল। এজমালি সম্পদরূপে তাঁর এই স্থিতিই প্রমাণ করে যে নজরুল এত বিচ্যুতি সত্ত্বেও সার্থক ও সফল কবি। বাঙলার ও বাঙালির তিনি আজও মনের মানুষ, হৃদয়ের ধন, সংগ্রামের প্রবর্তনদাতা নায়ক। এক হৃদয়ের প্রীতি অন্য হৃদয়েও অনুরাগ জাগায়। সীমিত ও সংকীর্ণ অর্থে নজরুলও মানবতাবাদী ও মানবপ্রেমিক। তাঁর বিদ্রোহের জড় রয়েছে এই মানবতাবোধে। মানবপ্রীতিই তাঁকে বিদ্রোহী ও নিষ্ঠুর সংগ্রামী করেছিল। তিনি বলেছেন, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। তাঁর সেই অভিলাষ পূর্ণ হয়েছে। নজরুল দীন-দুঃখী-নিপীড়িত মানুষকে ভালোবাসতেন, তাই শোষক- পীড়করা ছিল তার শত্রু। স্বদেশের কৃতজ্ঞ মানুষের কাছে তিনি প্রাণপ্রিয় হয়েই আছেন। তাই তারা তাঁকে ভুলেনি, ভুলবে না, ভুলতে পারবে না। জয়তু নজরুল।

নজরুল-কাব্যে বীর ও বীর্যপ্রতীক

যদি আমরা বিশ্বাস করি, যে-কোনোকিছুর উপযোগ ও ফলপ্রসূতা তার স্বকালেই সীমিত, তাহলে কোনোকিছুই কালজয়িতা ও চিরন্তনতার জন্যে আমাদের উৎকণ্ঠা ঘুচাবে। আসলে চিরন্তনতার কামনা একটি মানসমোহ ছাড়া কিছু নয়। এটি আবেগের প্রসূন, উপযোগ-বুদ্ধি কিংবা প্রয়োজন চেতনার ফল নয়। প্রকৃতির জগতে ফুল-পাতা, অথবা আম-জাম, কলা-মূলা স্বল্পজীবী, তাই বলে কোনো অর্থেই তাদের জীবন মিথ্যে বা ব্যর্থ নয়। তেমনি মানুষের জীবনে ও সমাজে কোনোকিছুরই উপযোগ চিরস্থায়ী নয়–অন্তত তার স্থানিক, কালিক ও ব্যক্তিক উপযোগ ভেদ ও রূপান্তর আছে। কোনো পুরাতনই নতুনকালের নতুন মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এই তাৎপর্যে নতুন মানে বর্তমান আর পুরাতন অতীতেরই প্রতীক। সকালে যা নতুন, অতিক্রান্তকালে তাই হৃতউপযোগ পুরাতন।

এই দৃষ্টিতে নজরুল-কাব্য আজো নতুন। তার উপযোগ ও প্রয়োজন আজো বর্তমান। কেননা আমাদের সমাজে, ধর্মে, অর্থনীতিতে ও রাজনীতিতে আজো রূপান্তর ঘটেনি। নজরুল-বিঘোষিত সগ্রাম ও সগ্রামের উদ্দেশ্য আজো সফল হয়নি। লক্ষ্য আজো অনায়ত্ত, মঞ্জিল আজো অদৃষ্ট। তাই নজরুল আজো প্রিয়নাম। নজরুল-কাব্য আজো অবশ্যপাঠ্য। এ-কারণেই বাঙলার সবকিছু ভাগ হয়েছে, ভাগ হয়নি নজরুল। পর হয়ে যাননি তিনি কারো–তাই তাকে নিয়ে আজো দুই বঙ্গে এত টানাটানি ও কাড়াকাড়ি।

বলাবাহুল্য, নজরুল ছিলেন বিপ্লবী ও বিদ্রোহী। তিনি উপায়নিষ্ঠ ছিলেন না বটে, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল অবিচল। এ-ও সত্য যে, তিনি রাজনীতিক জটিলতা বুঝতেন না। কিন্তু বৈপ্লবিক চেতনা ছিল তাঁর গভীর ও তীব্র। তাঁর মন ও মস্তিষ্কের মেলবন্ধন ছিল না বলেই তাঁর ভাবকর্ম যতটা আবেগ-চালিত, ততটা মনীষা-নিয়ন্ত্রিত ছিল না। রক্তপিচ্ছিল সহিংস বিপ্লবই তাঁর প্রিয় ছিল, তবু তিনি অভীষ্ট সিদ্ধির অন্য উপায়কেও অভিনন্দিত করেছেন। তার অস্থির অথচ অকৃত্রিম আগ্রহ ও সমর্থন ছিল সব পদ্ধতিরই প্রয়োগ-প্রয়াসে।

সমাজ ও ধর্মবুদ্ধির সংস্কারে, আর্থিক জীবনের রূপান্তরে এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর আকুতি-আকুলতার তীব্রতাই তাঁকে মারি অরি পারি যে-কৌশলে মতে প্রবর্তনা দিয়েছিল। এসব কিছুর মূলে রয়েছে শোষিত-পীড়িত মানুষের প্রতি দরদের গভীরতা। তা ছাড়া আরো একটি অবচেতন প্রেরণা হয়তো ছিল–সেটি আত্মত্রাণের; কেননা তিনিও ছিলেন নিঃস্বদের একজন। এই দ্বৈতকারণের সমন্বয়ে তাঁর বাণী তীব্র, তীক্ষ্ণ ও অকৃত্রিম যেমন হয়েছে, তেমনি হয়েছে ক্ষুব্ধ, কুদ্ধ ও বঞ্চিত ব্যক্তির প্রাত্যহিক জীবনের তুচ্ছ আবেগে ভারগ্রস্ত।

এ কারণেই জাগ্রত জীবনের আহ্বানে যারা বুকের রক্ত দিয়ে কঠিন মাটি নরম ও উর্বর করে, যারা পলাশলাল সূর্যের অনুধ্যানে আনন্দিত, যারা খুন-রাঙা তরুণ তপনের আকর্ষণে চঞ্চল, যারা আত্মাহুতির উল্লাসে মত্ত, যারা বাঁচবার আগ্রহে মৃত্যুবরণ করে চরম তাচ্ছিল্যে, যারা মহিমান্বিত মৃত্যুর সঞ্চয়ে ও জাগ্রত জীবনের ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ করে দেশ ও জাতিকে; তাদেরই বন্দনা গেয়েছেন। কবি। তাদেরকেই তিনি জেনেছেন দেশ-জাত-মানুষের ত্রাণকর্তা বলে। যৌবনে ও তারুণ্যে তাঁর প্রত্যয় ছিল প্রবল। তার দৃঢ় বিশ্বাস–চিরকাল এমনি তরুণেরাই নর-দানবের পাশব শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে লড়ে আত্মাহুতি দিয়ে দেশ-জাত-মানুষকে পীড়ন থেকে, শোষণ থেকে ও অপমৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছে। তাই যার মধ্যেই এই প্রাণপ্রাচুর্য, এই তারুণ্য, এই যৌবনদীপ্তি ও সংগ্রামী স্পৃহা প্রত্যক্ষ করেছেন; দেশ-কাল-জাতের গণ্ডী অতিক্রম করে তিনি তারই প্রশস্তি রচনা করেছেন। তাদের নামে সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছেন দেশের তরুণদের। প্রবুদ্ধ তারুণ্যের ও জাগ্রত যৌবনের বন্দনায় তিনি মুখর থেকেছেন সর্বক্ষণ।

শাসক-শোষক-পীড়ক এক রক্ত-খেকো রাক্ষুসে শক্তি। বাঘ-সিংহের মতোই তার লোভ ও হিংস্রতা। বুকের রক্ত দিয়েই তার মোকাবিলা করতে হয়। পার্থক্য কেবল এই, বাঘ-সিংহ রক্ত খেয়ে হয় পুষ্ট এবং আরো লুব্ধ, আর রক্তের স্পর্শে চুন-লাগা জেঁকের মতো কাবু হয়ে পড়ে ঐ দানবীয় শক্তি, গণরক্তের বিষক্রিয়ায় তার শক্তি-ভাণ্ড হয় জর্জরিত। এজন্যেই রক্তের বিনিময়ে আসে মুক্তি। দানবীয় রাক্ষুসে শক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা সম্মুখসমরের জন্যে তাই তরুণের তাজা টকটকে লাল রক্ত প্রয়োজন।

অতএব রক্তদানের অঙ্গীকারে নজরুলের গণসংগ্রামের শুরু এবং যারা এভাবে বুকে বুলেট কিংবা গলায় ফাঁস গ্রহণ করেছে, তারাই নজরুলের ব্যবীর। আর যারা মুক্তিসংগ্রামে বুকের রক্তদানে উৎসুক তারাই তাঁর ভরসাস্থল। সংগ্রাম-সুন্দর রক্ত-ঝরা দিন এবং রক্ত-রাঙা মাটিই তাঁর স্মৃতির সঞ্চয় ও ঐতিহ্যের আকর। তাই মৃত্যুর মহিমান্বিত রূপের অনুধ্যানে তার আনন্দ। নতুন সৃষ্টির সুখ-উল্লাসই তাঁকে প্রবর্তনা দেয় পুরোনো সবকিছুর ধ্বংস সাধনায় এবং জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ-স্বপ্নই মৃত্যুবরণ করে উৎসাহিত। এই ধ্বংস ও মৃত্যুর ভয়াল রূপের অন্তরে রয়েছে কল্যাণ সুন্দর রূপ :

জরায় মরা মুমূর্ষদের
প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে–
এবার মহানিশার শেষে
আসবে ঊষা অরুণ হেসে
করুণ বেশে।
দিগম্বরের জটায় লুটায়
শিশু চাঁদের কর
আলো তার ভরবে এবার ঘর।

কাজেই,

ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?
প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন।
আসছে নবীন জীবনহরা
অসুন্দরে করতে ছেদন।

কেননা,

ভেঙে আবার গড়তে জানে।
সে চির-সুন্দর।

এই ভয়ঙ্কর আসে দুরন্ত, দুর্মদ, দুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, অথচ গণকল্যাণকামী রক্ত-মাতাল মৃত্যু-মাতাল তরুণরূপে। তাই বেদুঈন, চেঙ্গিস, পরশুরাম, দুর্বাশা, জমদগ্নি, নটরাজ, বিশ্বামিত্র, খালেদ, উমর, হায়দর, কামাল, আনোয়ার প্রভৃতি তার কাছে পৌরুষের আদর্শ। এ দুর্বার বিদ্রোহ ভৃগুর মতোই ভগবান-বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেয়ার স্পর্ধা রাখে।

কবির প্রিয় ধ্বজা রক্তরঙিন, তাঁর প্রিয় ফুল জবা ও পলাশ, তাঁর প্রিয় পোশাক লাল-গৈরিক, তাঁর প্রিয় শরাবও রক্তরাঙা; তার সংগ্রামী প্রেরণাও হয়তো এসেছিল লালফৌজ থেকে, তাঁর আসমানও খুন-খারাবির রঙ মাখা, তাঁর বিপ্লবের ঘোড়াও রুধির-লাল-রক্ত অশ্ব। তাঁর প্রিয় শাড়ি লাল, কেননা তার বিশ্বাস রক্ত-দান ও গ্রহণ- সামথ্যেই মানবিক সমস্যার সমাধান। তাই তিনি শক্তিরূপিণী দেশমাতৃকার অঙ্গে কামনা করেছেন রক্তাম্বর, হাতে চেয়েছেন খুনরাঙা তরবারি, ললাটে দেখতে চেয়েছেন সিঁদুরের বদলে কালচিতার রাঙা আগুন এবং আরো কামনা করেছেন দেশমাতার চরণ-আঘাতে উদগারে যেন আহত বিশ্ব রক্ত-বান, এবং বুকে-মুখে-চোখে রোষ হুতাশন, নয়নে তার ধূমকেতু জ্বালা উঠুক সরোষে উদ্ভাসি। আর জালিমের বুক বেয়ে খুন ঝরে লালে লাল হোক শ্বেত হরিৎ।

যখন ছোটে রক্ত উদধি এবং ফেনা-বিষ ক্ষরে গলগল যখন ছোটে রক্ত-ফোয়ারা বহ্নির বান, যখন কোটি বীর প্রাণে–শত সূর্যের জ্বালাময় রোষ গমকে শিরায় গমগম, যখন স্বর্গমর্ত্য পাতাল-মাতাল রক্তসুরায়, বিধাতাও ত্রস্ত; তখনই কেবল দানবীয় শক্তির ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। কামাল পাশা, আনোয়ার পাশা, রণভেরী, কোরবানী প্রভৃতি কবিতায় তাঁর বীর ও বীরত্বের আদর্শ সুপ্রকট। রক্ত ও মৃত্যু, প্রাণদান ও গ্রহণ, হিম্মত ও খঞ্জর বীরের নিত্যসঙ্গী–বলা চলে জীবনচর্যার অবলম্বন। খুনে খেলব খুন-মাতন এই হচ্ছে বীরব্রত। রণ-বিপ্লব-রক্ত বর্জিত মুক্তি তার কল্পনাতীত। বাহুবল ও মনোবল ব্যতীত প্রতিকার প্রতিরোধের অন্য কোনো উপায় তার মনে ঠাই পায়নি।

তার কল্পনা উদ্দীপ্ত হয়েছে রণ, রক্ত, রুদ্র, শক্তি, ঝড়, সূর্য, বহ্নি, মৃত্যু প্রভৃতি অবলম্বনে। এগুলোকে তিনি বল-বীর্যে প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছেন। তেমনি ন্যায়, কল্যাণ ও অধিকারের প্রতীক হয়েছে সত্য। আর সবকিছুর গোড়ায় রয়েছে অহংবোধ–আমিত্ব তথা আত্মপ্রত্যয়। এটিই তাকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দিয়েছে প্রবর্তনা।

কিশোর বয়সেই নজরুল ইসলাম সৈন্যদলে ভর্তি হয়েছিলেন। পল্টনী ব্যায়ামেই তাঁর সৈনিক জীবন সীমিত। লড়াইয়ের কল্পচিত্র (যেমন ভার্দুনট্রেঞ্চ) ও বীরত্বের স্বপ্ন-সুন্দর জীবন তার মন হরণ করেছিল। বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকলে হয়ত তিনি এত রণ-রক্ত প্রিয় হতে পারতেন না, সহিংস বিপ্লবেও হয়তো থাকতো না তার এত আগ্রহ। ক্ষুধা-যন্ত্রণা-মৃত্যুশাসিত সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল না বলেই Chivalry যুগের কুইকসোটি প্রেরণার প্রভাব ছিল গভীর ও ব্যাপক। তাঁর সংগ্রামী কবিতায় তাই রক্ত-অগ্নি-ঝড় মৃত্যুই পেয়েছে প্রাধান্য। ত্রাস ও ধ্বংসকর মহাশক্তির অনুধ্যানেই তাঁর আনন্দ, সত্যের প্রতিষ্ঠা শক্তি দিয়েই সম্ভব–এই তার বিশ্বাস। কাব্যের ক্ষেত্রে এই প্রলয়ঙ্কর ভয়াল ভৈরবত্বের আবহ সৃষ্টির জন্যে প্রায় প্রতি কবিতায় হাইফেন-যোগে তিনি অসংখ্য বাপ্রতিমা নির্মাণ করেছেন। তাঁর মনোনীত ছন্দের বন্ধনে তাঁর নির্মিত বাক্-খণ্ডও উত্তেজিত মানুষের আবেগচালিত অনর্গল বক্তৃতার মতো করে তুলেছে তাঁর কবিতাগুলোকে। রুদ্ধশাসে যেন অনবসর জীবনের কথাগুলো বলে শেষ করতে পারলেই আবেগ-ভারাক্রান্ত মানুষটি স্বস্তি পান। আবেগের তাপে মুখে যেন তার খই ফুটছে, পটকার মতো গর্জে উঠছে যেন এক-একটি কথা।

অগ্নি-ঋষি, বহ্নি-রাগ, অগ্নি-মরু, বেদন-বেহাগ, অগ্নি-সুর, রক্ত-শিখা, প্রলয়-নেশা, মৃত্যুগহন, বজ্র-শিখা, প্রাণ-লুকানো, রক্ত-তড়িৎ, সৃজন-বেদন, বজ্ৰ-গান, শাসন-ত্রাসন, চুম্বন-চোর-কম্পন, রৌদ্র-রুদ্র, হিম্মত-হ্রেষা, অগ্নি-পাথার, নভ-তড়িৎ,বহ্নি-ফিনিকি, লাল-গৈরিক, রোষ-হুঁতাশন, রক্ত উদধি, ফেনা-বিষ, রক্ত- ফোয়ারা, রক্ত-সুরা, মন-খুনী, খুন-খচা, রক্ত-অশ্ব, জ্বালা-ক্রন্দন-কুর, বিষ-মদ-চিকুর, ফণা-ছায়া-দোল, অশুভ-অগ্নি-পতাকা, মমতা-মানিক, বিষ-অভিশাপ-সিক্ত, অগ্নি স্নান, অগ্নি-ফণী, সোহাগ-সুখ-ছোঁওয়া, জরজর শোক, বহ্নি-সিন্ধু, আঁসু-পরিমল, হারামণি-পাওয়া হাস্য, রক্ত-পাথার, ক্রন্দন-ঘন, জীবন-ফাগুন, মালঞ্চ-ময়ুর-তখৃত, ধ্বংস-বন্যা, শক্তি-বস্ত্র, বহ্নি বীর্য, অগ্নি-মন্ত্র, মুক্তি-তরবারি, উল্কাপথিক, মাভেঃবিজয়মন্ত্র, ফন্দি-কারার, গণ্ডী-মুক্ত, ভয়-দানব, অমর-মর-সিন্ধু-তীর, রক্ত-যুগান্তর, স্বরাজ-সিংহদুয়ার, দেশ-দ্রৌপদী, দুঃশাসন-চোর, জাত-শেয়াল, জাত-জুয়ারী, বহ্নি-লিখা, মুক্তি-শখ, মৃত্যু-শোণিত এলকোহল, প্রাণ-আঙুর, আকাশ গাঙ, স্নেহ সুরধুনী, গ্রহণ-বালা, বোলতা-ব্যাকুল–এমনি আরো শত শত বাক-মূর্তি রয়েছে তাঁর কাব্যে। বস্তুত এগুলো তার মনোভঙ্গির–তার মানস বা Style-এর পরিচয়বাহী এবং হয়তো অসম্ভুত আবেগেরও প্রমাণক।

পূর্বপুরুষ : উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য

০১.

নির্বোধ যখন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, ঘরে-সংসারে তখনই যথার্থ বিপদ নেমে আসে, ক্ষতির ঝুঁকি তখনই বেড়ে যায়। নির্বোধের কোনো স্বকীয় অভিজ্ঞতা থাকে না। পরের জ্ঞানে সে জ্ঞানী, পরের মুখে শোনা যুক্তিপ্রয়োগে সে তার্কিক।

মানুষের সমাজে প্রগতির বড় বাধা এই নির্বোধেরাই। তারা অবশ্য বৈষয়িক ব্যাপারে নির্বোধ নয়। বলতে গেলে তাদের অর্জিত বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, উদ্যম সবকিছুই তারা তাদের বৈষয়িক জীবনের নিরাপত্তা ও প্রসারের জন্যে নিয়োজিত করে। তাই তারা সমাজ–ধর্ম-রাষ্ট্রবিজ্ঞান-দর্শন প্রভৃতির তত্ত্বচিন্তার ভার কয়েকজনের উপরেই ছেড়ে দেয়। এবং নিজেদের পছন্দমতো কারো ভাব চিন্তা ও যুক্তি-বুদ্ধির প্রতি আনুগত্য রেখে দিব্যি সুখে জীবন কাটায়। কিন্তু তাদের সমর্থিত চিন্তা ও চিন্তানায়কদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী চিন্তা ও চিন্তানায়কদের মত-পথের দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হলে কাক শেয়ালের মতো স্ব স্ব নায়কের পক্ষে হৈ চৈ, মারামারি কিংবা প্রয়োজনমতো হানাহানি শুরু করে দেয়। জীবনের অন্যক্ষেত্রে যতই তাদের দায়িত্ববোধ কিংবা কর্তব্যবুদ্ধির অভাব থাক, এ ক্ষেত্রে তাদের সতর্কতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সঙ্প্রীতি নির্ভেজাল। এভাবে তারা হযরত মুসা-ঈসা-মুহম্মদ প্রমুখ অনেককেই লাঞ্ছিত, বিতাড়িত ও হত্যা করেছে।

.

০২.

তাঁদের বিশ্বাস, যুক্তি ও নীতি একটিই।

আমাদের পূর্বপুরুষ আমাদের ভাবনা ভেবে রেখেছেন। আমাদের তারা ধর্ম দিয়েছেন, আদর্শ দিয়েছেন, রীতি দিয়েছেন, নীতি শিখিয়েছেন, আচার জানিয়েছেন, আচরণ বাতলিয়েছেন, খাদ্যতালিকা দিয়েছেন, পোশাকের আদল দিয়েছেন, হাসি-কাসি-হাই তত্ত্ব রেখে গেছেন, দিন-ক্ষণ মাস-রাশি-নক্ষত্র জানিয়েছেন। আকাশ ও পৃথিবীর তথ্য, ইহ-পরকাল তত্ত্ব পাপ-পুণ্য ও স্বর্গ-নরক চিত্র –এর কোন্‌টি আমাদের আর জানতে বাকি আছে! এতে দর্শন-বিজ্ঞানের কোন্ তত্ত্ব নেই! কী তাঁরা দিয়ে জাননি যে আমরা নতুন করে খুঁজে খুঁজে খেটে খেটে হয়রান হব!

যারা পূর্বপুরুষের গড়া জীবন-ছাঁচ অবহেলা করে তারা পামর। এ সম্পদ, এ রিথ যারা অগ্রাহ্য করে তারা জাহিল। যারা বিদ্রূপ করে তারা নাস্তিক, যারা বিদ্রোহ করে তারা অভিশপ্ত শয়তান। কেননা পুরোনো কালেই বিধাতা নিজে এসে তার নির্বাচিত প্রিয়জনদের পাঠিয়ে শিশু ও পশু মানুষকে জীবনের যা কিছু জ্ঞাতব্য, যা কিছু কর্তব্য, যা কিছু প্রয়োজনীয়, তা শিখিয়ে পড়িয়ে বুঝিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন। সেসব ত্রিকালজ্ঞ নবী-ঋষির মতো জ্ঞান-প্রজ্ঞা-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক পৃথিবীতে কখনো হয়নি, কখনো হবে না। কারণ তাঁরা ছিলেন বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি বিশেষ মানুষ– লোক-শিক্ষক।

অতএব আমাদের কর্তব্য প্রদত্ত জ্ঞান আয়ত্ত করা, বিধি-নিষেধ মেনে চলা, তাঁদের প্রদর্শিত জীবন-পদ্ধতি অনুসরণকরা আর নিশ্চিন্তে জীবিকা অর্জনে মনোযোগ দেয়া। আহা তাঁদের দানের তুলনা নেই? আমাদের কাজ কেবল কৃতজ্ঞ ও অনুগত থাকা। নিতান্ত জাহিল অর্বাচীন না হলে কি কেউ এমন নিশ্চিন্ত নীড় ভাঙে, এমন সুখের জীবন পায়ে ঠেলে!

.

০৩.

অপরপক্ষের কথায় তারা কান দেয় না। কারণ তারা বিশ্বাস ও বিস্ময়কে জীবন-যাত্রার পাথেয় করেছে। বিধির ও ভগবানের অর্থাৎ নিয়ম-নীতি ও নিয়ন্তার অনুগত হলে বিবেক থাকে অবহেলিত। নিজেরা চিন্তা করে না, কাজেই নতুন যুক্তি খুঁজে পায় না, তাই নতুন জীবন-দৃষ্টিও লাভ করে না। বিশ্বাসে ও শ্রদ্ধায় তারা অভিভূত। তাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন। তাদের মন ভয়-ভরসায় বিমূঢ়। নইলে তারা ভোলা চোখেই দেখতে পেত বিধাতার বরপুষ্ট মানুষ যা ভাবতে-খুঁজতে বুঝতে-করতে পারেননি, আজকের জ্ঞানী-বিজ্ঞানী-মনীষীরা তা পেরেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস দর্শন কিংবা অভিজ্ঞতা ও জীবনের ক্ষেত্রে সেদিন যা ছিল অভাবিত ও অসম্ভব, আজ তা মানুষের আয়ত্তে। আজকের মানুষের এত বড় সর্বাত্মক সাফল্য দেখেও যারা প্রাচীন নবী-ঋষির তুলনায় আজকের জ্ঞানী-মনীষীকে তত্ত্ব ও তথ্যের ক্ষেত্রে নির্বোধ-নির্জন ভাবতে পারে তাদের অন্ধতা ঘুচবার নয়।

আশ্চর্য, ছোটখাটো ব্যাপারেও তারা প্রশ্নহীন। পূর্বপুরুষের নির্ধারিত খাদ্যতালিকাও আমাদের রদবদলের অধিকার নেই। হালাল আর কখনো হারাম হবে না, হারামও হতে পারে না হালাল। পোশাকের পরিবর্তনও দূষণীয়। পৈত্রিক শত্রুকেও বন্ধু করা চলবে না। চন্দ্র-সূর্য-পৃথিবী, কান্তার মরু-পর্বত-সমুদ্র সম্বন্ধেও আমাদের তাত্ত্বিকজ্ঞানের পরিবর্তন পাপপ্রসূ। কেবল পূর্বপুরুষের কদম মোবারক শরণ ও অনুসরণ করেই মানুষ থাকবে কৃতার্থ ও তৃপ্তমন্য।

তারা অবশ্য জানে, তাদের নবী-ঋষিরা অজ্ঞাতপূর্ব জ্ঞান দিয়েছেন এবং অশ্রুতপূর্ব নতুন কথা বলেছেন, নতুন ধর্মমতও প্রবর্তন করেছেন। এবং তা বিধাতার অভিপ্রায় ও অনুমোদনক্রমেই সম্ভব হয়েছে। কলিকালে ঈশ্বর আর কোনো পরিবর্তন কামনা করেননি। তিনি যে-পাট চুকিয়ে দিয়েছেন কলিকালে শয়তান তা খুলে বসেছে। শয়তানের চেলারাই কেবল পরিবর্তন প্রয়াসী ও নতুনের সন্ধানী। তারা এ-ও জানে তাদের প্রত্যেকেরই পূর্বপুরুষ সুদূর সেকালে কিংবা অনতি অতীত একালে কোনো-না-কোন সমকালীন নতুন ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। এবং তাদের মতে শেষবারের মতো সত্যধর্ম বরণ করে তাদের পূর্বপুরুষরা ঈশ্বর-দত্ত শেষ সুযোগ লাভের অনুগ্রহ লাভ করেছেন। এটিই ছিল বিধাতার সর্বশেষ আনুশাসনিক ও প্রশাসনিক সংস্কার বা পরিবর্তন। এর পরে তো বিধাতা প্রলয় অবধি বিশ্রাম-সুখই লাভ করেছেন।

.

০৪.

বিশ্বাসের অঙ্গীকারে ধর্মবোধের উদ্ভব ও স্থিতি। তাই ধর্মভাব অশিক্ষিত মানুষের ভূষণ, এবং ধর্মাদর্শ তাদের জীবনের দিশারী। ধর্মীয় নীতি ও রীতি তাদের জীবনযাত্রার পথ ও পাথেয়। লেখাপড়া-জানা ধর্মভীরু মানুষেরও মনোভূমি অনাবাদে অপচিত। আর একশ্রেণীর শিক্ষিত অথচ চরিত্রহীন বুদ্ধিমান দুরাত্মা সব জেনেবুঝেও স্বস্বার্থে এই বিশ্বাস-সংস্কার ও স্মৃতিকে প্রশ্রয় দিয়ে, পুঁজি করে মানুষকে শাসন-শোষণের আনন্দ, আরাম, গৌরব ও সম্মান লাভ করে। ধর্ম কিন্তু সব মানুষের সমান উপকার করে না। ধর্মের বিধি-নিষেধ প্রয়োগে বড়লোকের-ছোটলোকের ও নারী-পুরুষের পার্থক্য স্বীকৃত। রাজা যুদ্ধ করেন, পররাজ্য কেড়ে নেন, মানুষ হত্যা করেন –এতে পাপ নেই। সাধারণ লোক না বলে পরের তৃণখণ্ড নিলেও চৌর্যের কিংবা পীড়নের পাপ স্পর্শ করে। তাছাড়া ধর্ম বাধাপথে চলার যান্ত্রিক সুবিধা দান করে বটে, কিন্তু মনুষ্যত্ব বিকাশের কিংবা মানবিক বোধ-বুদ্ধির স্বাধীন প্রয়োগের অধিকার হরণ করে। ধার্মিক মানুষ পোষমানা প্রাণী। কেননা তার মন-বুদ্ধি বিবেকের স্বাধীন প্রয়োগ-পথ থাকে রুদ্ধ। এই মানুষ গোঁড়া, অসহিষ্ণু ও অনুদার না হয়ে পারে না।

অথচ ভাব-চিন্তা-কর্মের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও স্বকীয়তাপ্রসূত নতুন কিছু করতে গিয়ে ভুল করার অধিকারই মানুষের স্বাধীনতার ভিত্তি। কারণ ভ্রান্তি থেকেই সত্যকে ও শ্রেয়সকে চেনা যায়। ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করে মানুষের এই মৌল অধিকারই অহরহ হরণ করছে। ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র সমাজবদ্ধ মানুষকে শেখায় ফানাতত্ত্ব। অর্থাৎ ব্যক্তি-জীবন হবে সমাজ-স্বার্থের অনুগত যৌথ জীবনের প্রত্যঙ্গ। কারণ তার স্বাতন্ত্র্য সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক। অথচ ব্যক্তিজীবনের স্বাতন্ত্র্য, নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্ন বিকাশ লক্ষ্যেই শুরু হয়েছিল যৌথ আবাস, আচার ও কর্ম। অবশেষে মুক্তির অবলম্বন হয়ে উঠেছে বন্ধনের শৃঙ্খল। কিন্তু ভৌগোলিক সংহতি ও গণশিক্ষা–ব্যক্তিজীবনে না হোক, সামগ্রিক জীবনে আজ নতুন চেতনা দান করেছে। তাই দুনিয়ার সর্বত্র দেখা দিয়েছে দ্রোহ।

.

০৫.

জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্যেই মানুষ হল যূথবদ্ধ। আর যৌথ জীবনের নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রী শক্তি হিসেবে গড়ে উঠল সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র। এই তিন মনিবের ঘর করে মানুষ, সেবা করে তিন মালিকের, শাসন মানে তিন প্রভুর। মানুষ যেন সেভুইচড, গলে বের হবে, সে সাধ্যও নেই। কিন্তু যাদের কথা বলছি, তারা তা অনুভব করে না, তারা মনে করে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে আসমান ও জমিনের মালিকের হেফাজতে পাখির মতো তারা সোনার টঙ্গীর আশ্রয়ে রয়েছে, লীলাময়ের ইচ্ছে ব্যতীত সেখানে সাপ-বেড়ালের উপদ্রব ঘটে না। অথচ জীবন বিকাশের অবলম্বন হিসেবেই সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের উদ্ভব। জীবনবোধ ও প্রয়োজন বৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মবুদ্ধির ও ধর্মনীতির প্রসার ও পরিবর্তন হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি বলে পুরোনো ধর্ম লোপ পেয়ে নতুন ধর্মের ঠাই করে দিয়েছে। মানুষ অবশ্য কোনোদিন সচেতন ভাবে তা চায়নি। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই তা ঘটেছে। প্রয়োজনের শক্তি অপ্রতিরোধ্য। সেই প্রয়োজন প্রাকৃত শক্তির মতো অমোঘ, নদীর স্রোতের মতো তীরপ্লবী ও কূলগ্রাসী। যে-মানুষের মাধ্যমে নতুন প্রতিষ্ঠা পায়, তিনিও জানেন না তিনি কী কারণে কোন্ অমোঘ শক্তির প্রভাবে কী করছেন।

আজো সে নিয়মেই সব ভাঙছে, হচ্ছে, চলছে। কিন্তু সমকালীন মানুষ তা বুঝতে পারে না। চলন্ত ট্রেনে বসে সে ভাবছে, পাশের বস্তুই চলছে তার ট্রেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মন স্থিতিকামী, তাই তার এ বিভ্রান্তি। তার জীবনে কাজে লাগছে না, তবু সে ধর্ম ও সমাজ-ভূতের ভয়-ভরসা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। ধর্ম ও সমাজকে সে ভালোবাসে না, ভয় করে। সে-জুজুর ভয় তার দিবারাত্রির বিভীষিকা। ক্রীতদাসের অসহায়তায় ও আত্মসমর্পণেই তার স্বস্তি। সে কেবলই আত্মরক্ষায় উদ্বিগ্ন, তাই বাঁচার স্বাদ সে পায় না। মৃত্যুভীরু জীবনের মমতায় সদা ব্যাকুল, তাই জীবনের প্রসাদ থেকে সে হয় বঞ্চিত।

.

০৬.

যারা নতুন জীবন কামনা করে, আত্মপ্রত্যয় যাদের প্রবল, তারা ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রকে জীবনের অনুগত করে। ওগুলোর পুরোনো নিয়ম-নীতির কাছে আত্মবলি দেয় না। অতীত কারো জীবনের আদর্শ হতে পারে না। কেননা অতীত কখনো ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে না। ঐতিহ্যও প্রেরণার উৎস নয়। তাহলে গ্রীক-রোমান-আরবের পতন হল কেন? এটিলা-চেঙ্গিস-বুদ্ধ-হোমারের কী ঐতিহ্য ছিল? ঐতিহ্য বলে যদি কোনো কিছু মানতেই হয় তাহলে এক মানুষের পক্ষে যা সম্ভব অন্য মানুষের পক্ষেও তা সাধ্যাতীত নয় –এই মানবিক ঐতিহ্যে আস্থাই যথেষ্ট। অতীত যদি কোনো কাজে লাগে তবে তা ধর্ম বা সমাজের নীতি-আদর্শ নয়– ইতিহাসের জ্ঞান ও শিক্ষা।

অতীত ও ঐতিহ্য সম্বন্ধে আমাদের ধারণা মোটেই পষ্ট নয়। একটা শোনা-কথা আপ্তবাক্য রূপেই আমরা আওড়িয়ে চলছি মাত্র। যা পিছনে ফেলে আসি, যা চুকে-বুকে যায় হারিয়ে যায়, তাই অতীত। সে-স্মৃতি আমাকে কেবল ধরে রাখতে পারে, এগিয়ে দিতে পারে না। মানুষ তার চোখ দিয়ে সুমুখেই কেবল দেখতে পায়, সচেতন প্রয়াসে পাশেও। কিন্তু পিছনে তাকাতে হলে পিছনকে সুমুখ করতে হয়। অতীতকে স্মরণে রাখতে গেলে ভবিষ্যৎকে ভুলতে হয়। চোখের স্থিতি ও পায়ের পাতার বিস্তৃতি দেখে তো মনে হয় স্রষ্টা মানুষকে সুমুখে দেখবার ও এগুবার ইঙ্গিতই দিয়েছেন।

আমার প্রপিতামহের জমিদারি ছিল, আমার পিতার প্রপিতামহ কবিতা লিখেছিলেন, আমার পিতামহ দীঘি দিয়েছিলেন, আমার পিতা বিদ্বান ছিলেন, আমি সামান্য লেখাপড়া শিখে সম্প্রতি ঢাকায় এক দোকানে কর্মচারী। নিবাস তাঁতিবাজারের এক মেস। ঐতিহ্য আমাকে কী দিল?

হোমার-শেকস্পীয়র-টলস্টয়-কালিদাস-সাদী লিখিয়ে হলেন, তাদের কারো পিতৃপুরুষের কেউ লেখক ছিলেন না। আবার রবীন্দ্র-নজরুলের সন্তান কবি হতে পারলেন না। আদম-সন্তান কাবিল হল লম্পট, নূহর সন্তান হল পিতৃদ্রোহী। ঐতিহ্যের প্রভাব কোথায় পড়ল? সভ্যতায় ও শাসনে কালো আফ্রিকার কী ঐতিহ্য আছে? তাই বলে কি তারা আরণ্য থাকছে? আমার চৌদ্দপুরুষের কেউ লেখাপড়া করেননি, বাবা ছিলেন ক্ষেতমজুর; আমি বিদ্বান, বড় চাকুরে, অবশেষে মন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি হলাম। এ তো হবার কথা নয়।

ভূঁইফোড় লোক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, আর রাজার ছেলে রাজ্য রক্ষা করতে জানেন না। এই বা হবার কারণ কী! ব্যক্তিক কিংবা জাতিক জীবনে ঐতিহ্যই যদি প্রেরণার আকর ও আত্মোন্নয়নের ভিত্তি হত তাহলে সমাজে কিংবা দেশে কোনো মানুষের বা জাতের জীবনে উত্থান-পতন থাকত না। বর্ণে বিন্যস্ত হিন্দুসমাজের মতো জন্মসূত্রেই জীবন ও জীবিকা নিয়ন্ত্রিত হত। কেননা যার ঐতিহ্য নেই, সে তা কখনো অর্জন ও সৃজন করতে পারত না। ঐতিহ্য বলতে আমরা ভালো কৃতিই বুঝি– মন্দকৃতি ঐতিহ্য নয়। মানুষ কি এতই সুবোধ ও সুশীল যে সে কেবল পূর্বপুরুষের ভালটাই গ্রহণ করবে আর মন্দটা পরিহার কবে? ভালোটা শরণ করতে গেলে মন্দটা মনের কোণে উঁকি দেবে– আর ভালটাকে কেউ শরণ করলে মন্দটাও তাকে অনুসরণ করবে। কে না জানে মানুষের মন্দের আকর্ষণই বেশি? কারণ শয়তান অলস নয়।

বস্তুত পূর্বপুরুষের বস্তুগত সম্পদের উত্তরাধিকারই মানুষ পেয়ে থাকে-যা দৃষ্টিগ্রাহ্য ও কেজো। মানস-উত্তরাধিকার বলে কিছু যদি থাকেও তা সামান্য ও প্রয়োগসাপেক্ষ। এবং প্রয়োগের জন্যে চাই প্রয়োজনবোধ। এই প্রয়োজনবুদ্ধি জাগে আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মশক্তি সচেতন ও কাক্ষী মানুষের। আর এ তিনটে গুণই স্বকীয়তার স্বাক্ষর বহন করে। এ মানুষের ঐতিহ্য থাকা না-থাকায় কিছু যায় আসে না। সে হয় স্বসৃষ্ট –এটি ব্যক্তিক ও জাতিক জীবনে উভয়ত সত্য। দেশ-কালের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মোন্নয়নের পন্থা এই একটিই। আমার পিতার প্রাথমিক শিক্ষাটাই গৌরবের ও গর্বের হল, আর আমার এম.এ ডিগ্রীটা তুচ্ছ? বাবার কুটিরটারই গর্ব করব, আমার দালানটা কিছুই নয়? সচল ব্যবহারিক জীবনে স্থান-কাল ভেদে আচারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক রীতিনীতি– যতই মন্থর হোক–পরিবর্তিত হয়, কেবল ধার্মিক জীবনের নীতিই থাকবে ধ্রুব এ কেমন কথা। এ ক্ষেত্রে কি জীবনের গতিশীলতার কোনো চাহিদা নেই। কার্যত ধর্মনীতিও লঙ্ঘিত হয়, কেবল স্বীকার করতেই আপত্তি। নইলে একই ধর্মে এত বিভিন্ন মত-পথবাদী সম্প্রদায় গড়ে উঠল কী করে!

তাছাড়া, অর্জন-বিমুখ মানুষ পূর্বপুরুষের ধনে ধনী থাকতে পারে না। সে দরিদ্র হতে থাকে ব্যক্তিক ও জাতিক জীবনে –-এ স্বতেসিদ্ধ তথ্য। এবং রিখথ হিসেবে প্রাপ্ত কোনো বাস্তব সম্পদও সমকালীন জীবনের ব্যবহারিক-বৈষয়িক চাহিদা মিটাতে পারে না। কেননা তার কেবল ক্ষয়ই আছে, বৃদ্ধি নেই। স্বােপার্জিত সম্পদ বাড়তির লাবণ্যে প্রাণপ্রদ। পিতৃসম্পদ জীর্ণতার জনক। জোয়ারভাটার মতো আয়-ব্যয়ে বহমানতা থাকা চাই। প্রয়াসবিহীন প্রাপ্তিতে গৌরব নেই। প্রয়াসের মধ্যেই প্রাণের পরিচয় ও বিকাশ। আসলে ঐতিহ্য মানুষকে ধরে রাখে, এগিয়ে দেয় না। স্থিতির জীর্ণতা ও জড়তা তাকে পেয়ে বসে, গতির প্রাণ ও প্রেরণা থাকে অনায়।

এই পুরোনো পৃথিবী প্রতি-মানুষের চোখে নতুন করে দেখা দেয় বলেই পৃথিবী সুন্দর। প্রতিটি জীবন নতুন করে আবিষ্কার করে আপনার ভুবন। নতুন জীবনের চাহিদা মিটাতে দেশগত ও কালগত জীবনের অনুগত করে বদলাতে হয় ধর্মনীতি, সমাজরীতি ও রাষ্ট্রবিধি। প্রাণের সচলতার প্রতীক হচ্ছে সৃজনশীলতা, নতুনের স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের দিকে এগুবার আগ্রহ। জরা ও জড়তার ধর্ম হচ্ছে অতীতকে ও স্থিতিকে আঁকড়ে ধরে রাখা। কেননা জরা ও জড়তার ভবিষ্যৎ নেই, কেবল অতীতের স্মৃতিই থাকে। ভবিষ্যতে তার মৃত্যু-ত্রাস, অতীতে তার মধুর স্মৃতি।

পূর্বপুরুষের দানে নয়, মানুষকে বাঁচতে হয় স্বকালে স্বদেশে স্বকীয় সৃষ্টিতে। অন্যের কৃতির ফল ভোগ করার গ্লানির মধ্যে নয়, নিজের কৃতি ও কীর্তির উল্লাসের মধ্যে বাঁচাই যথার্থ বাঁচা। মানুষের এ-ই কাম্য।

প্রতিকার-পন্থা

অন্যায়ের প্রতিকার-পন্থা, হৃত-অধিকার আদায়ের উপায় ও পীড়ন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির নানা রীতি-নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ নানা চিন্তা-ভাবনা করেছে। এবং বিচিত্র পথে এই প্রতিকার-প্রয়াস বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রত্যেকটা উপায় ও নীতি আপাতদৃষ্টে যৌক্তিক। কেবল দেশ-কাল ও ব্যক্তি ভেদে সেগুলোর উপযোগ ভেদ ঘটেছে মাত্র। এক গোষ্ঠীর মতে যে-নীতি বাঞ্ছিত ও প্রযোজ্য, অপর গোষ্ঠীর ধারণায় তা অবাঞ্ছিত ও পরিহার্য। এমনি করে কাল এবং কর্তা ভেদেও পরিবর্তিত হয়েছে নীতি-পদ্ধতি। ক্রমবিবর্তন ও ক্রমউকর্ষ-ধারায় এই নীতি-পদ্ধতি আজ যে-স্তরে উন্নীত তাও সন্তোষজনক নয়, সবার মনঃপুত তো নয়ই। এখনো তা উন্নয়ন ও বিকাশ সাপেক্ষ। এই নীতি-পদ্ধতি দৈশিক, গৌত্রিক, কিংবা জাতিক সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবিকবোধ বিকাশের অন্যতম পরিমাপক হলেও তা দেশ-গোত্র-জাতির সব মানুষের বোধ-বুদ্ধি সংস্কৃতির আনুপাতিক মান নির্ণয়ের মাপকাঠি যে নয়, তাও উল্লেখ্য। কেননা, এ নীতি-পদ্ধতি নির্ধারিত ও প্রযুক্ত হয় দেশ, গোত্র বা জাতির নেতা বা কর্তৃপক্ষের দ্বারা। নেতা বা কর্তাগণের মন বিদ্যা-বুদ্ধি ও নীতিবোধই থাকে এর পশ্চাতে ক্রিয়াশীল, অন্যমানুষের সম্পর্ক নিতান্ত গৌণ। আবার ব্যক্তিগত প্রতিকার- নীতি ও গোষ্ঠী বা জাতিগত প্রতিকার-পদ্ধতিতে পার্থক্যও সামান্য নয়। এখানেও উপযোগ ও প্রয়োগভেদ স্বীকৃত।

ব্যক্তিগত প্রতিকার-প্রয়াসে কেউ প্রতিহিংসা নীতিতে আস্থাবান, কেউ ক্ষমার মাহাত্মে মুগ্ধ, কেউবা স্থান-কাল-পাত্রভেদে কখনোবা শাস্তি, কখনোবা ক্ষমার পক্ষপাতী। কিন্তু গোত্রীয়, জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রায় সবাই প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ নীতিকেই মোক্ষম বলে মানে। তাই হন্তা ও যোদ্ধাই বীর ও মহাপুরুষরূপে পরিকীর্তিত।

এক্ষেত্রে বিষে বিষ ক্ষয় বুনো কচু ও বাঘাতেঁতুল এবং শঠে শাঠ্যাং সমাচরেৎ –এই সুপ্রাচীন নীতির তত্ত্বগত সত্য ও তথ্যগত যাথার্থ্য বহু পরীক্ষিত। বহুলপ্রযুক্ত এই নীতি বৈজ্ঞানিক ও ফলপ্রসূ বলে নির্ভরযোগ্য। কেননা, মানুষ শক্তের ভক্ত, নরমের যম। এ পন্থা বাহুবল ভিত্তিক এবং দ্বন্দ ও সংঘাতপ্রসূ। এক্ষেত্রে কুশলী দুর্বলের নীতি হচ্ছে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা কিংবা হাতী দিয়ে হাতী বাঁধা।

শামীয়জগতে প্রতিকার-নীতির ক্রমবিকাশের ধারায় তিনটি সুস্পষ্ট পদ্ধতি দেখতে পাই। হযরত মুসা বলেন, দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ উপড়াও। অর্থাৎ বাহুবলে প্রতিরোধ কর, প্রতিশোধ নাও, কিন্তু অপরাধ ও শাস্তির সমতা রক্ষা করো তথা অন্যায় ও তার প্রতিকার আনুপাতিক হওয়া চাই।

হযরত ঈসা বলেন– একগালে থাপ্পড় পেলে তো অপর কপোলও থাপ্পড় নেয়ার জন্যে উন্মুক্ত কর। অর্থাৎ প্রতিরোধ করো না, প্রতিশোধ ব্যবস্থা মনে ঠাই দিয়ো না, বরং মহত্ত্ব ও ক্ষমা দিয়ে অন্যায়কারীর হৃদয় জয় করো–যাতে সে চিরকালের জন্যেই অপকর্ম থেকে নিবৃত্ত হয়–ক্ষমা ও মহত্ত্বের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে।

হযরত মুহম্মদ বললেন– পারো তো ক্ষমা করো, নইলে শাস্তি দাও। অর্থাৎ স্থান-কাল পাত্রভেদে ক্ষমা বা শাস্তির উপযোগ ও প্রয়োগসাফল্য নজরে রেখো।

এদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম কর্মবাদে আস্থা রাখে। পাপ-পুণ্যের শাস্তি ও পুরস্কার অমোঘ। গীতায় দুষ্কৃতিদমনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত। কিন্তু গৌতমবুদ্ধ প্রতিকারের চেয়ে অন্যায়-বিরতিতে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তার দশশিক্ষা Precautionary ও Preventive ব্যবস্থারূপে পরিগণিত। পার্থিব সবকিছুকে নশ্বর ও তুচ্ছ জেনে মায়া ও তৃষ্ণা তথা আকাক্ষা ও মোহমুক্ত হতে উপদেশ দিয়েছেন তিনি। এমনি রীতি ও সংযমের কথা অবশ্য সব ধর্মেই রয়েছে। মহত্ত্ব, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমাকেই তিনি উত্তম ও শ্রেয় বলে জেনেছেন। রাজোবাদ জাতকের কাহিনীতে তার এ মনোভাব সুপরিব্যক্ত। কাহিনীটি সংক্ষেপে এই :

বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তকুমার এবং কোশলরাজ মল্লিক উভয়েই সমসাময়িক এবং আদর্শ ধার্মিক রাজা। প্রজারা তাদের শাসনে-পালনে সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করছে। একদিন এই দুইরাজ্যের দুইরাজার রথ একই রাস্তায় এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। এখন কে কাকে পথ ছেড়ে দিয়ে নিজের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবেন, সে হল সমস্যা। উভয় রাজাই সমবয়স্ক। কাজেই বয়সের দাবীও টেকে না। এমনকি তাঁদের কুলগৌরব, রাজ্যপরিমাণ, সেনাবল, ঐশ্বর্য, যশ এবং জনপ্রিয়তাও সমান। এখন উপায়? অবশেষে স্থির হল, চরিত্রবলে যিনি মহত্তর, তাকেই পথ ছেড়ে দেয়া হবে।

প্রথমে কোশলরাজ মল্লিকের গুণপনা বর্ণিত হল : তিনি কঠোরে কঠোর এবং কোমলে কোমল; আর সাধুজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং শঠের সঙ্গে শাঠ্যনীতি অনুসরণ করেন।

আর বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তকুমার অক্রোধের দ্বারা কুদ্ধকে, সাধুতার দ্বারা অসাধুকে দানের দ্বারা কৃপণকে এবং সত্যের দ্বারা মিথ্যাবাদীকে শিক্ষাদানের নীতির মাধ্যমে শাসন করেন।

এমনি কাহিনী মহাভারতেও রয়েছে। সেখানেও কৌরব সুহোত্র এবং উশীনর-পুত্র শিবির রথ মুখোমুখি হলে চরিত্রগুণে শিবিই পথের অধিকার পান। কেননা, তিনিও দানের দ্বারা কৃপণের ক্ষমার দ্বারা কুরকর্মার, সত্যবাদিতার দ্বারা মিথুকের এবং সাধুতার দ্বারা অসাধুর চরিত্র সংশোধনের আদর্শ অনুসরণ করতেন।

বায়জিদ বিস্তামীকে যে মাতাল আঘাত করে রক্তাক্ত করে দিল তাকে পরদিন তিনি বললেন, ভাই, আমার মাথায় ঠেকে যে তোমার বীণাটি ভেঙে গেল তাতে আমি দুঃখিত।

কিংবা চৈতন্যদেবকে যে জগাই-মাধাই লাঞ্ছিত ও আহত করল, তাদেরও তিনি বলেলেন, ভাই মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না? –গৌতমবুদ্ধ বায়জিদ কিংবা চৈতন্যদেবের এসব মহত্ত্ব আদর্শের ক্ষেত্রে মানুষ অত্যন্ত মূল্যবান বলেই জানে, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধেয় বলে মানে না।

এ পর্যন্ত যে-সব নীতি-পদ্ধতির কথা বলা হল সবগুলোই পুরোনো কালের। তবে এ-যুগেও সে-সব মূল্য-মর্যাদা হারায়নি।

এ-যুগে বিশেষ করে ব্যক্তিক কিংবা সামাজিক জীবনে পীড়ন-প্রতিকার নিয়ে মানুষ বিশেষ মাথা ঘামায় না। একালে সব-সমস্যা জাতিক ও রাষ্ট্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই সমাধান প্রয়াসও চলছে যৌথপ্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং প্রতিকারনীতিও তাই জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে নির্মিত ও প্রযুক্ত হয়।

গ্যারিবল্ডী বাহুবল-নির্ভর হিংসাত্মক সংগ্রামের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি স্বাজাত্য ও স্বদেশপ্রেমের প্রেরণায় ক্ষুধার, যন্ত্রণার ও মৃত্যুর পথেই আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশবাসীকে।

মাও সে-তুঙও আপোষহীন রক্তক্ষরা সংগ্রামে আস্থাবান। তিনি বলেন : Political power grows out of the barrel of a gun–মার্কস লেনিনেরও ছিল এ মত।

নিগ্রো মনস্তত্ববিদ Frantz Fanon তাঁর The wretched of the Earth গ্রন্থে বলেছেন :

Violence is a cleansing force. It frees the native from his inferiority complex and from his despair and inaction, it makes him fearless and restores his self-repect.

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—

ক্ষমা যেথা হীন দুর্বলতা বলে অপব্যাখ্যাত হয়, সেখানে কঠোর হতে হবে। এই কঠোরতা নিশ্চয়ই হিংসাত্মক বা শাস্তি সমর্থক।

প্রতিকার পদ্ধতিটা কবিসুলভ হলেও এব্যাপারে তার আরো স্পষ্ট উক্তি রয়েছে :

অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে,
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।

গান্ধী অহিংস প্রতিরোধ ও অসহযোগকেই প্রতিকার পদ্ধতিরূপে বরণ করেছিলেন।

জওয়াহেরলাল নেহেরুর আস্থা ছিল Co-existence নীতিতে। এটি মূলত নৈতিকবোধের প্রীত আবেদন।

জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নীতি-পদ্ধতি হয়েছে সালিশির মাধ্যমে বিরোধের মীমাংসা। এটিও সদিচ্ছা ও শান্তিপ্রিয়তা সাপেক্ষ।

L. B. Johnson এক বক্তৃতায় বলেছেন, আজকের প্রতিকার পদ্ধতি হবে–To convert hostility into negotiation, bloody violence into politics and hate into reconciliation.

কেউ কেউ বলেন ব্যক্তিগত ও সামাজিক অন্যায় এবং পীড়নের ক্ষেত্রে ক্ষমা ও নিরস্ত্র প্রতিরোধ কার্যকর। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধ এবং শাসন ও শান্তির জন্যে সশস্ত্র শক্তির প্রয়োজন। যে গান্ধী অহিংস অসহযোগ ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়েছেন, তিনিই স্বাধীন ভারতে প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ শাসন-শান্তির জন্যে সহিংস-সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কিংবা জনসনের উক্ত নীতিতে নতুন কিছু নেই। প্রতিকার ব্যবস্থায় বাহুবল ও জনবলহীন মানুষ চিরকালই আশ্রয় নিয়েছে আইন আদালতের। আর ধনবলহীন মানুষ প্রতিকার খোঁজে সালিশে। এ দুটোই শক্তিমান লোকের কাছে অবজ্ঞেয়।

আসলে ধর্মের দোহাই দিয়ে, আল্লাহর কাছে গোহারী করে কিংবা নালিশে-সালিশে-ক্ষমায় প্রতিকার চেয়ে নির্বলই প্রবোধ এবং সান্ত্বনা খোঁজে। সবল চিরকালই নিজ হাতে স্বশক্তি প্রয়োগে প্রতিকার করেছে বা প্রতিকারের চেষ্টা করেছে। অস্ত্রাভাবেই গান্ধী ছিলেন অহিংস প্রতিরোধ প্রতিকারের প্রবক্তা, অস্ত্রাধিকার লাভের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সশস্ত্র শক্তিতে আস্থাবান হয়ে ওঠেন। কাজেই বাহুবল-ধনবল-জনবল যার আছে, সে কখনো সালিশে-নালিশে, দোহাই-গোহারীতে কিংবা শাপে-বরে বিশ্বাস করবে না। বোঝা যাচ্ছে দুর্বল ও অক্ষমই কেবল মহৎ আদর্শের বুলি কপচিয়ে আত্মরক্ষা ও আত্মসম্মান রক্ষার উপায় খোঁজে। সবল ও পরাক্রান্ত ব্যক্তির কাছে ওসব হাস্যকর বালভাষণ।

তবু মনে হয়, মহৎ আদর্শে কোনো অপ্রতিরোধ্য শক্তি নিহিত রয়েছে। নইলে প্রবল পরাক্রমশালীও একে প্রকাশ্যে সোজাসুজি তাচ্ছিল্য করতে সংকোচ ও লজ্জাবোধ করে কেন? কেন তারা অপকর্মের জন্যে ছলচাতুরীর আবরণ খোঁজে? কেন তাদের অন্যায় অপকর্মকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে চায়? কেন আজ অস্ত্রবল সঞ্চয়ে তৎপর হয়েও তারা অস্ত্রসংবরণ ও অস্ত্রবর্জনের কপট বুলি আওড়াতে বাধ্য হচ্ছে?

কাজেই আপাত অকেজো ও অশ্রদ্ধেয় সহিষ্ণুতা সালিশ, ক্ষমা ও নিরস্ত্র প্রতিরোধও যে মানুষের মানবিক বোধ-বুদ্ধির বিকাশের সহায়ক, নৈতিক চেতনা বৃদ্ধির অনুকূল, তা অস্বীকার করবার উপায় নেই।

আজ আর রাষ্ট্রপতি-রাষ্ট্রনায়কেরা আগেকার রাজা-বাদশার মতো প্রভু ও শাসক নন। এখন তারা একাধারে শাসক ও সেবক। সেজন্যে গণসমর্থন ব্যতীত তাঁদের স্থিতি অসম্ভব। নাগরিক মনে নৈতিক-চেতনা ও আদর্শানুগত্য থাকলে তা রাষ্ট্রপতির চিন্তা ও কর্মকে প্রভাবিত করেই। কেননা তাঁর হুকুম অমান্য করবার লোক তাঁর রাষ্ট্রেই থাকে এবং তারা নিরস্ত্র হয়েও সশস্ত্রবাহিনীর চেয়ে প্রবল। এই জনমত-রূপ আদর্শের প্রেরণা-পুষ্ট মনোবলের মতো বল আর নেই। ভিয়েতনামের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরোধী জনমতে সে ইশারাই পাওয়া গেছে। এমন দিনও হয়তো আর দূরে নয় যখন সৈন্যেরাও প্রাণের প্রেরণা ছাড়া কেবল হুকুমের চোটে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করবে। অথবা যুদ্ধের কারণই হবে অপগত। এ মনোবল আসে বিশ্বাস-মুক্তি ও মুক্তবুদ্ধি থেকে। আগের যুগে মানুষের জীবন ছিল বিশ্বাস-নির্ভর ও সংস্কার-ভিত্তিক; এখনকার অনেক মানুষের জীবনই বুদ্ধি ও যুক্তিনিষ্ঠ। তাই আত্মবিশ্বাস ও আত্মজ্ঞান এবং তজ্জাত সাহস বেশি। ভয় ও সন্দেহ-সংশয়ের স্থলে আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন ব্যক্তিই সাহস করে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসে। অন্যেরা যখন ভয়ে ও সংশয়-সংকোচে জড়বৎ অচল, তখন সাহসীই প্রথমে কদম বাড়ায়। আর এই পয়লা কদমই পৌরুষ ও কাপুরুষতার পরিমাপক। নামৰ্দমী-মর্দমী কাদমে ফাসেলা দারাদ। –মদামী না মদামীর মধ্যে ওই এক-কদমেরই ব্যবধান। কিন্তু সেই ব্যবধান কত ব্যাপক গুরুতর ও তাৎপর্যময় আর কী যুগান্তকারী পরিণামপ্রসূ! মরদের এই বাড়তি কদমই লক্ষ হৃদয়ে শক্তি ও সাহস যোগায়। এই বাড়তি কদমই নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের অধিকারী-মানবভাগ্যের নিয়ন্তা, দেশ-দুনিয়ার মানুষের শক্তির ও ভরসার আকর। এখনকার দিনে ভয়-সংশয় জয় করে পা বাড়ানোর লোক অনেক। তাই জনতা শক্তিমান, তাই জনতা ও জনমত প্রবলতম শক্তিরও বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী।

জার্মান দার্শনিক Riechl বলেছেন, মানুষই একমাত্র প্রাণী যে মেরুদণ্ডের উপর শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। মানুষ তা পারে, কারণ মানুষের জীবনে আদর্শ আছে, উদ্দেশ্য আছে, আছে মহৎ লক্ষ্যে উত্তরণের আগ্রহ। এ মহৎ লক্ষ্য হচ্ছে মানবতার মানবমনীষার ও মানবসংস্কৃতির পূর্ণবিকাশ। প্রতিকার-বাঞ্ছা যুক্তি ও প্রয়োজনবুদ্ধি সাপেক্ষ। বিশ্বাসের সঙ্গে যেহেতু নিয়তিবাদ যুক্ত সেহেতু বিশ্বাসের আনুগত্যের চেয়ে বড় কারাগার নেই। বিশ্বাসের কবল-মুক্তির চেয়ে বড় মুক্তিও তাই নেই। আগের যুগে অজ্ঞ অসহায় মানুষের জীবনযাত্রা ছিল বিশ্বাস-ভিত্তিক। তাই তারা বিশ্বাসীর চোখে গরুকেও দেখেছে দেবতারূপে আর বিশ্বাসের অভাবে হযরত নুহকে করেছে বিদ্রূপ। এবং হযরত ঈসাকে চড়িয়েছে শূলে, তাড়িয়েছে মুসা ও মুহম্মদকে। মনে যুক্তিবোধের উদয় হলেই কেবল মানুষ শ্রেয়সকে ও কল্যাণকে সহজেই বরণ করতে পারে, তা যতই নতুন ও অভাবিত হোক না কেন। মনে যুক্তি-বুদ্ধির ঐশ্বর্য থাকলেই তবে মানুষ পরিহার্য পুরাতনে আস্থা ও আকর্ষণ হারাবার যোগ্যতা অর্জন করে। এ-কথাটা বুঝতে চাননি বলেই হাকিম ইবনে সীনা বৃথা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন :

গাও-রা দারান্দা বাওর দর খোদায়ে আমিয়া
নুহরা বাওর না দারান্দ আজ পে পয়গম্বরী।
–গরুকে খোদা বলে মানতে তোমাদের বাধে না, নুহকে পয়গম্বর বলে মানতেই তোমাদের যত আপত্তি!

একালে মানুষ বিশ্বাস-সংস্কার ও যুক্তি-বুদ্ধির দ্বান্দ্বিক টানাপড়েনে উদ্বস্ত। তাই তারা কখনোবা বিশ্বাস চালিত, কখনোবা সন্দেহতাড়িত, আবার কখনোবা যুক্তিনিষ্ঠ। এ কারণেই কখনো তাঁরা আদিম ও স্থূল আবার কখনো শীলবান ও পেলবচিত্ত।

বস্তুত বাহুবল ও সশস্ত্র প্রতিকার-পদ্ধতি আজো real এবং বিবেক-বুদ্ধির কাছে নিরস্ত্র নিবেদন আজো ideal পাণঘাতী ও রক্তক্ষরা শাস্তিই শায়েস্তা করার মোক্ষম প্রতিকার-নীতি –এটি আজো real; আর প্রীতি, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা ও যুক্তিপ্রয়োগ প্রভৃতি এখনো ideal প্রতিকার-পদ্ধতি।

অতএব একটি real, অপরটি ideal. Real-এ আপাত কার্যসিদ্ধি হয়, কিন্তু পরিণাম নিষ্ফল। Ideal-এ আপাত ব্যর্থতা অবধারিত, কিন্তু পরিণাম ফলপ্রসূ। Ideal-এ পৌঁছতে সময় লাগে, real-এর ফল তাৎক্ষণিক। Ideal ভুললে আমাদের জীবন অর্থহীন হয়ে পড়বে, আর real-কে অস্বীকার বা অবহেলা করলে আমরা পথে দাঁড়াব। Ideal-হীনতা মনের নিঃস্বতা ও মানবিকবোধের নির্লক্ষ্যতার পরিচায়ক, আর real-এর প্রতি ঔদাসীন্য চলমান জীবনকে অগ্রাহ্য করার নামান্তর। Real-এর উপযোগ বর্তমানে, আর ideal ভবিষ্যতের পুঁজি। Real প্রাণে বাঁচায়, ideal মন গড়ে তোলে। প্রাণে না বাঁচলে মন অস্তিত্ব পায় না, আবার মনের পরিচর্যা না হলে প্রাণে বাঁচা অসার্থক।

তাই আমাদের আপাতকর্তব্য শোভন ও পরিশ্রুত পদ্ধতিতে real-কে বরণ করা যাতে তা ideal–এর পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যায়। বস্তুত মানুষের মানবিক বোধের ও কর্মের তথা সংস্কৃতির ও সভ্যতার বিকাশ এভাবেই হচ্ছে। নতুবা যুদ্ধ ও যুদ্ধবাজ ঘৃণ্য হল কী করে? শান্তির সপক্ষে এত মানুষ উচ্চকণ্ঠ কেন? অথবা নিরস্ত্রীকরণের কথাই বা ওঠে কী করে? কাজেই মানুষ ideal-এর দিকে মন্থর গতিতে হলেও–এগুচ্ছে, এটিই আশা ও আশ্বাসের কথা। নইলে কত বর্বরতা ও বর্বরনীতি মানুষ পরিহার করল কী করে!

প্রবন্ধ-সাহিত্য

সাহিত্যে আমরা জীবনের গানই শুনতে পাই। কেননা সাহিত্যের উৎসই হচ্ছে জীবন। জীবনের ভাব-চিন্তা-প্রয়াসই অভিব্যক্তি পায় সাহিত্যে। জীবনের গান অবশ্যই-সুর-তাল লয়ে ও বক্তব্যে বিচিত্র। কারণ জীবনে রয়েছে আনন্দ ও যন্ত্রণা, ভয় ও ভরসা এবং আশা ও নৈরাশ্য। যেখানে বিকার সেখানেই বিচলন। এ বিচলন থেকেই আসে গানে-গাথায়, গল্পে-উপন্যাসে, কাব্যে-নাটকে, রম্য রচনায় ও প্রবন্ধে বিচিত্র সুরে জীবনের শ্ৰেয় ও প্রেয়, উল্লাস ও বেদনা, প্রয়োজন ও সমস্যা প্রকাশ পায়।

সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো প্রবন্ধ-সাহিত্যের আবেদন পরোক্ষ নয়। উচ্ছ্বাস কল্পনা এবং অলৌকিকতার ভার প্রবন্ধ-সাহিত্য সয় না বলেই বাস্তব জীবন-প্রতিবেশে উদ্ভূত ভাব ও চিন্তা, তত্ত্ব ও তথ্য, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা-সম্পদ ও আপদ, প্রয়োজন ও সমস্যা, কল্যাণ ও দুর্ভোগ প্রভৃতিই প্রবন্ধ সাহিত্যের বিষয়। অতএব দুনিয়ার যাবতীয় ভাব ও বস্তুই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হতে পারে যা গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটক-কবিতার আঙ্গিকে সম্ভব নয়।

আমাদের ভাষায়ও প্রবন্ধ বিভিন্ন বিষয় উপজীবী। বিজ্ঞান-দর্শন-ইতিহাস, রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্ম, সাহিত্য-শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি-ভাষা, রীতিনীতি-আদর্শ প্রভৃতি চিরন্তন ও সাময়িক সব বিষয়েই অল্প-বিস্তর রচনা চোখে পড়ে। যদিও গুণগত কিংবা সংখ্যাগত দৈন্য আজো ঘোচেনি।

যেহেতু সমকালীন দৈশিক ও জাতিক জীবনের আনন্দ ও উদ্বেগ, প্রয়োজন ও সমস্যা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ইতিহাস ও দর্শন, শিক্ষা ও সম্পদ, ধর্ম ও রাষ্ট্র প্রভৃতি সম্বন্ধেই প্রবন্ধগুলো লেখা হয়; সেহেতু প্রবন্ধ-সাহিত্য নাগরিক চেতনারই প্রসূন। এবং তাই প্রবন্ধ-সাহিত্যে দেশের শিক্ষিত মননশীল কল্যাণকামী মানুষের বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, মন-মনন, রুচি-সংস্কৃতি, আদর্শ-উদ্দেশ্য, ভাব-চিন্তা প্রভৃতি প্রতিবিম্বিত হয়।

এ কারণেই প্রবন্ধ-সাহিত্যে দেশগত ও কালগত জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্মের প্রতিচ্ছবি যতটা পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে, এমনটি গানে-নাটকে-কবিতায় কিংবা কথা-সাহিত্যে কখনো সম্ভব হয় না। প্রবন্ধ-সাহিত্যেই বিশেষ দেশের ও কালের মানুষের জীবন-দৃষ্টির একটি সামগ্রিক পরিচয় মেলে। এজন্যে সাহিত্যের জাতীয় রূপ প্রবন্ধ-সাহিত্যেই থাকে সুপ্রকট। স্থানিক ও কালিক প্রতিবেশ, শৈক্ষিক যোগ্যতা, নৈতিক চেতনা, আর্থিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক মান, সামাজিক পরিবেশ, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ধার্মিক প্রত্যয়, আদর্শিক প্রেরণা প্রভৃতির সামষ্টিক প্রভাবে ও প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠে যে মন ও রুচি এবং যে-প্রবণতা ও অভিপ্রায়, তা-ই অভিব্যক্তি পায় প্রাবন্ধিকের রচনায়। প্রজ্ঞা, চিন্তা, যুক্তি, তথ্য, তত্ত্ব ও সামগ্রিক জীবন-দৃষ্টি প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রাণ বলেই লেখকের ব্যক্তিত্ব ঐ প্রবন্ধের প্রাণবায়ু। সুলিখিত প্রবন্ধ বুদ্ধিকে জাগ্রত ও তৃপ্ত করে এবং জ্ঞান ও বিচারকে দেয় প্রাধান্য।

সব প্রবন্ধ সাহিত্য হয় না। পাকা লিখিয়ের হাতেই প্রবন্ধ সাহিত্য-শিল্প হয়ে ওঠে জ্ঞান-যুক্তি প্রয়োগ-পরিবেশনের দুর্লভ নৈপুণ্যে। বাঙলায় বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-রামেন্দ্রসুন্দর-প্রমথ চৌধুরীর হাতে প্রবন্ধ সাহিত্য হয়ে উঠেছে।

আমাদের গবেষণামূলক প্রবন্ধ আজো পেশাগত প্রয়াসে সীমিত। কারণ তা উপাধি পরীক্ষার স্তর অতিক্রম করেনি। তাছাড়া গবেষণাবৃত্তগত বলেই গবেষণালব্ধ তথ্য পরিবেশিত হয় ইংরেজিতে। তবু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপকেরা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শন প্রভৃতি সম্পর্কে বাঙলায় কিছু কিছু লিখেছেন এবং সেগুলো নবলব্ধ জাতীয় চেতনাজাত নতুন দৃষ্টির প্রভাবে কিছু নতুন তাৎপর্য লাভ করেছে।

ভাষা সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি ধর্ম দর্শন ইতিহাস রাষ্ট্র সমাজ ঐতিহ্য প্রভৃতি সম্বন্ধে রচিত সাধারণ প্রবন্ধের মত, পথ ও দৃষ্টির পার্থক্য ও বৈপরীত্য বিচিত্রভাবে প্রকটিত হয়েছে বিভিন্ন মন ও মননের স্পর্শে বিচিত্র ও বর্ণালি হয়ে উঠলেও তাতে দেশ-কাল-জাত-চেতনা দুর্লক্ষ্য নয়।

জাতীয় জীবনের সম্পদ ও সমস্যা, প্রয়োজন ও অভিপ্রায়-সচেতনতা সর্বত্র সুলভ। কেননা লক্ষ্য তাদের বিভিন্ন আত্মিক ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনের সর্বাত্মক উন্নয়ন। এই উদ্দেশ্য সাধন কল্পে কারো দৃষ্টি দেশগত জীবনে নিবদ্ধ, কারো লক্ষ্য ধর্মগত আদর্শে সীমিত, কারো চিন্তা কালিক সমস্যার অনুগত, আবার কারো উদ্যম সর্বমানবিক কল্যাণ চিন্তায় নিয়োজিত। অর্থাৎ কেউ স্বাজাতিক পটভূমিকায়, কেউ স্বাধর্মিক প্রতিবেশে, কেউবা আন্তর্জাতিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে প্রয়াসী এবং সেভাবেই জাতীয় জীবনে উন্নয়নকামী। তবে আমাদের প্রাবন্ধিকদের মধ্য ধর্মবাদী ও রাষ্ট্রবাদীর চেয়ে মানববাদীর সংখ্যাই বেশি। ধর্মপন্থীরা গোড়া রাষ্ট্রপন্থীরা উগ্র এবং মানবপন্থীরা উদার বলে পরিচিত। লিখিয়ে মাত্রেই–কবি কিংবা কথাশিল্পী যেই হোন–প্রবন্ধ লেখেন। তাই জনপ্রিয় বিষয়ে প্রবন্ধের সংখ্যা অজস্র। কিন্তু নতুন বক্তব্য না থাকলে যে লিখতে নেই, তা তাঁরা বোঝেন না। জ্ঞান-প্রজ্ঞা, চিন্তা-রুচি, উদ্দেশ্য ও জীবন-দৃষ্টির সমন্বয়ে গড়ে উঠে নতুন বক্তব্য। বক্তব্য ব্যক্তিত্বেরই অভিব্যক্ত রূপ। বক্তার স্বাতন্ত্রই বক্তব্যকে বিশিষ্ট করে। নিজস্ব বক্তব্যহীন বাঁচালতায় কেবল আবর্জনারই সৃষ্টি হয়। প্রবন্ধে নতুন ব্যঞ্জনা, নতুন তাৎপর্য নতুন ব্যক্তিত্বের ছাপ আবশ্যিক। বলা বাহুল্য আমাদের প্রবন্ধ-সাহিত্যে অবাঞ্ছিত আবর্জনাই বেশি।

তবু বিভিন্ন মতাদর্শের অনেক প্রাবন্ধিকই পাঠকমনে প্রভাব বিস্তার করেছেন। জাগ্রত জীবনের আহ্বান যাদের চিত্তলোকে সাড়া জাগায় তাদের কিছু-না-কিছু বক্তব্য থাকেই এবং জাগ্রত জীবন থেকেই সাহিত্যের সৃষ্টি ও পুষ্টি। অতএব এ-যুগে প্রবন্ধ-সাহিত্যের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এবং তা হবে জাতির মনীষার মুকুর।

প্রবন্ধ দুই প্রকার : সৃষ্টিমূলক ও নির্মিতিমূলক। ভাব ও তত্ত্ব বিষয়ক বিমূর্ত রচনাই সাহিত্য গুণান্বিত হয় বেশি। আর তথ্য ও সমস্যামূলক Objective রচনা শিল্পায়িত করা অসামান্য শক্তির পরিচায়ক। রামেন্দ্রসুন্দর, রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর মধ্যে ছিল এই অনন্য প্রতিভা। নির্মিত প্রবন্ধে বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণ হয়, আর সৃষ্ট প্রবন্ধ ভাবাত্মক বলেই রসাত্মক এবং সে কারণেই কাব্যগুণান্বিত।

বলাকাকাব্যে মৃত্যু-মহিমা

রবীন্দ্রনাথ যে বিদ্রোহী-বিপ্লবী সগ্রামী কবি নজরুল ইসলামের পূর্বসূরী ও বিপ্লব-মন্ত্রে দীক্ষাগুরু, সে কথা আমরা প্রায়ই ভুলে থাকি। বলাকাকাব্য থেকে এখানে বিপ্লবী-সংগ্রামী রবীন্দ্রনাথের পরিচয় তুলে ধরছি।

ইন্দ্রনাথ চরম তাচ্ছিল্যে শ্রীকান্তকে বলেছিল, মৃত্যুকে ভয় কি, মরতে তো একদিন হবেই। নৌকাডুবি হয়ে, গাড়িচাপা পড়ে, ঝড়-বন্যা-মহামারীর কবলে পড়ে রোজ কত কত অপঘাত অপমৃত্যু হচ্ছে। মরণকে এড়ানো-আটকানো যায় না। মরতেই যদি হবে, তাহলে অন্য দশ প্রাণীর মতো অসহায় নিষ্ফল মৃত্যুর জন্যে সভয়ে অপেক্ষা করার চেয়ে স্বেচ্ছায় মহৎ মৃত্যুবরণ করাই তো মানুষের কাজ। সক্রেটিস, যিশু, ব্রোনো এমনি মহৎ মৃত্যুই হাসিমুখে বরণ করেছিলেন। এ মৃত্যু বাঁচবার ও বাঁচাবার জন্যেই। এক প্রাণ দিয়ে লক্ষ কোটি প্রাণের নিরাপত্তা দানই এমন মৃত্যুর লক্ষ্য। প্রয়োজনমতো যে মরতে প্রস্তুত, বাঁচবার অধিকার তারই। সময়মতো যে মরতে জানে সেই বাঁচিয়ে রাখে জগৎ-সংসারের মানুষকে ও মনুষ্যত্বকে। লক্ষ-কোটি মানুষের মধ্যেই সে সগৌরবে সার্থক হয়ে বাঁচে। নিঃশেষে প্রাণ যে করিব দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।

যিশু ক্রুসে বিদ্ধ হয় রক্ত দিয়েছিলেন, দিয়েছিলেন প্রাণ। তার রক্ত ধুইয়ে-মুছে দিয়েছে কোটি কোটি পাপী-তাপী খ্রীস্টানের পাপ-তাপ এবং তার এক প্রাণের বিনিময়ে কোটি কোটি প্রাণ পেয়েছে ত্রাণ। তাই যিশু হলেন মানুষের ত্রাণকর্তা Saviour এবং যে-সে যিশু বিদ্ধ হয়েছিলেন তা হল মানুষের প্রাণরক্ষক বর্ম। এমনি করে মৃত্যুর বিনিময়ে জাগে প্রাণ, বিকাশ পায় জীবন। দুনিয়াব্যাপী মানুষের অগ্রগতির মূলে রয়েছে বীর মুযাহিদের আত্মদান।

স্বার্থপর লোভী নিজেও শেষ অবধি বাঁচতে পারে না, অন্যকেও বাঁচতে দিতে জানে না। তার লোভ ও আত্মরতি তাকে পরস্বে ও পীড়নে প্ররোচিত করে। লোকহিতার্থে তাকে ঠেকানোর জন্যেই ত্যাগবীরের প্রয়োজন। যে-দেশে যে-সমাজে তেমন লোকের অভাব, সে-দেশের ও সে-জাতির জীবন-যন্ত্রণা কেবলই বাড়ে। ভীরুরা আত্মসংকোচন করে ও পালিয়ে বাঁচতে চায়। আত্মসংকোচন ও পলায়ন নামান্তরে আত্মবিলোপ বই কিছুই নয়। কেননা ওতে লোভীর লোভ ও দুবৃর্ত্তের পীড়ন-স্পৃহা বৃদ্ধি পায়। মানুষের জীবনে ও জীবিকার যেখানে যতটুকু নিরাপত্তা রয়েছে তা তো ঐ নির্ভীক ত্যাগবীরের প্রাণের বিনিময়েই লব্ধ। এবং প্রয়োজনমতো প্রাণদানে সমর্থ কিছুসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিই তো লোভী হিংস্রকে সংযত রেখেছে। দুবৃর্তের সম্বল বুদ্ধি ও বাহুবল। এগুলোর সীমা আছে। লোক-রক্ষক সংগ্রামীর শক্তির উৎস হচ্ছে সদিচ্ছা ও মনোবল। এ শক্তি তাই অসীম, অপরিমেয় ও অফুরন্ত। ত্রাসের ঝড় বিভীষিকাময় কিন্তু ক্ষণজীবী, ত্রাণের বায়ু মৃদু-প্রবাহী কিন্তু স্থায়ী ফলপ্রসূ। দুবৃত্ত নামে ঝড়ের বেগে এবং গতিও তার ঝড়ো। জনে জনে হয় জনতা। তার বেগ বন্যার। এবং বন্যা বাঁধ মানে না। জনতার সৃষ্টি রক্তবীজে। কেটে-মেরে তাকে নিঃশেষ করা যায় না। কেবলই বাড়ে, অসংখ্য ও অজয় হয়ে বাড়ে। বাহুবলে বলীয়ান দুবৃত্ত সিংহচর্মের আবরণে শৃগাল।

তাই আত্মপ্রত্যয়ী জনতা যখন রুখে দাঁড়ায়, তখন সেই দুবৃত্তপীড়ক–

পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাষ্য মিশে।

কেননা,

কেহ নাহি সহায় তাহার
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা
আপনার মনে মনে।

মনোবল আসে ন্যায়নিষ্ঠা ও আত্মপ্রত্যয় থেকে। সদিচ্ছা ও কর্তব্যবুদ্ধিই মানুষকে করে নির্ভীক ও আত্মদানে অনুপ্রাণিত। তেমন মানুষই পা বাড়ায় বিপদের মুখে। এগিয়ে যায় নিশ্চিত মৃত্যুর পথে। কেননা সে জানে, পরিণামে জয়ী হয় শহীদেরাই। ভয়-সংশয় দলিত করে জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে যে প্রথম এগিয়ে যায়, সেই-দেশ-জাত মানুষের ত্রাণকর্তা। পৌরুষ ও কাপুরুষতার মধ্যে ব্যবধান ঐ এক কদমেরই। ঐ বাড়তি কদমেরই নাম বীরত্ব, আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব, মনুষ্যত্ব এবং লোকাণ। জগতে ও জীবনে শক্তির ও সংগ্রামী প্রেরণার উৎস ঐ আগে-বাড়ানো কদমটিই। এই বাড়তি কদমের মূলে রয়েছে যে জাগ্রত চিত্ত, সে-চিত্ত আগেই জীবনের প্রসাদরূপে গ্রহণ করে :

কালবৈশাখীর আশীর্বাদ
শ্রাবণ রাত্রির বজ্রনাদ
পথে পথে কণ্টকের অভ্যর্থনা
পথে পথে গুপ্তসৰ্প গূঢ়ফণা।

সে-চিত্ত জানে-পীড়ন হবে যত প্রবল, মুক্তি আসবে তত দ্রুত। শিকল পরেই বিকল করতে হয় শিকল, একপ্রাণের বীজ সৃজন করতে হয় কোটি প্রাণ, বুকের রক্তই হয় রক্তবীজ যা সৃষ্টি করে অসংখ্য-অজেয়-অমর আত্মা। এমন মানুষের নেতৃত্বেই তো দেশ-জাত ও ধর্ম রক্ষার জন্যে মানুষ চিরকাল অকাতরে প্রাণ দিয়েছে–মরণোৎসবে উল্লসিত হয়েছে, রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে তুলেছে বিদ্রোহের ধ্বজা। যারা প্রাণের মমতায় প্রাণীমাত্র, তারা প্রাণটা জিইয়ে রাখার জন্যে সদসতর্ক থেকেও অকালে- অসময়ে-অকারণে-অঘোরে প্রাণ হারায়; আর যারা প্রাণের মূল্য বোঝে, তারা দেশ-জাত-মানুষের ত্রাণের জন্যে প্রয়োজনের মুহূর্তে প্রাণটি দিয়ে প্রাণের মূল্য প্রমাণ করে। এবং ধন্য হয় নিজে, ধন্য করে জগৎ সংসারকে।

আমরা চলি সমুখ পানে, কে আমাদের বাঁধবে?
দিনে দিনে যখন বঞ্চনা বাড়িয়া উঠে, ফুরায় সত্যের যত পুঁজি
তখন বন্ধন পীড়ন-দুঃখ অসম্মান ক্ষুব্ধ মৃত্যুঞ্জয় তরুণেরা –
ভীরুর ভীরুতাঞ্জ প্রবলের উদ্ধত অন্যায়
লোভীর নিষ্ঠুর লোভ বঞ্চিতের নিত্য চিত্তক্ষোভ
জাতি-অভিমান।

দূর করবার জন্যে নেমে পড়ে বন্ধুর পথে। ঝড়ো হাওয়ার মতো, ঝাবিক্ষুব্ধ-সমুদ্রের মতো তারা প্রতিবাদের রোল-কল্লোল জাগায়। তখন বিশ্বজগৎ অবাক হয়ে দেখে আর শোনে ঝড়ের মাতন, বিজয় কেতন নেড়ে, অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে এগিয়ে চলছে তরুণরা। এবং

ঝটিকার কণ্ঠে কণ্ঠে শূন্যে শূন্যে প্রচণ্ড আহ্বান
মরণের গান।
উঠেছে ধ্বনিয়া পথে নবজীবনের অভিসারে
ঘোর অন্ধকারে।

প্রপীড়িত আত্মার বন্ধন জর্জরতা ঘুচাবার সংকল্পে দৃপ্ত নির্ভীক তরুণের কণ্ঠে জেগে উঠে মরণজয়ী-গান :

লাঞ্ছিতেরে কে রে থামায়?
ঝাঁপ দিয়েছি অতল পানে
মরণ-টানে।

মরণপণ সংগ্রাম তাদের। তারা জানেই :

বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ কোনো সুখের-সম্পদের ও কোনো খ্যাতি-ঐশ্বর্যের লোভ দেখিয়ে তরুণদের আহ্বান করেননি। গ্যারিবল্ডীর মতোই তিনি সংগ্রামী সৈতিকদের ডাক দিয়েছেন-দুঃখ যন্ত্রণার ও মৃত্যুর পথে। তাঁর মতে যে প্রয়োজনমতো মরতে ও মারতে জানে, বাঁচবার ও বাঁচাবার যোগ্যতা রয়েছে তারই। দেশ-জাতমানুষের হিতার্থে আত্মাহুতি দিতে পারে, সমাজে তেমন তরুণের আবির্ভাব তিনি চিরকালই কামনা করেছেন। তার বিশ্বাস জীবন-মৃত্যুকে যে পায়ের ভূত্য করেনি, তেমন মানুষ দিয়ে দেশ-জাত-মানুষের কোনো কল্যাণ আসতে পারে না, কেননা সারা দুনিয়াব্যাপী পাশব-শক্তিরই দানবীয় লীলা চলছে। তার মোকাবেলার জন্যে দিতে হবে রক্ত ও প্রাণ, দিতে হবে শোণিত ও জীবন। এভাবেই দূর করা সম্ভব —

যত দুঃখ পৃথিবীর, যত পাপ, যত অমঙ্গল
যত অশ্রুজল
যত হিংসাহলাহল

মানুষের প্রাণে মানুষ যত বিষ মিশিয়েছে, সে বিষ ধুইয়ে-মুছে ফেলবার জন্যে চাই মহৎপ্রাণ ব্যক্তির রক্ত। কাজেই রবীন্দ্রনাথ ত্যাগবীর তরুণের রক্ত ও প্রাণ দান কামনা করেছেন নব-দানবের দেয়া দারিদ্র-পীড়ন-যন্ত্রণা থেকে মানুষের মুক্তির জন্যে। এই দানবের সাথে লড়াইয়ের জন্যে ঘরে ঘরে যে লড়িয়ে-তরুণ প্রস্তুত হচ্ছে, তাও তিনি দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। এবং এ-ও জানতেন :

কোনো ভাবী ভীষণ সংগ্রাম
রণ শৃঙেখ আহ্বান করিছে তার নাম।

আমরা যারা বাঁচবার মতো বাঁচতে জানলাম না, পারলাম না মরার মতো মরতে, এই মৃত্যুঞ্জয়ী বীরদের আত্মাহুতির সহজ প্রবণতা দেখে আমরাও জীবনে হঠাৎ করে খুঁজে পাই শক্তি, গর্ব ও প্রত্যয়। ভাবীসগ্রামে শহীদেরাই হয়ে থাকে প্রেরণার উৎস ও পথের দিশারী।

রবীন্দ্রনাথের মতে, দুঃখ-বেদনা ও মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ঘটে নবযুগের ও নতুন জীবনের অরুণোদয়। যে-পোষ মানে, সে মরে, যে অতীতকে আশ্রয় করে, সে হয় জীর্ণতায় অবসিত। কাজেই বিপদ সামনে নয়, পশ্চাতে। পশ্চাতই–পুরাতনই মানুষকে গ্রাস করে :

ওরা জীবন আঁকড়ে ধরে
মরণ-সাধন সাধবে
কাঁদবে ওরা কাঁদবে।..
রইল যারা পিছুর টানে।
কাঁদবে তারা কাঁদবে।

সম্মুখের বাধার আহ্বানে যে সাড়া দেয়, জীবনযাত্রায় সেই হয় জয়ী। জীবন তার কাছেই ধরা দেয়। সে জানে সামনে নতুন দিন। প্রভাত হতে দেরি নেই :

নতুন ঊষার স্বর্ণদ্বার।
খুলিতে বিলম্ব নাই আর।

রবীন্দ্রনাথের চিরকালই এ-বিশ্বাস ছিল যে-কোনো মহৎ মৃত্যুই বৃথা যায় না এবং রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে ছাড়া কোনো মহৎ কল্যাণ, কোনো বৃহৎ মুক্তি আসতে পারে না। কেননা পাপ ও পীড়ন, অন্যায় ও শোষণ দানবীয় শক্তিরই দান। সেই রাক্ষুসে রাহু- গ্রাসই ম্লান করে দিয়েছে– কালো করে দিয়েছে পৃথিবীর আলো। তাই আস্তিক্যবুদ্ধি নিয়ে কবি প্রশ্ন করেছেন :

মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে
সত্য যদি নাহি মেলে দুঃখ সাথে যুঝে,
পাপ যদি নাহি মরে যায়
আপনার প্রকাশ লজ্জায়,
অহংকার ভেঙ্গে নাহি পড়ে আপনার অসহ্য সজ্জায়,
তবে ঘর ছাড়া সবে
অন্তরের কি আশ্বাস রবে
মরিতে ছুটিছে শত শত
প্রভাত আলোর পানে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের মতো?
বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলায় হবে হারা?
রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন?
নিদারুণ-দুঃখরাতে
মৃত্যুঘাতে।
মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা
তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?

রবীন্দ্রনাথ গান্ধীপন্থী ছিলেন না, তিনি শক্তি দিয়ে শক্তির মোকাবেলায় আস্থা রাখতেন।

 বাউল মত ও সাহিত্য

ক.

বাউলমতের উদ্ভব সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছি অন্যত্র। কিন্তু সেসব বাহ্য পরিচয়ই বহন করে। অন্তরঙ্গ পরিচয়ের জন্যে তত্ত্বকথার জাল বুনতে হবে এবং তাতে ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণ প্রয়াগ করা সম্ভব হবে না। প্রমাণ যা থাকবে তা পরোক্ষ, তাই পঞ্জী হবে বিরল।

চলমান জীবন প্রতিমুহূর্তে বিচিত্ররূপে নিজেকে প্রকাশ করে। অভিব্যক্তির এ প্রবাহকে কোনো ছকে ফেলে যাচাই করা চলে না। এ-কথা কেবল ব্যক্তি সম্পর্কেই নয় জাতীয় জীবন সম্বন্ধেও সত্য। তবু জানবার-বুঝবার সুবিধের জন্য একটা মাপকাঠি স্বীকার না করলেই নয়। তাই সমাজ-নীতি ধৰ্ম-বিধি রাষ্ট্রসংস্থা ইতিহাস দর্শন বিজ্ঞান শিল্প স্থাপত্য ভাস্কর্য সাহিত্য সঙ্গীত পোশাক আচার আচরণ প্রভৃতি সাধারণভাবে সমাজের বা জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচায়ক ও পরিমাপক বলে স্বীকৃত হয়। যদিও এমন কোনো সাধারণ গুণনীয়ক কিংবা সমীকরণ পদ্ধতি নেই যা দিয়ে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের বিচিত্র আচরণকে একটি সামগ্রিক ধারণার অনুগত করে বিচার করা সম্ভব। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে একটা জাতির পূর্ণ পরিচয় নিবন্ধ নেই বলে সামগ্রিক স্বরূপে কোনো জাতিকে চিহ্নিত করাও অসম্ভব। তবু মানুষের বোধের ও ব্যবহারের পরিসরে জাতিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের যে রেওয়াজ চালু রয়েছে, আপাতত আমাদের তাই অনুসরণ করতে হবে।

জাতির পরিচয় ক্ষেত্রে ধর্ম ও সাহিত্যকে প্রধান উপকরণ বলে গণ্য করা হয়। কেননা জীবন একান্তই স্থান-কাল ভিত্তিক। কাজেই মানুষের দেহমন গড়ে তোলে প্রতিবেশ। আর মানুষের অন্তরের অপকট অনুভূতি ও উপলব্ধির সুন্দরতম ও নিবিড়তম প্রকাশ ঘটে সাহিত্যে। এবং জীবনের তথা মনের ও আচরণের অলক্ষ্য নিয়ন্তা হচ্ছে ধর্মীয় সংস্কার। ধর্মের অন্তলীন প্রভাবের স্বরূপ যাই হোক, সাহিত্য যে মানুষের বোধ-বুদ্ধির অবিকৃত প্রতিরূপ তা মানতেই হবে। কারণ সাহিত্য জীবনালেখ্য নয়, জীবনবোধের অভিব্যক্ত সাক্ষ্য। এজন্যেই সাহিত্য জাতীয় জীবনের মুকুর বলে স্বীকৃত। সাহিত্যে মানুষের মর্মমূলের স্বরূপ বিধৃত থাকে বলে মানুষের অন্তসত্তার পরিচায়করূপে একে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। আর মানুষের মননে ও আচরণে স্থানিক কালিক প্রভাব অনপনেয় বলে কোনো কোনো ঐতিহ্য মানুষের প্রেরণার মাতৃকা, কর্মের দিশারী ও মর্মের পরিচায়ক। কাজেই সাহিত্য ও ঐতিহ্যের উজান পথে সন্ধান নিতে হবে তত্ত্বের।

.

খ.

মানুষের মনে জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্য এবং জগৎ ও জীবনের মহিমা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে যে চিরন্তন ও সর্বজনীন জিজ্ঞাসা রয়েছে তারই জবাব খোঁজা হয়েছে ধর্ম ও আধ্যাত্মজীবন সম্পর্কিত রচনায়। বাস্তবধর্মী শক্তিমানের যে জিজ্ঞাসা মানুষকে বিজ্ঞানী করেছে, ভাববাদী দুর্বলকে তা-ই করেছে তাত্ত্বিক ও দার্শনিক। একই জিজ্ঞাসা আপাত বিরোধী দু-কোটির চিন্তা ও কর্মের প্রেরণা ও জন্ম দিয়েছে। এই একই জিজ্ঞাসা কাউকে করেছে বহির্মুখী, কাউকে দিয়েছে অন্তদৃষ্টি। বহির্মুখিতা মানুষকে করেছে বিষয়ী ও বিজ্ঞানী, অন্তর্দৃষ্টি মানুষকে করেছে রহস্যবাদী, গড়ে তুলেছে অধ্যাত্মবাদ। বিজ্ঞান এনেছে ভোগবাদ বা ঐহিক জীবনবাদ তথা বস্তুতান্ত্রিকতা। অধ্যাত্মবাদ দিয়েছে। বৈরাগ্য বা ইহবিমুখিতা জাগিয়েছে, জীবনের জীবনের আকাঙ্ক্ষা। বৈরাগ্য প্রাচ্যের মানস- সম্পদ আর বিজ্ঞান প্রতীচ্যের ঐশ্বর্য। দুটোরই মূল প্রেরণা জিগীষা–একটার লক্ষ্য আত্মজয়, অপরটার কাম্য দুনিয়া-জয়। একটার সম্বল হৃদয় ও মনোবল, অপরটার হাতিয়ার বুদ্ধি ও বাহুবল। একটি হৃদয়বৃত্তির লীলা, অপরটি প্রাণধর্মের অভিব্যক্তি।

তত্ত্বচিন্তা মানুষকে তিনটে মার্গের সন্ধান দিয়েছে–জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির পথ। জ্ঞানবাদ আস্তিক, নাস্তিক্য ও সংশয়প্রবণ দর্শনের জন্ম দিয়েছে। কর্মবাদ সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রবিধি গড়ে তুলেছে আর ভক্তিবাদ হয়েছে নিষ্ঠা ও বৈরাগ্যের উৎস। এবং ভক্তিবাদের উপজাত কিংবা পরিণাম হচ্ছে প্রেমবাদ। বাঙলা ভাষায়ও এই তত্ত্বজিজ্ঞাসা তিন ধারার সাহিত্য সৃষ্টির উৎস হয়েছে– ধর্মসাহিত্য, তত্ত্বসাহিত্য ও সাধনসাহিত্য। বাউল গান হচ্ছে তত্ত্বাশ্রয়ী মরমীয়া সাহিত্য।

.

গ.

বাউলগান আমাদের তত্ত্ব-সাহিত্যের অন্যতম শাখা। মুসলিম প্রভাবে তথা সূফীবাদের প্রত্যক্ষ সংযোগে এক প্রাচীন মতের রূপান্তরে বাউল মতের উদ্ভব হয়েছে। সে মতের জড় রয়েছে প্রাচীন ভারতে। আদিকাল থেকেই মানুষ সাধারণভাবে দৈহিক শুচিতাকে মানস-শুচিতার সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করেছে। এজন্যে যে-কোনো ধর্মমতে উপাসনাকালে দৈহিক পবিত্রতা আবশ্যিক। মনে হয় এ বোধেরই পরিণতি ঘটেছে দেহাত্মবাদে ও দেহতত্ত্বে। যোগে, সাংখ্যে বৌদ্ধ ও হিন্দুতন্ত্রে এবং সূফীসাধন তত্ত্বে দেহকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দেহের আধারে যে-চৈতন্য সেই তো আত্মা। এ নিরূপ নিরাকার আত্মার স্বরূপ-জিজ্ঞাসা শারীরতত্ত্বে মানুষকে করেছে কৌতূহলী। এ থেকে মানুষ বুঝতে চেয়েছে–দেহযন্ত্র নিরপেক্ষ আত্মার অনুভূতি যখন সম্ভব নয় তখন আত্মার রহস্য ও স্বরূপ জানতে হবে দেহযন্ত্র বিশ্লেষণ করেই। এভাবে সাধনতত্ত্বে যৌগিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে অসামান্য। তাই এদেশে অধ্যাত্ম সাধনায় যোগাভ্যাস একটি আবশ্যিক আচার। যোগসাধন পাক ভারতের একটি আদিম অনার্য শাস্ত্র। বৌদ্ধযুগে এর বহুল চর্চা ছিল। বাঙলায় পাল আমলের তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের একটি শাখাই মধ্যযুগে সূফী প্রভাবে বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউল মত রূপে প্রসার লাভ করে। এভাবে চর্চাগীতির পরিণতি ঘটে সহজিয়া পদে ও বাউল গানে। তত্ত্ব-সাহিত্যে তথা মরমীয়া সাধনায় সাধারণভাবে যোগ আর সূফী সাধন তত্ত্বের ও পদ্ধতির মিশ্রণ ঘটেছে। সমাজ ও ধর্মের আচারিক প্রভেদ সত্ত্বেও শাসক-শাসিত সম্পর্কের অন্তরালে ভিন্নাদর্শমুখী দুটো জাতির মধ্য কী নিবিড় প্রাণের যোগ সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে বাউল গানে ও এ ধরনের অন্যান্য রচনায়। জীবনের যে চিরন্তন প্রশ্নে আত্মার আকুলতা-উদার পটভূমিকায় ও বিস্তৃত পরিসরে তার সমাধান খুঁজতে চাইলে জাত, ধর্ম ও সমাজ চেতনার উর্ধ্বে উঠতেই হয়। মানস সংস্কৃতির এরূপ লেনদেন, এমনি আত্মিক যোগাযোগ চিরকালই মানুষের চিত্তপ্রসারের ও আত্মবিকাশের সহায়ক হয়েছে।

মুসলিম বিজয়ের পরে হিন্দু-মুসলমানের বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথমে দক্ষিণ ভারতে, পরে উত্তরভারতে এবং সর্বশেষে বাঙলা দেশে হিন্দুসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ আলোড়নের বাহ্যরূপ ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়াস। হিন্দুর মায়াবাদ ও তজ্জাত ভক্তিবাদ এবং ইসলামের সূফীতত্ত্বই এ আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের ভক্তিধর্ম; উত্তর ভারতের সন্তধর্ম এবং বাঙলার বৈষ্ণব ও বাউল মত সূফীবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। সেদিন ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মহিমা যে আবেগ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিল তারই ফলে মন্দির ছেড়ে মসজিদে না গিয়ে উদার আকাশের নিচে স্রষ্টার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক পাতাবার এ নতুনতরো প্রয়াসমাত্র। তারা বুঝেছে যদিও হিন্দু ধাবই দেহরা, মুসলমান মসীত সেখানে তো আল্লাহ নেই। কবীরের ভাষায় তাদেরকে আল্লাহ বলেছেন :

মো কো কঁ টুড়ো বন্দে মৈ তো তেরে পাসর্মে
না মৈ দেবল না মৈ মসজিদ, না কাবে কৈলাসর্মে।

জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার স্থিতি। কাজেই আপন আত্মার পরিশুদ্ধিই খোদা প্রাপ্তির উপায়-তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনাই এদের প্রাথমিক ব্রত। এদের আদর্শ হচ্ছে Knoweth thyself; আত্মানাং বিদ্ধি–নিজেকে চেনো, হাদীসের কথায় মান আরফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু–যে নিজেকে চিনেছে সে আল্লাহকে চিনেছে। জীবনের পরম ও চরম সাধনা সে-খোদাকে চেনা।

.

ঘ.

ইরানি সূফী সাধনাও যৌগিক প্রক্রিয়া নির্ভর। পাক-ভারতের যোগ-সাধনার সঙ্গে পরিচয়ের পর। সূফীদের দেহচর্চায় যোগশাস্ত্রে প্রচুর প্রভাব পড়ে। সূফীদের দেহতত্ত্বের সঙ্গে যোগশাস্ত্রের সার্থক মিশ্রণ ঘটিয়ে উভয় প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধন করে যিনি পাক-ভারতের মুসলিম সমাজে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন তাঁর নাম শেখ শরফুদ্দিন বু আলি কলন্দর শাহ (মৃত্যু ১৩২৪ খ্রী.)। তার প্রবর্তিত সাধনপদ্ধতির বাঙলা নাম যোগ কলন্দর। পানিপথে তার সমাধি আছে। উত্তরভারতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর তাঁর খ্যাতি আজো ম্লান হয়নি। এক সময়ে বাঙলায় কলন্দর-পন্থী বৈরাগীর এমনি প্রাদুর্ভাব ছিল যে কলন্দর বলতে মুসলিম বৈরাগীই বোঝাত। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে কলন্দর হৈয়া কেহ ফিরে দিবারাতি। ঋণ করি নাহি দাও, নহ কলন্দর। আর সূফীতত্ত্বের সঙ্গে এদেশের লোকের সাহিত্যিক পরিচয় ঘটে প্রথমে রুমীর মসনবী এবং পরে হাফিজ প্রভৃতির সৃষ্টির মারফৎ। ব্যবহারিক পরিচয় তো আগে থেকেই ঘটেছে, কেননা ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে প্রধানত সূফী দরবেশের ও তাদের অনুচরের মাধ্যমে।

আত্মা পরমাত্মার অংশ। কাজেই আত্মাকে জানলেই পরমাত্মাকে জানা হয়। তাই দেহধারাস্থিত আত্মাকে জানাই বাউলের ব্রত।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।

এ দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয়।

বাউলেরা তাদের ভাষায় অচিন পাখি, অলখ সাঁই (অলক্ষ্য স্বামী) মনের মানুষ বা মানুষ রতন-রূপ আত্মা তথা পরমাত্মাকে জানবার সাধনা করে। বৈষ্ণব বা সূফীর মতো এরা প্রেমিক নয় যোগীর মতো তাত্ত্বিক। বাউল গান একাধারে ধর্মশাস্ত্র ও দর্শন-সাধ, সঙ্গীত ও ভজন গান ও গীতিকবিতা। তথাপি ভাষায়, আঙ্গিকে ও ভঙ্গিতে এগুলো আমাদের লোকসাহিত্যেরই অন্তর্গত। মোটামুটিভাবে সতেরো শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকেই বাউলমতের উন্মেষ। মুসলমান মাধববিবি ও আউলচাঁদই এ মতের প্রবর্তক বলে বাউল সম্প্রদায়ের বিশ্বাস। মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দ-পুত্র বীরভদ্রই বাউল-মত জনপ্রিয় করেন। আর উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমেই এর পূর্ণ বিকাশ।

ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই বাউলেরা সাধনা করে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তারা সাম্য ও মানবতার বাণী প্রচার করে। এঁরা রুমী-হাফিজের সগোত্র সাধক। বাউল গুরুরা একাধারে কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও মরমী। তাদের গান লোকসাহিত্য মাত্র নয় বরং বাঙালির প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর।

বাউলের রূপক অভিব্যক্তিতে পরমাত্মা হচ্ছেন : মনের মানুষ, সহজ মানুষ, অধর মানুষ, অটল মানুষ, রসের মানুষ, সোনার মানুষ, মানুষ রতন, মনমরা, অলখ সই প্রভৃতি। চর্যাপদ, দোহা প্রভৃতি সব মরমীয়া রচনার মতো বাউলগানও সাধারণত রূপকের আবরণে আচ্ছাদিত। সে-রূপক দেহধার, বাহ্যবস্তু ও ব্যবহারিক জীবনের নানা কর্ম ও কর্মপ্রচেষ্টা থেকে গৃহীত। কারণ All creation-wonders excite the cry of Love. (foto)

বলেছি, ব্রাহ্মণ্য শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্ৰমত–যার নাম নাথপন্থ। বামাচার নয়, কায়াসাধন তথা দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। হঠযোগের মাধ্যমেই এ সাধনা চলে। একসময়ে এই নামপন্থ এবং সহজিয়া মতের প্রাদুর্ভাব ছিল বাঙলায়। এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময়ে ইসলামে ও বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু পুরোনো বিশ্বাস সংস্কার বর্জন সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেই এরা নিজেদের পুরোনো প্রথায় ধর্মসাধনা করে চলে। তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। বাউলেরা অশিক্ষিত। এজন্যেই তাদের কোনো লিখিত শাস্ত্র নেই। এবং তাদের মতবাদের কালিক কিংবা দার্শনিক পরিচয় তারা দিতে পারে না। সমাজের অজ্ঞ ও গরিব লোকের মধ্যেই এ সাধনা আবদ্ধ বলে বাউলমত শিক্ষিত লোকের শ্রদ্ধা পায়নি, সেজন্যে পণ্ডিতের আলোচনার বিষয়ও হয়নি। রবীন্দ্রনাথই প্রথম এদের প্রতি শিক্ষিত সাধারণের ঔৎসুক্য জাগান।

গুণী ও মরমী হয়েও বাউলেরা সমাজে উপেক্ষিত। বাউল সম্প্রদায়ে জাতি ও শ্ৰেণী-বৈষম্য নেই। হিন্দু-মুসলিম ভেদ নেই। হিন্দু গুরুর মুসলিম-শিষ্য, মুসলিম গুরুর হিন্দু-সাগরেদ গ্রহণে কোনো দ্বিধা-বাধা নেই। তাই বাউল মনাই শেখের শিষ্য কালাচাঁদ মিস্ত্রি, তাঁহার শিষ্য হারাই নমশূদ্র, তাহার শিষ্য দীনু জাতিতে নট, তাঁহার শিষ্য ঈশান যুগী, তাঁহার শিষ্য মদন। নিত্য নাথের শিষ্য বলা কৈবর্ত, তাহার শিষ্য বিশা ভূঁইমালী, তাঁহার শিষ্য জগা কৈবর্ত, তাঁহার শিষ্য মাধা পটিয়াল বা কাঁপালী, তাহার শিষ্য গঙ্গারাম। গঙ্গারাম ও মদন দুই বন্ধু ছিলেন। গঙ্গারামের ব্রাহ্মণ শিষ্যও ছিলেন।

অনার্য-অধ্যুষিত বাঙলা দেশে জনগণ চিরকাল অত্যধিক ভাবপ্রবণ। এই ভাবপ্রবণতা বা হৃদয়োচ্ছাস থেকেই বাঙালির গীতিকবিতার উদ্ভব। বাঙলা কেবল ধানের দেশ নয়, গানের দেশও। এখানকার মাটির ফসল ধান, মনের ফসল গান। শুধু বন্যাতেই দেশ প্লাবিত হয় না, গানেও হৃদয় প্লাবিত থাকে। লাল কাঁকরের পশ্চিমবঙ্গ শুষ্ক উত্তরবঙ্গ ও নদীবহুল পূর্ববঙ্গ-বাসীর দৃষ্টি চিরকাল আকাশের দিকে। শ্যামল সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতা জানায়, তেমনি প্রকৃতির নিদারুণ রুক্ষতায় কিংবা বিরূপতায় ঊর্ধ্বে দুচোখ তুলে ফরিয়াদও জানায়। মমতায় আঁকড়ে ধরা নয়, চরম ঔদাস্যে মোহ–মুষ্ঠি শিথিল করাই এদের জীবনাদর্শ। তাই চর্যাপদের দেশেই বৈষ্ণব-বাউলের উদ্ভব। মূলত সবগুলিই এক। প্রকাশভঙ্গিই ভিন্ন। সিদ্ধ-সূফী-যোগী-বৈষ্ণবেরা যেমন গুরুবাদী, বাউলেরাও তাই। বাঙালির স্বভাবেই রয়েছে মরমীয়াবাদ।

এই ভাবপ্রবণ বাঙালি-হৃদয়ে স্রষ্টা, সৃষ্টি ও রহস্যময় মানবজীবন সম্বন্ধে যে জিজ্ঞাসা জেগেছে সেই জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে বাঙালি কেবল কালে কালে ঘরছাড়া হয়নি আত্মহারাও হয়েছে। সেইজন্যে এদেশে যুগে যুগে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম লৌকিক দেবতার কাছে হার মেনেছে।

তাই স্মার্ত রঘুনন্দনের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ও শরিয়তী ইসলামের নিষেধের বেড়া ভেঙে, জগৎ ও জীবনের রহস্যসন্ধানী বাঙালি নিজের মনের মতো পথ তৈরি করে নিয়েছে।

এজন্যেই এক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান একগুরুর দীক্ষা নিয়ে মনে মনে এক হতে পেরেছে। স্রষ্টার একটা সর্বজনীন রূপ দেওয়ার জন্যেই বাউলেরা অনামক অলখসইর সন্ধানী। এজন্যেই তারা সহজে বলতে পারে :

কালী কৃষ্ণ গড খোদা
কোনো নামে নাহি বাধা।
মন, কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।

.

ঙ.

পথের পার্থক্য মতের অনৈক্য এবং সাধন পদ্ধতির বিভিন্নতা সত্ত্বেও বাউল, বৈষ্ণব ও সূফীর মধ্যে উদ্দেশ্য লক্ষ্য ও পরিণামগত মিল বর্তমান। তাই একের বাণীতে অপরের মনের কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এক চরম ক্ষণে দেহাধারস্থিত আত্মায় পরমাত্মার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তখন পরমকে উপলব্ধির আনন্দে সবাই একই সুরে বলে আনল হক কিংবা সোহম। এই অদ্বৈতসিদ্ধি আমরা বাউলে বৈষ্ণবে সূফীতে প্রত্যক্ষ করি। রাগাত্মিকা ভক্তিতে শুনি মুই সেই সূফীরাও বলেন আনল হক বাউলও বলেন দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয়। বাউল যেমন বলেন

এই মানুষে আছেরে মন
যারে বলে মানুষ রতন।

অথবা

ক্ষেপা তুই না-জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়।
আপন ঘর না-বুঝে বাইরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়
আমি যেরূপ, দেখুনা সেরূপ দীন দয়াল।

কিংবা

ডুবে দেখ দেখি মন–তারে–কিরূপ লীলাময়
যারে আকাশ পাতাল খোঁজ এই দেহে তিনি রয়।
লামে আলিফ লুকায় যেমন মানুষে সাঁই আছে তেমন।
তা না হলে কি সব নূরের তন
আদম তনকে সেজদা জানায়।

অথবা,

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।

বা

কারে বলব কেবা করে বা প্রত্যয় —
আছে এ মানুষে সত্য নিত্য চিদানন্দময়।
আত্মা আর পরমাত্মা ভিন্ন ভেদ জেনো না।
এই মানুষে রঙ্গে রসে বিরাজ করেন সাঁই আমার ( পাঞ্জু)

কেননা রুমীও বলেন :

I gaged into my own heart, there I saw Him. He was nowhere else.

কিংবা,

I, All in All becoming
Now clear see God in All
Ends up from union yearning
take flight the cry of Love.

রবীন্দ্রনাথও বলেন :

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
(আমি) তাই হেরি তায় সকল খানে।
–ও তোরা আয়রে ধেয়ে দেখরে চেয়ে আমার বুকে
ওরে দেখরে আমার দু নয়নে।

কিংবা

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিল দেখতে আমি পাইনি
বাহির পানে চোখ মেলেছি হৃদয় পানে চাইনি।

অথবা,

আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না
এই জানারই সাথে সাথে তোমায় চেনা।

এমনি বোধেরই গাঢ়তায় জীবাত্মা-পরমাত্মার ব্যবধান ঘুচে যায়। ইরানের সূফীমত ও ভারতের বেদান্ততত্ত্ব বাঙলার মাটিতে বাউল বাণীতে প্রত্যক্ষ বিরাজ করে। সূফী বৈষ্ণবদের মতো গানের মাধ্যমেই বাউলদের সাধন ভজন চলে :

বীণার নামাজ তারে তারে, আমার নামাজ কণ্ঠে গাই।

.

চ.

বাউলেরা রাগপন্থী। কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। ইন্দ্রিয় নিরোধ, বিষয় ত্যাগ কিংবা বৈরাগ্য এদের লক্ষ্য নয়। তবু প্রাচীন ভারতিক ঐতিহ্য প্রভাবে মুনি, আজীবক, ভিক্ষু, সাধু, সন্ন্যাসী, বৈষ্ণব, বৈরাগী প্রভৃতির মতো বাউলেও ভিক্ষাজীবী বৈরাগী আছে। সে হিসেবে বাউল দুই প্রকার: গৃহী ও বৈরাগী। বর্তমানে এরা বহু উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত। হযরতী, গোবরাই, পাগল নাথী, খুশী বিশ্বাসী, সাহেব ধনী, জিকির, ফকির, বাউল, আউল, কৰ্তর্ভজা, সাঁই, ন্যাড়া, বলরামী, শম্বুচাদী, রামবল্লভী প্রভৃতি নাম থেকে তাদের সম্প্রদায়ের প্রবর্তকের নাম ও সাধনপন্থার আভাস পাওয়া যায়। এদের সম্প্রদায়ের গুরুপরম্পরার ও ধর্ম-দর্শনের কোনো নির্ধারিত ইতিহাস বা শাস্ত্রগ্রন্থ নেই। তাই এসব মতের উন্মেষ, বিকাশ ও পরিণতির খবর পাওয়া দুষ্কর। বিশেষ করে বাউলেরা প্রায় অশিক্ষিত, তাদের শ্রুতি-স্মৃতির উপর তেমন নির্ভর করা চলে না। বাউল সাধনার মর্মকথা বাউল কবির ভাষায় এরূপ :

সখি গো জন্মমৃত্য যাহার নাই।
তাহার সঙ্গে প্রেম গো চাই।

এবং —

উপাসনা নাইগো তার
দেহের সাধন সর্বসার
তীর্থব্রত যার জন্য–
এ দেহে তার সব মিলে।

বাউল কবিদের মধ্যে : লালন শাহ, শেখ মদন, গঙ্গারাম, পাগলা কানাই, পাঞ্জু শাহ পদ্মলোচন ( পোদো) জাদু, দুদু, পাঁচু, চণ্ডী গোঁসাই, রশীদ, হাউড়ে গোঁসাই গোলাম গোঁসাই, চণ্ডীদাস গোঁসাই,ফুলবাসুদ্দিন, ঈশান, বাখেরা শাহ, এরফান শাহ, সৈয়দ শাহ নূর, মিয়া ধন, শীতলাঙ শাহ, আতর চাঁদ, তিনু, শ্রীনাথ, শেখ কিনু প্রভৃতি জনপ্রিয়।

বাউল গানের অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর রচনায় বাউল প্রভাবও কম নয়। তাঁর। ভাষাতেই আলোচনা শেষ করছি : বাউল গান) থেকে স্বদেশের চিত্তের একটা ঐতিহাসিক পরিচয় পাওয়া যায়। এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই। একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এ মিলনে গান জেগেছে। এ গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলছে। কোরানে পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।

বাঙলা সাহিত্যের উপক্রমণিকা

০১.

পাক-ভারত বর্ণ-সঙ্কর জাতি অধ্যুষিত দেশ। গ্রীক শক হুন কুশান তুর্কী মুঘল ও ইংরেজ জাতির আগমন ও বসবাস তো ঐতিহাসিক ব্যাপার। তারও আগে যারা এদেশে এসেছিল তাদের মধ্যে দ্রাবিড় আর্য নিগ্রো অস্ট্রিক মঙ্গোলীয়দের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়াও আরো কত জাতি এদেশে বিজয়ীর বেশে এসেছে–সে খবর কারুর জানা নেই সত্য, কিন্তু অনুমান করা যায় পাক ভারত চিরকাল বিদেশী বিজিত দেশই ছিল।

ভাগ্যের সে এক পরিহাস। এদেশে যারাই যখন এসেছে কিছুকাল পরে তারা বীর্যহীন হয়ে পড়েছে ফলে বিদেশ থেকে নতুন নতুন জাতি এসে তাদের উপর আধিপত্য করেছে। এটি হয়তো এদেশের আবহাওয়ারই প্রতিক্রিয়া।

আসল কথা, কোনো জাতির চারিত্রিক বিকৃতি না ঘটলে তার পতন হয় না। এ বিকৃতির দরুন যখন সমাজে, ধর্মে ও রাষ্ট্রে বিপর্যয় ঘটে, অর্থাৎ দেশের বেশির ভাগ লোক নীতিবোধ হারিয়ে ফেলে; ন্যায়নিষ্ঠা ও সততা প্রভৃতির প্রতি শ্রদ্ধাহীন হয়ে পড়ে; মহৎ ও বৃহতের সাধনায় পরাজুখ হয়; তখন তার পতন অনিবার্য হয়ে উঠে।

পুরাকালের কোনো খবর ইতিহাস দিতে পারে না। কিন্তু মধ্যযুগে কোনো কোনো ব্যাপারে আমরা এ বিপর্যয়ের আভাস পাচ্ছি। মধ্যযুগে বিদেশী বহু দরবেশ ও প্রচারক এদেশে ধর্মপ্রচার করতে আসেন। তাদের অনুচররূপে আসে নানা মন ও মতের বহুলোক। এদেশের সমাজ ও শাসন সম্বন্ধে কৌতূহলী লোকেরও অভাব ছিল না এদের মধ্যে। রাজনীতি সচেতন স্বদেশপ্রাণ ও স্বজাতি-বৎসল কেউ কেউ হয়তো এদেশের দণ্ডশক্তির দৌর্বল্যের খবর দিয়ে স্বজাতি-স্বদেশীকে এদেশ জয়ে উদ্বুদ্ধ করেছে অন্তত আজকাল ঐতিহাসিকেরা তাই অনুমান করেন।

এ অনুমানের সপক্ষে অন্তত কিছু তথ্যের আকস্মিক যোগাযোগও রয়েছে। হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতির আগমনের পর মুসলমানদের দিল্লী রাজ্য দখল বাবা আদমের আগমনে সোনারগাঁ জয়, শাহজালাল ও বদর আল্লামাহর খানকা করার পরে যথাক্রমে শ্রীহট্ট ও চট্টগ্রাম বিজয় প্রভৃতি ঐতিহাসিকের অনুমানের পরিপোষক। এভাবেই ইংরেজ ফরাসির রাজ্যলাভ তো একরকম চোখে দেখা সত্য। অবশ্য দরবেশ- প্রচারকদের উপর এসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কেউ আরোপ করে না।

ইতিহাস-আশ্রয়ী ঘটনার কথাই বলি। য়ুরোপীয় বেনেরা এল বাণিজ্য করতে। এদেশের আদর্শচ্যুত নির্বোধ দণ্ডধরদের দুর্বলতা টের পেয়ে শুরু করল লুটপাট আর জনগণের উপর উৎপীড়ন। বাধা না পেয়ে বেড়ে গেল তাদের সাহস ও লোভ। আর বেনেবৃত্তি একসময় রাজশক্তিতে রূপান্তরিত হল। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পলাশী আর অর্ধভারতের ভাগ্যবিধাতা দুর্ধর্ষ মারাঠাগণ। কিন্তু তাদের সঙ্-শক্তি ছিল না। তাই ছিদ্রপথ নদী হয়ে দেখা দিল, সাতসাগরের ওপারের কুমির এসে জুড়ে বসল। এমনি-ই হয়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে এদেশে ক্ষাত্রধর্মের অনুকূল পরিবেশ নেই। তাই শক হুন দল পাঠান মুঘল শক্তি একই পথে লোপ পেল।

.

০২.

এজন্যেই পাক-ভারত সঙ্কর জাতির দেশ। বাঙলা দেশের পক্ষে এ-কথা আরো খাঁটি। আদিকাল থেকে এদেশে নানা বর্ণের ও গোত্রের লোকের বাস। পুণ্ড সুহ্ম বঙ্গ গৌড় রাঢ় প্রভৃতি যে গোত্রবাচক শব্দ তা বিশ্বাস করবার কারণ রয়েছে। এগারো-বারো শতকের সংস্কৃত পুরাণগুলোতে এদের বহুবচনের রূপ পাওয়া যাচ্ছে : গৌড়াঃ বঙ্গাঃ রাঢ়াঃ প্রভৃতি। এতে বোঝা যায় এক-একগোষ্ঠী বা গোত্রের বসতি-অঞ্চল বাসেন্দাদেরই গোত্রীয় নামে পরিচিত হত। *

অস্ট্রিক আলপাইন পামিরীয় দ্রাবিড় আর্য নিগ্রো মঙ্গোলীয় প্রভৃতি জাতির সমবায়ে আধুনিক বাঙালি জাতির উদ্ভব। সাত শতকের গোড়ার দিকে বোধহয় শশাঙ্কের নেতৃত্বে প্রথম বঙ্গ-গৌড় রাজ্য গড়ে ওঠে। চর্যাপদে বঙ্গ–এর সঙ্গে আল ও আলী প্রত্যয় যোগে বঙ্গাল ও বঙ্গালী শব্দ চালু হয় দেশ ও জাতি অর্থে। ঐতরেয় আরণ্যকেও ( আ. ৫ম শতক) বঙ্গ শব্দ দেশ বা জাতি অর্থে পাওয়া যায়। চর্যাপদে আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী বা অদঅ বঙ্গাল দেশ লুড়িউ আর সর্বানন্দের অমর কোষে (১১৫৯ খৃ.) বঙ্গাল বচ্চার শব্দ পাচ্ছি। নিত্যাহ্নিকতিলকে (লিপিকাল ১৩৯৫ খৃ.) বঙ্গিদেশ ব্যবহৃত হয়েছে। মুঘল আমলেই কেবল গৌড়- বঙ্গাদি অঞ্চল সুবা-ই বঙ্গাল নামে আখ্যাত হয়। ফলে কয়েকশ বছরের অব্যবহারে অন্য নামগুলো অপরিচিত হয়ে উঠল, আর বঙ্গ নামটি গোটা সুবার জন্য ব্যবহৃত হতে থাকল। কাজেই বঙ্গ নামের প্রাচীনতা চর্যাপদ ও ঐতরেয় আরণ্যকের প্রাচীনতার ও প্রামাণিকতার উপর নির্ভর করে।

কোল ভীল ওরাও মুণ্ডা সাঁওতাল দ্রাবিড় চাকমা নাগা কুকী আর্য শক হুন তুর্কী মুঘল আরবি ইরানি হাবসী প্রভৃতি দুনিয়ার নানা গোষ্ঠী, গোত্র ও জাতির সমবায়ে উদ্ভূত আধুনিক বাঙালি জাতির মধ্যে তাই বিচিত্র আচার-সংস্কার, মননধারা, চারিত্রিক বৃত্তি প্রবৃত্তি ও রুচি-সংস্কৃতির আভাস আজো দুর্লভ নয়। দেহাকৃতিগত বৈচিত্র্যও কি কম!

[*মহাভারতেও আমাদের অনুমানের সমর্থন রয়েছে। মহাভারতোক্ত কাহিনী এরূপ : বলিরাজার মহিষী সুদেষ্ণা নিঃসন্তান ছিলেন। স্ত্রী-পুত্র কর্তৃক বিতাড়িত জন্মান্ধ মহর্ষি দীর্ঘতমাকে রাজা স্বীয় মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভে ধর্মার্থকুশল পুত্র উৎপাদন করিতে অনুরোধ করিলেন তদনুসারে মহর্ষি দীর্ঘতমার ঔরসে বলিরাজ-মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভে অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ, পুণ্ড ও সুহ্ম নামে পাঁচ পুত্র জন্মে। দীর্ঘতমা সুদেষ্ণাকে বর দিয়াছিলেন  তোমার পুত্রগণের অধিকৃতরাজ্যসমূহ তাহাদের নামে খ্যাত হইবে।]

.

০৩.

আমাদের দেশে আর্য ছাড়া আর সব গোত্রীয় মানুষই অনার্য–এই সাধারণ নামে পরিচিত। সংস্কারবশত আমরা অনার্য বলতে অসভ্যই বুঝে থাকি, যেন অনার্য অসভ্য–এর প্রতিশব্দ। দেশের পুরোনো ইতিহাসের যেসব উপাদান পাওয়া যাচ্ছে তাদের সবগুলোই আর্য ভাষায় ও আর্য প্রভাবে লিখিত বা উক্ত। তাই ঋগ্বেদের আমল থেকে আজ পর্যন্ত অনার্যদের সম্বন্ধে যা-কিছু বলা হয়েছে তা নিন্দা ও অবজ্ঞাসূচক। অনার্যেরা বিজেতার গৌরব-গর্বী আর্যদের কাছে মানুষ নামের যোগ্যও ছিল না। এজন্যই বিভিন্ন গোত্রের অনার্যেরা আর্যসমাজে দস্যু, রাক্ষস, যক্ষ, নাগ, পক্ষী, কুকুর, দৈত্য প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। অবশ্য আদিতে এগুলো ছিল টোটেম নামে। কিন্তু আর্যেরা ব্যবহার করেছে অবজ্ঞার্থে। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ, রাক্ষসকুলে রাবণ, নাগকুলে বাসুকী জরকারু, যক্ষকুলে কুবের প্রভৃতির কাহিনী আমরা পাচ্ছি। মহাভারত ও পুরাণাদিতে অনার্যদের সম্বন্ধে নানা উদ্ভট কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। অথচ এই যুগে আমরা জানতে পারছি কোনো কোনো অনার্য গোত্র বিশেষত দ্রাবিড়েরা আর্যদের চেয়েও সভ্য ও উন্নত ছিল। তার প্রমাণ কেবল ময়েঞ্জোদারো, হরপ্পা ও কোটদিজির আবিক্রিয়ায় নয়–আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষভাবে পাচ্ছি। ঋগ্বেদের আলোকে উত্তরকালের আর্যশাস্ত্রগ্রন্থগুলো যাচাই করলে আমরা দেখতে পাব, সেখানে শুধু যে অনার্য দেব-দেবীরাই ভিড় জমিয়েছে তা নয়-জ্ঞান ও ভক্তিবাদ, যোগ আর সাখ্যদর্শনও গড়ে উঠেছে যা একান্তভাবে অনার্য প্রভাব প্রসূত।

মহাভারতে বর্ণিত ময় দানবের কৌরবের সভা সাজানোর কাহিনীটি অনার্যশিল্প ও সভ্যতার উৎকর্ষের আভাস দিচ্ছে। ভক্তিবাদের উদ্গাতা শুক, নারদ, প্রহাদ ও ব্যাসদেব অনার্য রক্তসস্তৃত। নবঘনশ্যাম কৃষ্ণ আর নব দূর্বাদল শ্যাম রামও হয়তো অনার্যের রক্তে ঋণী। নারী দেবতা এবং শিব বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতা একান্তভাবেই অনার্য। দৈবকী, বাসুদেব,শিব, উমা উভূতি অনার্য নাম। আর্য দেবতা প্রকৃতির প্রতীক। কিন্তু অনার্য দেবতা গুণ ও ভাবকল্পের প্রতিমূর্তি। এভাবে আমরা নানা সূত্রে আর্যদের উপর অনার্যদের সাংস্কৃতিক বিজয়ের আভাস ও পরোক্ষ প্রমাণ পাচ্ছি। প্রতিমাপূজা, বৃক্ষ, পশু, পক্ষী ও নারী দেবতার পূজা, অবতারবাদ, জন্মান্তরবাদ, মন্দিরোপাসনা, যোগ, তন্ত্র ও সাংখ্যদর্শন, ধ্যান, সন্ন্যাস এবং ভূত, যক্ষ প্রভৃতি অপদেবতার পূজা প্রভৃতি অনার্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসূন।

আর্যরা বিজয়ী হিসেবেই বিদেশ থেকে এসেছে। কাজেই তাদের সংখ্যা বেশি হবার নয়। আমরা অনুমান করতে পারি আর্য বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এদেশের উচ্চবিত্তের ও আভিজাত্যের লোকগুলো আর্যসমাজে মিশে গিয়েছিল। নুইলে দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড়েরা উচ্চবর্ণের আর্যশ্রেণীভুক্ত হল কী করে? আর্যদের বসবাসের সাথে সাথেই উত্তরভারত আর্যাবর্তে পরিণত হল। ব্রহ্মাবর্ত, কুরুক্ষেত্র, মৎস্য, পাঞ্চাল, শূরসেন প্রভৃতি অঞ্চল এর অন্তর্ভুক্ত। দক্ষিণভারতে সামীয় দ্রাবিড় আজো রয়ে গেছে। এদিকে মগধ পেরিয়ে বহুকাল অবধি আর্যেরা আধুনিক বাঙলা দেশের খবর নেয়নি। এই পাণ্ডববর্জিত দেশ সম্বন্ধে আর্যদের যেমন অবজ্ঞার ভাব ছিল, তেমনি এর সম্বন্ধে নানা অদ্ভুত ধারণাও তারা পোষণ করত। এভাবে কতকাল কেটেছে জানা যায় না, তবে গৌড়বঙ্গাদি অঞ্চলে যে বর্বর-প্রায় গোত্রগুলোর বসতি ছিল, তার আভাসও জৈন আর ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থাদিতে পাওয়া যাচ্ছে।

.

০৪.

অনেককাল অবধি আর্য-অনার্যের রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই চলেছিল এও অনুমান করা কষ্টকর নয়। বিভিন্ন অঞ্চলের অনার্য রাক্ষস, নাগ, দৈত্য প্রভৃতি গোত্রশক্তিকে রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক রণে পরাজিত ও পর্যদস্ত করে চিরদাসে পরিণত করতে বা এদের উচ্চবিত্তের লোকগুলোকে আর্যসমাজভুক্ত করে নিতে আর্যদের সময় লেগেছিল অনেক। যারা বশ্যতা স্বীকার করেনি, তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরে গিয়ে কিংবা বনে-জঙ্গলে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছে। যেসব বিত্তহীন অজ্ঞ মানুষ আর্যসমাজে দাসরূপে ঠাই পেল তারা কিরূপ উৎপীড়িত হত ও অবজ্ঞা পেত, তার চিত্র মনু, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতির ব্রাহ্মণ্য সংহিতার পাতিগুলো থেকে পাওয়া যায়। আর্যেরা সম্ভবত বহুকাল ধরে প্রবল প্রতাপে শাসন চালিয়ে যায়। এমনি করে একসময় যখন বিজেতা-বিজিতের স্মৃতি গণমন থেকে মুছে গেল অথচ বেশির ভাগ অনার্য সমাজে হীনবর্ণরূপে লাঞ্ছিত, অবজ্ঞাত ও উৎপীড়িত হচ্ছিল তখন জৈব নিয়মেই সেকালের প্রথামতো ধর্মবিপ্লবের আবরণে সমাজ-বিপ্লব দেখা দিল। এ বিপ্লবের সার্থক নেতা বর্ধমান মহাবীর ও গৌতমবুদ্ধ। গৌতম-পূর্ব বহু বোধিসত্ত্বের এবং জৈনদের মহাবীর-পূর্ব তেইশজন তীর্থঙ্করের উল্লেখ থেকেই বোঝা যাচ্ছে অসন্তোষ ও বিদ্রোহ অনেক আগে থেকেই দানা বেঁধে উঠছিল, সাফল্য আসে তথা পূর্ণ রূপায়ণ সম্ভব হয় মহাবীর ও গৌতমের নেতৃত্বে। এই দেব-দ্বিজ-বেদদ্বেষী বিপ্লবীদ্বয়ের অনুশাসন থেকে সহজেই অনুমান করা যায় ব্রাহ্মণ্য দৌরাত্ম্য সমাজদেহ কিরূপ বিষাক্ত করে তুলেছিল। তারা দুজনেই প্রচলিত ধর্ম-দর্শন তথা সমাজব্যবস্থা অস্বীকার করলেন। যাগ-যজ্ঞ, ক্রিয়া-কাণ্ড, বর্ণাশ্রম ও ব্রাহ্মণ মাহাত্ম্য এক কথায় তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি প্রভৃতি সবকিছুরই বিলোপ সাধনে ব্রতী হলেন। মানুষের দুঃখ ঘুচাতে গিয়ে মানুষের প্রাণ ও আত্মার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে ব্ৰতী হয়ে তারা সর্বজীবের জীবনের মর্যাদা ও মাহাত্ম প্রচারে এগিয়ে এলেন। এতবড় কথা এর আগে আর কোথাও কেউ বলেননি। সাম্য, মৈত্রী ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বাণীবাহক মানবতার এই মহাসাধকগণ সেদিন কোটি কোটি নিপীড়িত নরনারীকে ( দেবী পূজার যুগেও আর্যসমাজে নারীর প্রতি কোনো শ্রদ্ধা ছিল না,শূদ্রের চেয়ে নারীর মর্যাদা বেশি ছিল না।) সম্প্রদায়- বিশেষের খামখেয়ালি অত্যাচার থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। আর্য-অনার্যের বিভেদ উঠে গেল- ইতর ভদ্রের ব্যবধান ঘুচে গেল। সাধারণের বুলি অভিজাত ভাষার আসনও কেড়ে নিল। নিম্নবর্ণের নর-নারী নতুন ধর্মচ্ছায়ায় ও সমাজাশয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাচল। (উচ্চবর্ণের খুব কম লোকই জৈন-বৌদ্ধ ধর্ম বরণ করেছিল)।

এই বিদ্রোহ বিপ্লবের লক্ষণটা আরো পষ্ট করে বলা দরকার: দেবতার নাম করে বামুনেরা শোষণ ও পেষণ করত। গৌতম দেবপূজা অস্বীকার করলেন–আত্মা-নরক-পিণ্ড প্রভৃতির ব্যাপারে নিরীহ লোকদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করে পীড়ন করা হয়। তাই বুদ্ধ বললেন–সব মিথ্যে। বর্ণাশ্রম দুষ্ট সমাজে ভয়ঙ্কর বিভীষিকা দেখা দিল। তাই প্রচারিত হল সাম্যবাদ। দেব ও দ্বিজের দৌরাত্ম্য অসহ্য হয়ে উঠল–তাই দেব-দ্বিজ পূজা অস্বীকৃত হল। সংস্কৃতে ব্রাহ্মণেতর শ্রেণীর অধিকার ছিল না–তাই গণভাষা পালি ও প্রাকৃত মর্যাদা পেল। বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদকে অনার্য অভ্যুত্থান বলেও আখ্যাত করা যেতে পারে। গৌতম জন্মেছিলেন অনার্য-অধ্যুষিত নেপালের তরাই অঞ্চলের কপিলবাস্তুতে। তিব্বতী ভোটচীনা লিম্বীরা ছিল তাঁর মাতৃকুল। মহাবীরও ছিলেন অনার্য-অধ্যুষিত তথা আর্যাবর্ত বহির্ভূত অঞ্চল-সদ্ভূত।

যে- দেবতাকে নিজের সুখ-দুঃখের কথা নিজমুখে নিবেদন করা চলে না, যে, ধর্মের ক্রিয়াকাণ্ড নিজের আচরণ-সাধ্য নয়, যে-ধর্মের বাণী নিজমুখে উচ্চারণ ও নিজ কানে শ্রবণ সম্ভব নয়, তার সঙ্গে কারো আত্মিকযোগ থাকার কথা নয়। একারণে লোকেরও কোনো অন্ধসংস্কারের বন্ধন ছিল না। তাই ভারতময় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সহজেই প্রচারিত হতে পেরেছিল।

আর্য-অনার্যের বিভেদ যখন ঘুচে গেল, তখন দেশ বা মানুষ অবিশেষের কাছে বুদ্ধ-মহাবীরের বাণী পৌঁছিয়ে দেবার পক্ষে কোনো বাধা রইল না। এ সময়েই প্রথম জৈন ওবৌদ্ধ ভিক্ষুগণ মগধের সীমা অতিক্রম করে রাঢ়ে-পুণ্ডে তথা আধুনিক বাঙলাদেশে নবধর্ম প্রচারের জন্যে উপস্থিত হলেন। এদেশের বর্বর-প্রায় জনগণের মধ্যে আর্যভাষা ও সংস্কৃতির আবরণে এই দ্রোহী-ধর্ম অর্থাৎ জৈন বৌদ্ধ মতবাদ প্রচারিত হল। এদের লিপি ছিল না, সাহিত্যের শালীন ভাষা ছিল না, উঁচুমানের সংস্কৃতি ছিল না; তাই আর্যধর্মের (নামত অবশ্য) সঙ্গে আর্যভাষা আর সংস্কৃতিও তাদের বরণ করে নিতে হল। এভাবে বাঙলাদেশে অল্পকালের মধ্যে আর্যধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসার লাভ করল এবং এসঙ্গে কিছুসংখ্যক তথাকথিত আর্যও এদেশে প্রচার উপলক্ষে বসবাস করতে শুরু করেছিল বলে অনুমান করতে বাধা নেই।

.

০৫.

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মান্দোলনকে আমরা অনার্য অভ্যুত্থানও যে বলতে পারি তার পক্ষে কিছু তথ্য আছে। মেঘাস্থিনিসের বিবরণে দস্যু সর্দারের রাজ্যলাভ এবং নাপিতপুত্ররূপে ঘৃণিত নৃপতির কথা আছে। রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন–শূদ্রগণ অনার্য বংশ সম্ভুত।… .. শিশুনাগ বংশীয় মহানন্দের শূদ্ৰাপত্নীর গর্ভজাত পুত্র ভারতের সমস্ত ক্ষত্রিয়কুল নির্মূল করিয়া একচ্ছত্র সম্রাট হইয়াছিলেন। … … মগধে শূদ্রবংশের অভ্যুত্থান ও আর্যাবর্ত পুনর্বার নিঃক্ষত্রিয় করণের প্রকৃত অর্থ বোধহয় যে, এই সময়ে বিজিত অনার্যগণ অবসর পাইয়া পুনরায় মস্তকোত্তোলন করিয়াছিলেন এবং মহাপদ্মনন্দের সাহায্যে ক্ষত্রিয় রাজকুল নির্মূল করিয়ছিলেন। মহাপদ্মনন্দের পূর্বে ভারতবর্ষে কোনো কোনো রাজা সমগ্র আর্যাবর্ত অধিকার করিয়া একরাট পদবী লাভ করিতে পারেন নাই।

রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্তে যদি ত্রুটিও থাকে, তবু আমরা বলতে পারি মহানন্দ, চন্দ্রগুপ্ত কিংবা অশোক–এ তিনজনের যে-কোনো একজনের নেতৃত্বে অনার্য অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। রাজবংশী প্রভৃতি কৈবর্ত শূদ্রগণও একসময় আর্য শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। গৌতমবুদ্ধের দেব-দ্বিজ ও বেদদ্রোহিতা এতই তীব্র ছিল যে নির্বাণকালে তিনি নাকি সংস্কৃত-চর্চা করতে নিষেধ করে যান। মহাভারতে আর্য-অনার্যের যুদ্ধ-বিগ্রহের বহু কাহিনী আছে। বাসুকীর বিদ্রোহ, বৃত্রের দেবতাতাড়ন, রাবণের সীতাহরণ প্রহাদের আর্যধর্ম গ্রহণ, রামের হরধনু ভঙ্গকরণ, রামের পাদস্পর্শে অহল্যার প্রাণলাভ-অগস্ত্যের দাক্ষিণাত্য যাত্রা প্রভৃতি আর্য-অনার্যের সংঘর্ষ ও মিলনের কাহিনী। ব্যাস, বশিষ্ট, নারদ, সত্যকাম, শুকদেব প্রভৃতির জন্ম অনার্যার গর্ভে। আর্যেরা যে অনার্য সুন্দরীদের ধর্ষণ করত এগুলো তারও নজির।

.

০৬.

মনে করা যাক, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রচারিত হওয়ার আগে বাঙলাদেশে আর্য-প্রভাব পড়েনি। কিন্তু দেশে মানুষ ছিল অথচ তাদের ভাষা ছিল না, সুখ-দুঃখের গান বা গাথা ছিল না, ছড়া ছিল না, বচন ছিল না কিংবা ধর্মসঞ্জাত সংস্কার ছিল না–এমন হতেই পারে না। কাজেই মেনে নিতে হয় যে, আর্যপূর্ব যুগে এদেশে কোনো একটি সর্বজনীন ভাষা কিংবা গোত্রীয় ভাষাগুলো চালু ছিল। জৈন-বৌদ্ধ ধর্ম বরণ করে নিয়ে তারা নিজেদের ভাষা ত্যাগ করে উন্নত আর্যভাষা গ্রহণ করে। এর সঙ্গে তাদের বিশিষ্ট সংস্কৃতির ও বস্তুর নির্দেশক কিছু কিছু শব্দ ও বাগ্বিধি আর্যভাষার (সম্ভবত মাগধী প্রাকৃত) সঙ্গে মিশে গেল। কোনো জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি অপরিণত থাকলে সেগুলোকে উন্নততর ভাষা ও সংস্কৃতির চাপে পড়ে অপমৃত্যু বরণ করতে হয়। সবক্ষেত্রে না হলেও কোনো কোনো অবস্থায় এ বিপদ এড়ানো যায় না। বাঙলা সেদিন এই শেষোক্ত অবস্থায় পড়েছিল। কোনো ভাষা সেকালে কোনো ধর্মবিপ্লবের বাহন হলে তার বিকাশ দ্রুততর হত একালে যেমন হয় রাষ্ট্রভাষা কিংবা কোনো মতবাদের বাহন হলে। এর প্রসারও হত কারণ কোনো ভাষা কোনো ধর্মবিপ্লবের বাহন হলে তার প্রভাব এড়ানো সে-ধর্মে দীক্ষিত জাতির পক্ষে অসম্ভব। এবং যে, কোনো ভাষার প্রসার নতুন ভাব-চিন্তা ও নতুন বস্তু ভিত্তিক। জৈন ধর্ম নয়–বৌদ্ধমতবাদই বাঙলাদেশে বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছিল। যারা এ মতবাদ গ্রহণ করতে পারেনি, তারা আত্মরক্ষা কিংবা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবার জন্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথা বনে-জঙ্গলে পালিয়ে যায়। এজন্যেই আজো কোল, ভীল, মুণ্ডা, কুকী, লেপচা, ভুটিয়া প্রভৃতি নিজেদের ভাষা ও বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে দেখতে পাই। এসব ভাষাকেই সম্ভবত আর্য-মঞ্জুশ্রীমূলকল্পে (৮ম শতক খৃ.) অসুরভাষা বলে উল্লেখ করা হয়েছে : অসুরানাং ভবেৎ বাঁচা গৌড়-পুন্ড্রোদ্ভবা সদা। কিংবা ঐতরেয় আরণ্যকে বায়াংসির বুলি বলে নিন্দিত হয়েছে।

.

০৭.

ব্রাহ্মণ্য-উৎপীড়ন থেকে নিষ্কৃতির উপায়রূপে জনগণ বৌদ্ধ ও জৈনমত উৎসাহের সাথে গ্রহণ করলেও প্রথম উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উভয় ধর্মে নানা বিকৃতি দেখা দিল। কারণ এ দুটো ধর্মের শিক্ষা ও অনুশাসন জৈব ধর্মের এতই প্রতিকূল যে তা প্রাত্যহিক জীবনে আচরণসাধ্য নয়। সাধারণভাবে মানুষের জীবনে সাধনা হচ্ছে ধন- জন-মানের সাধনা। অন্তরের অভাব ও অতৃপ্তিবোধই আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং কর্ম প্রেরণারূপে প্রকাশিত হয়, ভোগেচ্ছাবিহীন জীবন সাধারণ মানুষের কল্পনাতীত। অথচ বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের মূল কথা বৈরাগ্য–তৃষ্ণাবিহীন জীবন সাধনা অর্থাৎ ব্যবহারিক জীবনকে পঙ্গু ও অথর্ব করে তোলা। তাই বৌদ্ধধর্মের বিকৃতি ও বৌদ্ধদের নৈতিক চারিত্রিক দৌর্বল্যের সুযোগে শঙ্করাচার্য প্রমুখের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ্য শক্তি আবার সুপ্রতিষ্ঠিত হল।

বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য সংঘর্ষে দেদার হত্যাকাণ্ড, বহু অত্যাচার ও নানা উৎপীড়ন যে হয়েছিল, তার প্রমাণ সে-যুগের পুঁথিপত্রে নানা সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন শঙ্কর বিজয়ে আছে: দুষ্টমতাবলম্বিনঃ জৈনান অসংখ্যাতান অনেক বিদ্যাপ্রসঙ্গে নির্জিত্য তেষাং শীর্ষাণি পরশুভিশ্চিত্ত্ব বহু উদুখলেষু নিক্ষিপ্য কটভ্রমণে স্ফুর্ণীকৃত চৈবং দুষ্টমত ধ্বংসম আচরণ নির্ভয়ো বৰ্ততে। (অর্থাৎ: অসংখ্য দুষ্টমতাবলম্বী বৌদ্ধ ও জৈন রাজ্যমুখদিগকে অনেক বিদ্যাপ্রসঙ্গে নির্জিত করিয়া তাহাদের মাথা কুঠার দ্বারা ছিন্ন করে, অনেক উদূখল নিক্ষেপ করে, মুষল দ্বারা চুর্ণ করে, এইরূপ দুষ্টমত ধ্বংস আচরণ করে তিনি নির্ভয় থাকতেন।) এই ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বে বৌদ্ধগণ নির্মূল হয়ে গেল। তাদের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি প্রভৃতিও বৌদ্ধদ্বেষী নবজাগ্রত ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায় কর্তৃক হয়তো বহুলাংশে বিনষ্ট হয়েছিল।

বাঙলাদেশের কথায় আসা যাক। বাঙালিরা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করল সত্য কিন্তু ধর্মের অনুশাসনের সাথে জনগণের আন্তর যোগ ছিল না, তাই নিরীশ্বর নৈরাত্ম বৌদ্ধ চৈত্যগুলো ক্রমে বহুদেবতা ও উপদেবতার মন্দিরে পরিণত হল। হীনযান, মহাযান, সহজযান বজ্রযান, প্রভৃতি নানা মতাদর্শ ও সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হল। কারণ সুখে-দুঃখে সুদিনে-দুর্দিনে স্বস্তি ও প্রবোধ পাবার জন্যে একটি মহাশক্তিকে অবলম্বন স্বরূপ পাওয়া চাই। নইলে ভরসা কী? বাঙলার পাল-রাজগণ বৌদ্ধ ছিলেন। তাই তাঁদের সময়ে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম নামত টিকে ছিল। সেন-রাজগণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁদের প্রতিকূলতায় বাংলাদেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। তৎসঙ্গে বৌদ্ধযুগের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিও বিলুপ্ত হল। বাঙলাদেশে কোনোকালে যে বৌদ্ধ ম ও সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব ছিল তা অনুমান করবার সামান্য উপাদান পর্যন্ত অবশিষ্ট রইল না। এতেই বোঝা যায় কী অসামান্য উগ্রতা নিয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মধ্বজীগণ বৌদ্ধদের ধর্ম, সংস্কৃতি তথা বৌদ্ধজাতিকে ধ্বংস করেছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গেও জনসাধারণের বিশ্বাস সংস্কারের যোগ নিবিড় ছিল না। রাজধর্ম বলে সেন বংশীয় শাসনকালে ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুসৃত হলেও আসলে ধর্মগ্রন্থ, মন্দির, দেবতা প্রভৃতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ও সম্পর্ক ব্রাহ্মণের মারফত হত বলে তা কখনো অকৃত্রিম হয়ে উঠেনি। তাই বাঙলাদেশে মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে (সেন রাজবংশের পতনযুগেই এর সূচনা) রাজরোষ ভয়মুক্ত জনসাধারণ স্ব স্ব বিশ্বাস সংস্কার দিয়ে নিজেদের ইষ্ট দেবতা সৃষ্টি করল। এটাই বাঙলাদেশে ও সাহিত্যে লৌকিক ধর্মান্দোলন। মনসা, চণ্ডী, ধর্মঠাকুর, নাথপন্থ প্রভৃতি দেবতার ও মতের সৃষ্টি হল। এইগুলো মূলত বৌদ্ধ-হিন্দু প্রভাবিত অনার্য ধর্ম অবশ্য। এতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাব প্রচুর। এ প্রভাব পড়ে প্রধানত রামায়ণ অথবা মহাভারত ও পুরাণের মাধ্যমে।

এসব লৌকিক দেবতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন– এক কালে পুরুষ দেবতা যিনি ছিলেন তাঁর বিশেষ কোনো উদ্রব ছিল না। খামকা মেয়ে-দেবতা জোর করে এসে বায়না ধরলেন আমার পূজা চাই। অর্থাৎ যে জায়গায় আমার দখল নেই, সে জায়গা আমি দখল করবই। তোমার দলিল কী? গায়ের জোর। কী উপায়ে দখল করবে? যে উপায়ে হোক। তারপর যে সকল উপায় দেখা গেল মানুষের সদবুদ্ধিতে তাকে সদুপায় বলে না। কিন্তু পরিণামে এই সকল উপায়েরই জয় হোলো। ছলনা, অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতা কেবল যে মন্দির দখল করল তা নয়, কবিদের দিয়ে মন্দিরা বাজিয়ে চামর দুলিয়ে আপন জয়গান গাইয়ে নিলে। রবীন্দ্রনাথের এ মন্তব্য একটু কঠোর। আসলে সমাজের যে, স্তরের লোক দ্বারা এসব লৌকিক দেবতা পরিকল্পিত, প্রতিষ্ঠিত ও পূজিত তাদের বিদ্যাবুদ্ধি ও রুচিসংস্কৃতি কোনোকালেই উঁচু ছিল না। যে পরিবেশ ও শিক্ষা পেলে মানুষের মন ও মননের বিকাশ ও প্রসার হয় তা চিরকাল এদের কাছে রুদ্ধ ছিল। তাই এদের অপরিণত মন-বুদ্ধি-বোধিরই নগ্নরূপ ধরা দিয়েছে দেবতার শক্তি ও ঐশ্বর্য পরিকল্পনায়।

মঙ্গল কাব্যের উদ্ভবের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :… তখন সমাজের মধ্যে যে উপদ্রব-পীড়ন, আকস্মিক উৎপাত, যে অন্যায়, যে অনিশ্চয়তা ছিল মঙ্গলকাব্য তাহাকেই দেবমর্যাদা দিয়া সমস্ত দুঃখ অবমাননাকে ভীষণদেবতার অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছার সহিত সংযুক্ত করিয়া কথঞ্চিৎ সান্ত্বনা লাভ করিতেছিল এবং দুঃখক্লেশকে ভাঙ্গাইয়া ভক্তির স্বর্ণমুদ্রা গড়িতেছিল। এই চেষ্টা কারাগারের মধ্যে কিছু আনন্দ-কিছু সান্ত্বনা আনে বটে কিন্তু কারাগারকে প্রাসাদ করিয়া তুলিতে পারে না। এই চেষ্টা সাহিত্যকে তাহার বিশেষ দেশকালের বাহিরে লইয়া যাইতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ মুসলমান বিজয় ও তজ্জনিত অত্যাচারকেই লৌকিক দেবতা ও তাদের মাহাত্মজ্ঞাপক কাব্য সৃষ্টির জন্য দায়ী করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই সিদ্ধান্ত যথার্থ নয়। কারণ খ্রস্টীয় এগারো বারো শতকে অর্থাৎ সেন-রাজত্বের শেষের দিকে রচিত সংস্কৃত পুরাণগুলোতে এসব লৌকিক দেবতার উল্লেখ দেখা যাচ্ছে। বরং বাঙলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাসে আশুতোষ ভট্টচার্য (১ম সংস্করণ) যা বলেছেন তা অনেকটা সমীচীন বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন : সেন রাজাদিগের সময় হইতেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতি সাধারণের মধ্যে বিস্তৃত হইতেছিল সত্য কিন্তু এত কালের একটা দেশীয় ধর্ম-সংস্কৃতিও-যাহা জাতির একেবারে মজ্জাগত হইয়া পড়িয়াছিল মুখ্যত না হউক গৌণত হইলেও এই সমাজদেহেই রহিয়া গেল। সেকালের বাঙ্গালী হিন্দুর সামাজিক জীবনের এই সন্ধিযুগে, দেশীয় প্রাচীন সংস্কার ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের নূতন আদর্শ এই উভয়ের সংঘাত মুহূর্তে বাংলা পুরাণ বা মঙ্গলকাব্যগুলি সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল।.. তাহারা (বাঙালি হিন্দুগণ) নূতনকে (ব্রাহ্মণ্যধর্মকে) যেভাবে গ্রহণ করিল তাহা পুরাতনেরই রূপান্তর মাত্র হইল; এই দেশীয় প্রচলিত ধর্ম-সংস্কারই যুগোচিত পরিমার্জনা মাত্র লাভ করিয়া সমাজের অন্তঃ স্থলে প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজ করিতে লাগিল। মঙ্গল কাব্যগুলি এই নূতন ও পুরাতনের মধ্যে সুন্দর সামঞ্জস্য বিধান করিয়া দিয়া পরস্পর বিপরীতমুখী দুইটি সংস্কারকে এক সূত্রে গাঁথিয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছে। বাংলার জলবায়ুতে দেশীয় লৌকিক সংস্কারের সহিত ব্রাহ্মণ্য সংস্কার যে কীভাবে একদেহে লীন হইয়া আছে মঙ্গল কাব্যগুলি পাঠ করিলে তাহাই জানিতে পারা যায়। … তাহারই ফলে বর্তমান বাঙলার হিন্দুসমাজে পঞ্চোপাসক হিন্দু সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। সুতরাং ড. সুকুমার সেনের উক্তি যথার্থ বলে গৃহীত হতে পারে না। তিনি বলেছেন : মুসলমান অভিযান যে আলোড়ন ও বিক্ষোভ জাগাইয়া তুলিল কথাগুলো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মুসলমান বিজয় ও তারপরে কিছুকাল বাঙলার রাজনৈতিক সামাজিক অবস্থা কিরূপ ছিল তা সংক্ষেপে আলোচনা করে দেখা যাক।

.

০৮.

১২০২-৪ খ্রীস্টাব্দের কোনো সময়ে বখতিয়ার খলজী নদীয়া অধিকার করেছিলেন সত্য কিন্তু গোটা বাঙলাদেশ জয় করা বহুঁকালাবধি তুর্কীদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। লক্ষ্মণ সেনের বংশধরগণ এবং অপরাপর সামন্তগণ মধ্য ও পূর্ব বাঙলায় অনেককাল স্বাধিকার বজায় রেখেছিলেন। সুতরাং ড. দীনেশ সেন ড. সুকুমার সেন বা অন্যান্য হিন্দু ঐতিহাসিকগণ দুশ আড়াইশ বছর যাবৎ বাঙলাদেশে মুসলমানগণ অত্যাচার ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে বলে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা সত্য নয়।

লক্ষ্মণ সেনের আমলে বাঙালির নৈতিক দৌর্বল্য, চারিত্রিক বিকৃতি ও সামাজিক শৈথিল্য দেখা দিয়েছিল। এর বহু প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। হলায়ুধ মিশ্রের শেখ শুভোদয়া জয়দেবের গীতগোবিন্দ শূন্য পুরাণ বা ধর্ম পূজাবিধানের নিরঞ্জনের রম্মা প্রভৃতিতে এর আভাস আছে। গীতগোবিন্দে আধ্যাত্মিকতা সন্ধান করা বাতুলতা মাত্র কারণ এতে তা নেই। বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্য উৎপীড়নের রেশ তখনো ছিল। রাজধর্মে ও ক্ষাত্রশক্তিতেও শিথিলতা এসেছিল। মন্ত্রতন্ত্র প্রভৃতি আধিদৈবিক শক্তির উপর একান্ত নির্ভরতা এ যুগের প্রাসাদ ও কুটিরবাসীর চিত্তদৌর্বল্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

সেন আমলের রণনীতির একটু নমুনা :

তুকতাকের উপর বিশ্বাস সেকালে রাজশক্তিরও যে কতটা দৃঢ় ছিল তার একটু নিদর্শন দিচ্ছি সেকালের একটি তথাকথিত রণনীতির বই থেকে। শত্রুসৈন্য যদি চারিদিক থেকে ঘিরে দাঁড়ায় তখন কী কৰ্তব্য সে সম্বন্ধে বইটিতে অনেক রকম বিধান আছে। তার মধ্যে একটি বলছি। শ্মশানের ছাই কয়েকটি বিশেষবিশেষ গাছের ছাল ও মূলের সঙ্গে বেটে ভূর্যের গায়ে ভালো করে মাখিয়ে এই মন্ত্র পড়ে বাজাতে হবে,

ওং অং হং হালিয়া হে মহেলি বিহঞ্জহি সাহিনেহি।
মশানেহি খাহি লুঞ্চহি কিলি কিলি কালি হুংকট স্বাহা।

আর শ্বেত অপরাজিতার মূল ধুতুরাপাতার রসে বেটে নিজের কপালে তিলক এঁকে সর্বঞ্জোদয় মন্ত্রজপ করতে হবে। তাহলে সেই সূর্যের শব্দ শুনে ভবতি পরচক্রভঙ্গঃ স্বসৈন্য বিজয়। (ড. সুকুমার সেন–মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালি)

দেশের দণ্ডশক্তির যখন এমনি অবস্থা তখন মুসলিমশক্তি দেশ শাসন ব্যাপারে বিশেষ বাধা পেয়েছিল বলে মনে হয় না। কাজেই ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালাবার কারণ ঘটেনি। বরং ড. সুকুমার সেনের অপর একটি উক্তি যথার্থ বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন : আমাদের দেশের চিন্তাধারার একটা সাধারণ সূত্র হচ্ছে সুখের মতো দুঃখকেও ঈশ্বরের অলঙ্ঘ্যবিধান বলে মেনে নেওয়া।…. তাই কিছুকাল পরে জনসাধারণ সহজেই মুসলমান বিজয়কে ঈশ্বরের মার বলে মেনে নিয়ে মনে সান্ত্বনা আনতে চেষ্টা করলে। (মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালি)

.

০৯.

মুসলমান অভিযানের সময় বিজেতা-বিজিতের দ্বন্দ্ব স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান ছিল। বিজেতাগণ প্রয়োজনের তাগিদে দেউলদেহারা ও দেশীয় সামন্তশক্তির উপর হামলা করতে যে বাধ্য হয়েছে তা অস্বীকার করবারও কারণ দেখি না। বিজেতাগণের উত্তম্মন্যতা ও বিজিতদের হীনমন্যতার দরুন পারস্পরিক সম্পর্ক যে কিছুকাল অবজ্ঞা ও বিদ্বেষদুষ্ট ছিল তাও সত্য। তুর্কী অভিযান তথা ভারতে মুসলমান বিজয় যে ধর্ম-সম্পৃক্ত নয় তা সবাই স্বীকার করেছে। সুতরাং শাসক বিশেষের অত্যাচার উৎপীড়ন জাতীয় কলঙ্করূপে চিত্রিত হওয়াও উচিত নয়। যেমন গণেশের পুত্র জালালউদ্দীন যে কয়জন ব্রাহ্মণকে জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করিয়েছিলেন, তা একান্তভাবেই তার ব্যক্তিগত আক্রোশবশে। ইসলাম বা মুসলমানের এর সঙ্গে কোনো যোগ ছিল না। ভারতে ইসলাম প্রচারে কোনো কোনো রাজশক্তির সহানুভূতি ছিল হয়তো। কিন্তু সহযোগিতা যে ছিল না তা অস্বীকার, করবার উপায় নেই। তুর্কী মুসলমানেরা রাজত্ব করতে এসেছিল ধর্ম প্রচার করতে নয়। অবশ্য মুসলমান বিজয়ের আনুষঙ্গিক ফল পরোক্ষভাবে ইসলাম প্রচারের সহায়ক হয়েছিল। বিদ্যাপতির কীর্তিলতায় এবং বৈষ্ণব গ্রন্থগুলোতে মুসলমান অত্যাচারের যেসব কথা বর্ণিত হয়েছে, তাদের সত্যতা স্বীকার করেও বলা যায় এসব অত্যাচার-উৎপীড়ন অহেতুক ছিল বলে বিশ্বাস করা উচিত নয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক যুগেও স্বদেশী সরকার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বজাতির উপর রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে রূঢ় ও কঠোর হতে বাধ্য হয়। বিরোধীদল একে অকারণ অত্যাচার-উৎপীড়ন বলে রটিয়ে থাকে। কে না জানে সকারণ শাস্তি চিরকালই শাস্তিভোগীর দ্বারা অকারণ উৎপীড়ন বলে বর্ণিত হয়? আত্মপক্ষ সমর্থন মানুষের সহজাত বৃত্তি। আবার কোনো কোনো মুসলমানের কাফেরদের প্রতি অবজ্ঞা, কাফের সম্বন্ধে ব্যক্তিগত দায়িত্বহীন উক্তি ও কার্য পুঁথিপত্রে বিস্তৃত থেকে গোটা মুসলমান জাতিরও কলঙ্কবাদী ঘোষণা করছে। বস্তুত ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধদের মধ্যে যেভাবে ধর্মীয় সংঘর্ষ হয়েছে এবং হবার কারণ ছিল, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সে কারণ থাকার কথা নয়। ওটাতে প্রতিবেশীসুলভ বহুকাল পোষিত আক্রাশের রেশ ছিল, এটাতে ছিল না। কেননা দীক্ষিত মুসলমানের বিরলতার দরুন মুসলমান তখনো হিন্দুর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী হয়ে উঠেনি। তখন কেবল বিদেশী প্রশাসক মুসলমান ও দেশী হিন্দুই ছিল–অনেকটা ইংরেজ শাসক ও ভারতীয় প্রজার মতো।

হিন্দু ও শাসক মুসলমানের বিরোধই সত্য ছিল, সম্প্রীতি মিলন কাহিনীই কি মিথ্যা? এ দেশে আসিয়া মুসলমান রাজারা সংস্কৃত হরফে মুদ্রা ও লিপি ছাপাইয়াছেন, বহু বাদশা হিন্দু মঠ মন্দিরের জন্য বহু দানপত্র দিয়াছেন। সেসব ঐতিহাসিক নজীর দিন দিনই নূতন করিয়া বাহির হইতেছে। (ক্ষিতি মোহন সেন)

তুর্কী রাজত্বের প্রথম যুগে রাষ্ট্রশক্তির স্থিরতা ছিল না। রাজা ও রাজপুরুষগণ নিজেদের মধ্যেই স্বার্থ ও অধিকার নিয়ে ষড়যন্ত্র, হানাহানি ও কাটাকাটিতে লিপ্ত ছিলেন। সুতরাং এ সময় দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না-থাকারই কথা। কিন্তু ইলিয়াস শাহী শাসনে দেশে যে স্থায়ী শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল তাতে সন্দেহ নেই। এ সময় থেকেই মুসলমান শাসকগণ দেশে। সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নে তৎপর হন। এ সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রক্তসম্পর্কস্থাপিত হতে থাকে। কোনো কোনো মুসলমানের ব্যক্তিগত লাম্পট্যে হিন্দু-রমণী ধর্ষণ যে চলেনি তা নয়, তবে এগুলো সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিজাত নয়–কামজ। সুন্দরীর প্রতি পুরুষসম্ভব আকর্ষণজাত।

শাসকগোষ্ঠী চিরকাল আলাদা একটা জাতি। তাঁদের স্বার্থ ও সুখের প্রেরণাতেই তাদের কর্মপ্রচেষ্টা। তা জনসাধারণের পক্ষে কখনও বিপদের কারণ হয়ে উঠে মাত্র। শাসকদের মধ্যে কেউ কেউ নরশ্রেষ্ঠ, আবার কেউ বা নরদানব। এসবই হচ্ছে ব্যক্তিগত চরিত্রনির্ভর ব্যাপার। কোনো বিশেষ জাতি বা গোত্রের সঙ্গে সুশাসন-কুশাসনের কার্য-কারণ সম্পর্ক সন্ধান নিতান্ত নিরর্থক। বাঙলার তথা ভারতের মুসলমান নৃপতিদের অনেকেই সুশাসক ছিলেন, নরদানবও ছিলেন কেউ কেউ। তাদের অনুগ্রহ-নিগ্রহ স্বজাতি-বিজাতি সমভাবে ভোগ করেছে। আস্তিক মানুষেরা কেবল স্বধর্মকেই সত্য বলে জানে। পরধর্মে আস্থার অভাবহেতু ধার্মিক মাত্রেই পরধর্মের প্রতি অবজ্ঞাপ্রবণ। কাজেই ধর্মের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা কখনো ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু তাই বলে বৈষয়িক ও রাজনীতিক ব্যাপারে হিন্দু-মুসলমান ভেদবুদ্ধি যে প্রবল ছিল তার প্রমাণ দুর্লভ। প্রতাপ-শিবাজীর মুসলমান অনুচর ছিল বহু। আওরঙজীবের হিন্দুসেনা ও সেনাপতির সংখ্যাও কি কম! তারপর যেসব সূত্রে আমরা বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্য অত্যাচার, হিন্দুর উপর মুসলমান উৎপীড়নের সংবাদ পাচ্ছি তাতে লেখকের ব্যক্তিগত মতাদর্শ নিশ্চয়ই রয়েছে। যেমন পাক-ভারতে সাম্প্রদায়িক বিরোধ যেমন আছে, তেমনি সম্প্রীতি ও শুভেচ্ছাও কম নয়। কিন্তু ব্যক্তিবিশেষে বিরোধের কথা ফলাও করে বেড়ায় আবার কেউ সম্প্রীতির কথা তুলে ধরে। অথচ সত্য থাকে এ দুয়ের মাঝখানে। ১২০০ থেকে ১৪৫০ পর্যন্ত আড়াইশ বছর যাবত মুসলমানগণ বাঙলা দেশে অত্যাচার ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালাবার ফলেই এ সময়ে বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি বলে ড. সুকুমার সেন প্রভৃতি যে সিদ্ধান্ত করেছেন তার অযৌক্তিকতা প্রদর্শন করবার জন্যেই আমাদের এত কথার অবতারণা করতে হল।

.

১০.

আমাদের ধারণা মুসলমান বিজয় ও তারপরের বাঙলার অবস্থা নিম্নরূপই ছিল ও মুসলমানদের বাঙলা অভিযানকালে তারা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে ধনরত্ন প্রাপ্তির আশায় এবং পলাতক শত্রুর সন্ধানে দেউলদেহারা আক্রমণ করেছে ও ভেঙেছে। বিজয়ী হয়ে এদেশের শাসনভার গ্রহণ করার পরে দেউলদেহারা ভাঙবার কোনো কারণ ছিল না। অবশ্য ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় অপরাধ বা আক্রোশবশে সামন্তশ্রেণীর কোনো কোনো হিন্দুর উপর দুর্ব্যবহার যে করতে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তেমন অত্যাচার থেকে মুসলমানও নিষ্কৃতি পায়নি। সাধারণ মুসলমানের উত্তম্মন্যতা ও সাধারণ হিন্দুর হীনমন্যতাজাত পারস্পরিক অবজ্ঞা ও বিদ্বেষ তাদেরকে কিছুকাল অনাত্মীয় করে রেখেছিল বলেও অনুমান করা যায়। কিন্তু হিন্দুদের উপর মুসলমানরা অত্যাচার করতে পারেনি। কারণ :

১. রাজ্যশাসনে ও রাজস্ব ব্যবস্থায় এমনকি সৈনাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। ( ড. সুকুমার সেন)। অধিকাংশ আফগানই তাহাদের জায়গীরগুলি ধনবান হিন্দুদের হাতে ছাড়িয়া দিতেন।… এই জায়গীরগুলির ইজারা সমস্তই ধনশালী হিন্দুরা লইতেন এবং ইহারাই ব্যবসায় বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভোগ করিতেন। (স্টুয়ার্টের বাঙলার ইতিহাস)

২. সাধারণ মুসলমানরা বিশেষ করে প্রচারক দরবেশরা চাইতেন এদেশে ইসলামধর্মের প্রচার ও প্রসার থোক। কাজেই ইসলামের মাহাত্ম্য ও মুসলিম জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর জন্যও সাধারণ মুসলমানকে সংযত হয়ে চলতে হয়েছে। বিশেষত গৌড়েই হযরত জালালউদ্দীন তাবরেজী, ও আলাউল হক, তাঁর পুত্র হযরত নূর-কুতবে আলম প্রভৃতি অবস্থান করতেন।

৩. গৌড়ের প্রথম দিককার সুলতান ও রাজপুরুষগণ নিজেদের মধ্যেই স্বার্থ ও ক্ষমতা নিয়ে ষড়যন্ত্র, হানাহানি ও মারামারিতে ব্যস্ত ছিলেন। এসময়ে হিন্দু প্রজাদের (যারা ছিল শতকরা প্রায় পঁচানব্বই জন) তাঁরা উৎপীড়ন দ্বারা উত্তেজিত হবার সুযোগ দিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। ধর্মান্তর ও বৈবাহিক সম্বন্ধের ফলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অতি অল্পকালের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। এরূপে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রতিবেশীসুলভ সম্প্রীতি স্থাপিত হওয়া সম্ভব। ইলিয়াসশাহী শাসনকালে দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি ছিল। গৌড়ের সুলতানের অধীনে হিন্দুরাও মুসলমানদের ন্যায় নিজেদের স্বাধীন জাতি বলে মনে করত। এজন্যেই মুঘলের বিরুদ্ধে বাঙলার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে তারা কখনো উদাসীন ছিল না। ধর্ম-ব্যাপারেও পারস্পরিক সহনশীলতার ভাব বিরাজ করত। বৃন্দাবন দাস বলেন–

হিন্দুকুলে কেহ যেন হইয়া ব্রাহ্মণ।
আপনে আসিয়া হয় ইচ্ছায় যবন ॥
হিন্দুরা কি করে তারে তার যেই কর্ম।
আপনে যে মৈল তারে মারিয়া কি ধর্ম ॥

এবং বৈষ্ণবদের হাতে অনেক মুসলমান স্বধর্ম স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

এই ইলিয়াসশাহী আমল থেকেই বাঙলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। কবিচক্রবর্তী, রাজপণ্ডিত, পণ্ডিতসার্বভৌম, কবিপতি ও চূড়ামণি মহাচার্য রায়মণি বৃহস্পতি মিশ্র এ সময়কার পরপর কয়েকজন সুলতানের দরবার অলংকৃত করেছিলেন। হোসেনশাহী আমল বাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনের সুবর্ণযুগ। এ সময়ে বাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনের নতুন অধ্যায় সূচিত হল। ধর্মে সাহিত্যে শিল্পে সংগীতে বাঙালির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য ফুটে উঠল। বাঙলার নিজস্ব সংস্কৃতি আর্য-সংস্কৃতিকে ম্লান করে দিয়ে মহিমার আসনে প্রতিষ্ঠিত হল। দীনেশ চন্দ্র সেন (বৃহত্বঙ্গ) বলেন–বাঙ্গালা দেশে পাঠান প্রাবাল্যের যুগ একবিষয়ে বাঙ্গলার ইতিহাসে সর্বপ্রধান যুগ। আশ্চর্যের বিষয় হিন্দু স্বাধীনতার সময়ে বঙ্গদেশের সভ্যতার যে শ্ৰী ফুটিয়াছিল, এই পরাধীন যুগে সেই শ্রী শতগুণে বাড়িয়া গিয়াছিল। … এই পাঠান যুগে সর্বপ্রথম হিন্দু সমাজে নূতন বিক্ষোভ দৃষ্ট হইল। জনসাধারণের মধ্যে শাস্ত্রগ্রন্থের অনুবাদ প্রচারিত হওয়াতে তাহারা গরুড়পক্ষী হইয়া ব্রাহ্মণের নিকট করজোড়ে থাকিতে দ্বিধাবোধ করিল। ব্রাহ্মণেরা বাধ্য হইয়া শাস্ত্রগ্রন্থ বাঙলায় প্রচার করিলেন। তাঁহারা ঘোর অনিচ্ছায় ইহা করিয়াছিলেন। এই অনুবাদকার্য সম্পন্ন করিয়া তাহারা শাস্ত্রের অনুবাদ ও শ্রোতাদিগের বাপান্ত করিয়া অভিশাপ দিতে লাগিলেন। অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানবঃ শ্ৰত্বা রৌরবং নরকংব্রজেৎ। একদিকে মুসলমান ধর্মের প্রভাব, অপর দিকে বাঙলা ভাষায় ধর্মপ্রচার– এই দুই কারণে বঙ্গীয় জনসাধারণের মন নবভাবে জাগ্রত হইল। শাসন ও রুচি হইতে মুক্ত হইয়া চিন্তাজগতে হিন্দুরা গণতান্ত্রিক হইয়া পড়িল। ব্রাহ্মণেরাও রাজ্যশাসন হইতে মুক্তি পাইয়া অবাধে স্বীয় মত সমাজে চালাইতে লাগিলেন। এই পাঠান-প্রধান্য যুগে চিন্তাজগতে সর্বত্র অভূতপূর্ব স্বাধীনতার খেলা দৃষ্ট হইল, এই স্বাধীনতার ফলে বাঙ্গালার প্রতিভার যেরূপ অদ্ভুত বিকাশ পাইয়াছিল, এদেশের ইতিহাসে অন্য কোনোও সময়ে দ্রুপ বিকাশ সচরাচর দেখা যায় নাই।

মিথিলার পণ্ডিত চক্ৰায়ুধের মৃত্যুর পর নবদ্বীপ ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রালোচনার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হয়ে উঠে। এখানে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এতই প্রবল হয়ে ওঠে যে, নবদ্বীপসম্ভব কোনো ব্রাহ্মণ বীর মুসলমানদের বিতাড়িত করে হিন্দু রাজত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করবে বলে গুজব রটে ফলে হোসেন শাহ চঞ্চল ও সতর্ক হয়ে ওঠেন এবং নবদ্বীপ অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ করেন। কিন্তু চৈতন্যদেবের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান হওয়ায় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের স্বপ্নসাধ ধসে গেল। রঘুনন্দন, রামনাথ ও রঘুনাথ শিরোমণি ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। ব্রাহ্মণ্য সংহতির প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই হয়তো রাজনৈতিক স্বার্থে হোসেন শাহ চৈতন্যের মত প্রচারে পরোক্ষ সহায়তা দান করেন।

.

১১.

ব্রাহ্মণ্য দৌরাত্ম্যের বাহন দেবভাষা সাধারণ বাঙালিকে বহুকাল মূক করে রেখেছিল। বাঙালি তার বুকের আশা মুখের ভাষায় বহুকাল প্রকাশ করতে পারেনি। সেন রাজাদের আমলে শূদ্রমাত্রেরই উচ্চশ্রেণীর লেখাপড়ার অধিকার কাড়িয়া লওয়া হইল।…. এই জনসাধারণ অজ্ঞ ও মূর্খ হইয়া রহিল। (দীনেশ সেন–বৃহৎ বঙ্গ)। ব্রাহ্মণ্য শাসনের অক্টোপাস থেকে ছাড়া পেয়ে বাঙালির যুগযুগান্তের সঞ্চিত রুদ্ধ আবেগ নানা ধারায় প্রকাশিত হয়ে বাঙালিকে আর্যপ্রভাব মুক্ত পৃথক জাতিরূপে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করল। এমন শুভযুগ বাঙালির জাতীয় জীবনে এর আগে বা পরে কোনোদিন আসেনি।

শেখ শুভোদয়া বা গীতগোবিন্দের ভাষা তো প্রসিদ্ধ গৌড়ীয় রীতির তুলনায় নিকৃষ্ট। শেখ শুভোদয়ার ভাষা তো বিশুদ্ধও নয়, তবু এঁরা দেশীভাষায় গ্রন্থ রচনা করতে সাহস পাননি দেবদ্বিজের ভয়ে। নাথপন্থীদের প্রচেষ্টা এখানে উল্লেখযোগ্য নয়, কারণ হিন্দু বাঙালির সমাজে তাদের কোনো প্রভাব ছিল না। সুতরাং একান্তভাবে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার ফলেই বাঙলা ভাষার পুষ্টি ও বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। শুধু কি তাই! মুসলমানেরা কেবল সাহিত্যের উৎসাহদাতা বা পাঠক ছিলেন না, সাহিত্য সৃষ্টিতেও হাত দিয়েছিলেন হিন্দুদের সাথেই। আর এ ব্যাপারে তাদের কোনো বাধাও ছিল না। বেশির ভাগ বাঙালি মুসলমান তো হিন্দু থেকেই ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে, কাজেই অনুকূল পরিবেশে তারা যে মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনায় উৎসাহবোধ করবে তাতে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।

.

১২.

তবু পণ্ডিত ও প্রতিভাবানদের কাছে এ ভাষা মধ্যযুগে কোনোদিন কদর পায়নি। তাঁরা সংস্কৃত ও ফারসিকেই স্ব স্ব অবদানে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছেন। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের যারা সেবা করেছেন তাঁদের প্রতিভা খুব উঁচুদরের ছিল না। তাই কৃত্তিবাস, মুকুন্দরাম প্রভৃতি যতই পাণ্ডিত্যাভিমান দেখান না কেন–আলাউল, দৌলতকাজী, ভারতচন্দ্র, ঘনরাম যত বড় প্রতিভার পরিচয় দিন না। কেন–কেউই সমসাময়িক সংস্কৃত বা ফারসি সাহিত্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট রচনা রেখে যেতে পারেননি। বাঙলা সাহিত্যের পাঠকদের মতো অধিকাংশ লেখকও যে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না তা নিশ্চিতভাবে বলা চলে। এ জন্যেই চারশ বছর ধরে অনুশীলিত হয়েও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য আশানুরূপ ঋদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি। যদিও এসব রচনা রূপকল্পে না হোক, রসকল্পে তথা মননভঙ্গির স্বাতন্ত্রে বাঙলার সংস্কৃতির কিছু রূপান্তর ঘটিয়েছিল।

কোনো জাতির মুখের বুলিও যে সাহিত্য সৃষ্টির বাহন হতে পারে তা অসামান্য প্রতিভা ছাড়া কারুর মনে জাগেও না। তাই বাঙলায় হিন্দুদের সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস ছিল না, জনগণের মধ্যে লৌকিক দেবতার পূজাপ্রচারের আগ্রহ ও গরজই তাদেরকে বাঙলা লেখায় প্রবর্তনা দিয়েছে। এজন্যেই হিন্দুর হাতে আমরা নিছক সাহিত্য-শিল্প পাইনি। গোড়া থেকেই কিন্তু মুসলমানরা এ কাজে হাত দেন। বাঙলার মাধ্যমে ধর্মকথা শোনানোর সাথে সাথে উত্তরভারতীয় ও ইরানী রস কথাও শোনানোর ব্যাপারে তারা উদ্যোগী হলেন। আধুনিক পাক-ভারতীয় ভাষার মধ্যে সম্ভবত বাঙলা ভাষাতেই প্রথম রোমান্স রচিত হয়। এ কৃতিত্ব ইউসুফ জোলেখা রচয়িতা শাহ মুহম্মদ সগীরের (১৩৮৯-১৪০৯ খৃ.)। কিন্তু এ প্রয়াস দেখা দেয় সেকালের মুষ্টিমেয় কয়জনের মধ্যে মাত্র। জনসাধারণ তাদের দিকে চেয়ে বসে ছিল না। তাদের সাহিত্যের ভাষা না থাক, মুখের বুলি ছিল। আরো ছিল জৈব-রস পিপাসা ও হৃদয়-নিঃসৃত বক্তব্য। তাই শিল্প সৃষ্টির মহৎ আদর্শে নয়, বক্তব্য প্রকাশেরই জৈব-প্রয়োজনে তাদের নিজ নিজ আঞ্চলিক বুলিতে অঞ্চলবাসীর উদ্দেশে গান গাথা ছড়া বচন রূপকথা ও রসবার্তা তৈরি করে তারা মুখে মুখে প্রচার করতে থাকে। এগুলোই আমাদের আধুনিক সংজ্ঞায় লোক সাহিত্য বা পল্লী সাহিত্য। বহু মুখের স্পর্শে এগুলো রূপ ও রস বদলেছে, তাই এসব ব্যক্তিক রচনা আর নেই। এ কারণেই গুলোকে গণ রচনা বলে নির্দেশ করা হচ্ছে আজকাল। দেশের লেখ্যভাষায় রচিত নয় বলে এসব রচনা কোনোকালেই অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে দেশময় ব্যাপ্ত হতে পারেনি। আগেই বলেছি পল্লী সাহিত্য সাহিত্য সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস প্রসূত নয়। অনুভূতির আন্তরিকতা ও গভীরতাই এগুলোকে সাহিত্যের স্তরে উন্নীত করেছে, আর আজকাল মর্যাদা পাচ্ছে সাহিত্য হিসেবে। আমাদের মঙ্গলকাব্যও বলেছি দেবতার মাহাত্ম্য প্রচার প্রয়াসের ফল। তবু আনুষঙ্গিক ভাবে তাতে সাহিত্যরস ও সাহিত্যশিল্প গড়ে উঠেছে। তাই ওগুলোও সাহিত্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

অতএব অন্যান্য দেশের বুলি যেমন ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের মাধ্যম রূপে বা গেঁয়োলোকের ভাব-ভাবনা ও অনুভূতি-উপলব্ধি প্রকাশের বাহনরূপে ক্রমে সাহিত্যের শালীন ভাষায় উন্নীত হয়েছে, আমাদের বাঙলা বুলির সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরের ইতিহাসও সেরূপ। এর জন্মতারিখ জানা নেই, তবে এর জন্মপদ্ধতি ও জন্মের ইতিকথা আঁচ করা যায় সহজেই।

এবার যে-বাঙালি এ সাহিত্য সৃষ্টি করেছে তাদের মন-মননের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করা যাক। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি বুঝবার জন্যে বাঙালিকে তথা বাঙালির চরিত্র জানা আবশ্যক। কেননা, জীবের বিশেষত মানুষের কর্ম ও আচরণে তার আন্তর সত্তার ( Innerself) নিবিড়তম প্রকাশ ঘটে। মানুষের কর্ম ও আচরণ তার অভিপ্রায়েরই বহিঃপ্রকাশ। আর অভিপ্রায় হচ্ছে মন-মনন প্রসূত। এবং ব্যক্তির বা জাতির মন-মনন গড়ে উঠে তার Heredity (জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বৃত্তি-প্রবৃত্তি) ও environment-কে (পরিবেশ) ভিত্তি করে। যেহেতু মানুষের কর্ম ও আচরণ তার ভাব-চিন্তা ও অনুভূতি উপলব্ধিরই প্রতিমূর্তি এবং যেহেতু ভাষা-সাহিত্যও জাতির কর্ম ও আচরণের অন্তর্গত, সেহেতু ভাষা ও সাহিত্য ব্যক্তি বা জাতির মানস-সন্তান-মানস ফসল। আবার আমরা এও জানি প্রত্যেক ক্রিয়ারই কারণ রয়েছে, তেমনি সব কারণেরই ক্রিয়া আছে। কিন্তু ক্রিয়ার কারণ একাধিক হতে পারে। যেমন কোথাও যদি আমরা দূর থেকে দেখি যে আমাদের অপরিচিত একটি ছেলে অপর একটি ছেলের পিঠে একটি ঘুষি বসিয়ে দিল তাহলে এ ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না। কেননা এর তিনটি কারণ থাকতে পারে। এক. হয়তো এরা বন্ধু, রসিকতাচ্ছলে একে অপরকে ঘুষি মারল; দুই. হয়তো ঘুষি খাওয়া ছেলেটি আগে ওকে চটিয়েছে তাই ও প্রতিশোধ নিল; তিন. হয়তো ঘুষিদাতা ছেলেটি অন্য একটি ঘটনার বর্ণনাচ্ছলে ঘুষিটি কোথায় কেমন করে দেয়া হয়েছিল তারই বাস্তব দৃষ্টান্ত দিচ্ছে। কাজেই ঘটনার বিশ্লেষণে ও বিচারে পূর্বইতিহাস জানা আবশ্যিক। কারণ আমরা জানি ব্যক্তিকে না জানলে তার কর্ম ও আচরণের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তার ফলে ব্যক্তির কর্ম ও আচরণের গুরুত্ব লঘুত্ব ও যাথার্থ্য বিচারেও ভুল হয়। যাকে সত্যবাদী বলে জানি, সে একটা প্রায় অসম্ভব কথা বললেও পূর্বধারণাবশে বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয়; আর মিথ্যাবাদীর মুখের সত্যকথাও যাচাই না করে প্রত্যয় করা সম্ভব হয় না। কাজেই বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি তথা স্বরূপ জানতে হলে বাঙালির চরিত্রও জানা দরকার। আর চরিত্র জানতে হলে অতীতে-ঘটা পৌনঃপুনিক ক্রিয়া ও আচরণের সাধারণ লক্ষণ বিচারেই তা সম্ভব।

আগেই বলেছি, বাঙালি সঙ্কর জাতি। নানা গোত্রের রক্তের মিশ্রণের ফলে বিভিন্ন চারিত্রিক উপাদানের বিচিত্র সমন্বয় ঘটেছে তাদের জীবনে। এর ফলে বাঙালি চরিত্রে নানা বিরুদ্ধগুণের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। ভাবপ্রবণতা ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি, ভোগলিপ্সা ও বৈরাগ্য, কর্মকুণ্ঠা ও উচ্চাভিলাষ, ভীরুতা ও অদম্যতা, স্বার্থপরতা ও আদর্শবাদ, বন্ধনভীরুতা ও কাঙালপনা প্রভৃতি ও দ্বান্দ্বিক গুণই বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।

বাঙালি ভাবপ্রবণ ও কল্পনাপ্রিয়। উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনাতেই এর প্রকাশ। তাই বাঙালি যখন কাঁদে তখন কেঁদে ভাসায়। আর যখন হাসে তখন সে দাঁত বের করেই হাসে। যখন উত্তেজিত হয় তখন আগুন জ্বালায়। তার সবকিছুই মাত্রাতিরিক্ত। তার অনুভূতি-ফলে অভিভূতি–গভীর। কেঁদে ভাসানো, হেসে লুটানো আর আগুন জ্বালানো আছে বটে কিন্তু কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী নয় যেহেতু উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা মাত্রেই তাৎক্ষণিক ও ক্ষণজীবী। বাঙালির গীতিপ্রবণতার উৎস এখানেই।

কালো পিঁপড়ের মতো বাঙালি অতিচালাক। তাই সে ধূর্ততা যত জানে সুবুদ্ধির সুপ্রয়োগ তত জানে না, ফলে আত্মরক্ষা ও স্বার্থপরতার হীন প্রয়োগে তার তীক্ষ্ণবুদ্ধি কলুষিত হয়, আত্মপ্রতিষ্ঠার মহৎ প্রয়াসে প্রযুক্ত হয় না। তাই তার সঙ্শক্তি নেই ব্যবহারিক জীবনের উন্নয়নে বুদ্ধির অবদান গ্রহণে সে অক্ষম।

ভাবপ্রবণ বলেই বাঙালি মুখে আদর্শবাদী ও বৈরাগধর্মী। কিন্তু প্রবৃত্তিতে সে একান্তভাবে অধ্যাত্মবাদীর ভাষায় বস্তুবাদী গণভাষায় জীবনবাদী এবং নীতিবিদের ভাষায় ভোগবাদী। এজন্যে বাঙলাদেশে জীবনবাদ বা ভোগবাদ অধ্যাত্মচিন্তার উপর বারবার জয়ী হয়েছে। নৈরাত্ম ও নিরীশ্বরবাদী এবং নির্বাণকামী বৌদ্ধধর্ম বাঙালি মুখে স্বীকার করে নিয়েছিল মাত্র, সেজন্যেই তার অন্তরের জীবনসাধনা ধর্মের উপর জয়ী হল তাই বৌদ্ধচৈত্য হল দেব-দেবীর আখড়া। নির্বাণের নয়—-জীবনের ও জীবিকার আরাম ও বিলাসের দেবতারূপে পূজিত হলেন তারা। পারত্রিক নির্বাণ নয়, ঐহিক ভোগই হল কাম্য। যেহেতু বাঙালি কর্মকুণ্ঠ তাই পৌরুষের দ্বারা আত্মপ্রতিষ্ঠা বা জীবনোপভোগের প্রয়াস তাদের ছিল না। মহাজ্ঞান, তুকতাক, ডাকিনীযযাগিনী প্রভৃতির দ্বারা সিসম ফাঁক আয়ত্ত করে খিড়কিদ্বার দিয়ে জীবনের ভোগ্যসম্পদ আহরণের অপপ্রয়াসই তাদের কর্মাদর্শ বা জীবনের লক্ষ্য হল। পালদের আমল এমনি করেই কাটল। আবার সেন আমলে যখন শঙ্করাচার্যের শিষ্য উপশিষ্যেরা সেন-রাজশক্তির সহায়তায় এদেশে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রবর্তন করেন তখন বাঙালি বাহ্যত ব্রাহ্মণ্য মতবাদ গ্রহণ করে নিল কিন্তু হৃদয়ে জিইয়ে রাখল তার জীবন-বিলাসের আকাঙ্ক্ষা। তাই মায়াবাদ পরব্রহ্মপ্রীতি, জীবাত্মা, পরমাত্মার রহস্য প্রভৃতিতে তার কোনো উৎসাহ ছিল না। শুধু তাই নয়, এতে সে হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাই নিজের জীবনের নিরাপত্তা ও ভোগের দেবতা সৃষ্টি করে সে আশ্বস্ত হয়। এভাবে চণ্ডী (অন্নদা, দুর্গা), মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী, শনি, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি দেবতার পূজা দিয়ে সে জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়। এসব দেবতা তার পারলৌকিক মুক্তির কিংবা আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জীবন উন্নয়নের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন না। একই কারণে ইসলামোত্তর যুগে বিশেষত মুঘল আমলে বাঙলা দেশে হিন্দুর পুরোনো দেবতাকে ও ইসলামের নির্দেশকে ছাপিয়ে উঠেন সত্যপীর-সত্যনারায়ণ, বনবিবি-বনদেবী, কালুগাজী-কালুরায়, বড়খা গাজী-দক্ষিণ রায়, ওলাবিবি-শীতলা প্রভৃতি জীবন ও জীবিকার ইষ্ট দেবতা। অতএব কোনো বৃহৎ ও মহতের সাধনা সাধারণ বাঙালির কোনোকালেই ছিল না। সে একান্তভাবে জীবনসেবী ও ভোগবাদী। এ ব্যাপারে সে আত্মা-পরমাত্মাকে তুচ্ছ জেনেছে,স্বর্গ-নরককে করেছে অবহেলা। বৈষ্ণব সমাজের বিকৃতিও এই একই মানসের ফল। যেখানেই সে ভোগের সামগ্রী দেখেছে, সেখানে তার লুব্ধচিত্ত কাঙাল হয়েছে। পৌরুষ তার ছিল না। ভীরুতা ও কর্মকুণ্ঠা তার মজ্জাগত। তাই জীবন ধারণের প্রয়োজনে দেব-নির্ভর তথা অপ্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃত শক্তি ও উপায় খোঁজাই ছিল তার আদর্শ। তবে লোভের তীব্রতায় এবং ত্রস্ত জীবনের মমতায় কখনো কখনো সে ক্ষণকালের জন্যে মরিয়া হয়ে বিরুদ্ধশক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে নেমেছে, সে সাহস দেখিয়েছে। কিন্তু জৈব-ধর্মবিরোধী নির্জলা অধ্যাত্মচিন্তা তাকে প্রলুব্ধ করেনি। সে আদর্শবাদের বন্ধনভীরু এবং জীবন-সাধনায় ও ভোগে অদম্য।

বাঙলার বাঙালির যা গৌরব-গর্বের অবদান, তা সব সময়েই ছিল ব্যক্তিক অবদান, সামগ্রিক জীবনে তা কৃচিৎ ফলপ্রসূ হয়েছে তাই। বাঙালি মহৎ পুরুষদের মহা অবদানের ফলভোগে ধন্য হতে পারেনি তারা। এই বাঙলা দেশেই চিরকাল নতুন চিন্তা জন্ম নিয়েছে। কিন্তু লালন পেয়েছে সামান্য। তবু যখন আমরা স্মরণ করি এই মাটির বুকেই এই মানুষের মনোভূমেই উপ্ত হয়েছিল বজ্রযান সহজযান, কালচক্রযান, কায়াবাদ, নবন্যায় নবস্মৃতি, নবপ্রেমবাদ ওহাবী-ফরায়েজী মতবাদ কিংবা ব্রাহ্মদর্শন; তখন গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠে। আবার যখন স্মরণ করি মীননাথ, গোরক্ষনাথ, দীপঙ্কর, শীলভদ্র, জীমূতবাহন রামনাথ রঘুনাথ চৈতন্যদেব রামমোহন ঈশ্বরচন্দ্র তীতুমীর শরীয়তুল্লাহ দুদু মিয়া রবীন্দ্রনাথ নজরুল এদেশেরই সন্তান; তখনো নতুন করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই।

আমাদের মধ্যযুগীয় পাঁচালি সাহিত্যে বাঙালির এই চারিত্র– এই মানসই ফুটে উঠেছে। আমাদের সাহিত্যে তাই ইষ্টদেবতাই প্রধান হয়ে উঠেছে। কারণ তিনি জীবন-জীবিকার অবলম্বন। তবু তার প্রাণপ্রাচুর্যের লক্ষণ ফুটে উঠেছে তার স্বধর্মে সুস্থিরতায়। বহিরাগত কোনো ধর্মই সে মনেপ্রাণে বরণ করে নেয়নি। এ স্বাতন্ত্র্য ও অনমনীয়তা একালে ক্ষেত্রবিশেষে তার মর্যাদা বাড়িয়েছে।

বিদ্যা ও বিশ্বাস

বিদ্বানেরা বলেন, আদিতে মানুষ ছিল অরণ্যচর ও পর্বতবাসী। ফল, মূল ও মাংস ছিল তাদের খাদ্য। ক্রমে তাদের বুদ্ধির বিকাশ হয়। বুদ্ধি ও কর্মশক্তির প্রয়োগে মানুষ জীবিকা-পদ্ধতির উন্নয়ন, খাদ্যবস্তুর উৎকর্ষ এবং নিবাসের রূপান্তর সাধন করে।

ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনবোধের প্রেরণায় তারা অনবরত সন্ধান, পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ চালিয়ে ক্রমে ক্রমে আগুন, পাথর, ধাতু প্রভৃতি আবিষ্কার করে আর উপযোগ-বুদ্ধি প্রয়োগে এগুলোকে নানাভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। এভাবে তাদের অস্ত্র হল, শাস্ত্র হল, ঘরদোর হল, গরু ঘোড়া-গাধা-মোষ-উট প্রভৃতিকে তারা পুষতে শিখল এবং বাহনও করল। চাকা বানাল, নৌকা ভাসাল, গরু-ঘোড়া-গাধা-মোষ-হাতির গাড়িও চালু হল। বত্রিশব্যঞ্জনে খেতে শিখল, বিচিত্র পোশাকে সাজতে জানল, ধাতব গয়না বানাতে পারল। কাঠ-পাথর, পোড়ামাটি দিয়ে ঘরও তৈরি করল, চাষ করে কত ফসল তুলল, ফুল-ফলের উদ্যানও রচল। এমনি করে সৃষ্টি ও নির্মাণে তারা প্রাণিজগতের ত্রাস ও প্রকৃতি-জগতের প্রভু হয়ে উঠল। আর করল জরু, জমি ও জেবর নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি, মারামারি ও হানাহানি। সমাজ গড়ল, দেব-দৈত্য পূজল, রাজ্য গড়ল। ভেতরে ভেতরে রীতি-নীতি-রেওয়াজ, আইন-কানুন-শাসন, ন্যায়-অন্যায়-সত্য, পাপ-পুণ্য-মিথ্যা, বিচার ক্ষমা-শাস্তি, দয়া-দাক্ষিণ্য-সাহায্য প্রভৃতি কত কত কথা, ভাব, তত্ত্ব, তথ্য, বিশ্বাস, সংস্কার, স্মৃতি, ভয়, ভরসা প্রভৃতির অদৃশ্য বন্ধনে বদ্ধ হয়ে নিশ্চিন্ত জীবন-জীবিকার নিশ্চিত অঙ্গীকারে আশ্বস্ত হতে চেয়েছে মানুষ। বিজ্ঞানের বলে আজ মানুষ মাটি ও আকাশের প্রভু। জ্ঞান তার পরিণতির পথে। বিজ্ঞান তার জগজ্জয়ে উৎসুক।

মানুষের এই ক্রমবিকাশের ধারা বর্ণনাকালে বিদ্বানেরা এতে কোনো দেব-দৈত্যের ভূমিকা স্বীকার করেন না। মানুষের আত্মোন্নয়নের ও আত্মপ্রসারের প্রয়াসে দেবতার সহায়তা কিংবা দৈত্যের প্রতিকূলতার কথা বিদ্বানেরা অবগত নন। বিদ্বানদের সবাই নাস্তিকও নন। তবু তারা উত্তরকালের মানুষের শ্রেষ্ঠত্বই স্বীকার করেন। কিন্তু শাস্ত্রকারেরা বলেন যে গোড়া থেকেই ভূত-ভগবান, দেব দৈত্য, প্রেত-পিশাচ, জিন-পরি ফিরিস্তা-শয়তান প্রভৃতি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে মানুষের সহায়তা ও বিরোধিতা করে আসছে। মিত্রশক্তির পোষণে ও অরিশক্তির পেষণে মানুষ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও লাভ-ক্ষতি পেয়ে ও সয়ে সংখ্যায় ও সামর্থ্যে বেড়ে উঠেছে। কলিতে দেব-দৈত্যের প্রত্যক্ষ ভূমিকা সমাপ্ত। পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট। নবী-ঋষির কালও অপগত। তাঁদের বাণী দেশ কাল নিরপেক্ষ চির-মানবের দিশারী।

আশ্চর্য এই দুই বিপরীত তত্ত্বে ও তথ্যে– বিদ্যায় ও বিশ্বাসে আমরা বিরোধ স্বীকার করিনে। কাজ চালানো গোছের একটা আপোশ, একটা সন্ধি –একটা সহঅবস্থান নীতি কেমন যেন অবচেতন প্রয়োজন-প্রেরণায় আপনা থেকেই গড়ে উঠেছে। তাই পাঠ্য বইতে ও বিদ্বানের আলোচনায় শাস্ত্র অবহেলিত। আবার শাস্ত্রীয় আলোচনায় ইতিহাসের তথ্য অস্বীকৃত। পাঠক কিংবা শ্রোতারা ঘরে-সংসারে, মন্দিরে-মসজিদে শাস্ত্র মানে। আর ইস্কুলে-কলেজে ও সভায় ইতিহাসকে যথার্থ বলে গ্রহণ করে। বিদ্যায় ও বিশ্বাসে এই দ্বন্দ্ব, জ্ঞানে ও প্রত্যয়ে এই বিবাদ যেন ক্রীড়াসুলভ প্রতিপক্ষতা। বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতির ক্ষেত্রে এই অদ্ভুত আপোশ একালে সর্বত্র সুরক্ষিত। শাস্ত্রকারেরা কিংবা ধর্ম-বিশ্বাসীরা কেন যে এই অশাস্ত্রীয় অতএব মিথ্যা-বিদ্যা নিজেদের ও নিজেদের সন্তানের জন্যে কামনা করে তা বোঝা সহজ নয়। সেই গেলেলিও-ব্রুনো কপার্নিকাসের পর থেকে তারা উদার ও সহিষ্ণু হয়ে উঠেছে এ কি তাদের পর-চিন্তা ও পর বুদ্ধিজীবিতার ফল অথবা বিশ্বাস-নিষ্ঠতার অভাবজাত? যাই হোক না কেন, কোনোটাই তাদের পক্ষে সম্মানজনক নয়। মিশরীয় ব্যাবিলীয়-গ্রীক-ভারতীয়-চৈনিক পুরাণের পাশে পাশে মুসা-ঈসা বুদ্ধ জোরাস্টার-কনফুসিয়াস প্রভৃতির শাস্ত্র এবং এগুলোর পাশে ডারুইন-ফ্রয়েড-মার্কস-হেগেল নীৎসে-সার্জের মতবাদ এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের সহঅবস্থানগত বৈচিত্র্য-বৈপরীত্য ও জটিলতা আজকের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষকে বিচলিত ও বিব্রত করে না– জ্ঞানী-গুণী-বিদ্বানেরাও ঘরোয়া কিংবা মানসজীবনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানে-বিশ্বাসে কোনো বিরোধ, কোনো অসঙ্গতি অনুভব করে না। তাহলে বিষয়ী মানুষকে নির্বোধ কিংবা উদাসীন বলে ভাবতে হবে। বলতে হবে তারা জৈব প্রয়োজন-সচেতন প্রাণী এবং জীবন ও জগৎ, তত্ত্ব ও তথ্য এবং রহস্যচর্চা তাদের কাছে ক্লাবীয় খেলামাত্র।

কিন্তু তাও যে নয়, তার প্রমাণ নিস্তরঙ্গ ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে যদি কোনো ব্যতিক্রম তারা দেখতে পায় তখন তারা সনাতনী সেজে নীড় ভাঙা পাখির মতো হৈচৈ শুরু করে দেয়। বাহ্যত তাঁরা তর্ক করে, যুক্তি মানে, বিজ্ঞান ও দর্শনকে মান্য করে, সমাজবিজ্ঞান স্বীকার করে, কিন্তু স্বার্থ ও প্রয়োজনানুগ গ্রাহ্য না হলে গ্রহণ করে না। সবকিছুর উপর বিশ্বাসজাত আস্থা, সংস্কারজাত ভীতি এবং স্মৃতিপ্রসূত ভরসাই জয়ী হয়।

একে তারা ধর্মভাব, ঐতিহ্য-প্রীতি ও সত্যনিষ্ঠা বলে চালিয়ে দিতে সদা উৎসুক। আর্থনীতিক ও রাজনীতিক পরিবর্তনে তাদের আপত্তি ক্ষীণ। কিন্তু তার সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তনের সম্পর্ক থাকলে তাদের প্রতিরোধ হয় প্রবল, আর ধর্মীয়নীতির ব্যতিক্রম দেখলে তারা খেপে ওঠে। তখন তারা শিক্ষা জ্ঞান, যুক্তি সব পরিহার করে। সনাতন রীতিনীতির মমতায় তারা তখন ধর্মোন্মাদ ও রণ-মত্ত। যুগে যুগে কত নবী-ঋষি-জ্ঞানী-গুণী এভাবে তাদের হাতে লাঞ্ছিত, বিতাড়িত ও নিহত হয়েছেন! সমাজের মানুষের এই চরিত্রই মানুষের সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও আর্থনীতিক জীবনে প্রগতির বড় বাধা। এ কারণেই আরণ্য জীবনের রেশ উন্নততম সমাজেও দুর্লক্ষ্য নয়।

তবু মানববাদীর হতাশ হয়ে বসে থাকা চলবে না। অধ্যবসায়ে কী না হয়! ক্রমাগত মানুষের বদ্ধমনের দ্বারে আঘাত হানতে হবে। অর্গল টুটবেই, দ্বার ভাঙবেই তা যত বিলম্বেই হোক– যেমনটি গুহাযুগ থেকে ঘটে আসছে। তবু এরও একটা স্বাভাবিক পদ্ধতি আছে। ইতিহাস তার সাক্ষ্য। প্রচার-প্রতিরোধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রক্তপাত, হত্যা প্রভৃতি কোনোটাই এড়ানো যাবে না। এতে সময় লাগবে বটে, কিন্তু সাফল্য সুনিশ্চিত। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও মুক্তির জন্যেই সনাতনের বেড়া ভাঙতেই হবে। তার জন্যে চাই মানববাদী সৈনিকদের আপোশহীন বিরামহীন নির্ভীক মসীযুদ্ধ।

মধ্যযুগের বাঙলায় মুসলিম-রচিত তত্ত্বসাহিত্য

চলমান জীবন প্রতিমুহূর্তে বিচিত্রভাবে নিজেকে প্রকাশ করে চলে। কাজেই কোনো ছকে ফেলে তাকে বিচার করা চলে না। এ-কথা কেবল ব্যক্তি সম্পর্কে নয়, জাতির জীবন সম্বন্ধেও সত্য। সমাজনীতি ধর্ম-বিধি রাষ্ট্রসংস্থা ইতিহাস দর্শন বিজ্ঞান শিল্প স্থাপত্য ভাস্কর্য সাহিত্য সঙ্গীত পোশাক আচার আচরণ প্রভৃতি সাধারণভাবে সমাজের বা জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচায়ক ও পরিমাপক বলে স্বীকৃত হয় বটে, তবু বিভিন্ন ক্ষেত্রের সুস্পষ্ট সামগ্রিক ধারণা পাওয়া দুঃসাধ্য। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে একটা জাতির পূর্ণ পরিচয় যেহেতু নিবদ্ধ নেই, সামগ্রিক স্বরূপে কোনো জাতিকে চিহ্নিত করাও তাই অসম্ভব। তবু মানুষের বোধের ও আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে তার জাতিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের রেওয়াজ চালু আছে। এতে অন্তত আমাদের ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটে।

জাতির পরিচয়-ক্ষেত্রে সাহিত্যকে অন্যতম প্রধান উপাদান মনে করা হয়। কেননা জীবন একান্তই স্থান-কাল ভিত্তিক। কাজেই মানুষের দেহমন গড়ে তোলে পরিবেশ। আর মানুষের অন্তরের অকপট অনুভূতি ও উপলব্ধির সুন্দরতম ও নিবিড়তম প্রকাশ ঘটে সাহিত্যে। সাহিত্য মানুষের বোধ-বুদ্ধির অবিকৃত প্রতিরূপ। তাই একে জাতীয় জীবনের মুকুর বলা হয়। যে-কোনো ঐতিহ্য ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের প্রেরণার উৎস, কর্মের দিশারী ও মর্মের পরিচায়ক হয়। সাহিত্যে মানুষের মর্মলোকের স্বরূপ বিধৃত থাকে বলে মানুষের অন্তসত্তার পরিচায়করূপে সাহিত্যকেই বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। আর মানুষের আচরণে ও মননে স্থানিক ও কালিক ছাপ না-থেকেই পারে না। কাজেই প্রাচীন রচনামাত্রেই সমাজ-সংস্কৃতির কিংবা মন-মননের ঐতিহাসিক উপাদান। এতে সাহিত্যগুণ থাকে তো ভালো, না থাকলেও ক্ষতি নেই।

বাঙলা দেশে মুসলমানের প্রায় হাজার বছরের বাস। কালক্রমে তারা দেশে সংখ্যাধিক্যও লাভ করেছে। এবং এ কথাও এখন আর কেউ অস্বীকার করে না যে, শতকরা নব্বই জন মুসলমানই দেশজ। কাজেই মুসলমান সুলতান-সুবাদারের প্রতিপোষকতায় যে বাঙলা ভাষার চর্চা ও সাহিত্য-সৃষ্টি শুরু হল, তাতে মুসলমান সাগ্রহে শরিক হয়নি–এ-কথা ভাবার কোনো সঙ্গত কারণ নেই।

অতএব গত পাঁচশ বছরে মুসলমানের রচনা পরিমাণে অমুসলমান বাঙালির রচনার চাইতে কম হওয়ার কথা নয়। এ পাঁচশ বছরে কোটি কোটি মুসলমান কত বিচিত্রভাবে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছে তাদের কারো কারো কত জিজ্ঞাসা কত উপলব্ধি, কত বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনা নানাভাবে অভিব্যক্তি লাভ করেছে রচনার মাধ্যমে। গোটা বাঙলা দেশে ছড়িয়ে ছিল মুসলমানদের এসব রচনা। সগ্রহ ও সংরক্ষণের অভাবে এর এক বিপুল অংশ লোপ পেয়েছে। অবশিষ্টটকুও লোপ পেতে বসেছে। মরহুম আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, জনাব আলী আহমদ ও বাঙলা একাডেমী পুঁথি সুগ্রহ করেছেন কেবল চট্টগ্রাম বিভাগ থেকেই। কাজেই বাঙলার অন্যান্য অঞ্চলের রচনার খোঁজ আজো বিশেষ নেয়া হয়নি।

তবু একটিমাত্র অঞ্চলে সংগৃহীত রচনারও বিষয় বৈচিত্র্য আমাদের মুগ্ধ করে। প্রণয়োপাখ্যান, চরিতাখ্যান জ্যোতিষ, সঙ্গীত, মরমিয়া, মর্শিয়া, ধর্মশাস্ত্র, অধ্যাত্মতত্ত্ব ইতিহাস প্রভৃতি বাঙলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা সৃষ্ট ও পুষ্ট হয়েছে মুসলমানের দানে।

সব রচনায় অবশ্য সাহিত্য-রস মিলবে না, কিন্তু মানুষের প্রাণের পরশ পাওয়া যাবে এতে। কেননা লেখার পেছনে রয়েছে মানুষ, আর মানুষ প্রাণ-মন বিহীন নয়।

আমাদের তত্ত্বসাহিত্যে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে মানবমনের চিরন্তন জিজ্ঞাসার মনোময় উত্তর খোঁজা হয়েছে। মানুষের মনে জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্য এবং জগৎ ও জীবনের মহিমা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে যে চিরন্তন ও সর্বজনীন প্রশ্ন রয়েছে, তারই জবাব খোঁজার প্রয়াস আছে এতে। কেতাবীদের বিশ্বাস, হযরত মুসা তুর পর্বতে বসে আল্লাহর কাছে প্রশ্ন করে জগৎ ও জীবনের নানা তত্ত্ব জেনে নিতেন। সাইত্রিশ শ বছর আগেকার হযরত মুসার সে তত্ত্বালোচনা আজো প্রাকৃত মনের কৌতূহলাবেগ তৃপ্ত করে। বাস্তবধর্মী শক্তিমানের যে জিজ্ঞাসা মানুষকে বিজ্ঞানী করেছে, ভাববাদী দুর্বলকে তাই করেছে তাত্ত্বিক ও দার্শনিক।

তত্ত্বচিন্তা মানুষকে তিনটে মার্গের সন্ধান দিয়েছে : জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি মার্গ। জ্ঞানবাদ আস্তিক্য, নাস্তিক্য ও সংশয়প্রবণ দর্শনের জন্ম দিয়েছে। কর্মবাদ সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রবিধি গড়ে তুলেছে। আর ভক্তিবাদ হয়েছে নিষ্ঠা ও বৈরাগ্যের উৎস এবং ভক্তিবাদের উপজাত (by product)–কারো কারো মতে পরিণতি হচ্ছে প্রেমবাদ।

বাঙলা ভাষায়ও এই তত্ত্বজিজ্ঞাসা তিন ধারার সাহিত্য সৃষ্টির উৎস হয়েছে : এগুলো ধর্মসাহিত্য, তত্ত্বসাহিত্য ও সাধন সাহিত্য।

ক. ধর্মসাহিত্যে উল্লেখ্য হচ্ছে :

নেয়াজ ও পরাণের (১৭ শতক) কায়দানি কেতাব, খোন্দকার নসরুল্লাহর (১৭ শতক) হেদায়তুল ইসলাম, শরীয়নামা, শেখ মুতালিবের (১৬৩৯ খ্রী.) কিফায়তুল মুসল্লিন, আলাউলের (১৬৬৪ খ্রী.) তোহফা, খোন্দকার আবদুল করিমের (১৮ শতক) হাজার মাসায়েল, আশরাফের (১৭ শতক) কিফায়তুল মুসল্লিন, আবদুল্লাহ (১৮ শতক) নসিয়ত নামা, কাজী বদিউদ্দীনের (১৮ শতক) সিফৎ-ই-ইমান, সৈয়দ নাসির উদ্দিনের (১৮ শতক) সিরাজ ছবিল, মুহম্মদ মুকিমের (১৮ শতক) ফায়দুল মুবদী, বালক ফকীরের (১৮ শতক) ফায়দুল মুবদী, সৈয়দ নুরুদ্দীনের (১৮ শতক) দাকায়েকুল হেকায়েক রাহাতুল কুলুব, মুহাম্মদ আলীর (১৮ শতক) হায়রাতু ফেকাহ, হায়াৎ মাহমুদের (১৮ শতক) হিতজ্ঞানবাণী, আফজল আলীর (১৮ শতক) নসিয়ত নামা প্রভৃতি।

খ. তত্ত্বসাহিত্যে পাই : হাজী মুহম্মদের (১৬ শতক) নূর জামাল, মুহম্মদ আকীলের মুসানামা, খোন্দকার নসরুল্লাহর মুসার সাওয়াল, শেখচাঁদের (১৬ শতক) শাহদৌলাপীর বা তালিবনামা, আবদুল হাকিমের (১৬ শতক) শিহাবুদ্দিন নামা, আলী রজার (১৮ দশক) সিরাজকুলুব, আগম ও জ্ঞানসাগর; শেখসাদীর (১৭ শতক) গদামল্লিকা, সেরবাজ চৌধুরীর ফরনামা বা মল্লিকার সওয়াল, এতিম আলমের (১৮ শতক) আবদুল্লাহর হাজার সওয়াল, সৈয়দ নুরুদ্দীনের মুসার সওয়াল, বুরহানুল আরেফিন, অ-জানা কবির মুসার রায়বার, হোরান জরীপ (সম্ভবত পুরাণ জরীপ) মীর মুহম্মদ শফীর (১৭ শতক) নূর নামা, কাজী মনসুরের (১৮ শতক) সিনামা অজ্ঞাতনামা কবির মুসা পয়গাম্বরের কেচ্ছা, শেখ জেবের আগম, শেখ জাহেদের আদ্য পরিচয়, রমজান আলীর আদ্যক্ত প্রভৃতি। গ. সাধনসাহিত্য : ভক্তিবাদে রয়েছে দ্বৈতরূপ–সাধন ও ভজন। সাধনস্তরে সূফী ও যোগতত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে। সাধন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ্য শেখ ফয়জুল্লহর (১৬ শতক) গোরক্ষ বিজয়, সৈয়দ সুলতানের (১৫৮৪-৬৮ খ্রী.) জ্ঞান প্রদীপ, অজানা কবির যোগকলন্দর, আবদুল হাকিমের চারি মোকাম ভেদ শেখ চান্দের হর গৌরী সম্বাদ, মোহসিন আলীর মোকাম মঞ্জিলের কথা প্রভৃতি। আর ভজন সংগীতরূপে পাচ্ছি : রাধাকৃষ্ণরূপক গীত, বাউল ও মুর্শিদী গান।

শাহ্ আবদুল লতিফ ভিটাই

করাচী থেকে ট্রেনে করে হায়দরাবাদ রওয়ানা হলাম ভিটশাহ উদ্দেশে। মরু সিন্ধুর বুক চিরে ছুটে চলেছে ট্রেন। দুদিকে বসতি বিরল ও বসতিহীন প্রান্তর; এখানে ওখানে বাবলা গাছ, কাঁটা ঝোঁপ আর পাথুরে টিলা। প্রকৃতির এ রুক্ষতা ভাবিয়ে তোলে, বিস্মিতও করে। যেখানে সংগ্রাম সেখানেই বুঝি স্বাস্থ্য। নইলে প্রাচুর্যের দেশ বাঙলায় কেন জন ও জীব দুইই ক্ষুদ্রকায়। আর অনুর্বর অঞ্চলে মানুষে পশুতে কী পায় আর কী খায় যে সেখানে এরা আকারে বড় আর স্বাস্থ্যে সুষ্ঠু। ট্রেন চলেছে। একঘেয়ে দৃশ্য। তাই মন চলে গেছে সুদূর অতীতে। ইতিহাসের পাতা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। এ মরুভূমিতে দেখা দিয়েছিল একদিন প্রাণ-বন্যা, উঠেছিল বিচিত্র জীবনের কলরোল। ময়েনজোদাড়োর বিস্ময়কর সংস্কৃতি-সভ্যতা সেই মুখর জীবনের প্রতীক। সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা প্রাচীন মানুষের অক্ষয় কীর্তি। দেখতে পাচ্ছি দাহিরের পরাজয় ও লাঞ্ছনাম্লান মুখ, মুহম্মদ বিন কাসিমের বিজয়দীপ্ত চেহারা, দৃপ্ত পদক্ষেপ। মুসলিমের বিজয় কেতন। পরে আরো কত পরাক্রান্ত দাম্ভিক বিদেশীর উদ্ধত পদধ্বনি। তারপর এই বিগত শতকে তালপুর বংশীয়রা সিন্ধু শাসন করেছেন। ১৮৩১ সনে বৃটিশের নজর পড়ল সিন্ধুর ওপর। তালপুরেরা সে শ্যেনদৃষ্টির সামনে টিকতে পারল না। ১৮৪৩ সনে সিন্ধু পড়ল বৃটিশ খপ্পরে।

কতক্ষণ অতীতের ইতিহাসলোকে ছিলাম জানিনে, আবার যখন নিজের মধ্যে ফিরে এলাম, তখন দেখছি ট্রেন কোটরি স্টেশনে থেমেছে। কোটরি একটি ক্ষুদ্র শহর–সিন্ধুর আঞ্চলিক শাসন ও বাণিজ্য কেন্দ্র।

এক ঘণ্টার মধ্যে হায়দরাবাদ পৌঁছলাম। হায়দরাবাদ প্রাক্তন সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী, তখন আঞ্চলিক শাসনকেন্দ্র। বড় শহর। লোকসংখ্যা শুনলাম প্রায় তিন লক্ষের মতো। রাজধানীসুলভ সব প্রতিষ্ঠানই আছে। দু-তিনটে সিন্ধি ও উর্দু দৈনিক বের হয় এখান থেকে। আমরা সরকারি অতিথি। আমাদের দেখাশুনার ভার পড়েছে হায়দরাবাদের ইনফরমেশন বিভাগের উপর। ইনফরমেশন অফিসার ও তার দুই সহকর্মী জনাব হাজী আবদুর রহমান আর জনাব আলাড়ী দায়-সারানো সরকারি কাজ হিসেবে আমাদের ভার নেননি, বরং শ্রদ্ধেয় পারিবারিক অতিথি হিসেবেই বরণ করেছিলেন। তাঁদের সৌজন্য, আন্তরিকতা, যত্ন-আপ্যায়ন আমাদের অভিভূত করেছে। দু-দিন আমরা সেখানে ছিলাম। আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারা ছায়ার মতো আমাদের সঙ্গে থাকতেন। হালিম সাব সুদ্ধ এ চারজন সিন্ধি ভদ্রলোকের আচরণ সুপ্রাচীন আরবি ঐতিহ্যের কথা মনে পড়িয়ে দিল।

প্রাণের স্পর্শে প্রাণ জাগবেই। তা প্রেমে হোক, প্রীতিতে হোক কিংবা সৌজন্যে হোক। তাঁদের আন্তরিক আতিথেয়তায় আমরাও তাই তাঁদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠলাম। ভুলে গেলাম যে তারা সরকারি কর্মচারী, কর্তব্য করছেন মাত্র, তাই বিদায়কালে আত্মীয় বিচ্ছেদের বেদনা অনুভব করেছি।

হায়দরাবাদ থেকে বাসে ভিটশাহ্ যাত্রা করলাম। পাকা ঋজু রাস্তা চলে গেছে লাহোর পেশোয়ারে। দু-ধারে সবুজের সমারোহ। মনে হচ্ছে, বাঙলা দেশেরই কোথাও শরতে ক্ষেতের পাশ দিয়ে চলেছি। মনে হয় পানির স্পর্শে পাষাণ-প্রাণ অহল্যা জেগে উঠেছে। মরুতে সোনা ফলেছে। গম আর তূলা ক্ষেত। বাড়ন্ত ফলন্ত অবস্থা। দেখলে চোখ জুড়ায়।

সিন্ধু জেগেছে। তার মাটি জেগেছে, তার মানুষ জেগেছে। প্রাণের পরশ মাটির ফসল সে উল্লাস ব্যক্ত করছে নৃত্যের তালে তালে। আর মানুষের আশাপ্রদীপ্ত প্রাণে দেখা দিয়েছে কর্মচাঞ্চল্য। মরু বালুকার বুকে যেমন জেগেছে জীবন-স্বপ্ন, তেমনি সিন্ধিরাও করেছে বৃহৎকে তাদের ধ্যানের বস্তু। দুটোই সম্ভব হয়েছে শুকুর ও গোলাম মোহাম্মদ বাঁধ প্রভৃতির মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার ফলে। প্রকৃতি-নিগৃহীত সিন্ধিরা এভাবে প্রকৃতিকে এনেছে বশে, আর তাদের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিচ্ছে বাস্তবায়নের পথে। এসবের আভাস পেয়েছি সাধক কবি শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই-এর উরসের মেলায়। বসতি-বিরল সিন্ধুর জনসংখ্যা হচ্ছে মাত্র চল্লিশ লক্ষ।

দূরদূরান্তর থেকে দুইদিনব্যাপী মেলায় এসেছে প্রায় দু-লক্ষের মতো লোক। চল্লিশ লক্ষের মধ্যে দু-লক্ষের উপস্থিতিতেই সাক্ষ্য দেয় যে, শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই সিন্ধিদের হৃদয়-রাজ্যের রাজা ও জাতীয় মানসের প্রতীক। তাই আজ ভিটাই-বার্ষিকী দূরদেশের উরস মাত্র নয়, বরং জাতীয় মহোৎসব। এ উৎসবের মাধ্যমে সিন্ধু নিজেকে প্রকাশ করছে। স্থির করেছে নিজেদের আদর্শ ও লক্ষ্য। শাহ আবদুল লতিফের সাধনা ও বাণীর মাধ্যমে জাগছে তাদের জীবন-জিজ্ঞাসা। আর জীবনের দিশাও তারা খুঁজছে সেই আলোকে। আবদুল লতিফ ভিটাই ইতর-ভদ্র ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবারই প্রিয়। অশিক্ষিতরা তাঁর কাছে যায় অভীষ্ট সিদ্ধির বাচ্ছা নিয়ে; আর শিক্ষিতেরা তার মধ্যে খোঁজে জাতীয় মানসের স্বরূপ। অশিক্ষিতের কাছে লতিফ ঐহিক জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা-সহায় আর অধ্যাত্ম জীবনের পীর এবং শিক্ষিতের চোখে তিনি জাতীয় মনন ও সংস্কৃতির প্রভিভূ। অশিক্ষিতেরা করে উস আর শিক্ষিতেরা করে স্মৃতিবার্ষিকী। এভাবেই শাহ লতিফ হয়েছে সিন্ধিদের আশা-ভরসা ও লক্ষ্যের অবলম্বন। এক কথায় লতিফ National hero, সবাই তাঁর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়। দেখেশুনে মনে হয়, লতিফের সাধনা ও বাণী আদর্শ করেই সিন্ধু জেগেছে, সিন্ধু জাগছে।

এবার শাহ লতিফের পরিচয় দেব। মহৎ জীবনের উপর অলৌকিকতা আরোপ করা একটি মানবিক দুর্বলতা। শাহ লতিফ-চরিত্রও এই অলৌকিকতার প্রলেপ থেকে মুক্ত নয়। তাঁর শৈশব, বাল্য, কৈশোর সম্বন্ধে কয়েকটি অদ্ভুত কাহিনী চালু আছে। ভক্তজনের কল্পনাপ্রসূত এসব কাহিনী থেকে তথ্য ও সত্য উদ্ধার করা সহজ নয়। তাই আগে শাহ আবদুল লতিফের জীবনী লিখিত হয়নি। তবে যারা দশের উপরে বড় হন, তাঁদের জীবনে হয়তো কিছু অসামান্যতা থাকে। সে অসামান্যতাই ভক্তজনের চিত্তমুকুরে অলৌকিকতার রূপ ধরে প্রচার লাভ করে।

১৬৮৯ সনে হায়দরাবাদের হালাহাবেলী গ্রামের এক প্রখ্যাত সৈয়দ বংশে শাহ লতিফের জন্ম। তাঁর পিতার নাম শাহ্ হাবীব। প্রপিতামহ শাহ আবদুল করিম কবি ছিলেন। পীরালিই পারিবারিক পেশা। মেধাবী লতিফ অল্প বয়সেই আরবি, ফারসি ও ইসলামে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

হালাহাবেলী অঞ্চলে এক তায়মুরী পরিবার ছিল চেঙ্গিস-তৈমুরের বংশধর এবং দিল্লীর বাদশাহর জ্ঞাতি বলে সমাজে তাদের বিশেষ মর্যাদা ও আভিজাত্য ছিল। শাহ লতিফেরা ছিলেন তাদের পীর-পরিবার। একবার তায়মুরী পরিবারের প্রধান মীর‍্যা মুঘল বেগের কুমারী কন্যা অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিরাময়ের জন্যে আল্লাহর নাম কালাম পড়ে দোয়া করবার জন্যে ডাক পড়ল পীর শাহ হাবীরের। তিনি কোনো কারণবশত যেতে পারলেন না, পাঠালেন কিশোর ছেলে লতিফকে। পীরের কাছে পর্দা নেই। কাজেই লতিফকে অন্দরে রোগীর শয্যাপাশে নেয়া হল। বয়োধর্মের গুণে লতিফ প্রথম দৃষ্টিতেই মেয়েটির রূপে মুগ্ধ হলেন। এবং তার হাত ধরে আত্যন্তিক আবেগে তাকে প্রেম নিবেদন করলেন। বললেন, সৈয়দের হাতের ছোঁয়া লেগেছে যার আঙুলে, সাগর তরঙ্গের সাধ্য নেই তাকে ছিনিয়ে নেয়। দেশজ প্রথায় এটা যথার্থই পাণিগ্রহণ। পীর-পুত্রের এই ঔদ্ধত্য সহ্য করা মীর‍্যা মুঘল বেগের পক্ষে কঠিন হল। কলঙ্কের ভয়ে তিনি এ কথা প্রকাশ করলেন না বটে, কিন্তু পীর-পরিবারের উপর নানাভাবে নিপীড়ন শুরু করলেন। ফলে শাহ্ হাবীব গাঁ ছেড়ে আত্মরক্ষা করলেন। এদিকে কিশোর লতিফ প্রণয়ে ব্যর্থতার আঘাতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘর ছাড়লেন এবং বিবাগী হয়ে, যোগী হয়ে সন্ন্যাসীদলে ভিড়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ালেন। এ সময়ে তিনি যোগশাস্ত্র ও সুফীমতের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হন। কাবুল, কান্দাহার, হিংলাজ, যশশ্মীর, কচ্ছ, কাথিওয়ার, লাসবেলা, মাকরান প্রভৃতি অঞ্চল ভ্রমণ করলে তিনি নানা ধর্মমত ও বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সংস্পর্শে আসেন। এ অভিজ্ঞতার প্রভাবে তিনি নতুন মানুষ হয়ে উঠলেন, নারী-প্রেম ভূমা-প্রেমে উন্নীত হল। ঐহিক কামনা পরমের সাধানায় রূপ পেল। তিনি হলেন যোগী সূফী এবং সাধক কবি। বিবাগী জীবনে তিনি স্বরচিত দোহরা গেয়ে বেড়াতেন। আমাদের পদাবলীর সঙ্গে দোহরার একদিকে মিল আছে; কেননা এগুলো মানবিক ও অধ্যাত্ম- এই উভয় প্রেমের গান হিসেবে উপভোগ করা চলে।

বহুকাল পরে তিনি ঘরে ফিরলেন। এদিকে মীর‍্যা মুঘল বেগের পরিবারে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। পীর-পরিবারের উপর পীড়ন করার ফলেই দুর্ভাগ্যের দুর্দিন দেখা দিয়েছে মনে করে অনুতপ্ত মীর‍্যা মুঘল বেগ লতিফের হাতে কন্যা সম্প্রদান করলেন। এ কাহিনী ছোট ভিটাই (ভিটাইয়ের দুলামিয়া) নামে আজো চালু আছে।

এবার গৃহী সাধক লতিফ ইরানি সূফী কবিদের মতো পুরোনো লৌকিক প্রণয় গাথাগুলোকে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মানুষ ও আল্লাহর প্রেমের রূপকে রূপান্তরিত করেন। এগুলোও রুচিমতো মানবিক প্রণয় কিংবা অধ্যাত্মপ্রেমের রূপক হিসেবে আস্বাদন করা যায়। এতে স্বদেশপ্রেম, সাহস প্রভৃতি ব্যবহারিক গুণের আলেখ্য আছে। এভাবে পুরোনো প্রণয় গাথাগুলোক তাঁর হাতে নতুন মহিমায় উজ্জ্বল ও জনপ্রিয় হয়ে উঠল। মুহনী মহিয়াল, শশীপুন্ন, হির ঝনঝা, মোমেল-রানু, লীলা-চানেসার, সোবথ দিয়া-বিজল, মা আরভি-মারুঙ্গ-উমর প্রভৃতি তাঁর অমর কীর্তি। কেউ কেউ বলেন, শাহ লতিফ ৩৬টি নাট্য-গাথার রচয়িতা।

১৮৬৬ সনে জার্মান পণ্ডিত Tremp-ই প্রথম শাহ লতিফের কাব্য-সগ্রহ বের করেন। পরের বছর বোম্বাই সরকারের শিক্ষা দফতর থেকেও একটি সংশোধিত ও বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৪০ সনে Dr.Surely তাঁর Shah Abdul Latif of Bhit Shah নামের গবেষণামূলক গ্রন্থে লতিফের জীবনকাহিনী ও তাঁর রচনার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। হায়দরাবাদের সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় শাহ লতিফের রচনার নির্ভরযোগ্য সিন্ধি সংস্করণ ও তার উর্দু তরজমা প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়াও, পাকিস্তানের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ও বোম্বাই প্রদেশে শাহ লতিফ সম্বন্ধে নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে এবং সে সূত্রে তাঁর রচনার কিছু কিছু অনুবাদও হচ্ছে।

শাহ লতিফ সাধনা ও কবিত্বের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার জন্মসূত্রেই পেয়েছিলেন। পীরালি সূত্রে লোকসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ঐতিহ্যও ছিল সুপ্রাচীন। তাই তিনি সহজেই জনগণকে আপন করে নিতে পেরেছিলেন, আর নিজেও হয়ে উঠেছিলেন তাদের আপন মানুষ। ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা হিসাবেই চিরকাল মুখের বুলি সাহিত্যের শালীন ভাষায় উন্নীত হয়েছে। সিন্ধি-ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। ঐতিহাসিক যুগে দেখতে পাচ্ছি, ধর্মের, দরবারের ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাষা ছিল সংস্কৃত, তারপরে মুসলমান আমলে দরবার ও সংস্কৃতির ভাষা হল ফারসি, ইংরেজ আমলে হল ইংরেজি। তাই দেশের আঞ্চলিক বুলিগুলো স্বাধীন ও স্বাভাবিকভাবে বিকাশ লাভ করে শালীন সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হতে পায়নি। তবু এর মধ্যে গৌতমবুদ্ধ ও বর্ধমান মহাবীরের ধর্মপ্রচারের বাহন হয়ে পালি ও প্রাকৃত, রাজপুত রাজাদের প্রশাসনের মাধ্যমরূপে অবহট্ট, এবং মধ্যযুগের কলন্দর, রামানন্দ, কবীর, দাদু, রামদাস, রজব, নানক, চৈতন্য প্রমুখের মতপ্রচারের বাহন হয়ে আধুনিক সাহিত্যিক ভাষাগুলো গড়ে ওঠে। ধর্ম প্রচার ও রাষ্ট্র পরিচালনার সহায়ক ভাষারূপে তুর্কী আমলে একবার এবং ইংরেজ শাসনের গোড়ার দিকে আর একবার বাঙলা ভাষার বহুল চর্চা হওয়ার ফলেই বাঙলা অন্যান্য পাক-ভারতীয় আধুনিক ভাষাকে (রূপে ও সামর্থ্যে) অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু সিন্ধি ভাষা এ সৌভাগ্য থেকে অনেক কাল বঞ্চিত ছিলো। প্রধান কারণ, সিন্ধু ভারতের সীমান্ত-মুখের দেশ হওয়ায় চিরকাল বিদেশী আক্রমণের কবলে পড়েছে, স্বাধীন বিকাশের সুযোগ পায়নি। দারা, আলেকজান্ডার, মুহম্মদ বিন কাসিম, মুহম্মদ গজনভী, মুঘল, নাদির শাহ, আহমদ শাহ প্রভৃতির আক্রমণের কবলে যে সিন্ধু প্রাণে মরেনি, তাই তা যথেষ্ট। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭ খ্রী.) পর কুলহুড় বংশীয় নূরমুহম্মদ-আধা স্বাধীনভাবে সিন্ধু শাসন করবার অধিকার পান। কুলহুড়রা ছিলেন সিন্ধিভাষী। দরবারি ভাষা ফারসি থাকা সত্ত্বেও এদের সময়েই সিন্ধি ভাষার বহুল চর্চা শুরু হয় এবং সাহিত্য সৃষ্টি হতে থাকে। অবশ্য পনেরো শতক থেকেই সিন্ধিরচনার কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। কুলহুড় বংশের পতনের পর তালপুর বংশীয়রা ১৮৪৩ সন পর্যন্ত সিন্ধুর শাসক ছিলেন। এরপর ইংরেজ শাসনে সিন্ধির কদর হ্রাস পায়।

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সময় শাহ লতিফের বয়স ছিল আঠারো। কাজেই শাহ লতিফের বাকি জীবন কুলহুড় শাসনাধীনেই কেটেছে। শাহ লতিফের সূফীমত তার সিন্ধি ভাষায় রচিত গানগাথার মাধ্যমেই প্রচার লাভ করে। তখনো এ ভাষা ও সাহিত্যে লোকবুলিও লোকসাহিত্যের স্তরে উত্তীর্ণ হয়নি। বিশেষ করে শাহ লতিফের উদ্দিষ্ট শ্ৰেতাও ছিল অশিক্ষিত জনগণ। শাহ লতিফ মুখে মুখেই তার গান ও গাথা রচনা করেন। (জনশুতি এই যে, লতিফ লিখে লিখেই তাঁর গান ও গাথা রচনা করেন। কিন্তু অহংকার বিলুপ্তির জন্যে তিনি নিজের হাতেই তার পুথিগুলো কিরার হ্রদের পানিতে ফেলে দেন।) গাইয়ে শিষ্যরা তা শ্রুতিস্মৃতিতে জিইয়ে রেখেছে এবং পুরুষপরম্পরায় তা মুখে মুখে চালু রয়েছে। অবশ্য শিক্ষিত লোকের পড়বার জন্যে আঠারো শতকের একেবারে শেষের দিকে তার রচনাবলী লিপিবদ্ধ হয়। কাজেই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, তাঁর রচনা অবিকৃতভাবে আমাদের হাতে পৌঁছায়নি। তবু ভাবে, ভাষায়, ছন্দে, সুরে, শব্দের চয়ন ও বিন্যাস-সৌন্দর্যে শাহ লতিফের রচনা সিন্ধিভাষায় অতুলনীয়। তাই আজো তিনি শ্রেষ্ঠ সিন্ধি কবি। তিনি একাধারে লোককবি, সাধক কবি এবং শালীন সাহিত্যের কবি-শিল্পী। এজন্যেই রসিক ও ভক্ত, পণ্ডিত ও মূর্খ, যোগী ও সূফী এবং হিন্দু ও মুসলমান সকলেরই তিনি প্রিয় কবি। আঙ্গিকের দিক দিয়ে সিন্ধি ভাষায় তাঁর বিশেষ দান ওয়াই-শ্রেণীর কবিতা। সোরথ, মা আরভি, আ-আরবি, দোথী, মা আয়ুরী হোসাইনী, সোহিনী, কোহিয়ারী (পাহাড়ী) প্রভৃতি সুরে শাহ লতিফের গান ও গাথা গীত হয়।

পাঞ্জাবের বুলেহশাহ ও আমাদের লালন প্রভৃতি বাউল কবির সমগোত্রীয় ছিলেন লতিফ। সাধারণভাবে হয়তো বলা যায়–রুমী, জামী, হাফিজ প্রমুখ সূফী কবি এবং রামানন্দ, কবীর, দাদু। কলন্দর, রজব প্রভৃতির উত্তরসাধক ছিলেন শাহ আবদুল লতিফ ভিটাই। ভিট শব্দের অর্থ টিলা, আর টিলাবাসী বলে ভিটাই এবং শাহর টিলাই হল ভিটশাহ।

সূফী বৈষ্ণবদের মতো পরমের বিরহবাধই শাহ লতিফের অধ্যাত্ম-প্রেরণার উৎস এবং পরমের সাথে মিলনই কবির সাধনার লক্ষ্য।

বৈষ্ণব কবি বলেন :

জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু
নয়ন না তিরপিত ভেল,
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু
তব হিয়া জুড়ন ন গেল।

লতিফও বলেন:

প্রিয়তমা মোরে ছাড়িয়া গিয়াছে।
হৃদয় আমার বিরহে বিধুর,
প্রেম থেকে আমি বঞ্চিত তাই
পরাণে বাজিছে বেদনার সুর।

এবং প্রেমিকের গানে না-পাওয়ার সুর চিরকাল তাই ধ্বনিত হয়।

কিংবা –

আমার হৃদয় একটি বহ্নিশিখা
অবিরাম জ্বলছে। সেই জ্বালিয়েছে
শিখাটি যাকে আমি ব্যাকুল হয়ে
খুঁজে চলেছি।

রবীন্দ্রনাথও বলেন :

আজিও কাঁদিছে রাধা হৃদয়-কুটিরে।

সূফীরা প্রেমের রাহে ফানা হয়ে যেতে উপদেশ দেন। শাহ লতিফেও তাই পাই–হে পতঙ্গ, প্রেমের অনল তোমায় ইশারায় ডাকছে। ভয় পেও না তুমি, ঝাঁপ দাও নিঃসঙ্কোচে। সে-অনলে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হবে তোমার চিত্ত।

লতিফ আরো বলেন :

আশেক মাশুকে কোনো ভেদ নেই। সাগর আর ঢেউ যেমন মূলত এক হয়েও দুইরূপে দেখা দেয়, কিংবা ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি যেমন দুই সুরে বেজে উঠে, আত্মা ও পরমাত্মাও তেমনি ভিন্ন বলে প্রতীয়মান হয় মাত্র।

লতিফ তাই বলেন :

তুমি বৃথাই দূরের পথে যাত্রা করছ; চেয়ে দেখ, বন্ধু তোমার কাছে রয়েছে রয়েছে তোমার মেঝের উপর। যাকে পাওয়ার জন্যে এত দুঃখ পাচ্ছ, সে তো তোমার ভিতরেই বাস করে। তাকে নিজের হৃদয়ের মধ্যে খোজো। তোমার পায়ের পর্যটন থামাও। এবার হৃদয়পথে মন চালাও। কেননা, পায়ে হেঁটে কচ্ছদেশে পৌঁছার সে সাধ্য নেই।

আমাদের বাউল কবিও তাই বলেন :

লামে আলিফ লুকায় যেমন
মানুষে সাঁই আছে তেমন।
তা না হলে কি সব নূরের তন
আদম তনকে সেজদা জানায়।

অথবা—

এ মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষ রতন
যারে আকাশ পাতাল খোঁজো
এই দেহে তিনি রয়।

কিংবা–

দেহের মাঝে আছে সোনার মানুষ
ডাকলে কথা কয়।

অথবা —

আছে তোরই ভিতর অতল সাগর
তার পাইলি না মরম।
তার নাই ফুলকিনারা শাস্ত্রধারা নিয়ম কী রকম।

রবীন্দ্রনাথও বলেন

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
আমি তাই হেরি তায় সকল খানে।

অথবা —

ও তোরা আয়রে ধেয়ে দেখরে চেয়ে আমার বুকে
ওরে দেখরে আমার দুনয়নে।

কিংবা —

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি,
বাহির পানে চোখ মেলেছি হৃদয় পানে চাইনি।

রুমীও বলেন

আমি দেখলাম, তিনি আমার অন্তরেই আছেন, আর কোথাও নাই।

লালনের —

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।

সিন্ধি মরমী কবি সাচালও বলেন–

প্রিয়তম আমার হৃদয়েই আছেন, তিনি আমার দেহ-বাগের
কোকিল, আমি প্রিয়তমকে আমার হৃদয়ের মধ্যেই দেখেছি,
দিল-আলোকরা তিনি এসেছিলেন আমার চেতনার সীমার
ভেতরে।

আল্লাহ বলেন

মো কো কহ ঢুড়ো বন্দে, র্মৈ তো তেরে পাসর্মে।
সৈঁ দেবল, না মৈ মসজিদ, না কাবে কৈলাস মে। (কবীর)

কলন্দর বলেন–

নহো মোল্লা, নহে ব্ৰহমন দুই কো ছোড় কর পূজা
হুকুম হৈ শাহ কলংরকা আনলক কহা তাজা।

মদন বলেন–

তোমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে মসজিদে।

লতিফও বলেন —

আল্লাহ হচ্ছেন প্রেমের বশ। তাই তিনি বলেন,
তোমার হৃদয় কর আলিফের লীলাস্থল
তাহলেই বুঝবে তুমি কেতাবী গানের অসারতা।
জীবনকে দেখতে শেখো, তাহলে বুঝবে
আল্লাহর নামই যথেষ্ট। প্রিয়ের মিলন আকাঙ্ক্ষা
যার জেগেছে, সে কেবল প্রিয়তমের পাঠই পড়ে।

কিংবা–

প্রিয়তমের পথ অতি সরল ও প্রশস্ত।
কেবল কামনা-বাসনার কাটাই তাকে আকীর্ণ করেছে।

অথবা–

নামাজ রোজা ভালো বটে
কিন্তু প্রিয় মেলে অন্য বাটে।

হাফিজও বলেন —

ঢালো সুরা সখি সাজাও পেয়ালা শরম আছে কি তায়
প্রেমের মরম তারা কি জানে লো ধরম যাহারা চায়।

কবি সাচাল বলেন

পাপ-পুণ্যের পথে আল্লাহকে কেউ জানতে পায় না।

বেদিল বলেন —

পুথি পড়ে কী হবে; কেবল ফানার তত্ত্ব শেখো।

শাহ লতিফ বলেন

আমার চোখদুটো দেখে কেবল দেখে।
তারা দেখেছে প্রেমে এবং চিনেছে প্রেম
আর তাই ফিরে এসেছে আমার কাছে।

কিংবা

প্রিয়তম তুমি যখন আমার তখন পৃথিবী আনন্দে গেয়ে ওঠে
পথে পথে তৃণ-লতা-ফুল তোমাকে চুম্বন করে ধন্য হয়।
তোমাকে দেখে আমার সকল আশা মুহূর্তে মিটে যায়।

রবীন্দ্রনাথও বলেন–

তোমার আমার মিলন হবে বলে
এমন ফুল্ল শ্যামল ধরা…

তাদের কথায় ধাঁধা লাগে।
তোমার কথা আমি বুঝি,
আমার আকাশ তোমার বাতাস।
এই তো সবি সোজাসুজি।…

আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।

উপরে আমরা দেখতে চেয়েছি, দুনিয়াব্যাপী সব মরমী সাধকের এক বোল এবং সাধনার লক্ষ্যও অভিন্ন; কেবল ভঙ্গিটি দেশ, কাল ও ব্যক্তিভেদে বিচিত্র। আমাদের বাউল গানে যতটা ব্যবহারিক জীবন ও সমাজ-চেতনা রয়েছে, সিন্ধি মরমী সাহিত্যে ততটা নেই। আবার বাউল গানে ছন্দোমাধুর্যের বিশেষ অভাব আছে, সুরের লালিত্য এবং বৈচিত্র্যও কম। কিন্তু শাহ লতিফের গান ও গাথা রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই ছন্দোবদ্ধ কবিতা। শাহ লতিফ সচেতন সুরকার ও ছন্দকুশল শিল্পী। তার অধিকাংশ দোহরা, কাফী ও গাথার সুর তাঁর সৃষ্টি। সিন্ধিরা আজো তার দেয়া সুরে তাঁর সৃষ্ট রাগ-রাগিণীতে যে কেবল তাঁর রচিত গানই গায় তা নয়: অন্যন্য গান এবং গাথায়ও তার সাধা সুর প্রয়োগ করে। তাঁর অনেক গান ক্ল্যাসিক্যাল ঢঙে গীত হয়। মরুভূ সিন্ধুর লু হাওয়া যখন সিন্ধিদের দেহমন তপ্ত ও অশান্ত করে তোলে, তখন শাহ লতিফের দোহরার গীতমূৰ্ছনা তাদের। দেহেমনে স্বস্তি-শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। কিংবা যখন জীবন-জীবিকার নানা যন্ত্রণায় তারা মুষড়ে পড়ে, তখনো শাহ লতিফের গানের অনবদ্য প্রাণ-জুড়ানো সুরে ও ভাব-রসে বিভোর হয়ে তারা স্নিগ্ধ প্রশান্তি লাভ করে। এক কথায়, শাহ লতিফের রচনা সিন্ধিদের জীবনমরূর মরূদ্যান। তাই সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বেদনায়, উৎসবে-পার্বণে, সাফল্যে-ব্যর্থতায় তারা শাহ লতিফের শরণ নেয়। সে শরণ তার রুহের দোয়ার, তাঁর গানের-তার বাণীর। দু-শ বছর আগের শাহ লতিফ আজো সিন্ধিভাষীর হৃদয়-মনের একচ্ছত্র রাজা। তিনি তাদের প্রাণ জুড়ে বিরাজ করছেন, তাদের মন মননের দিশা দিচ্ছেন।

শিক্ষার হের-ফের

লেখাপড়া করলেই বা জানলেই লোক শিক্ষিত হয় না। কাজেই লেখাপড়া জানা আর শিক্ষিত হওয়া এক কথা নয়। অর্জিত বিদ্যার ও জ্ঞানের প্রয়োজনীয় অংশ বোধ-বুদ্ধির আয়ত্তে এনে জীবনচর্চার অন্তর্গত করে নিতে না জানলে বা না নিলে মানুষ শিক্ষিত হয় না। এজন্যে আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা থাকা আবশ্যক।

শিক্ষা মানুষের রুচি করে পরিশ্রুত, বুদ্ধি করে তীক্ষ্ণ, মন করে পরিচ্ছন্ন, মনন করে মার্জিত ও বিন্যস্ত। অতএব শিক্ষা পরিশীলন ও পরিশ্রুতির মাধ্যম ও বাহন। লেখাপড়াই তাই মন-বুদ্ধি আত্মার পরিমার্জনা ও বিকাশের উৎকৃষ্ট পন্থা বলে বিবেচিত। কিন্তু তা কোনো দেশেই বিশেষ করে আমাদের বেলায় আশানুরূপ ফলপ্রসূ হয়নি।

তার কারণ যে-বিদ্যা অর্জনের জন্যে আমাদের মানসিক ও পরিবেশিক প্রস্তুতি নেই, সে বিদ্যা আকস্মিকভাবে আমাদের ঘাড়ে এসে চেপে বসেছে। ফলে আমাদের অর্জিত বিদ্যা, লব্ধ জ্ঞান আর লালিত বিশ্বাস নীলনদের প্রবাহের মতো তিনটে পৃথক ধারায় আমাদের মন ও মননের ক্ষেত্রে জীবনরস সিঞ্চিত করে।

সন্তানদের লোকে স্থূল-কলেজে পাঠায় বিদ্যার্জনের জন্যে, জ্ঞান বা শিক্ষা লাভের জন্যে নয়। এ-বিদ্যা যে বিদেশী-বিজাতি-বিধর্মীর সরকারি বিদ্যা এবং তা যে কেবল অর্থোপার্জনের জন্যে প্রয়োজন, জীবনের আর কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্যে নয়–এ চেতনাও জিইয়ে রাখার চেষ্টা থাকে অভিভাবকদের এবং সতর্কতা থাকে বিদ্যার্থীর।

ফাঁক-ফুকুরে যদি জ্ঞানের ছিটেফোঁটা চিত্তলোকে প্রতিষ্ঠা পায়, তা হলেও তা জীবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে হয় না, কেবল কেতাব লেখার আর কথা বলার ক্ষেত্রেই সীমিত থাকে তার উপযোগ।

লালিত বিশ্বাস-সংস্কারই আমাদের জীবনযাত্রার ভিত্তি জীবন যাপনের দিশারী। বিশ্বাস সংস্কারের নিয়ন্ত্রণেই আমাদের জীবন চালিত। কেননা এগুলোই আমাদের আচরণীয় ধর্মবিধির উৎস। অতএব বিদ্যা ও জ্ঞান আমাদের বহিরঙ্গের আভরণ ও আবরণ আর বিশ্বাস-সংস্কার আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পদ। ফলে আমরা স্থূল-কলেজে যা পড়ি তা দুর্লভ সম্পদরূপে মন-বুদ্ধির স্পর্শ বাঁচিয়ে রক্ষা করি, অথবা বিস্মৃত হয়ে দায়মুক্ত হই। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের চিন্তায়, কর্মে কিংবা অনুভবের পরিসরে তা ছায়াও ফেলতে পারে না। যেমন স্বধর্মের কথা ছাড়া অন্য ধর্মের কথা যতই ভালো হোক, তা যে আমার জন্যে নয়–এ সচেতনতা আমাকে গোড়াতেই বিরূপ করে রাখে। তাই তেমন কথা শ্রুতিমধুর ও যুক্তিগ্রাহ্য হলেও হৃদয়ভেদ্য হয় না।

এজন্যেই রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপকও পড়া-পানিতে খুঁজে পান রোগের ও দুর্ভাগ্যের নিদান, পদার্থবিজ্ঞানী ঝাড়ফুকে লাভ করেন বৈদ্যুতিক সেকের ফল। উদ্ভিদবিজ্ঞানীর কাছেও বেলপাতার মর্যাদা আলাদা। জীববিজ্ঞানীও হুতোম, পেঁচা কিংবা টিকটিকির দৈব-প্রতীকতায় আস্থা রাখেন। এমনি করে নৃতত্ত্ববিদ কিংবা সমাজবিজ্ঞানী, ভূতাত্ত্বিক কিংবা জ্যোতির্বিদ কেউই অধীত বিদ্যাকে জীবনে অধিগত বোধে পরিণত করেন না। জর্ডন-জমজম কিংবা গঙ্গার পানি, বার-তিথি-নক্ষত্র, হাঁচিকাশি-হোঁচট, জীন-পরী-অপ্সরা, ভূত-প্রেত-দৈত্য অথবা পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্ব ও দৈব-কাহিনী তাঁদের কাছে তাঁদের অধীত বিদ্যা ও পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানের চেয়ে বেশি সত্য ও বাস্তব।

তাই নিজের সন্তানই যখন পিছু ডাক দেয়, তখন সে আর আত্মজ থাকে না, মুহূর্তের জন্যে হয়ে উঠে দৈব-প্রতীক, তেমনি হাঁচি কিংবা কাশিও থাকে না নিছক দৈহিক প্রক্রিয়া বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে হয়ে ওঠে দৈব-ইশারা। সেরূপ কাক, হুতোম পেচক কিংবা টিকটিকির ডাক হয়ে যায় দৈববাণী।

এ কারণে অধীত বিদ্যা, লব্ধ জ্ঞান, আর লালিত বিশ্বাসের টানাপড়েনে স্থিতধী বুদ্ধিমান মানুষের জীবনেও ঘোচে না কর্মে ও চিন্তায় অসঙ্গতি, ভাব ও অনুভবের জটিলতা।

এই অসমন্বিত বিদ্যা ও বিশ্বাস লেখাপড়া-জানা মানুষকে সুস্থ হতে দেয় না। মানুষ হয় বিশ্বাসের দ্বারা চালিত হোক, অথবা জ্ঞানকেই পাথেয় করুক–এই দুটোর অসমন্বিত মিশ্রণে মানুষ তার চরিত্রের ও চিন্তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে।

এর জন্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদও অনেকখানি দায়ী। আমরা বিজ্ঞানের বই ও দীনিয়াত একই ছাত্রের জন্যে একই সঙ্গে পাঠ্য করি। ফলে সে বিজ্ঞানের বইতে সৃষ্টিতত্ত্ব কিংবা প্রাণিতত্ত্ব পায় এক রকম, দীনিয়াতে পড়ে অন্য রকম। বদ্ধমনের ছাত্র দীনিয়াতকেই জানে জীবনের সত্য বলে, আর বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে পরীক্ষা পাসের বিদ্যারূপে। এ অসঙ্গতি তার জীবনে কখনো ঘোচে না। যে-ছেলে সমাজবিজ্ঞানে মানুষ, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের উদ্ভবতত্ত্ব পড়ে ও মুখস্থ করে এবং প্রশ্নহীনচিত্তে যান্ত্রিক-নৈপুণ্যে পরীক্ষার খাতায় পুনরাবৃত্তি করে পরীক্ষককে চমকে দিয়ে আশি-নব্বই নম্বর পায়, সে হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে দেও-দানু-ভূত-প্রেত প্রভৃতির ভয়ে অস্থির কিংবা তাবিজ কবচ মাধ্যমে দৈবানুগ্রহ লাভে তৎপর।

আবার যে-ছাত্র মুক্তমনের কিন্তু দুর্বলচিত্ত তারও জ্ঞানে-বিশ্বাসে দ্বন্দ্ব কখনো ঘোচে না। তার অবস্থা আরো শোচনীয়। কেননা, তার জীবনে অসঙ্গতি আরো প্রবল ও প্রকট। সে কখনো সন্দেহ তাড়িত, কখনো বা বিশ্বাস-চালিত। সে ঘরেও সুস্থ থাকে না, ঘাটেও পায় না স্বস্তি। এমনি লোকের যৌবন ও বার্ধক্য দ্বৈতসত্তায় হয় বিকৃত, প্রৌঢ়ত্ব থাকে পীড়িত।

যারা ধর্ম ও বিজ্ঞানের যুক্তি ও বিশ্বাসের সমন্বয় চান, তাঁরা চাঁদ-সূর্যের অদ্বয়রূপে উপস্থিতিই কামনা করেন। পরস্পর বিপরীত সত্যে আস্থা স্থাপন, কেবল যে চরিত্রহীনতার পরিচায়ক তা নয়, কোনো সত্যকেই গ্রহণ না-করার নামান্তর মাত্র। সামাজিক মানুষের জীবনে মূল্যবোধ জাগে যুক্তি অথবা বিশ্বাস থেকে। মূলত উপযোগ-চেতনাই মূল্যবোধের উৎস হলেও যুক্তি ও বিশ্বাসই তার বাহ্য অবলম্বন।

কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে অন্ধ। বলতে গেলে যুক্তির অনুপস্থিতিই বিশ্বাসের জন্মদাতা। যুক্তি দিয়ে তাই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা চলে না। বিশ্বাসের ভিত্তিতে যুক্তির অবতারণাও তেমনি বিড়ম্বনাকে বরণ করা ছাড়া কিছুই নয়।

আজকাল একশ্রেণীর জননেতা, শিক্ষাবিদ ও সমাজকল্যাণকামী মনীষী শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্ম ও বিজ্ঞানের যুক্তি ও নীতিবোধের সমন্বয় ও সহ-অবস্থান কামনা করছেন। নতুন ও পুরোনোর, কল্পনার ও বাস্তবের, যুক্তির ও বিশ্বাসের অথবা দুই বিপরীত কোটির সত্যের সমন্বয় সাধন করে নতুনে ও পুরাতনে, সত্যে ও স্বপ্নে সঙ্গতি স্থাপনে তারা আগ্রহী। তাই পুরোনো ধর্ম ও পুরোনো নীতিবোধের সঙ্গে আধুনিক জীবন-চেতনার মেলবন্ধনের উপায় হিসেবে তারা বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মশিক্ষা দানেও উদ্যোগী। কিন্তু এর পরিণাম যে শুভ হবে না–অন্তত যে হয়নি তার প্রমাণ পাদ্রি স্থূল ও নিউস্কিম মাদ্রাসা।

অবশ্য উক্ত শ্রেণীর চিন্তাবিদদের সদিচ্ছা প্রশ্নাতীত। তবে তাঁরা বিভ্রান্ত এ-ই যা। য়ুরোপে যারা বৈজ্ঞানিক সত্যর আবিষ্কারক ও দার্শনিক সত্যের প্রবর্তক তাঁরা হয় নাস্তিক নয়তো সংশয়বাদী। আমরা গ্রন্থের মাধ্যমে তাঁদের বাণীই শুনি এবং চোখ মেলে দেখি তাঁদেরই কৃতি। অথচ সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাই যুবরাপীয় সাধারণ মানুষের দিকে–যেন এরাই এ কৃতিত্বের দাবীদার। এবং দেখি যে, এরা জীবনে পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার ও ধর্ম ছাড়েনি। কাজেই আমরাই বা ছাড়ি কেন? মনে ভাবি, বিজ্ঞানে-বিশ্বাসে বুঝি বিরোধ নেই। দুটোর সমন্বয়েই যেন সম্ভব হয়েছে য়ুরোপের প্রগতি ও ঐশ্বর্য, প্রাপ্তি ও প্রতিষ্ঠা। এমনি একটা ভুল অথচ দৃঢ়মূল ধারণার বশেই আমাদের শিক্ষাবিদদের এই সৎ-প্রয়াস। বহতা নদীর দুইকূল রক্ষা করা যায় না এবং দুই নৌকায় পা রাখাও বিপদসঙ্কুল–এই আপ্ত বাক্যদ্বয়ে আজো আস্থা রাখা নিরাপদ। তাই বিশ্বাস অথবা বিজ্ঞান–দুটোর একটা ছাড়তেই হবে। নইলে মানুষের চারিত্রিক বিকৃতি বাড়বে বই কমবে না।

অবশ্য এককালে বিশ্বাসই মানুষের চিন্তা ও কর্ম নিয়ন্ত্রণ করেছে। মানুষ দুঃখে-বিপদে প্রবোধ ও শক্তি পেয়েছে সে-পথেই। তখন কিন্তু জ্ঞানের প্রসার হয়নি, তখন বিজ্ঞানও হয়নি জীবন-যাত্রার অবলম্বন। বিশ্বাসই ছিল মানুষের অভয় শরণ। আজ যুক্তি ও বিজ্ঞানের মোকাবিলায় বিশ্বাস দেউলে। বিশ্বাসের মহিমা কীর্তনে আজ আর কী ফল! চালু ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দিয়ে নিজেকে প্রতারিত করা অসুস্থ মনেরই পরিচায়ক মাত্র।

যারা মানুষের নৈতিক জীবনের মানোন্নয়ন-বাঞ্ছয় ধর্মশিক্ষা কামনা করেন, তাঁদেরকে এ আশ্বাসটুকু হয়তো সঙ্গত কারণেই দেয়া যায় যে, যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞান-চেতনার মাধ্যমেও জীবন ও সমাজ সম্বন্ধে নতুন নীতিবোধ জাগানো সম্ভব এবং নৈতিক জীবনও উন্নততর করা দুঃসাধ্য হবে না। কেননা মানুষের মানবিক গুণের বিকাশ ত্বরান্বিত হয় সাহিত্য-দর্শন-ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান পাঠে। যুক্তিপ্রবণতার উদ্ভব ও বৃদ্ধি এতেই হয়। আর বিজ্ঞান করে যুক্তিনিষ্ঠ ও সত্যসন্ধ।

কিন্তু এতেও মাকড়সার জালের মতো এক সূক্ষ্ম বাধা মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। আজকাল সরকার, শিক্ষক ও অভিভাবক সবাই বৃত্তিমূলক বিদ্যার অনুরাগী ও পক্ষপাতী। তারা জনগণকে ও ছাত্রকে বৃত্তিমূলক বিদ্যার উপযোগ সম্বন্ধে সচেতন করিয়ে দেয়ার প্রয়াসী। পেশাগত লক্ষ্য স্থির করেই পড়–এ-ই হচ্ছে তাদের স্লোগান। শুনে শুনে ছাত্রছাত্রীরাও লেখাপড়াকে পেশা শিক্ষা বলেই মনে করে। বিদ্যার্জন যেন ভাবী পেশারই Training। ফলে লেখাপড়া করে বিদ্যার্জন করে শিক্ষিত হও, মানুষ হও এমন কথা আজকালকার ছেলেমেয়রা শুনতেই পায় না। মানবিক বৃত্তির পরিশীলন, পরিশ্রুতি ও বিকাশের জন্যেই বিদ্যার্জন এবং বিদ্যার্জনেই যে বিদ্যাচর্চার শেষ –এর বৈষয়িক গুরুত্ব থাকলেও তা যে ছাত্রছাত্রীদের অমন করে জানিয়ে দিতে নেই, এ যুগে সে কথা কেউ স্বীকারই করেন না। ফলে লেখাপড়া শিখে লোক যন্ত্রীই হচ্ছে, মানুষ হয়ে ওঠার প্রেরণা পাচ্ছে না। তাই সমাজে এখন লেখাপড়া-জানা যুবকেরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, উকিল-অধ্যাপক বা সরকারি-সওদাগরী কর্মচারী হয়। সততায়, প্রতিবানতায়, পরার্থপরতায়, উদারতায়, মানবিকতায় ও বিচারশীলতায় মানুষ হয় কৃচিৎ। এর পরিণাম যে সমাজের পক্ষে শুভ হচ্ছে না, তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদ্যাকে এভাবে বিষয়বৃত্তির অনুগত করে সীমিত লক্ষ্যে নিবদ্ধ রাখা আর মানবমনীষা ও মানবিক বৃত্তিতে জৈবিকতার সংকীর্ণ সীমায় নিয়ন্ত্রিত করা একই কথা। এতে প্রাণ বাঁচে কিন্তু মন নিশ্চিতই মরে এবং প্রাণ থাকলে প্রাণী হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না।

সঙ্গীত ও অধ্যাত্মসাধনা

মানস প্রয়োজনে ও জৈবধর্মের তাকিদে সঙ্গীত মানবসমাজে স্বতোউদ্ভূত। সে কারণেই কৌম সমাজে art আর ritual অভিন্ন। আদি সমাজে গান কর্মেরই অঙ্গ ছিল–মুখে গান, হাতে কাজ। গানের ছাদে হাত চলে, তাই আজো ছাদ নির্মাণে গান অপরিহার্য। এভাবে জীবনকে কলার অনুগত করে কিংবা কলাকে জীবনানুগ করে সাধনার শুরু হয়েছে কবে থেকে তা কেউ বলতে পারে না। তবে জানা অতীতের গোড়ার দিকের কুয়াশার প্রলেপেও যা ঢাকা পড়েনি তা হচ্ছে : কলাশিল্পের ও অধ্যাত্মজীবনবোধের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। তাই চিত্রকলা ভাস্কর্য নৃত্য ও গীতি এমনকি স্থাপত্যও একই উৎসের ইঙ্গিত দেয়। সঙ্গীতের সঙ্গে জীবনের এমনি গভীর যোগ রয়েছে বলেই ইসলামের সুকঠোর নির্দেশও আরবেরা বেশি দিন মেনে চলতে পারেনি। ইসলামের উন্মেষের মাত্র কয়েক বছর পরেই উমাইয়াদের আমল থেকেই সঙ্গীতচর্চা প্রশ্রয় পেতে থাকে।

আরবদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ কেবল গতানুগতিক চর্চায় নিঃশেষ হয়নি, বরং ইরানী, নবেতিক, সিন্ধি, গ্রীক প্রভৃতি সঙ্গীত পদ্ধতির অনুশীলনে ঋদ্ধ ও উন্নত করার প্রয়াসেও অভিব্যক্ত হয়েছে। তফাতের মধ্যে এই : মুখ্যত মানসপ্রবণতাবশে এবং কিছুটা শাস্ত্রীয় প্রভাবে তা কেবল সৌন্দর্যানুশীলন ও আনন্দের উপকরণ রূপেই গৃহীত হয়েছে। আব্বাসীয় পতনযুগে মুসলিম-সঙ্গীতে আবার ধর্মীয় আবেগ যুক্ত হয়েছে। আসলে ইরানী প্রভাবে সূফীমতের প্রসারেই সঙ্গীত হয়ে উঠল বোধন-গীতি, সাধনসঙ্গীত ও ভজন। কেননা আরবে সঙ্গীতচর্চা ইসলামোেত্তর যুগে অবাধ ছিল না, তার উপর সৌন্দর্যপিপাসা আনন্দ-অন্বেষা ও স্বপ্নালুতাই ছিল তাদের সাঙ্গীতিক প্রয়াসের মূলে।

এদের লক্ষ্য কখনো সঙ্গীতে অধ্যাত্ম আবেগ সৃষ্টির দিকে ছিল না। সমস্ত আরব ইতিহাস, তাহার ভাষা ও সামাজিক জীবন সংক্ষেপে যে একটি কথায় বলা চলে, তাহা হইল কল্পনাবিলাস ও খেয়াল। তাহাদের সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ললিত কলায় এই কল্পনার যথেষ্ট নির্দশন বিদ্যমান। ইহাদের স্থাপত্য শিল্পের দিকে লক্ষ্য করিলে দেখা যাইবে যে, সুদৃঢ় ইমারত অপেক্ষা ইহা জটিল রূপকল্প এবং আলঙ্কারিক নকশামাত্র। ইহাদের চিত্রকলা বর্ণসমাবেশের প্রকাশ এবং ইহা সুসম্বন্ধতাহীন সুর সৃষ্ট এমন এক কাল্পনিক নকশা যাহাকে কোনো সংজ্ঞায় বাঁধিয়া দেওয়া যায় না। সঙ্গীত সম্বন্ধেও ঐ একই কথা : শোভা-সৌন্দর্য, সুবৈচিত্র্য এবং অলঙ্করণই হইল ইহার মৌলিক উপাদান। Encyclopaedia of Islam গ্রন্থে সংকলিত মুসলিম স্থাপত্যাদি সম্বন্ধে লিখিত প্রবন্ধে Berchem ( বাৰ্চেম) এই দিকটারই বারবার উল্লেখ করিয়াছেন–সেখানে তিনি বলিয়াছেন আরবি য় শিল্পকলা প্রকৃতি নহে, প্রকৃতির স্বপ্ন। … সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মুসলিমগণ শিল্পের জন্যই শিল্প হিসাবে আনন্দ ও সৌন্দর্যভোগের উপায় স্বরূপ ও বিচিত্র অভিজ্ঞতায় উদ্বেল ইন্দ্রিয়ানুভূতির অবলম্বনরূপে সঙ্গীতের চর্চা করিয়াছিলেন এবং সেইজন্যই ইহার সমগ্রতা, ঔজ্জ্বল্য, ভব্যতা ও শালীনতা লইয়া ইহা বিশিষ্ট।

অতএব আর্য বলেই হোক কিংবা ভারতিক প্রভাবেই হোক অথবা জোরাস্ট্রীয় মতবাদের সংস্কার বশেই হোক, ইরানে মরমীয়াবাদের পরিণতি কালে সঙ্গীত ও নর্তন সাধন-ভজনের উপায়রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। ইরানি মরমীয়াবাদ তথা সুফীমত কোনো ঋজু ও অবিমিশ্র দর্শন-উদ্ভূত নয়; এটি গ্রীক বৌদ্ধ খ্রীস্টান ইহুদী মানী ও বেদান্তদর্শনের মিশ্রণে এক জটিল ও বহুধা বিভক্ত মতবাদ। ইসলামের মতো বৌদ্ধধর্মেও নাচ-গান বাজনা নিষিদ্ধ ছিল বটে কিন্তু বৌদ্ধেরাও একই অনিবার্য কারণে তা মেনে চলেনি। ট্রানসকসিয়ানার বৌদ্ধরাই পরবর্তীকালের তুর্কী, পাঠান ও মুঘল মুসলমান। কাজেই তাদের রক্তেও বৌদ্ধগুরুবাদ ও যোগতান্ত্রিক সংস্কার সুপ্ত ছিল। এদিকে ভারতে কালক্রমে অনার্য যোগ-সাংখ্য-তন্ত্র ও আর্য কর্মবাদ আর জ্ঞানবাদের সংমিশ্রণে যে সর্বেশ্বরবাদমূলক বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদ প্রশ্রয় পেল, তারই পরিণতিকালে ভারতে মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটে।

যদিও শঙ্কর-দর্শনের প্রভাবেই বৌদ্ধ-উচ্ছেদে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠা পায়, তবু শঙ্করের জ্ঞানবাদ তথা মায়াবাদ লোকের জীবনচর্যায় ফলত ধর্মাচরণে বিশেষ গৃহীত হয়নি। কাজেই যোগতান্ত্রিক সাধনাই মরমীয়াবাদের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে শাস্ত্রীয় ধর্মও নানা মিশ্র মতে জটিল এবং আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরে বিপুল হয়ে উঠে। বেদান্ত দর্শনের প্রচ্ছায় গড়া এই আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতীকি কল্পনায় প্রকৃতির স্থান ছিল মুখ্য আর অলৌকিকতার প্রভাব ছিল অসামান্য। এজন্যেই ভারতীয় কলাশিল্প ধর্মসম্পৃক্ত; ইহা ধর্মের এবং ব্যাপকতর অবস্থায় সমগ্রজীবনের অনুগত। ভারতীয়দিগের নিকট কলাশিল্প সৌন্দর্যানুশীলন অপেক্ষা জীবনকে তাহার সামগ্রিক পূর্ণতায় এবং তাহার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধীয় যাবতীয় রহস্যে উপলব্ধি করার মধ্যেই সমধিক নিহিত। অতলস্পর্শী ব্ৰহ্মতত্ত্বের রূপায়ণ হইল ভারতীয় ললিতকলার জাগ্রত লক্ষ্য। ৫

ইসলাম ও সঙ্গীত *[* এই অংশটুকুর উপকরণ ডক্টর মাখন লাল রায় চৌধুরীর Music in islam: JASBLetters & science 1957 থেকেই বিশেষভাবে সংগৃহীত।]

ইসলাম-পূর্বযুগে অন্য মানুষের মতো আরবেরাও ছিল সঙ্গীতপ্রিয়। আরবি ভাষায় গিনা, মুসিকী ( গ্রীক) এবং সামা ( সিরীয়)–এই তিনটে শব্দ সঙ্গীতবাচক। আরবে পেশাদার গায়িকারা কইনাৎ ( Qainat) কিংবা কিয়ান ( Qiyan) নামে অভিহিত হত। দেশী গায়িকা ছাড়াও আবিসিনিয়া থেকে অনেক গাইয়ে-মেয়ে আসত। এরা সমাজ-জীবনের অঙ্গ ছিল। ইসলাম পূর্বযুগের সঙ্গীতযন্ত্রের মধ্যে আমরা মিযহার (Lute), মিযাফা ( Psalter), কুসাবা (Flute), মিযমার ( Reed pipe) এবং ডাফ (Tambourine), সুর, নাকাড়া, তবলা (অতবল) সঞ্জ, জলাজিল প্রভৃতির নাম পাই। মক্কার উকায-এ যে-বার্ষিক মেলা হত তাতে গোটা আরবের গোত্রগুলো জড়ো হত নিজেদের শৈল্পিক উৎকর্ষ দেখাবার জন্যে। মুয়াল্লাকাগুলো এখানেই গীত বা আবৃত্ত হত। তখনকার আরবে জাদুকর এবং গণকরাও তাদের পেশা চালাত গানের মাধ্যমেই। হজ উদযাপনের সময়ও গান চলত, তার রেশ রয়েছে তাহলিল ও তালবিয়ায়। আশরিক সবির কয়মা নুঘীর–এই আয়াত এখনো সুর করেই পড়া হয় মীনায় ইফাদা করবার সময়। আযানও ইসলাম-পূর্বযুগের প্রথার অনুসরণ। নারী-পর্দাপ্রথা চালু মা-থাকায় রসুলের আমলেও নারীরা উৎসবে-পার্বণে-যুদ্ধে গানে-বাজনায় অংশগ্রহণ করত। ওহুদের যুদ্ধেও নাকি রণগীতি গেয়েছিল নারীরাই।

দেবতা ও উপদেবতার অনুগ্রহ লাভের জন্যেও গায়িকার গানই কার্যকর বলে মনে করা হত। এজন্যে তাদের অপর নাম ছিল দজিনা (Dajina) বা মদজিনা (Madjina)। তাই ইসলাম পূর্বযুগের আরবে নারীর প্রভাব সম্বন্ধে : R.A. Nicholson বলেছেন : Wise women inspired the poets to sing and warriors to fight…. কাফেলায় কিংবা সরাইখানাতেও গায়িকা পোষা হত। আবুল ফারাজ ইসফাহানীর কিতাবুল আগানি ইবন, আবদুরব্বিহির (মৃত্যু : ৯৪০ খ্রী.) ইকদুল ফরিদ, ভৌগোলিক আল মাসুদীর কিতাবুৎ তানবিহ ওয়াল ইশরাক প্রভৃতি পুরোনো গ্রন্থে এবং কোরআনে-হাদিসে নানা প্রসঙ্গে কয়েকজন প্রখ্যাত গায়কের নাম আমরা জানতে পাই। নজর বিন হাবিস, মালিক বিন যোবায়ের, হরায়রা, খুলায়দা, বিলাল হাবসী, শিরিন, সারা, কুরায়ানা, কুরিল্লা, আমর, হামজা প্রভৃতি।

আমরা ইসলাম-পূর্বযুগের আরবে উৎসবে-পার্বণে-হজে, অনাবৃষ্টি-অজন্মায়-দুর্ভিক্ষে, দেবতার আবাহনে, যুদ্ধে, জাদুতে ও ভাগ্যগণনায় গানের প্রয়োগ দেখেছি। তাছাড়া প্রাত্যহিক জীবনে। আনন্দের উপকরণ হিসেবে গুঁড়িখানায়, সরাইতে ও কাফেলায় পেশাদার গায়িকা পোষার রীতিও ছিল অবাধ। এসব গায়িকার সবাই আরব ছিল না; আবিসিনিয়া, গ্রীস ও ইরান থেকেও আসত। এমনকি রসুলের আমলের যুদ্ধে ড্রামবাদক ছিলেন একজন ভারতীয়, তার নাম বাবা Sawandik।

এতে বোঝা যায় আরবেরা সঙ্গীতপ্রিয় জাতি। কাজেই ইসলামোত্তর যুগে সঙ্গীত-বিমুখ হওয়া তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য কৃচ্ছু সাধনার মতোই দুষ্কর ঠেকেছিল। ফলে প্রবৃত্তির প্রতিকূল সংগ্রামে তারাও বেশিদিন আত্মরক্ষা করতে পারেনি। অবশ্যম্ভাবীরূপে শুরু হল খোঁজাখুঁজি ও ব্যাখ্যা-নিরীক্ষা কোরআন-হাদিসের সমর্থন লাভের আশায়। এবং অভীষ্ট ফল লাভে দেরি হল না।

কোরআন থেকেই সঙ্গীতে আনা আয়াতের অনুমোদন বা অনুমোদনের আভাস ইঙ্গিত বের করা হল :

ক. নিশ্চয়ই গাধার ডাকই সবচেয়ে ঘৃণ্য স্বর।

খ. তিনি ইচ্ছেমতো তাঁর সৃষ্টিতে বৃদ্ধি করেন সুন্দর স্বর।

গ. এবং কোরআন আকর্ষণীয় করে পড়ো।

এমনি আরে অনেক আয়াত থেকে পরোক্ষ ইঙ্গিত২৪ সংগ্রহ করে সঙ্গীতের সমর্থনে ভাষ্য তৈরি হয়েছে। আবার একই পদ্ধতিতে সঙ্গীতবিরোধী তথ্যও উদ্ধার করেছে সঙ্গীতবিমুখ গোঁড়ারা।

হাদিস থেকেও পক্ষে-বিপক্ষে প্রমাণ সংগৃহীত হয়েছে প্রচুর। এতে কেবল বিতর্ক বিস্তৃত ও জটিলই হয়েছে; সবার পক্ষে গ্রহণীয় কোনো মীমাংসা মেলেনি।

হাদিসে সঙ্গীতের সমর্থন

ক. যারা দাউদের সুকণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করে, তারা আবু মুসা আল আশারীর কণ্ঠ শুনুক।

খ. রসুল স্বয়ং শ্লোক বা পদবন্ধ রচনা করে গীতিসুরে আবৃত্তি করেছেন :

১। ইন আন্তা ইল্লা অসবুউ দুমিতি
ওয়া ফি সবিলিল্লাহি মা লকিতি।
(হে রক্তপূর্ণ আঙুল, তুমি আল্লাহর রাস্তায় গিয়েছ)।

২। আতাইকুম আতাইকুম ..
ফাহাইয়ানা ওয়া হাইয়াকুম।
(আমি তোমাদের কাছে এসেছি, এসেছি,  আল্লাহ আমাকে এবং তোমাদেরকে দীর্ঘজীবী করুন)

রসুলের ওফাতে শোকাভিভূতা কন্যা ফাতেমাও পদ রচনা করে বিলাপ করেছিলেন:

৩। সব্বত আলাইয়া মসাইবু লউ ইন্নাহা–
সব্বত অলালাইয়ামি শররফা লাইয়াহিয়া।

আমার উপর বিপদপাত হয়েছে। যদি তা দিবালোকের উপর পড়ত, তা হলে তা রাত্রি হয়ে যেত।

গ, হযরত আয়েশা বলেছেন : রসুলের উপস্থিতিতে তার সাহাবীরা পরস্পরকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনাতেন। রসুল মৃদু হাসতেন।

ঘ. আমর বিন আশশারীয়া বলেছেন : আমিরসুলের সামনে উমাইয়া বিন আবিল সাতের শতেক শ্লোক ((verse) সবই আবৃত্তি করে শুনিয়েছি। রসুল বলছিলেন, আবৃত্তি করতে থাকো এবং মন্তব্য করেছিলেন উমাইয়া তাঁর কবিতার ভাবে প্রায় মুসলিম হয়ে গেছে।

ঙ. আয়েশা রসুলের আর এক উক্তি উল্লেখ করেছেন : তোমাদের সন্তানদের কবিতা শেখাও, এতে তাদের জবান মিষ্টি হবে।

চ. তিরমিজীতে বর্ণিত আছে : রসুল এক যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে এলে এক মহিলা ডফ (ডাফ) বাজিয়ে গান গেয়ে তাঁকে সম্বর্ধনা করতে চাইলে তিনি অনুমতি দেন।

ছ, তবরানি (Tabarani) তাঁর মজমি কবির-এ বর্ণনা করেছেন : একদিন রসুল নিজেই আয়েশায় কাছে এক গায়িকা এনে হাজির করেন এবং আয়েশার অভিপ্রায়-ক্রমে সে গান গাইল, রসুল শুনে (মুগ্ধ হয়ে) মন্তব্য করলেন : নিশ্চয়ই শয়তান (মিষ্টিস্বরের অধিকারী) তার নাসারন্ধ্র দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। কি নফখাশ শয়তানু মেন খারাইয়া।

জ, আয়েশা এক ঈদের দিনে এক আনসার মেয়ের গান শুনছিলেন, রসুল তখন বিছানায় শায়িত ছিলেন। আবু বকর এসে গান-বাজনা হচ্ছে দেখে আয়েশাকে তিরস্কার করে বললেন : শয়তানের যন্ত্র বাজুছে রসুলের ঘরে! রসুল বললেন : তাকে করতে (শুনতে) দাও আবুবকর, আজ ঈদের দিন।  [ আবু বকর: মিযমারুশ শয়তানি ফি বায়ত-ই-রসুলিল্লাহ্। রসুল : দাহুন্না ইয়া আবুবকর, ফা ইন্নাহা আইয়ামু ঈদ।]

ঝ, আয়েশা একবার এক এতিম মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, বিয়ের উপহার সামগ্রীর সঙ্গে গায়কও পাঠানো হয়েছিল, রসুলের সম্মতিক্রমে এবং রসুল নিজেও এ উপলক্ষে একটি গান রচনা করেছিলেন :

আনা নবীউ লা কঝিব।
আনা ইব্‌ন আবদ-ইল মুত্তালিব।

ঞ. একবার রসুলের উপস্থিতিতে আয়েশাকে কয়েকটি গায়িকা ডফ বাজিয়ে গীত শুনাচ্ছিল, উমর এসে বললেন, সঙ্গীত হচ্ছে শয়তানের বিদ্যা,অতএব হারাম। রসুল ভিন্নমত প্রকাশ করলেন। তারপর থেকে উমরও সঙ্গীত উপভোগ করতেন।

ট. আব্বাস ইবন মালিক বলেছেন : রসুল হুদা (কাফেলা চলাকালীন গান-উটগীতি) শুনতেন। এবং আয়েশা স্বয়ং মেয়েদের জন্যে এবং আনাসের ভাই বারা-ইন মালিক পুরুষদের জন্যে হুদা গাইতেন।

ঠ. রসুল আবিসিনিয়াবাসীদের বলেছিলেন : আরফাঁদ গোত্রের সন্তানেরা, তোমাদের অনুষ্ঠান (গান-বাজনার Performance Acrobatic) চালিয়ে যাও। (দুনাকুম ইয়া বনি আরফাদা ববাজি-মাশুগুল বাঁশি।]

ড. আবিসিনীয়গণের (জঙ্গীদের) ক্রীড়া ছিলো নাচ-গান। (বাজি-ই-জঙ্গীয়ান–রক্স ওয়া সুরূদ বুদা।

ঢ, আল্লাহ্ মিষ্টি কণ্ঠস্বর বঞ্চিত কোনো নবী পাঠাননি। মা বাসাল্লাহু নবীয়ান ইল্লা হসন আসসও।

ণ. মিষ্টিস্বরে কোরআনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত কর। [জাইয়িনুল কোরআন বি অসওয়াতিকুম।]।

ত, আল্লাহ্ নবীদের মিষ্টিসুর যেভাবে অনুমোদন করেছেন, এমনটি আর কিছুই করেননি। (মা আজান আল্লাহুতায়ালা লিশায়িন কমা আজানা আন নবীয়িতন হন অসসওত।]

খলিফাদের মধ্যে হযরত আবুবকর সঙ্গীত নিষিদ্ধ মনে করতেন। হযরত উমরও সঙ্গীতবিরোধী ছিলেন, তবে শেষের দিকে তিনি আর তেমন রুষ্ট হতেন না।

হযরত উসমান গান শুনতেন। নিজে গাওয়া গর্হিত মনে করতেন। তাঁর প্রিয় গায়কের নাম ছিলো আবু সাজ্জাদ। হযরত আলি নিজে কবি ছিলেন এবং ললিত কলার সমাদর করতেন। কিন্তু তিনি পেশাদার গায়িকাদের ঘৃণা করতেন।

মোটামুটিভাবে বলতে গেলে খলিফারাও সঙ্গীত বৈধ বলে মনে করতেন না। আরবদের বিশ্বাস শয়তান বড় শিল্পী। ভারতে যেমন সঙ্গীতাদি শিবপ্ৰােক্ত বলে ধারণা, তেমনি শিল্প শয়তান উদ্ভাবিত বলেই আরবদের বিশ্বাস। রসুলের উক্তিতেও এই শয়তানের কথা আছে।

বিশেষ করে ইসলাম-পূর্ব আরবে মদ, নারী ও সঙ্গীত নিয়েই জনগণ মত্ত থাকত, ইসলামের সংগ্রাম ছিল এসব অনাচারের বিরুদ্ধে। কাজেই যৌন-আবেদনমূলক সঙ্গীত ও পেশাদার গায়িকার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উপায় ছিল না। তাই কোরআনে, হাদিসে ও ফেকায় সঙ্গীতের প্রতি বিরূপতা প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি কবি ও গায়কের সততায় ও সত্যবাদিতায় অবিশ্বাস করার স্পষ্ট নির্দেশও রয়েছে :

ক. বিপথগামীরাই কবির অনুসরণ করে। [ আশু-অরাউ ইবাত্তাবি-উঁহুমুল গাউন।]

খ. [ওয়া মিনান্নাস-ই-মাই ইয়াতারি লাহওয়াল হদিসি লি য়ুদিল্লা আন সবিলিল্লাহ্।]

গ. রসুল বলেছেন : [ ইহজারুল গিনা ফাইন্নাহু মিন ফি, লি ইব্লিস ওয়া হুয়া শিরকুন ইনদাল্লাহি তায়ালাওয়ালা তাগান্নি ইল্লি শয়তান।] : সঙ্গীত থেকে আত্মরক্ষা কর।

এটি ইব্লিসের লক্ষণ; এটি শিরক। শয়তান ছাড়া কেউ গান গায় না।

ঘ. গায়ক ও শ্রোতা আল্লাহর অভিশপ্ত। (লা আনল্লাহ্ অল মুগান্নিআতা ওয়াল মুগান্না লাহু।

ঙ. রসুল গান করা ও শোনা নিষিদ্ধ করেছেন। [ আনিল গিনা-ই-ওয়াল ইসতিমা-ই আনিল গিনা।]

সব প্রতিরোধ ব্যর্থ করে দিয়ে আরব-মনের সাঙ্গীতিক প্রস্রবণ ক্ষীণধারায় ৬৬১ খ্রীস্টাব্দ অবধি বইতে থাকে। তারপর খলিফা মুয়াইয়া (মাবিয়া) যখন শাসনাধিকার পেলেন, তখন থেকে আরব সমাজে সাঙ্গীতিক প্রবণতা বাড়তে থাকে। কেননা, মুয়াইয়া নিজে সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন এবং স্বয়ং গায়িকা পুষতেন। তবু সাহাবী ও ইমামদের মধ্যে সঙ্গীত ব্যাপারে কখনো মতদ্বৈধতা ঘোচেনি। স্থান, কাল, প্রয়োজন ও প্রবণতা অনুযায়ী কেউ বলেছেন যায়েজ, কেউ করেছেন নিষেধ।

ইমাম আবু হানিফা যন্ত্রসহযোগে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা গান শুনতেন। ইমাম মালিকও গান উপভোগ করেছেন। ইমাম শাফী তাঁর কিতাবুল উলুম-এ সঙ্গীতকে সমর্থন করেছেন। গাজ্জালী তাঁর কিমিয়া-ই-সাদৎ-এ কিতাবুল উলুম সম্বন্ধে মন্তব্যসূত্রে বলেছেন যে শাফী সঙ্গীতের পক্ষপাতী ছিলেন। ইউনুস-বিন-আবদুল আলা একবার সঙ্গীত সম্বন্ধে ইমাম শাফীকে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে শাফী বলেন : হেজাজে আমি কাউকে সঙ্গীতবিরোধী দেখিনি।

ইমাম আহমদ-বিন হাম্বলের দুই পুত্রের উক্তিতে প্রকাশ, তিনি সঙ্গীত উপভোগ করতেন। নির্দোষ ও মহম্ভবের গানের প্রতি তিনি বিরূপ ছিলেন না। মোল্লা আলি কার হানাফী বলেন : চার ইমাম ও মুজতাহিদগণ সঙ্গীত উপভোগ করতেন।

আসলে কোনো ইমামই সঙ্গীতকে যায়েজ বলেননি। বিশেষ অবস্থায় শর্তসাপেক্ষে কখনো কখনো তাদের সঙ্গীত শুনতে বা অনুমোদন করতে দেখা গেছে মাত্র। কিন্তু তাঁরা স্পষ্ট মত দিয়েছেন সঙ্গীতের বিরুদ্ধে। সঙ্গীত হৃদয়ে মন্দভাব জাগিয়ে তোলে, এ-ই হচ্ছে সাধারণ ধারণা। অতএব সঙ্গীত ফাসেকী। যারা চরিত্র ও সাধনা বলে বলীয়ান; কেবল তাদের পক্ষেই সঙ্গীতচর্চা বৈধ হতে পারে। রসুল বলেছেন : সঙ্গীত হৃদয়ে উত্তেজনা আনে, যেমন জল (জলের স্পর্শে মাটির বুকে) ঘাস জন্মায়। এই মত সাধারণভাবে খলিফা, সাহাবী, তাবিন ও ইমাম সবাই পোষণ করতেন। কাজেই গীত গওনে-শ্রবণে অধিকারী ভেদ আছে। সুকণ্ঠ গায়ক যে সুরের জাদুকর এবং মহম্ভাবের সঞ্চারক, সে তত্ত্ব দাউদ নবীর কাহিনীর মধ্যে রয়েছে। তখন গান ফাসেকী নয় সাদেকী। অবশ্য Fakihani (ফাঁকিহানী] বলেন, আমি কোরআনে, হাদিসে কিংবা রসুলের জীবনে প্রত্যক্ষভাবে তথা স্পষ্টভাবে সঙ্গীতবিরোধী কিছু পাইনি।

গায়িকার প্রতি রসুল, খলিফা, সাহাবী, তাবিন, ইমাম প্রভৃতি সবাই ছিলেন বিরূপ। শিয়ারাও সঙ্গীতবিরোধী।

দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মৌলানা উপরোক্ত পরোক্ষ উক্তির ও তথ্যের প্রমাণে সঙ্গীত যায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছেন। ইমাম জাফর সাদিক, শেখ আবু এজিদ বিস্তামী, শেখ ইবনুল আরাবী, নুর কুতব-ই-আলম পাণ্ডুবী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ, শাহ রফিউদ্দিন, ইব্রাহিম সাদ জহিরী, শেখ আবু তালিব মক্কী, আবদুল হক দেহলবী, মৌলনা মুহম্মদ শাহ্ আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ প্রাচীন ও নবীন অনেক সাধক ও আল্লামা সঙ্গীতকে বৈধ বলেছেন।

নক্শবন্দিয়া ছাড়া আর সব মতের সূফীরাই সঙ্গীতকে সাধনার মাধ্যম করে নিয়েছেন।

বলেছি, শেখ আহমদ মুজাদ্দাদী নকশবন্দী ছাড়া অন্যান্য প্রধান সূফীদের সবাই সাধনায় সঙ্গীতের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। অবশ্য কাদিরিয়া ও শাত্তারিয়া সম্প্রদায় সঙ্গীতচর্চায় শর্তারোপ করেছে। আবু নসর সারাজ, ইমাম গাজ্জালী, শেখ আলি বিন উসমান হুজুইরী(কাশফ উল-মাহজুব লেখক, এটি ফারসি ভাষায় সূফীতত্ত্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ), ফরিদউদ্দীন আত্তার, শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, খওয়াজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া, জালালউদ্দিন রুমী প্রমুখ সঙ্গীতকে সাধনার অবলম্বন করেছিলেন।

.

০২.

সুফীরা প্রেমধর্মে বিশ্বাসী। কিতাব-উল-লুম্মায় আবু নসর সারাজ এবং এহিয়া-উল-উলুম ও কিমিয়া-ই সাদত গ্রন্থদ্বয়ে ইমাম গাজ্জালী সঙ্গীতের তাত্ত্বিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। আচারবাদীদের কাছে যা গর্হিত, মরমীয়াদের কাছে তা-ই কাম্য। এখানেই যাহের ও বাতেনের পার্থক্য। অতএব তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় সঙ্গীতে মানব-মনের একটি মহত্তর প্রকাশ স্বীকৃত হয়।

গাজ্জালীর মতে (কিমিয়া) সঙ্গীত হচ্ছে পাষাণে নিহিত সুপ্ত আগুনের মতো। ঘর্ষণে শিলা থেকে যেমন আগুন বের হয়, এবং তা গোটা অরণ্য দগ্ধ করে, তেমনি সঙ্গীতের স্পর্শে আত্মার আগুন জ্বলে উঠে। সোনা যেমন আগুনে পুড়ে বিশুদ্ধ ও রূপবান হয়, তেমনি হৃদয়কে সঙ্গীতের আগুন মুকুরে পরিণত করে, যার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয় জগতের সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্যের রূপভেদে তাত্ত্বিক নাম: জমাল, হুসন ও তনাসুব। সঙ্গীত সৌন্দর্যকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেয়। তার মতে নিঃসঙ্গতায় মানুষ বাঁচাতে পারে না। সে সঙ্গীত খোঁজে। যাকে ভালোবাসে তাকেই সে পেতে চায় সঙ্গীরূপে। কাজেই প্রেম বা মহব্বত করার জন্যে আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই। যাকে পেলে আর কিছুই পাবার থাকে না, একের মধ্যে সবকিছুই মেলে, সব অভাব মেটে; তার সঙ্গেই তো প্রেম করা, তাঁকেই সাথী হিসেবে পাওয়ার কামনা করা উচিত। বিশেষ করে, আল্লাহও মানুষের প্রেমকামী :

ক. আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, তারা আল্লাহকে ভালোবাসবে।

খ, আল্লাহপ্রেম, পিতামাতা, সন্তান ও ভ্রাতৃপ্রেমের চেয়ে বেশি।

গ, রসুলও বলেন : যে তার আর সব সম্পদের চেয়ে বেশি করে আল্লাহ ও রসুলকে ভালোবাসতে না পারে, সে ধার্মিক নয়। শরীয়তপন্থীদের মতো সূফীরাও সঙ্গীতে অধিকারী-ভেদ মানে। ৫৬ক তাই আবু নসর সারাজ যোগ্যতানুসারে শ্রোতারা তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছন :

ক. মুবদী ও মুরীদ (Beginners and disciples) খ. মুতওয়াসসিত্ ও সিদ্দিকী (Advanced and Purists). গ. আরেফিন (Mystics).

জুনাইদ বাগদাদীও স্থান (Makan), কাল (Zaman) ও পাত্র বা সঙ্গকে (Akhwan) সঙ্গীত শ্রবণের ঔচিত্য ও অনৌচিত্য বিচারে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। হুজুইরীরও এই মত। তিনিও আমাদের জন্যে নয়,অধ্যাত্মচিন্তা উদ্রেক করার উদ্দেশ্যে গীত বা শ্রুত সঙ্গীতই বৈধ বা বাঞ্ছনীয় বলেছেন।

যদিও হযরত আয়েশা প্রমুখের দোহাই ও নজির দিয়ে সঙ্গীতকে বৈধ করে নেবার প্রয়াস ইসলামের উন্মেষ-যুগ থেকেই শুরু হয়েছে, তবু বৈধ বলার চেয়ে অবৈধ বলার পক্ষে তথ্য, প্রমাণ ও যুক্তি যে বেশি, তা কেউ সহজে অস্বীকার করে না। আয়েশা-সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় : ঈদের দিনে, বিবাহোৎসবে এবং অন্যদিনে নির্দোষ সঙ্গীত গীত ও শ্রুত হতে পারে। আর অধ্যাত্মসাধনার বাহন হিসেবে সঙ্গীতের উপযোগে আন্তরিক বিশ্বাস রেখে কেউ যদি সঙ্গীতচর্চা করে কিংবা সঙ্গীতকে চর‍্যা হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে তার পক্ষে সঙ্গীত অবৈধ হতে পারে না। এমনি সব বিশ্লেষণ ও বিবেচনার ভিত্তিতে মুসলিম সমাজে সঙ্গীত বৈধ হয়েছে।

অবশ্য পাপ বলে জেনেও যেমন মানুষ লোভের বশে আর দশটা অপকর্ম করে, মুসলমানেরাও তেমনি মানুষ হিসেবে ফাসেকী জেনেও সঙ্গীতকে পরিহার করতে পারেনি। শোনা যায়, বাদশাহ কুতবউদ্দিন আইবেক সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন; ফলে তাঁর আমলে রাজ্যের জনগণও সঙ্গীতানুরাগী হয়ে উঠে। ইলতুতমিসের সময় গোঁড়া মুসলিমরা রাজকীয় হুকুমে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করে দেয়ার জন্যে ইলতুতমিসকে অনুরোধ করে। ইলতুতমিস কুতুবউদ্দীনের প্রতি শ্রদ্ধাবশে নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করাই স্থির করলেন। ফলে মুসলিম শাসনের গোড়া থেকেই ভারতে সঙ্গীত মুসলিম-সমাজে প্রশ্রয়। পায়।

পাক-ভারতে চিশতিয়ারাই মনেপ্রাণে সঙ্গীতকে সাধন-ভজন ও বোধনের মাধ্যম করেছিলেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (১১৪২-১২৩৮) সুলতান মুহম্মদ ঘোরীর বাহিনীর সঙ্গে তিনি ১১৯২ সনে ভারতে আসেন এবং হিন্দুতীর্থ পুষ্করের কাছে আজমীরে খানকা তৈরী করেন।

.

০৩.

ভারতের এক বৃহত্তর অঞ্চলে বিশেষ করে উত্তরভারতে এই চিশতিয়ারাই ইসলাম প্রচার করে। ইসলামের আনোদানকারী বলে তাঁদের প্রধানরা চেরাগী বলে অভিহিত হন। এঁদের মধ্যে কুতুবউদ্দিন দেহলবী, ফরিদুদ্দীন শকরগঞ্জী, জালালুদ্দীন পানিপথী, নিযামুদ্দীন আউলিয়া বলখী (প্রকৃত নাম মুহম্মদ বিন আহমদ বিন দাখিয়াল অল বোখারী), মুহম্মদ সাদিক গুনগুবী ও শেখ সলিম ফতেপুরীর মাহাত্ম্য আজো অম্লান। আমীর খুসরুও বুজুর্গ বলে খ্যাত। এরা সবাই সঙ্গীতকে সাধনার অবলম্বন করেছিলেন। এবং এঁরা হিন্দুদেরও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন। পঞ্চপঞ্জ চিশতিয়া গ্রন্থে সঙ্গীতানুরাগ ও সঙ্গীত সম্বন্ধে এঁদের ধারণার আলোচনা রয়েছে। শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী বলতেন–যারা সঙ্গীতের বিরোধিতা করে তারা রসুলের ও সাহাবীদের জীবন ও আচার সম্বন্ধে অজ্ঞ। তিনি তাঁর সন্তানকে সঙ্গীতচর্চায় উৎসাহিত করতেন।

য়া বুনাইয়া লা তকিজ-ই সামা
ফা ইন্নাহা লাহ্ওয়া ওয়ালা ইব।
(বৎস, সঙ্গীত পরিহার করো না, বহু মহাপুরুষ তা চর্চা করেছেন

সূফীদের মতে সঙ্গীত অধ্যাত্মসাধনায় সিদ্ধি ত্বরান্বিত করে। ইবনুল ফরিদ বলেন : সঙ্গীতের মূর্ঘনার মধ্যে আমি আমার দয়িতকে (আল্লাহকে) সমগ্র সত্তা দিয়ে দেখি।

আবুল কাসিম অল বঘবী (Baghwi) বলেন : সঙ্গীত আত্মার (spirit) খাদ্য। আত্মা যখন খাদ্য পায়, তখন দেহের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ হয়।

জালালুদ্দিন রুমীও বলেন, আগার আজ বুর্জি মানা-ই বুয়াদ সাইর-ই-উ ফিরিশতাহ্ ফিরু মানাদ আজ তায়র-ই-উ।

(If the musician soars up to pinnacle of ecstasy, the angel cannot follow in pursuit of him,)

চিশতিয়া সোহরওয়ার্দিয়া, কলন্দরিয়া, মারিয়া, কাদিরিয়া এবং মখদুমিয়া সূফীদের দান বাঙলাদেশে ইসলাম বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ। আশরাফ জাহাগীর তার একটি চিঠিতে সগর্বে লিখেছেন :

In the blessed land of Bangal, there is hardly a village or town where a muslim Sufi is not to be found and the innumerable graves of the muslim mystics which dot the country are a silent testimony to their self-denying devotion to their ideal.

জালালউদ্দিন তাবরেজী সম্বন্ধে Siyar-ul-Arifin (p ১৭১) গ্রন্থে আছে?

Shaikhul Mashaikh Jalaluddin Tabrezi went to Bengal. All the people of that (place) turned towards him and became his disciples. The Shaikh established a khanqah there and started a free Kitchen…etc.

চিশতি সূফীদের মধ্যে সিরাজুদ্দিন উসমান ওফেঁ আখি সিরাজ তাঁর সাগরেদ আলাউল হক, আলাউল-পুত্র নূর-কুতুব-ই-আলম, তাঁর শিষ্য শেখ হেসামুদ্দিন মানিকপুরী (কারা মানিকপুরের) বাঙলাদেশে প্রতিষ্ঠাবান ছিলেন। নূর-কুতুব-ই-আলমের ওয়াহাদাৎ-উল ওজুদ বিষয়ক পত্রের আলোকে চৈতন্যদেব প্রবতিত নব-বৈষ্ণব ধর্মের বিশ্লেষণ করলে এতে সূফী প্রভাবের আভাস পাওয়া যাবে।

শরীয়তী ইসলাম আর পাক-ভারতে সূফী দরবেশ প্রচারিত মুসলমান ধর্ম এক নয়। কাজেই সূফী-দীক্ষিত মুসলমানেরা পাক-ভারতে অবাধে সঙ্গীতচর্চার সুযোগ পায়। বিশেষ করে চিশতিয়া খান্দানে তো সঙ্গীতের মাধ্যমেই সাধন-ভজন শুরু হয়। পরে কলন্দরিয়া প্রভৃতি প্রায় সব মরমীয়া সম্প্রদায়েই সামা, হাল্কা ও দারা সাধনার মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হয়। সিন্ধুর লতীফ শাহ, পাঞ্জাবের বুলে শাহ, আজমীরের খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি, দিল্লীর নিযামউদ্দিন আউলিয়া, আমীর খুসরু এবং সুফী শেখ বাহাউদ্দিন, শের মোহাম্মদ ও মিয়া দলু, সাচল, বেদিল, রোহল, কুতব, য়্যারী, দরিয়া থেকে বাঙলার লালনশাহ ও আহমদুল্লাহ শাহ প্রভৃতি সবাই সঙ্গীতকে সাধনার উপায় রূপে গ্রহণ করেছেন। তাদের দরগায় আজো সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। কাজেই পাক-ভারতে মুসলমানদের সঙ্গীতচর্চা কলা-বিলাস মাত্র নয়, জীবনচর্যার তথা ধর্মাচরণের বাহন। এভাবে সঙ্গীত সমাজে নতুন মহিমায় ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হল। কেবল তা-ই নয়, কবীর, দাদু, রজব প্রমুখ দেশী মরমীয়ারাও সঙ্গীতকেই প্রচারের ও ভজনের বাহন করেছেন। আদি সূফী দরবেশদের মধ্যে কেবল খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি, কিংবা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া কোরায়শী মুলতানীই যে সঙ্গীতবিদ ও সঙ্গীত সাধক ছিলেন, তা নয়, আরো অনেক অখ্যাত দরবেশ ও তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্য সঙ্গীতানুশীলন জনপ্রিয় করে তোলেন। হযরত বাহাউদ্দিন জাকারিয়া রাগ-রাগিণীরও স্রষ্টা।

কবীর যেমন সূফী ও ভারতিক মরমীয়া ধারার সমন্বয় সাধক ৬৬; তেমনি আমীর খুসরুই মুসলিম (আরব্য-পারসিক তুর্কী) ও ভারতিক সঙ্গীতের মিশ্ৰধারার আদি প্রবর্তক। ৬৭ এখন থেকেই শুরু হল পাক-ভারতে সঙ্গীতের সোনার যুগ।

আগেই বলেছি, ইসলামের উদ্ভবের মাত্র কয়েক বছর পরেই উম্মাইয়াদের আমলে মুসলমানদের মধ্যে সঙ্গীতচর্চা শুরু হয়। অবশ্য ইসলামেও স্বর-মাধুর্যে মর্যাদা আরোপিত হয়েছে। নামাজে শিরিন-সুরে কেরাত পড়ার সামর্থ্য ইমামের অন্যতম যোগ্যতা বলে স্বীকৃত। কিন্তু তবু গোড়া শরীয়তী কোনোকালেই সঙ্গীতকে সুনজরে দেখেনি। তা সত্ত্বেও এর সর্বগ্রাসী মায়াবী প্রভাব থেকে দূরে থাকা সম্ভব হয়নি অনেকের পক্ষেই। তাই গোঁড়া মুসলিম সুলতান সিকান্দার লোদী কিংবা নিষ্ঠাবান গোড়া শরীয়তপন্থী ম্রাট আওরঙজীবও প্রথম জীবনে সঙ্গীতবিমুখ হতে পারেননি। পরে ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দে শাফী মজাহাবী হয়ে আওরঙজীব সঙ্গীতবিরোধী হলেন।

.

০৪.

বাঙালি মুসলমানেরাও যে সঙ্গীতকে অপার্থিব উল্কণ্ঠার তথা অধ্যাত্ম জিজ্ঞাসার নিবৃত্তির ও সাধনার বাহন করেছিলেন, তা চিশতিয়া, কাদিরিয়া, কলন্দরিয়া প্রভাবের প্রমাণ ছাড়াও, আঠারো শতকের কবি আলি রজাব জবানীতে পাচ্ছি :

আলি হোন্তে সে সকল সন্ন্যাসী ফকিরে
শিখিল সকল যন্ত্র রহিল সংসারে।
ভাবের বিরহ সব শান্ত হৈতে মন
রাগতাল কৈল প্রভু সংসারে সৃজন।
সর্বদুঃখ দূর হয় গীত যন্ত্র রাএ।
গীত যন্ত্র শুনি মহামুনি ভ্রম যাএ।
গীত যন্ত্র মহামন্ত্র বৈরাগীর কাম।
রাগযন্ত্র মহামন্ত্র প্রভুর নিজ নাম।
জীববন্ত যথ আছে ভুবন ভিতর
সর্বঘটে যন্ত্র বাজে গীতের সুস্বর।
ঘটে গুপ্ত যন্ত্র গীত যোগিগণে বুঝে।
তেকারণে সর্বজীবে সে সবারে পূজে।
গীতযন্ত্র সুস্বর বাজায় যে সকলে
মহারসে ভুলি প্রভু থাকে তা মেলে।
শুদ্ধভাবে ডুবি নৃত্য করে যেই জনে
গীতরসে মজি প্রভু থাকে তার সনে।

অপর একজন কবিও বলেন :

কহে হীন দানিশ কাজী ভাবি চাহ সার
রাগযন্ত্র নাদ সব ঘটে আপনার।
অষ্টাঙ্গ তন্ন মধ্যে আছএ যে মিলি।
তনান্তরে মন-বেশি করে নানা কেলি।
মোকামে মোকামে তার আছে যে স্থিতি
ছয় ঋত তার সঙ্গে চলে প্রতিনিত।…
রাগঋত অন্ত যদি পারে চিনিবার
জীবন মরণ ভেদ পারে কহিবার।
কিবা রঙ্গ কিবা রাগ কিবা তার রূপ
ধ্যানেত বসিয়া দেখ ঘটে সর্বরূপ।

বাঙালি মুসলিম সমাজে সঙ্গীতচর্চা যে সূফী প্রভাবেরই ফল, আমাদের সে অনুমান উক্ত চরণ কয়টির দ্বারা প্রমাণসিদ্ধ হল। কবি সৈয়দ সুলতান, আলাউল প্রভৃতিও সূফী সাধক ও পীর। তাদের সঙ্গীতপ্রীতি সাধনার অনুগত। আর তত্ত্ব-সঙ্গীত রচনার প্রেরণাও তাঁরা সাধন-সূত্রেই পেয়েছেন। আগেই বলেছি, বাঙালি মুসলিম মরমীয়ারা যে-সাধন পন্থা গ্রহণ করেছেন, তা মূলত ইসলামী নয়। ভারতিক সূফীমতবাদও একান্তভাবে আরব-ইরানি নয়। এর অবয়বে যেমন ভারতিক প্রভাব পড়েছে, বাঙালি মরমীয়াদের দর্শনে, ধর্মে ও আচারে প্রচুর দেশজ তথা ভারতিক উপাদান রয়েছে। কাজেই এদেশে হিন্দু-মুসলমান চিরকাল হাতে হাত মিলিয়ে ও মনে মন মিশিয়ে অধ্যাত্ম সাধনা করেছে। এভাবেই বাঙালি দেশে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনায় মরমীয়াদের উপমতগুলো সৃষ্টি হয়েছে।

বলেছি, মুসলিম অধিকারের পূর্বে ও পরে ভারতে যারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন, তাঁরা সবাই সূফী ছিলেন। এই মরমীয়াদের অনেকেরই সঙ্গে শরীয়তের বাহ্যানুষ্ঠানের বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। অথচ সাধারণের পক্ষে ধর্ম আচারিক ও আনুষ্ঠানিক না হলে ধর্মাচরণ দুঃসাধ্য হয়ে উঠে। ফলে মুসলমানেরা তাদের চারপাশেই অবলম্বন খুঁজেছে। এভাবেই তাদের তত্ত্ব-দর্শনে পীরপূজা ও দেহচর‍্যা মুখ্য হয়ে উঠেছে। তাদের তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যম হয়েছে ভারতিক রূপকল্প।৬৯ আরাধ্যের প্রতীক হলেন রাম ও রাধাকৃষ্ণ, এমনকি কালীও।

.

০৫.

মরমীয়াদের মতে, সৃষ্টি হচ্ছে স্রষ্টার আনন্দ সহচর। কাজেই মানুষের সঙ্গে আল্লাহর বান্দা-মনিব সম্পর্ক হতে পারে না; হতে পারে না পিতা-পুত্রের কিংবা ভক্ত-ভগবানের সম্বন্ধ। মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক হচ্ছে বন্ধুত্বের, প্রণয়ের। যেখানে প্রণয় আছে, সেখানে গতিবিধি অবাধ হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই নামাজ-রোজার বা এই প্রকার আনুগত্যের প্রশ্নই অবান্তর। ফলে শরীয়ত সেখানে নিরর্থক। অনুরাগে প্রণয়ের উন্মেষ, বিরহবোধে উপলব্ধি এবং মিলনে সার্থকতা। প্রেমের ধর্ম হচ্ছে প্রেমিক প্রেমাস্পদ পরস্পর পরস্পরকে আত্মস্থ করতে আকুল হবে, পরস্পরের মধ্যে আত্মবিলোপে কৃতার্থ হবে। এই প্রেম জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার প্রেম। জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মার খণ্ডিতাংশ। স্বরূপত খণ্ডের অখণ্ডে বিলীন হওয়ার আকুলতার নামই প্রেম।

গরজ খণ্ডের তথা জীবাত্মার, তাই সে প্রেমিক, তাই সে রাধা। পরমাত্মারও গরজ আছে। যেমন সমুদ্রও বারিবিন্দুর সমষ্টি মাত্র। বারিবিন্দুর উপরই তার অস্তিত্ব। কিন্তু কোনো বিশেষ বিন্দুর জন্যে তার বিশেষ আকুলতা নেই। এজন্যেই জীবাত্মা সদা উদ্বিগ্ন, পাছে সে বাদ পড়ে। তাই রাধা বলে : এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে; না জানি কানুর প্রেম তিলে জনি টুটে। প্রেমের পরিণতি একাত্মতায়, যখন বলা চলে আনল হক কিংবা সোহম। এ অবস্থাটা সূফীর ভাষায় ফানাফিল্লাহ অথবা বাকাবিল্লাহ আর বৈষ্ণবের কথায় যুগল রূপ বা অভেদ রূপ। এ দুটোতে সূক্ষ্ম দার্শনিক তাৎপর্যের প্রভেদ আছে। তবে অবস্থা ও অভিপ্রায় মূলত একই।

কুন ফায়াকুন দ্বৈতবাদের পরিচায়ক। আর একোহম বহুস্যাম অদ্বৈতবাদ নির্দেশক। সূফীরা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী; কিন্তু অদ্বৈত সত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগণ ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া, তবু তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে এবং পরিণামে অদ্বৈত সত্তার প্রয়াস। সূফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরমের কাঙাল। মানবাত্মার সুপ্ত বিরহবোধের উদ্বোধনই সূফী–বৈষ্ণবের প্রধান কাজ। কেননা, রুমীর ভাষায় :

দানা ছুঁ অন্দর জমিন পেনহা শওয়াদ
বাদ আজো সারে সবজি বস্তা শওয়াদ।

জীবাত্মা তখন বাঁশীর মতো বলে: বসোনো আজনায়ে ফুঁ হেকায়েত নি কুনদ…।

জ্ঞানদাসও বলেন : অন্তরে অন্তর কাঁদে কিবা করে প্রাণ অথবা পরাণ পিরীতি লাগি স্থির নাহি বাধে।

রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন :

বিরহানলে জ্বালোরে তারে জ্বালো
রয়েছে দীপ না আছে শিখা
এই কি ভালে ছিল রে লিখা
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।

এজন্যে সূফীগানে ও বৈষ্ণবপদে আমরা মিলনপিপাসু বিরহী আত্মার করুণ কান্না শুনতে পাই। সূফীগজল ও বৈষ্ণবপদ মানবাত্মার চিরন্তন Tragedy-এর সুর ও বাণী বহন করেছে। তার বেদনার অন্ত নেই। কেননা, সর্বক্ষণ চিত্তকাড়া কালার বাঁশি লাগিছে অন্তরে, সে কারণেই চিরকাল কাদিছে রাধা হৃদয়-কুটিরে।

এই প্রেমধর্মের আর একটি দিক হচ্ছে আত্মতত্ত্ব। কেননা, আত্মা এই প্রেমের এক পক্ষ তথা প্রেমিক। আর আত্মা পরমাত্মার অংশ তো বটেই। তাই সক্রেটিসের Knoweth thyself, উপনিষদের আত্মানাং বিদ্ধি, হাদিস বলে অভিহিত ইসলামের মান আরাফা নাফসাহু ফাঁকাদ আরাফা রাব্বাহু কিংবা উপনিষদের তং বেদ্য পুরুষৎ বেদমা বো মৃত্যু পরিব্যথাঃ-এই আত্মতত্ত্বের ভিত্তি ও লক্ষ্য দুই-ই। মুসলিম মরমীয়া কবিদের রাধা-কৃষ্ণ প্রতীক গ্রহণের কয়েকটি কারণ অনুমান করেছেন অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য। ৭০ তার মধ্যে তিনটে প্রধান- ক, দেশজ মুসলমান পূর্বসংস্কার বশে চৈতন্যের প্রেম-ধর্ম প্রচারকালে রাধাকৃষ্ণ লীলারসে মুগ্ধ হয়ে নিজেরাও পদ রচনা করেছেন। খ. রেওয়াজের প্রভাবে রাধাকৃষ্ণের রূপকে পদ রচিত হয়েছে বটে, তবে কৃষ্ণ অনেক মুসলমান কবির কাছে অপৌরুষেয়। এবং কানু ছাড়া গীত নেই যুগের নৈর্ব্যক্তিক নাগর কানাইরূপে লৌকিক প্রেমের নায়ক হয়েছেন। গ. আর সুফী মতের মুসলমানরা ভাব-সাদৃশ্য বশে জীবাত্মা-পরামত্মসূচক জনপ্রিয় দেশী রূপক হিসেবে রাধাকৃষ্ণের শরণ নিয়েছেন।

সৈয়দ সুলতান প্রভৃতি মুসলিম কবিরা শেষোক্ত কারণেই রাধা-কৃষ্ণ রূপকে পদ রচনা করেছেন। সূফী হলেও একেশ্বরবাদী মুসলমানের মনে রাধা-কৃষ্ণের রাস, মৈথুন প্রভৃতির কল্পনা প্রশ্রয় পাওয়ার কথা নয়। তাই তারা রূপ, অনুরাগ, বংশী, অভিসার, মিলন বিরহ প্রভৃতিকে জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্কসূচক ও ব্যঞ্জক বলে গ্রহণ করতে পারলেও বস্ত্র হরণ, দান, সম্ভোগ, খণ্ডিতা, বিপ্রলব্ধা প্রভৃতির সঙ্গে তাদের অধ্যাত্মতত্ত্বের মিল খুঁজে পাননি। সেজন্যে মুসলমানের লেখায় ওসব শ্রেণীর পদ সাধারণত পাওয়া যায় না। তাদের রচনায় অনুরাগ ও বিরহবোধ এবং জীবন-জিজ্ঞাসাই বিশেষরূপে প্রকট।

সৃষ্টিলীলা দেখে স্রষ্টার কথা মনে পড়ে–এটিই রূপ; সৃষ্টিবৈচিত্র্য দেখে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক বোধ জন্মে–এটিই অনুরাগ এবং তাঁর প্রতি কর্তব্যবুদ্ধি জাগে–এটিই বংশী আর সাধনার আদি স্তরে পাওয়া না-পাওয়ার সংশয়বোধ থাকে–তারই প্রতীক নৌকা। এর পরে ভাবপ্রবণ মনে আত্মসমর্পণব্যঞ্জক সাধনার আকাক্ষা উপ্ত হয়–এটিই অভিসার। এর পরে সাধনায় এগিয়ে গেলে অধ্যাত্ম স্বস্তি আসে–তা-ই মিলন। মিলনে আত্মসমর্পণের আকুলতা প্রশমিত হয়–তা-ই ফানাফিল্লাহ। এরও পরে চরম আকাক্ষা–একাত্ম হওয়ার বাঞ্ছ, যার নাম বাকাবিল্লাহ-এই বিরহ। মৃত্যুর আগে সাধারণের পরম মিলন নেই, সেজন্যেই বাকাবিল্লাহ সূচক পদের অভাব। কেউ কেউ সে দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেন। তারাই বাকাবিল্লাহ হন–আর বলেন আনল হক, বা। সোহম–যেমন মনসুর, বায়যিদ ও আদহাম বলেছেন। এজন্যেই মুসলিম রচিত পদ রাগানুগ নয়। শশিভূষণ দাশগুপ্তও তাই বলেন :

এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যাইত পারে যে, বাঙ্গালার মুসলমান কবিগণ রাধা-কৃষ্ণকে লইয়া যে কবিতা রচনা করিয়াছেন তাহা কোনো বিধিবদ্ধ বৈষ্ণবধর্মের আওতায় রচিত নহে। … বৈষ্ণবমতে রাধাকৃষ্ণের যত লীলা তাহার ভিতর মানুষের কোনো স্থান নেই। … শ্রীকৃষ্ণের সহিত মিলন বাসনাও বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত-বিরুদ্ধ। … কিন্তু অন্যরূপ পরিণতির সম্ভাবনা দেখা দিল মুসলমান কবিগণের ভিতরে, কারণ তাহারা চৈতন্য প্রবর্তিত একটি সাধারণ প্রেমধর্মের প্রভাব সামাজিক উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করিলেন; একটা সাহিত্যিক বিষয়বস্তু এবং প্রকাশভঙ্গিও উত্তরাধিকার সূত্রেই পাইলেন, কিন্তু পাইলেন না রাধাকৃষ্ণ লীলা সম্বন্ধে কোনো স্থিরবদ্ধ ভাবদৃষ্টি। সুতরাং বাঙ্গালার জনসমাজে যে সাধারণ ভক্তিধর্ম ও যোগধর্ম প্রচলিত ছিল, এই সকল কবিগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে সেই সকলের সঙ্গেই যুক্ত করিয়া লইলেন। বাঙ্গালা দেশের প্রেমপন্থী মুসলমান সাধকগণ অল্পবিস্তর সকলেই সুফীপন্থী সূফীমতে প্রেমই হইল। ভগবানের পরম স্বরূপ প্রেমের দ্বারাই আবার এই জগৎ সৃষ্টি। নিজের অনন্ত প্রেম আস্বাদনের জন্যই এক পরম স্বরূপের, বহুরূপে লীলা, ইহাই হইল সৃষ্টির তাৎপর্য। জীব হইল এই এক-এর সৃষ্টিলীলার প্রধান শরিক-লীলা দাসর। .. সূফী প্রেমধর্ম এবং বাঙ্গালার প্রেমধর্ম জনগণের মধ্যে যে একটি জনপ্রিয় সহজ সমন্বয় লাভ করিয়াছে, বাঙ্গালাদেশের মুসলমান কবিগণ সেই সমন্বয়জাত প্রেমধর্মের আদর্শের সহিত রাধাকৃষ্ণকে অনেক স্থলে মিলাইয়া লইয়াছেন। ফলে রাধার যে পূর্বরাগ অনুরাগ বিরহের আর্তি, তাহা কবিগণের জ্ঞাতে অজ্ঞাতে পরম দয়িতের জন্য নিখিল প্রেমসাধকগণের পূর্বরাগ বিরহের আর্তিতেই পরিণতি লাভ করিয়াছে এবং সেই আর্তির ক্ষেত্রে কবি নিজেকে শুধু দর্শক বা আস্বাদক রূপে খানিকটা দূরে সরাইয়া লন নাই, নিখিল আর্তির সহিত নিজের চিত্তের আর্তিকেও বিলাইয়া দিয়াছেন। ইহারই ফলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব কবিগণের ভাবদৃষ্টি হইতে বঙ্গীয় মুসলমান কবিগণের ভাবদৃষ্টি অনেক স্থানে পৃথক হইয়া পড়িয়াছে। আমরা মুসলমান কবিগণের রচিত রাধা-কৃষ্ণ লীলা সম্বন্ধীয় পদগুলির ভণিতা লক্ষ্য করিলেই এই কবিগণের মূল ভাবদৃষ্টির ও ইঙ্গিত পাইব।

উত্তরভারতীয় সাধক কবিগণও রাম বা রাধাকৃষ্ণকে এমনি ভাবদৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন এবং নতুন তাৎপর্যে গ্রহণ করেছেন। দাদু, দরিয়া, রজব, শেখ কাইম, এয়ারী, মইজুদ্দীন, আফসোস প্রমুখ কবির পদাবলী এ সাক্ষ্যই বহন করে।

বাঙলাদেশে রাধাকৃষ্ণ জীবাত্মা পরমাত্মার প্রতীক যেমন হয়েছেন, তেমনি দেহ ও আত্মা–ভক্ত ও ভগবানের রূপক হিসেবেও তাদের পাই। মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ করে বাউল সাধনায় দেহতাত্ত্বিক তাৎপর্যেও রাধাকৃষ্ণ চিহ্নিত। অবশ্য দেহতত্ত্বের প্রতীকী প্রকাশে রাধা-কৃষ্ণ তন-মনের প্রতিনিধিত্বে সীমিত থাকেননি, তন-মনের অস্থির ও বিভ্রান্তিকর রূপকল্প হয়েছেন। একে তো সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানেরা ধর্মান্তরিত ভারতীয়দের বংশধর, তাদের রক্তের সংস্কারে ভারতিক প্রভাব বিদ্যমান, তার উপর ইসলামের একটি বিশিষ্ট শাখা সূফীমতবাদ ভারতে প্রাধান্য লাভ করে। সুতরাং মুসলমানদের মন, ইন্দ্রিয়, আত্মা ও ধর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভারতিক ভক্তিবাদ তাদের সহজেই প্রভাবিত করতে পেরেছিল। তাই বাঙালি কবি শাহনূরের কথায় মুসলমানদের রাধা-কৃষ্ণ প্রতীক গ্রহণের সঙ্গত কারণ খুঁজে পাই :

সৈয়দ শাহনুরে কয় রাধাকানু চিন হয়।
রাধাকান্ত আপনার তনে রে।

আরো স্পষ্ট হয় যখন শুনিঃ

তন রাধা মন কানু শাহনুরে বলে।

অথবা,

সৈয়দ শাহনুরে কয় ভব কূলে আসি।
রাধার মন্দিরে কানু আছিলা পরবাসী।

অথবা, উসমানের কথায় :

রাধা-কানু এক ঘরে কেহ নহে ভিন।
রাধার নামে বাদাম দিয়া চালায় রাত্রিদিন।
কানুরাধা এক ঘরে সদায় করে বাস
চলিয়া যাইবা নিঠুর রাধা কানু হইবা নাশ।

সৈয়দ মর্তুজাও বলেন :

আনন্দমোহন মওলা খেলা ধামালী
আপে মন আপে তন আপে মন হরি।
আপে কানু আপে রাধা আপে সে মুরারি
সৈয়দ মর্তুজা কহে, সখি, মওলা গোপতের চিন
পুরান পিরীতি খানি ভাবিলে নবীন।

এর সঙ্গে স্মর্তব্য :

রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি
অন্যান্যে বিলাসয় রসাস্বাদন করি।

বিকৃত বৈষ্ণব সাধক বাঙলার বাউল ও অন্যান্য উপসম্প্রদায়ের অনেকগুলোই রাধাকৃষ্ণের রূপকে দেহতত্ত্ব তথা জীবাত্মা ও পরমাত্মার রহস্যভেদে প্রয়াসী।

 সাহিত্যে দেশ কাল ও জাতিগত রূপ

মানুষ তার স্বদেশে স্বকালের জাগতিক আনন্দ ও যন্ত্রণা এবং সম্পদ ও সমস্যার মধ্যেই জীবন নির্বাহ করে। অতএব দেশগত ও কালগত সম্পদে ও প্রভাবে মানুষের দেহ-মন-আত্মা গড়ে উঠে। অর্থাৎ মানুষ তার দৈশিক জলবায়ু প্রকৃতি-নিসর্গ এবং ভাষা ও জীবিকা-পদ্ধতি এবং কালিক ধর্মবোধ বিশ্বাস, সংস্কার, নৈতিক চেতনা, আর্থিক অবস্থা, আচারিক নিয়ম, সামাজিক বিধান ও রাষ্ট্রিক শাসনের মধ্যেই লালিত হয়। কাজেই মানুষের জীবনচেতনার বারোআনাই দেশ-কালের দান, বাকি চার আনা অনুশীলন লব্ধ। আবার বোধ, বুদ্ধি, জ্ঞান ও শিক্ষা ভেদে মানুষের চেতনায়ও বিকাশ ভেদ ও বৈচিত্র্য থাকে। এজন্যেই মানুষের অভিব্যক্ত আচরণে মগ্ন চৈতন্যের প্রভাব যত বেশি, পরিস্রত-চেতনার সাক্ষ্য তত নেই। ফলে বোধ-বুদ্ধি ও জ্ঞান-সংস্কৃতি সম্পন্ন অগ্রসর মানুষের সংখ্যা কম।

এই স্বল্পসংখ্যক অগ্রসর মানুষই তাদের অনুশীলন লব্ধ ভাব-চিন্তা-জ্ঞান প্রত্যয়ে ও কর্মে, আচরণে ও আবিষ্কারে, শিল্পে ও সাহিত্যে এবং দর্শনে ও ইতিহাসে প্রকাশ করেন। সামান্য অর্থে জীবনচেতনাই সংস্কৃতি। এ তাৎপর্যে প্রত্যেক সভ্য ও অসভ্য ব্যক্তির সংস্কৃতি রয়েছে কিন্তু তা সর্বমানবে সুলভ বলেই আমরা তাকে সংস্কৃতি বলে স্বীকার করিনে। অতএব বিশেষ পরিশীলিত চেতনাই সংস্কৃতি এবং সে-কারণে সংস্কৃতি সব সময়েই ব্যক্তিক। তা কখনো দেশগত কিংবা সমাজাশিত হতে পারে না। সংস্কৃতিকে যদি রুচি ও কর্মে বিভক্ত করি, তাহলে যা দেখতে শুনতে বলতে-করতে-শুঁকতে চাখতে-ধরতে কুৎসিত তা এড়িয়ে চলা এবং যা সুন্দর–শোভন ও কল্যাণকর- প্রত্যয়ে ও কর্মে, আচারে ও আচরণে, বরণে ও বর্জনে, সৃজনে ও আবিষ্কারে তার অনবরত চর্চাই সংস্কৃতি। ব্যক্তিক সংস্কৃতি অনুকৃত হয়ে দৈশিক, সামাজিক কিংবা জাতিক-রাষ্ট্রিক সংস্কৃতি রূপে পরিচিত হয়। আসলে ব্যক্তিক চেতনাসঞ্জাত সংস্কৃতি অনুকারীদের পক্ষে আচার মাত্র। এবং তা-ই দেশীয়-জাতীয় কিংবা গোত্রীয় সংস্কৃতি নামে অভিহিত হয়।

ব্যক্তিক সংস্কৃতিতে যে সৌন্দর্য-বুদ্ধি, কল্যাণ-চিন্তা, সৃষ্টিশীলতা, গ্রহণপ্রবণতা, সৌন্দর্য- অন্বেষা থাকে; দৈশিক, সামাজিক কিংবা জাতিক সংস্কৃতিতে তা থাকে না বলেই তা প্রাণহীন লোকাঁচার মাত্র। আর তখন সে-সংস্কৃতি প্রাণের প্রেরণা নয়-সুজনের সুরুচি সুকর্ম ও সৌজন্য নয়, আচারের বেড়ি বা সংস্কারের শৃঙ্খল মাত্র। যেমন ধূতি-চাদর কিংবা পাজামা-পাঞ্জাবি বাঙালির সংস্কারগত আচার মাত্র। কিন্তু এ পোশাক উদ্ভাবকের পক্ষে ছিল সংস্কৃতিবানতা।

সাধারণত মানুষের সংস্কৃতি প্রকাশ পায় তার দায়িত্ব ও কর্তব্য চেতনায়; তার সৌন্দর্য, সুরুচি ও সৌজন্য বোধে; তার ন্যায়-অন্যায় বোধজাত আইন-কানুনে; তার নৈতিক-সামাজিক আর্দশানুগত্যে; তার বরণ-বর্জন ক্ষমতায়, ঈর্ষা-দ্বেষ-দ্বন্দ্ব-ঘৃণা-লোভে-ক্ষোভ প্রভৃতির ক্ষেত্রে তার সংযম সাধনায়; পরের প্রতি তার প্রীতি ও শুভেচ্ছার অনুশীলনে ও তার মানবকল্যাণ কামনায়। কাজেই সংস্কৃতি পরিসুতি ও পরিশীলন সাপেক্ষ।

শিল্প-সাহিত্য-দর্শন প্রভৃতি মানস-সংস্কৃতির প্রসূন। যার সংস্কৃতি নেই, তার সৃজনশীলতা নেই। ব্যক্তিভেদে সংস্কৃতির মাত্রাভেদ আছে। কাজেই শিল্পে-সাহিত্যে-দর্শনেও গুণভেদে উৎকর্ষের স্তরভেদ রয়েছে। সংস্কৃতির প্রকাশ সাহিত্যে সুলভ। আমাদের পূর্ববাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনের পরিমাপও তাই আমাদের সাহিত্য দিয়েই সহজে করা সম্ভব।

আগেই বলতে চেয়েছি, দেশগত ও কালগত জীবন মানুষের ভাব-চিন্তা-কর্মে প্রতিফলিত হয়। সাহিত্য সেই জীবনের প্রতিবিম্বিত রূপ। শিক্ষা ভেদে, মন ভেদে, আর্থিক-সামাজিক অবস্থানভেদে মানুষের জীবনচেতনা বিভিন্ন হয়। কাজেই সাহিত্যও হয় বিভিন্ন স্তরের, আদর্শের ও লক্ষ্যের। জ্ঞান রুচি-আদর্শ ও চিত্তের প্রসারভেদে ভাষা, ভঙ্গি, অলঙ্কার এবং অনুভূতি ও দৃষ্টি হয় বিভিন্ন। কাজেই সাহিত্যের বহিরঙ্গে ও অন্তরঙ্গে দৈশিক ও কালিক স্বাক্ষর থাকেই।

সৎসাহিত্যের রস সর্বমানবিক হওয়া সত্ত্বেও দেশ-কালের প্রভাব থাকে বলেই সাহিত্য কখনো নির্বণ, নির্বিশেষ ও নির্লক্ষ্য হয় না। বক্তব্যের অবলম্বন হয় দেশজ-কালজ আনন্দ কিংবা যন্ত্রণা, গৌরব কিম্বা লজ্জা, সম্পদ কিংবা সমস্যা, আশা কিংবা নৈরাশ্য। আমাদের বাঙলা সাহিত্যেও তা সুপ্রকট।

ভাষার ক্ষেত্রে গল্প-উপন্যাস লেখকদের কেউ বুলির ব্যবহারে উৎসুক, কেউ আরবি–ফারসি শব্দ প্রয়োগে আগ্রহশীল, কেউবা নতুন শব্দ গঠনে তৎপর, কারো বা লৌকিক Idiom-এ বেজায় আকর্ষণ।

বুলির সতর্ক ও সুষম ব্যবহারে উৎসুক দেখি সৃজনশীল প্রগতিবাদী লেখকদের। বুলির যথেচ্ছ ব্যবহারে আগ্রহ রয়েছে স্বাতন্ত্রকামী লিখিয়েদের আরবি–ফারসি শব্দের প্রতি গভীর মমতা আছে আরব-ইরান প্রিয় প্যান-ইসলামী তমদুনপন্থীদের। কিন্তু কবিতা ও প্রবন্ধের ক্ষেত্রে দুই-একজন ছাড়া সবাই চলতি রীতির ও চালু বাঙলা শব্দ সম্পদের প্রয়োগে অভ্যস্ত। দশ বছর আগেকার মোহ ও মূঢ়তা এখন আর কোথাও তেমন প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করে না।

তবু সাহিত্যিকের শক্তিভেদে ভাষায় শব্দের অপপ্রয়োগ ও ভঙ্গির ত্রুটি প্রায়ই দৃশ্যমান। জ্ঞান-বিদ্যা-মন-রুচি অনুসারে রূপপ্রতীক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কেউ দেশী ঐতিহ্যে, কেউ স্বধর্মীর বিদেশী পুরাণে, কিংবদন্তিতে ও ইতিহাসে আশ্রয় খোঁজেন এবং অন্যেরা প্রয়োজনমতো পৃথিবীর যে- কোনো দেশের বা জাতির পুরাণ, কিংবদন্তি ও ইতিহাসের সহায়তা গ্রহণে উৎসুক। এর কারণ একশ্রেণীর লেখক স্থানিক জাতীয়তায়, আর এক দলের লেখক ধর্মীয় জাতীয়তায় আস্থা রাখেন এবং তৃতীয় দল উদারচিত্তে মানবিক প্রয়োজনকে স্বীকার করেন। এই মানববাদী দল দেশ-কাল জাত-ধর্ম নিরপেক্ষ সর্বমানবিক ঐশ্বর্যে ও ঐতিহ্যে বিশ্বাসী।

অবশ্য স্বাদেশিক ও স্বাধর্মিক রূপ-প্রতীক প্রীতির আড়ালে জ্ঞানগত অসামর্থ্যও আছে। ডালিয়া ডেইজি ডেফোডিল ক্যামেলিয়া রডেনডভ্রো বিদ্যাসাপেক্ষ। অধিগত বিদ্যা ও জ্ঞানের পরিসরেই মানুষের মন-মননের বিচরণ। আবার পরিচিত দেশী রূপ-প্রতীক সাধারণ পাঠকের সহজবোধ্য। কাজেই সেদিক দিয়ে তা অভিপ্রেত। কিন্তু সাহিত্যের দিগন্ত বিস্তারকামীর পক্ষে দেশান্তরে রূপ প্রতীক সন্ধান আবশ্যিক। যারা স্বজাতির ও স্বধর্মীর ঐতিহ্যনিষ্ঠ, তারা ভুলে থাকেন যে ভবিষ্যতের জন্যে ঐতিহ্য সৃষ্টির দায়িত্ব তাঁদেরও রয়েছে এবং সে দায়িত্ব পালন করতে সম্মুখ দৃষ্টির প্রয়োজন। ফেলে-আসা পশ্চাতের দিকে তাকাতে হলে দেহ ফিরিয়ে পশ্চাৎকেই সম্মুখ করতে হয় এবং তাতে অগ্রগতি কেবল ব্যাহতই হয়। এমনি ঐতিহ্যনিষ্ঠ শিল্পী-সাহিত্যিকের দানে পাঠকের মন-আত্মার বিকাশ অসম্ভব, কেননা এতে লেখক-পাঠক কারো চিত্তের বদ্ধতা ও অন্ধতা ঘুচে না।

মানুষের প্রগতির পথে ঐতিহ্যের পাথেয় কি অপরিহার্য? ঐতিহ্য কি সবার থাকে? দিগ্বিজয়ী সিকান্দর-চেঙ্গিস- এটিলার কি ঐতিহ্য ছিল? হযরত ইব্রাহিম-মুসা-ঈসা- মুহম্মদের, সক্রেটিস এ্যারিস্টটল-কনফুশিয়াসের, কোপার্নিকাস-রুশো-গেলেলিওর, শেকসপীয়ার- গ্যটে-রবীন্দ্রনাথের কিংবা ডারুইন-মার্ক-ফ্রয়েডের কি ঐতিহ্য ছিল? এঁরা প্রত্যেকেই কি স্বস্ব ক্ষেত্রে দেশীয়, গোত্রীয় বা জাতীয় ঐতিহ্য পরিহার করে নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করেননি? বুনো নিগ্রোদের রাষ্ট্রিক ঐতিহ্য নেই বলে কি তাদের আত্মোন্নয়ন ও আত্মপ্রসার রুদ্ধ থাকবে? মানুষের জীবনে সত্যি সত্যি ঐতিহ্য প্রেরণার প্রয়োজন যদি থাকে তবে তা হবে মানবিক ঐতিহ্য–প্রয়াসে ও প্রযত্নে মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। এবং এ প্রত্যয় অঙ্গীকার করে এগুলোই হবে তার কর্তব্য।

তাছাড়া ধর্মসূত্রে, শাসনসূত্রে, জ্ঞান ও বিদ্যাসূত্রে মানুষ কি চিরকাল বিদেশী-বিজাতি ও বিভাষী-বিধর্মীর ঐতিহ্যকে নিজের করে নেয়নি? তাহলে স্বাদেশিক ও স্বাধর্মিক ঐতিহ্যে ঐকান্তিক নিষ্ঠা বদ্ধচিত্তের অন্ধতারই নামান্তর। সাহিত্য-শিল্প-দর্শন মানুষের একই বৃত্তি-প্রবৃত্তির এবং ব্যক্তি সমাজ-ধর্ম-রাষ্ট্র সম্পর্কিত সমস্যা, সংকট-আনন্দ যন্ত্রণা ও ভাব-চিন্তার অভিব্যক্ত রূপ।

গদ্যে পদ্যে বাঙলা সৎসাহিত্যে বহিরাঙ্গিক উপাদান-উপকরণ দৈশিক ও কালিক। আর্থিক দৈন্য, সামাজিক পশ্চাৎমুখিতা, প্রশাসনিক ত্রুটি, নৈতিক শৈথিল্যে মানবিক দায়িত্বে অস্বীকৃতি ও কর্তব্যে অবহেলা, রাজনীতিক অনিশ্চয়তা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতির পটভূমিকায় মানুষের দয়া দ্বন্দ্ব, প্রীতি-অসূয়া ভয়-ভরসা, পীড়ন-পোষণ, মাৎসর্য-রিরংসা, আনন্দ-যন্ত্রণা-সম্পদ-সমস্যা, চাওয়া পাওয়া প্রভৃতির রূপায়ণ ঘটেছে। এই রস সর্বমানবিক জীবন ও জীবিকার সর্বক্ষেত্রে মানবিক সমস্যার সমাধান-প্রয়াস ও প্রতিবেশ- প্রভাবিত মানবিক বৃত্তি-প্রবৃত্তির স্বরূপ নিরূপণই তাই এ সাহিত্যের অন্তরঙ্গ রূপ।

অতএব ভাষা বা ভঙ্গি, কাহিনী বা বিষয়, গৌরব বা লজ্জা, ক্ষোভ বা উল্লাস, বিশ্বাস বা সংস্কার, আদর্শ বা উদ্দেশ্যে, লক্ষ্য কিংবা সমস্যা হবে স্থানিক ও কালিক, কিন্তু প্রতিপাদ্য বিষয় থাকবে সর্বমানবিক। অর্থাৎ স্থানিক ও কালিক বিষয় হবে সাহিত্যের বহিরঙ্গ আর অন্তর্নিহিত রস হবে সর্বজনীন।

আমাদের পূর্ব বাঙলার সাহিত্যে আমরা পূর্ব বাঙলার মানুষ ও প্রকৃতিকেই প্রত্যাশা করি। এই মানুষ ও প্রকৃতি পৃথিবীর আর কোথাও মিলবে না। অর্থাৎ সব মানুষে ও প্রকৃতিতে গূঢ় সাদৃশ্য থাকলেও বাহ্য স্বাতন্ত্র্য থাকে অলঙ্ঘ্য। এখানকার মানুষ তার বিশ্বাসে সংস্কারে, মনে মননে ও আদর্শে উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র। তার ভূত-প্রেত-দেও তার, হুর- পরী-জীন, তার যক্ষ-রক্ষ-গন্ধর্ব, তার আকাশ-জল-মাটি, তার তুকতাক-দারু-টোনা, তার-ঝাড়ফুঁক-মানত, তার-তাবিজ-কবজ, মাদুলি তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে।

সে জীবনের ও মানসের রূপায়ণ ঘটে তার সাহিত্যে ও সঙ্গীতে তার নৃত্যে ও চিত্রে, তার দর্শনে ও অধ্যাত্মচিন্তায়, তার জীবন-ভাবনায় ও জীবিকা নির্বাচনে, তার সমাজবোধে ও নৈতিক চেতনায়, তার ধর্ম ভাবে ও রাষ্ট্রিক জীবনে।

এই দেশের নদী-নালা-হাওরের প্রভাব তাকে কখনো করেছে উদাসী, তখন তার বিবাগী মন ও দেহকে ভেবেছে অকুল নীরে মন-পবনের নৌকা বলে। আবার কখনো করেছে সংগ্রামী। পদ্মা-মেঘনা ব্রহ্মপুত্রের তীরবাসী মানুষ প্রকৃতি ও প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যেই বাঁচে। বাউল-ভাটিয়ালী-ভাবাইয়া-হাপু-জাগ-জারি-সারি গানেই তাই তার জগৎ ও জীবনচেতনা অভিব্যক্ত। তার পারত্রিক চিন্তায় প্রাধান্য পেয়েছে পীর, মুর্শিদ ও দরগাহ। তার অধ্যাত্মসাধনার অবলম্বন হয়েছে যোগ ও জিকির। তার জাগতিক জীবন-ভাবনায় নিয়ম ও নিয়তির বাধা তাকে কখনো করেছে উদ্বিগ্ন, কখনো করেছে উদ্বেল, আবার কখনো করেছে বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহী। চাঁদ বেহুলার কাহিনীতে ও ময়মনসিংহ-চট্টগ্রামের গীতিকায় রয়েছে তার সাক্ষ্য। আমাদের একালের সৎসাহিত্যেও রয়েছে স্বদেশের ও স্বজাতির সে-পরিচয়। বাঙলার গদ্য-পদ্য রচনায় গ্রাম-বাঙলার প্রকৃতি ও মানুষ সুচিত্রিত এবং জীবন ও জীবিকার ধ্যান-ধারণা সুপরিব্যক্ত। আরও রয়েছে বিশ্বাস সংস্কার-দুষ্ট পীড়িত, শোষিত ও দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট বিপর্যস্ত জীবনের আলেখ্য এবং পীর-দরগাহ-সংপৃক্ত জীবনচরিত্র।

অনেক তরুণ লেখকের রচনা প্রপীড়িত শোষিত মূক মানুষের জীবনের মর্মবেদনার ও জীবন যন্ত্রণার বর্ণনায় মুখর।

আমাদের শিক্ষিতের সংখ্যা আজও কম। কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যা শিক্ষিত লোকের তুলনায় আরো কম। তাছাড়া দেশ-কাল ও জনজীবনের অন্তরঙ্গ পরিচয় তুলে ধরার যোগ্যতা থাকা চাই শিল্পীদের। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালো না বাসলে তার পরিচয় জানা সম্ভব নয়। মানুষকে সত্যই ভালোবাসেন তেমন লেখকও আমাদের বেশি নেই। এসব কারণে আমাদের দেশ-কাল মানুষের সামগ্রিক পরিচয়–তাদের বিশিষ্টতা আজো সাহিত্যে তেমন পরিস্ফুট হয়ে ওঠেনি।

সাহিত্যে স্বাতন্ত্র

স্বাতন্ত্র্য আজকাল একটি মুখরোচক ও শ্রোত্ররসায়ন চালু কথা। মানুষ ভাবে কম এবং পরের মুখে ঝাল খাওয়ায় অভ্যস্ত, আর কানকথা শুনতে উৎসুক, এমনকি কানকথায় কান ভার করতেও তার দ্বিধা নেই। তাই চলতি বুলির জনপ্রিয়তা প্রায় অপ্রতিরোধ্য। চলতি কথার প্রভাবও গভীর এবং ব্যাপক। এর প্রভাব ভালো-মন্দ, আবেগ-উদ্বেগ, আনন্দ-বেদনা, আশা-হতাশা, সাহস-ভীরুতা, উৎসাহ-নৈরাশ্য, উত্তেজনা-ঔদাসীন্য প্রভৃতি যে-কোনো ভাব মানবমনে জিইয়ে রাখতে সমর্থ। ফলে এর থেকে লাভের লোভ ও ক্ষতির ঝুঁকি এড়ানো যায় না।

স্বাতন্ত্র্য কথাটিও এখন একটি জনপ্রিয় চলতি বুলি! রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্র, জাতীয় স্বাতন্ত্র, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র, সামাজিক স্বাতন্ত্র, ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র, সাহিত্যে স্বাতন্ত্র প্রভৃতি জীবনের প্রতিক্ষেত্রে প্রায় শতেক স্বাতন্ত্রের বেড়ায় আমরা নিজেদের বদ্ধ করছি। দেখে-শুনে মনে হয় জগতে স্বাতন্ত্র গৌরবের মতো গৌরব নেই। স্বাতন্ত্রের অনুশীলন কর, তাহলেই ঘুচবে সব দুঃখ, মিটবে সব অভাব। ইরি ধানের মতো স্বাতন্ত্রের চাষে যে ফলন তার যেন তুলনা নেই।

ঘরে যারা এভাবে বিভেদের বীজ বুনে চলেছে, তারাই আবার UNO-এর প্রেক্ষা- মঞ্চে বিশ্বমানবের বিশ্বরাষ্ট্রের সংহতি ও ঐক্যের বাণী কপচায়। নিবর্ণ ও নির্বিশেষ মনুষ্যসমাজের প্রচারক যাঁরা, তাঁরা বৈষম্যের ব্যবধান জিইয়ে রাখার উপায় উদ্ভাবনেও উৎসাহী। সত্যিই মানুষ বড় বিচিত্র ও অদ্ভুত প্রাণী। মুখে তার প্রীতি ও মৈত্রীর বাণী, হাতে তার মারণাস্ত্র। সে এক হাতে কাড়ে, আর এক হাতে বাহবা ললাটে।

আবাল্য ম্যাকিয়াভেলীকে একজন সুন্দর শয়তান বলে জেনেছি। কিন্তু আজকাল যেন তার প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে উঠছি। মাঝে মাঝে মনে হয় মানব-প্রকৃতির এতবড় ব্যাখ্যাতা বুঝি আর দ্বিতীয়টি নেই। তার উচ্চারিত তত্ত্ব যে চিরন্তন ও চর্চার বিষয় হয়ে থাকবে তা হয়তো তিনিও জানতেন না। তিনি বলেছেন– A Prince must know how to play at once man and beast, lion and fox. He neither should nor can keep his word, when to do so, will turn against him…I venture to maintain that it is very disadvantageous always to be honest, useful, on the other hand to appear pious and faithful, humane and devout. Nothing is more useful than the appearance of virtue.

আজকের দিনের রাষ্ট্রপতি-রাষ্ট্রনায়কেরা এই নীতি অবিচল নিষ্ঠায় মেনে চলেছেন। প্রজার আনুগত্য লাভের সহায়ক হিসেবে ধর্মের বুলি কপচানো এবং প্রবল পক্ষের ধর্মমতকে সমর্থন করাও সরকারের পক্ষে আবশ্যিক বলে জানতেন ম্যাকিয়াভেলী। বিশ্বের অনুন্নত দেশের কোনো কোনো সরকার তাও আক্ষরিকভাবে মানে এবং নির্বিঘ্ন নিশ্চিন্ত শাসন-শোষণের সুযোগ পায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্ণের, গোত্রের ও ধর্মের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বুলি। দুনিয়ার সর্বত্র বিশেষ করে আমেরিকায়, আফ্রিকায় ও অস্ট্রেলিয়ায় আজ এটিও শাসন-শোষণের একটি ফলপ্রসূ কৌশল ও মোক্ষম উপায়রূপে বিবেচিত, প্রযুক্ত ও প্রমাণিত। ফলে দুনিয়ার সর্বত্র সরকারের পরোক্ষ প্ররোচনায় আজ স্বাতন্ত্র-সাধনা দ্রুত প্রসার লাভ করছে। রোমকদের সেই Divide and Rule নীতি আজো উপযোগ হারায়নি, বরং তার গুরুত্ব বেড়েছে।

জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যের ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য-চেতনা এবং স্বাতন্ত্র-সাধনা প্রবল। হয়ে উঠেছে। সুন্দরের ও আনন্দের আয়োজনে ও উপভোগে স্বাতন্ত্র্য-চেতনা নিরপেক্ষ কানে অদ্ভুত শোনায় বটে, কিন্তু আজ এও সত্য ও স্বাভাবিক হতে চলেছে। এতকাল আমরা জানতাম শিল্প, সংগীত ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে রসিকের রুচি ও বোধের মাত্রাভেদ আছে। কিন্তু স্বাতন্ত্র যে আছে, তা ইদানীং জানছি।

কিন্তু এ স্বাতন্ত্র কোন্ তাৎপর্যে প্রযুক্ত তা আমরা জানিনে। যে-কোনো কলা-স্রষ্টার ব্যক্তিগত বোধ-বুদ্ধি, রুচি-সংস্কৃতি, মন-মনন ও চেতনার কথা জীবন-দৃষ্টির প্রসূন। সে কারণে প্রত্যেক শিল্পীর সৃষ্টি স্বতন্ত্র অর্থাৎ অনন্য ও মৌলিক। এ অর্থে সাহিত্যে জাতিগত কিংবা দেশগত স্বাতন্ত্র্য থাকতে পারে না, পারে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য।

আবার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনগত ঐক্য থাকলে, রূপগত অর্থাৎ আঙ্গিকগত অনৈক্য স্বাতন্ত্র্য দান করে না। যেমন জুতা কিংবা পাজামা প্রত্যেকেই তার পায়ের ও গায়ের মাপে তৈরি করায়, তাতে কিন্তু জুতো বা পাজামা স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে না। সাহিত্য-সংগীত-চিত্র-নৃত্য-ভাস্কর্য প্রভৃতির আবেদন সর্বজনীন। কেননা এগুলো মনের এক নিরূপ চাহিদা পূরণ করে, চেতনার এক মানবিক পিপাসা মিটায়। এগুলো কলা-চেতনার সৌন্দর্যময় ও আনন্দময় অভিব্যক্তি। এজন্যে প্রাত্যহিক জীবনের স্থূল প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে এগুলোর স্থিতি। চিত্তে বিশেষ এক চেতনা বা চিত্তবৃত্তি না জাগলে অথবা না থাকলে এগুলোর কোনো আবেদন অনুভব কিংবা এগুলোর অভাববোধ করা সম্ভব হয় না। কাজেই অনুভবের এই বিশেষক্ষেত্রে দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম না-থাকারই কথা।

যেহেতু এসব কলার আধার-নিরপেক্ষ অবয়ব নেই, সেজন্যে এগুলোর আধার ভেদ নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আধার ভেদে আধেয় রূপ বদলায়, গুণ বদলায় না। কাজেই দেশ-কাল ও নামভেদ থাকলেও সাহিত্যে আর কোনোরূপ স্বাতন্ত্র সম্ভব নয়। এবার দৃষ্টান্ত নিয়ে বুঝবার চেষ্টা করা যাক।

প্রথমত, ধরা যাক জাতীয় সঙ্গীত ও স্বদেশ-স্বজাতি-প্রীতিমূলক গান ও কবিতা। এগুলো সবদেশের সবজাতের লোকই রচনা করে। তাতে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও বক্তব্য থাকে অভিন্ন। কেবল দেশের নামভেদ থাকে মাত্র। ওটি বদল করে দিলে সর্বজনীন ও সর্বকালিক অনুভূতির বাহন হয় সেই গান বা কবিতা। নাটক-উপন্যাস-গল্পের ক্ষেত্রেও আদর্শ, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন যেহেতু অভিন্ন, পরিবেশ ও পাত্র-পাত্রীর নাম পালটে দিলে তা যে-কোনো দেশের মানুষের জীবনে চেতনার চিত্র হয়ে উঠতে পারে। তেমনি নৈতিক-সামাজিক জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্বন্ধীয় রচনায়ও ব্যক্তিভেদে মতাদর্শের পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু দেশভেদে প্রয়োজন ও ফল ভেদ হতে পারে না।

প্রেম কিংবা পীড়ন, লোভ কিংবা অসূয়া, ক্রোধ কিংবা সহিষ্ণুতা, ক্ষমা কিংবা প্রতিহিংসা, আনুগত্য কিংবা কৃতঘ্নতা প্রভৃতি জৈব বৃত্তি-প্রবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেশভেদে আলাদা হয় না, ব্যক্তিভেদে মাত্রার তারতম্য ঘটে কেবল।

অতএব যথার্থ সাহিত্য-রস দেশ-কালের ঊর্ধ্বে সর্বমানবিক। কেবল প্রচার সাহিত্যেরই দেশ কাল ও জাত-ধর্ম আছে। বলাবাহুল্য সংস্কৃতিবান কোনো মানুষ তা রচনাও করে না, পড়েও না এবং সাহিত্য বলে স্বীকারও করে না। সৎ-সাহিত্য মানুষকে ভাবায়, পরিশ্রুত করে চিত্তবৃত্তি এবং অনুভবের জগৎ করে প্রসারিত। এক-একটি মহৎ সৃষ্টি পাঠকের চেতনায় নতুন ভুবন রচনা করে। এক-একটি মহৎ কথার অনুভবে পাঠক তিলে তিলে নতুন হয়ে ওঠে। তেমন কথায় ঘটে জীবনবোধের উন্নয়ন ও আত্মার স্বাধীন জগতে উত্তরণ। তেমন গ্রন্থ বিদেশীর-বিজাতির কিংবা বিধর্মীর রচনা বলে পরিহার করলে জীবনের আশীর্বাদ ও প্রসাদ থেকেই কেবল নিজেকে বঞ্চিত রাখা হয়, রোধ করা হয় নিজের অগ্রগতি। মানুষের চেতনার শ্রেষ্ঠ প্রসূন ভাব-চিন্তা-জ্ঞান-অনুভূতি বর্জনের দুর্বুদ্ধি যার মনে বাসা বাঁধে, সেও কি শিক্ষিত!

সাহিত্য-শিল্পাদি কলার ক্ষেত্রে অন্তত স্বাতন্ত্র-চিন্তা বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়। এখানে স্বাতন্ত্র্য নয়, সহযোগিতা ও সহ-অবস্থানই কাম্য। তা ছাড়া এগুলো যখন বৈষয়িক নয়, মানসিক এবং সাধারণের নয়, কেবল বিশেষেরই চর্চার বিষয় তখন সহিষ্ণুতাই শোভন। এক্ষেত্রে সাড়ে পাঁচশ বছর আগেকার এক মনীষীর বাণী আমাদের হয়তো দিশা দিতে পারে :

Love the truth. Let others have their truth and the truth shall prevail. (Jan Huss of Bohemia)

এ সূত্রে গ্যটের বাণী স্মরণ করেও আমরা হয়তো চক্ষুষ্মান হতে পারি :

National literature is now rather and unmeaning term; the epoch of world literature is at hand and each one must try to hasten its approach.

তা ছাড়া বৈষয়িক জীবনেই যখন স্বস্বার্থে আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দৃঢ় ও গাঢ় করবার প্রয়াসী, তখন মানসিক-জীবনেই বা স্বাতন্ত্র্য কামনা করে দীনতাকে দীর্ঘস্থায়ী করব কেন!

সাহিত্যের দ্বিতত্ত্ব

মানুষ তার পরিবেষ্টনীর আনন্দ ও যন্ত্রণা, সম্পদ ও সমস্যার মধ্যেই বাঁচে। এজন্যেই দেশ-কাল নিরপেক্ষ জীবনানুভূতি নেই। তাই বলে প্রতিবেশ আহৃত সব অনুভূতি সবহৃদয়ে সমান গুরুত্ব পায় না। বিদ্যা-বুদ্ধি-বোধি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, রুচি-সংস্কৃতি ও মানস-প্রবণতার আনুপাতিক প্রভাবও অনুভবকে লঘু-গুরু করে। ফলে একের কাছে যা অসহ্য গুরুতর বা চাঞ্চল্যকর, অপরের কাছে তা নিতান্ত তুচ্ছ।

এ না হয়ে পারে না। কেননা জীবন ঋজু নয়, ঘটনা-বিরলও নয়। নিতান্ত ঘটনা-বিরল প্রাত্যহিকতার মধ্যেও কি ঘটনা কম! স্ত্রীর মেজাজ, ছেলের অবাধ্যতা, চাকরের ফাঁকি, প্রতিবেশী গৃহে ঝগড়া, রোয়াকে ইয়ারদের মধ্যে বিতর্কের ঝড়, বাজারে বেপারীর সঙ্গে চটাচটি, সংবাদপত্রের নানা খবর, চড়া বাজারদর, ভাগ্নের অসুখ–এমনি শতেক দিকে মন ও নজর আকৃষ্ট হচ্ছে। জীবনে এসব ঘটনার কোনোটাই ফেলনা নয়।

শত্রুকল্প প্রতিবেশীর ঘরের ঝগড়া কেমন শ্রোত্ররসায়ন ও মুখরোচক। আবার বাজারে পণ্যের অগ্নিমূল্য কীরকম ক্ষোভ জাগায়! বিরোধীদল জাতীয় পরিষদে সরকার পক্ষকে জব্দ করছে–এ সংবাদও তৃপ্তিকর। এমনি কত বিপরীত রসের অনুভবে চিত্তলোক তোলপাড় করছে। কিন্তু সবটা সমান আকর্ষণীয় নয় কোনো একজনের কাছে। ঘর-সংসারের দায়-দায়িত্ব যার নেই তেমন রাজনীতি-প্রিয় লোক যে-সংবাদে আনন্দিত কিংবা বিচলিত, ছাপোষা স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে তা পড়ার মতোও নয়। ক্রীড়াপ্রিয় কিংবা সিনেমাপ্রিয় কিশোর-তরুণ যে-কারণে সংবাদপত্র উলটাতে উৎসুক, সে-কারণ আমাতে একবারেই অনুপস্থিত।

অতএব আমার মনের উপর আজকের যে-ঘটনা প্রভাব ফেলেছে, আমার অনুভব ও চিন্তা উদ্ৰিক্ত করেছে অথবা আমার মেজাজে প্রসন্নতা কিংবা বিকৃতি এনেছে, সে ঘটনাই আমার আত্মীয় বন্ধুর সঙ্গে আলাপে কিংবা আমার লিখিত চিঠিপত্রে আভাসিত হবে। অন্য সব ঘটনা ও অনুভূতি চিরকালের জন্যে বিস্মৃতির আকাশে হাওয়া হয়ে যাবে। তা ছাড়া যার উদ্দেশে বলা, তার রুচি, প্রবণতা ও আগ্রহ নেই তেমন ঘটনা কিংবা অনুভুতি তার কাছে প্রকাশ করা অনুচিত–এমন চেতনাও ক্রিয়াশীল থাকে। কাজেই প্রসঙ্গ এবং পাত্র চেতনাও আমাদের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে।

তাই গানে-গাথায়-কাব্যে-গল্পে উপন্যাসে প্রবন্ধে-ভ্রমণবৃত্তান্তে-বক্তৃতায় কোথাও আমরা সমকালীন-জীবনের-সমাজের-দেশের সামগ্রিক পরিচয় পাইনে। কোথাও বাজার দর মেলে, কোথাও হাট-বাটের বর্ণনা পাই, কোথাও বা ফলমূলের ফিরিস্তি থাকে, কোথাও থাকে ঘর-বাড়ি আসবাব-তৈজসের বর্ণনা, আবার কেউ বলেন আচার-আচরণ-পাল-পার্বণের কথা, কেউ বয়ান করেন অঙ্গের আবরণ-আভরণের বৈচিত্র্য, কারো কাছে মানুষের ধনদৌলত ও রাজনীতিই বর্ণিতব্য বিষয়– কিন্তু কোনো একজনের কাছে সবকিছুর খবর মিলে না।

সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এ সমভাবে সত্য। তাছাড়া সব মানুষের জীবন-দৃষ্টি ও জীবন-সমস্যা একরূপ নয়। দেশ কাল ব্যক্তি ভেদে তা ভিন্ন ও বিচিত্র। স্বাধীন দেশে মুক্তিসংগ্রামের গান রচিত হয় না, কিংবা আজকের চীন-রাশিয়ায় গণসংগ্রামের বাণী, নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদ কাব্যে ধ্বনিত হওয়ার কারণ অপগত।

ফোর্ড-রকফেলার ডালমিয়া-বিরলা, দাউদ-ভাওয়ানী-ইস্পাহানী-আগা খাঁর মনে জীবন সম্পর্কে যে জিজ্ঞাসা জাগে তা অন্ন-বস্ত্রের নয়, তাঁদের চেতনায় প্রেম-প্রকৃতি-পরকাল বিমূর্ত সত্য ও অম্লান আনন্দের তত্ত্ব ও তথ্যই মুখ্য। এমন মানুষের রচনায় বঞ্চিত-লাঞ্ছিত-শোষিত মানুষের কান্না ধ্বনিত হওয়ার কথা নয়। এবং ধ্বনিত হয় না বলে ক্ষুব্ধ হওয়াও কারো পক্ষে অনুচিত। কেননা নিরপেক্ষ ও অনাসক্ত দৃষ্টি ও মন মানুষে সুলভ নয়। যে যেই গাঁ, দেশ, জাত, ধর্ম, পরিবার এবং আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার অন্তর্গত, সে-সবের প্রতি মমতা ও আনুগত্য তার স্বভাবগত। এ কারণে শ্রেয়ো-বোধ কখনো সর্বজনীন হয় না। জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য, আদর্শ-উদ্দেশ্য তাই সবার অভিন্ন নয়। যে-মুহূর্তে যার মনে যে-যন্ত্রণা বা আনন্দ, যে-সমস্যা বা সম্পদ গুরুত্ব পায় তা-ই তার কথায় কাজে কিংবা লেখায় অভিব্যক্তি লাভ করে।

মানুষের বৈষয়িক জীবনে যেমন শ্ৰেণী আছে, শ্ৰেণীস্বার্থ আছে, দেশ-জাত-ধর্ম আছে, অন্তর্জগতেও তেমনি রয়েছে শ্রেণীগত মনন। কোনো আনন্দ বা যন্ত্রণা, কোনো সমস্যা বা বিপর্যয়, কোনো সৌভাগ্য বা গৌরব, দেশের সব মানুষকে স্পর্শ করে না, অন্তত সমভাবে করে না। এসব ক্ষেত্রে কেউ হারে, কেউ জেতে, কারো হয় সর্বনাশ, কারো আসে পৌষমাস। কাজেই দেশ-কাল অভিন্ন বলেই ভাব-চিন্তা-কর্ম অভিন্ন হয় না। এমনকি স্বার্থবুদ্ধির প্রভাবমুক্ত মনও অন্যের হয়ে ভাবতে পারে না। সহানুভূতিও তাই কখনো সমানুভূতির পর্যায়ে ওঠে না। তেমন অবস্থায় মানবিক বোধ ও আদর্শ-চেতনাই যোগায় অনুপ্রেরণা।

অতএব সাহিত্যে-সঙ্গীতে, চিত্রে-ভাস্কর্যে দুইরূপ-দুইতত্ত্ব থাকবেই। যারা বেদনামুক্ত যারা আনন্দিত, যাদের জীবন সমস্যা-সঙ্কুল নয় তারা নান্দনিক কলাচর্চায় পাবে আত্মার খোরাক। আর যারা বঞ্চিত, শোষিত ও যন্ত্রণাগ্রস্ত তাদের কলায় থাকবে জমাট আর্তনাদ কিংবা মুক্তি-অন্বেষা। এভাবে সাহিত্যাদি কলায় সুন্দরের অনুধ্যান ও আনন্দের অভিব্যক্তি যেমন থাকবে; হাভাতের হাহাকার, আর্তের চিৎকার, বঞ্চিতের অভিশাপ, নির্যাতিতের ক্ষোভ, শোষিতের সংগ্রামী কণ্ঠও তেমনি ধ্বনিময় হয়ে উঠবে।

কাজেই বুর্জোয়ার আনন্দের সাহিত্যের পাশাপাশি পরাধীন নির্যাতিত শোষিত মানুষের বেদনা, বিক্ষোভ ও সগ্রামের সাহিত্যও থাকবে।

অবশ্য এমন দিনের স্বপ্নও আমরা দেখতে থাকব যখন সংগ্রামী গণসাহিত্যের প্রয়োজন ফুরাবে। তখন সাহিত্যাদি কলা আবার পুরোনো নান্দনিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন আবার প্রেম-পাখী-প্রকৃতি সত্য ও সত্তার রহস্য, সুন্দর ও আনন্দের অনুধ্যান আমাদের আঁকার ও লেখার, গানের ও বাজনার, নাচের ও নির্মাণের অবলম্বন হবে। কেননা যন্ত্রণাবিহীন জীবনই তো সবার কাম্য। আনন্দলোক সৃষ্টি করাই তো সবার লক্ষ্য। সে পথে যে-বাধা রয়েছে সে-বাধা অপসারণের চেষ্টার নামই গণ-সগ্রাম। সে লক্ষ্যে উত্তরণের জন্যেই সগ্রাম। সেদিন আর শোষিত-নির্যাতিত শ্ৰেণীর জন্যেই নয়–মানুষ নির্বিশেষের জন্যে প্রীতির অনুশীলনই হবে লিখিয়েদের লক্ষ্য। বঞ্চিত শোষিত-নির্যাতিত মানবতার সেবার ব্রত তাদের মুক্তির জন্যে সংগ্রামী প্রেরণা যোগানোর সাধনা, তাদের বেদনা-বিক্ষোভের অভিব্যক্তি দানের দায়িত্ব-মানবতাবাদীদের গ্রহণ করতেই হবে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই আসবে এ সংগ্রামের সৈনাপৈত্য, এ ক্ষোভ-মিছিলে নেতৃত্ব, এ প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা। কাজেই আজকের আফ্রো-এশিয়ায় দরদী ও দায়িত্বশীল লিখিয়েরা সংগ্রামী সাহিত্যই সৃষ্টি করবেন, যেমন প্রতীচ্যের সুখী মানুষেরা করেছেন ভঙ্গিসরস, মনন-প্রধান, লীলা-সখ্য সাহিত্য।

বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন–লোক-শিক্ষা, লোকোপকার কিংবা সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী ধারণ পাপ। হৃদয়বান মানববাদীরাও বলেন যেখানে মানুষ আজো অনিকেত, আজো অভুক্ত, আজো দাসত্বে পশুপায়, আজো অশিক্ষায় পঙ্গু, আজো অজ্ঞানে অন্ধ, আজো অবিদ্যায় অবোধ, আজো পীড়নে পৃষ্ঠ, আজো শোষণে অস্থিসার, আজো অকালমৃত্যুর শিকার, আজো রুদ্ধকণ্ঠ, আজো বদ্ধহস্ত; সেখানে সৌন্দর্য সৃষ্টি পাপ– অমানুষিক অনাচার দানবিক নির্মমতা।

কিন্তু এ নিন্দা ও বিক্ষোভ অবিবেচনাপ্রসূত। কেননা জীবনে যাঁরা অবাধসুখ ও অপরিমেয় সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন তাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চা হবে আনন্দের জন্যেই অর্থাৎ আনন্দলোক নির্মাণ লক্ষ্যে তাঁরা সৌন্দর্য সৃষ্টি করবেন। বাধা পেলে বরং লেখনী ত্যাগ করবেন, কিন্তু অন্তরে প্রেরণা নেই বলেই গণসাহিত্য সৃষ্টি করতে কখনো পারবেন না। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। এ শ্রেণীর কোনো কোনো মানববাদী গণ-সগ্রামের সৈনিকরূপে মসীযুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

ব্যক্তিগত জীবনে যেমন পীড়ন পেলে প্রতিকার-প্ৰয়াস জাগে তেমনি সামাজিক ঔপনিবেশিক, আর্থিক ও কায়িক পীড়ন মুক্তির জন্যে সগ্রাম না করে অন্য পক্ষের উপায় নেই। তাছাড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লিখিয়ে-আঁকিয়েরাও তো ঘা-খাওয়া মানুষ, তারাও তো আর্থিক-সামাজিক-মানসিক অনেক ন্যায্য অধিকার থেকেই বঞ্চিত। কাজেই তাদের নিজেদের জন্যেও মুক্তিসংগ্রাম প্রয়োজন। মনোবল থেকেই আসে বাহুবল, কাজেই লেখনী মাধ্যমে গণমনে মনোবল জাগানো, চোখ খুলে দেয়া, চেতনা সঞ্চার করা তাঁদেরও গরজ। কারণ এক্ষেত্রে সাফল্যের একমাত্র উপায় হচ্ছে জনমত গঠন তথা গণশক্তি প্রয়োগ। এ হচ্ছে সামাজিক তথা যৌথ কর্ম। একক মানুষের দায়িত্ব কেবল সভ ঘক্তির অনুগত্যে সাড়া দেওয়া। অবশ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লেখকও বুর্জোয়া প্রলোভনে লক্ষচ্যুত হয়ে স্বস্বার্থে সুখ-সুবিধা লাভের লোভে দায়িত্ব এড়িয়ে কর্তব্য-ভ্রষ্ট হয়ে অথবা নিছক মানস-প্রবণতা বশে জুটে যান নিরাপদ নান্দনিক কলার চর্চায়। এদের কেউ কেউ সরকারি শিরোপারও উমেদার। এঁরা স্বশ্রেণীদ্রোহী চরিত্রহীন। এবং প্রয়োজন ও প্রতিবেশ চেতনাহীন। মধ্যবিত্তশ্রেণীর কোনো কোনো লিখিয়ে কৃপার ও ক্ষমার পাত্র। কেননা তারা জানেন না তারা কী লিখছেন আর কেন লিখছেন। এভাবে মধ্যবিত্ত সমাজের লিখিয়েদের তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে। একদল যথার্থ সংবেদনশীল, দায়িত্ব-সচেতন, কর্তব্যপরায়ণ ও নিষ্ঠ সগ্রামব্রতী; এঁরাই জনগণের আশা-আশ্বাসের অবলম্বন। এঁরা সরকার-শত্রু। আর একদল আছেন সরকার-ঘেঁষা–এরা সুবিধাবাদী-স্বার্থবাজ। এরা গণ-শত্রু। তাই ঘৃণ্য। শেষ দল সরকার-ভীরু। এরা গা বাঁচিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রত্যাশী। এরা কৃপার পাত্র।

কাজেই যতদিন পর্যন্ত কলাকৈবল্যরস উপভোগ করার অবস্থা ও সামর্থ্য সর্বমানবে সম্ভব না হচ্ছে ততদিন এই কেজো–এই বৈষয়িক–এই বাস্তব জীবনের চাহিদা-সর্বস্ব গণ-সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজন থাকবে।

অতএব সাহিত্যের দুইরূপ– দুইতত্ত্ব-দুইধারা এবং দুটোই রসময়; একটি কেবল উপভোগের জন্যে আর একটি নিছক উপলব্ধির জন্যে। একটির রস হয়তো যথার্থই মধুর, অপরটি ভিন্ন নামে কষ– যা কলিজা-নিঃসৃত এবং প্রথমে লাল ও পরে কালো।

হবীবুল্লাহ বাহার স্মরণে

০১.

প্রথমে চট্টগ্রামে, মধ্যে কোলকাতায় এবং পরে ঢাকায় বাহার ছিল একটি প্রিয় নাম। প্রিয়জনের উচ্চারিত নাম চিত্তে একপ্রকার প্রসন্নতা আনে। বাহারও ছিল তেমন একটি মধুর ধ্বনি।

সুদীর্ঘ সুঠাম শ্যামল সুপুরুষ বাহার সাহেবের আঙ্গিক লাবণ্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল তার অন্তরের সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য। আবাল্য তিনি ছিলেন দেহে-মনে সুস্থ, সুন্দর ও প্রাণবান। তিনি অন্যের অন্তরের স্পর্শ পেতে যেমন চাইতেন, তেমনি নিজের অন্তরও মেলে ধরতেন অন্যের কাছে। তাঁর সঙ্গ-প্রিয়তা তাঁকে করেছিল বাকপটু, বন্ধুবৎসল, অকপট ও পরার্থপর। তার এই মানস-প্রবণতা বা চারিত্রিক গুণই তাঁকে করেছিল মজলিশি লোক ও আড্ডাবাজ। তাঁর জীবনে বৈচিত্র্য এবং ব্যপ্তিও আসে হয়তো এই সঙ্গ-সুখ প্রবণতা থেকেই। খেলার মাঠে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, সাহিত্যের আসরে ও রাজনীতিক মঞ্চে তাঁর ছিল সমান আকর্ষণ, পাওয়া যেত তাকে সর্বত্র। তার নির্দিষ্ট কোনো পেশা বা বৃত্তি ছিল না বলে তিনি সমান উৎসাহে যোগ দিতে পেরেছেন সামাজিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মে ও খেলাধুলায়। ক্রীড়া ও কর্ম দু-ই তাঁর কাছে সমান ছিল। তাঁর প্রাণময়তা ও আনন্দিত জীবনের উল্লাস প্রকাশ পেয়েছে তার সব ভাব-চিন্তা ও কর্মে। বাহার সাহেবের জীবন খেলা দিয়ে শুরু এবং সেবা দিয়ে শেষ। প্রথম জীবনে ক্রীড়ানৈপুণ্য এবং পরবর্তী জীবনে বাকপটুতাই তাকে জনপ্রিয় করে। তুচ্ছ কথাকেও রসিয়ে রসিয়ে বলে বা লিখে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার আশ্চর্য জাদু ছিল তার আয়ত্তে। কারো নিন্দায় বা প্রশংসায় তিনি সমান মুখর থাকতেন। কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল আসূয়ামুক্ত ও স্বার্থবুদ্ধিবিহীন, তাই এ সব নিন্দা-প্রশংসায় তাঁর বিদ্বেষ বা অনুগ্রহ লোভ ছিল না। ফলে তা হত অনাবিল উপভোগ্য আড্ডা-রস।

.

০২.

বাহার সাহেবের মাতৃ ও পিতৃভূমি ছিল ফেনী মহকুমার পরশুরাম থানার অন্তর্গত উত্তরগুথুমা গাঁ। তার প্রপিতামহ তমিজুদ্দীন চৌধুরী ওর্ষে তমিজুদ্দিন মুন্সী ছিলেন নোয়াখালী আদালতের ফারসিনবিশ উকিল। প্রমাতামহ আমজাদ আলি ছিলেন ইংরেজি জানা সরকারি চাকুরে–চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনারের প্রথমে পেশকার ও পরে Personal assistant. তমিজুদ্দীন মুন্সীর বজলুর রহিম, ফজলুল করিম, আব্দুল ওদুদ, শামসুদ্দীন প্রভৃতি পাঁচটি পুত্ৰই উচ্চ ইংরেজি শিক্ষালাভ করে চট্টগ্রাম বিভাগের মুসলিম সমাজে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন এবং এ পরিবার প্রখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠে। আমজাদ আলির জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদুল আজিজই নোয়াখালী জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট। এই দুই পরিবারের অনেকেই পদস্থ সরকারি কর্মচারী, ব্যবহারজীবী ও জননেতা হিসেবে সরকারি খেতাব এবং সামাজিক মর্যাদা অর্জন করেন। আবদুল আজিজ বিয়ে করেন তমিজুদ্দিন মুন্সীর মেয়ে এবং আমজাদ আলির কন্যার সঙ্গে বিয়ে হয় বজলুর রহিমের। তমিজুদ্দিন মুন্সীর প্রথম পুত্র ফজলুল করিমের পুত্র নুরুল্লাহ চৌধুরী। নুরুল্লাহ চৌধুরী বিয়ে করেন আমজাদ আলির পুত্র খান বাহাদুর আবদুল আজিজের জ্যেষ্ঠা কন্যাকে। বাহার সাহেব ও বেগম শামসুন। নাহার মাহমুদ এঁদেরই সন্তান। বাহার সাহেবের মাতৃ ও পিতৃকুলে উচ্চশিক্ষা ও ঐশ্বর্য দু-ই ছিল। বাহার-নাহার এই পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্যুতি ও ঐশ্বর্যের প্রসাদের মধ্যে লালিত।

তা ছাড়া বাহার ও নাহার আরো একটি বিশেষ পরিবেশ পেয়েছিলেন। তা দুর্ভাগ্য দিয়ে শুরু বটে কিন্তু সৌভাগ্যের সম্ভাবনাও সূচিত হয় সে-পথেই। খান বাহাদুর আবদুল আজিজ অপুত্রক ছিলেন। তাঁর ছিল পাঁচটি কন্যা। আশ্চর্য, অতি অল্প সময়েই তিন কন্যার হয় মৃত্যু এবং দুই কন্যা হন বিধবা। বাহার সাহেবের মা ছিলেন জ্যেষ্ঠা কন্যা। তিনি যখন বিধবা হন তখন তার বয়স বিশের বেশি নয়। এবং বাহার তিন বছরের আর নাহারের বয়স তখন দেড় বছর। এসময় তাদের মা-খালারা এবং নানা-নানী সব জীবিত এবং সম্ভবত খালারাও অবিবাহিতা। আবদুল আজিজ সাহেব চট্টগ্রাম বিভাগের মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের সহকারী পরিদর্শক ছিলেন এবং চট্টগ্রাম শহরেই স্থায়ীভাবে বাস করতেন। এখানেই পিতৃহীন বাহার-নাহার নানা-নানী, মা-খালাদের চোখের মণিরূপে পরম আদরযত্নে লালিত হন। খান বাহাদুর আব্দুল আজিজ জনহিতৈষী শিক্ষাবিস্তারকামী উদার-হৃদয় ও সাহিত্য-প্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি কাব্যচর্চাও করেছিলেন। সমকালীন বিরুদ্ধ সামাজিক পরিবেশেও তিনি কন্যাদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। তারই ঘরে তারই তত্ত্বাবধানে বাহার-নাহার লালন ও শিক্ষা পান। ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে বাহার এবং ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে নাহারের জন্ম।

.

০৩.

শিশু স্বাস্থ্যবান হলেই চঞ্চল হয়, আর শৈশবের চাঞ্চল্যের অপর নাম দুরন্তপনা। এবং দুরন্ত ছেলেই বাল্যে-কৈশোরে-যৌবনে ক্রীড়াপ্রিয় হয়। আবার ক্রীড়াপ্রিয় মানুষ বন্ধু ও সঙ্গ-সুখকামী হয়। বাহার সাহেবের আবাল্য এসব বৈশিষ্ট্য ছিল। আজীবন আড্ডাবাজ থাকার মূলে রয়েছে এই মানসচেতনা। খেলোয়াড়েরা সাধারণত পড়ুয়া ছাত্র হয় না। বাহার সাহেব ছিলেন মাঝারি ছাত্র। বাড়ির পাশের চট্টগ্রাম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। আই-এসসি পাস করে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে শুরু করেন–কিন্তু এ কর্ম আড্ডাবাজ ছেলের জন্য নয়, তাই চট্টগ্রাম কলেজে আরবিতে অনার্স নিয়ে বি এ পড়তে থাকেন। পরীক্ষার সময় কিন্তু অনার্স পরীক্ষা দেননি। বিএ পাস করার পর তাঁর শিক্ষাপর্ব সমাপ্ত হয়।

.

০৪.

চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদী তরুণদের কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। অনন্ত সিং তাঁদের অন্যতম। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবে তাঁর সমর্থন ছিল না–তিনি নিয়মতান্ত্রিক-আন্দোলন সাফল্যে আস্থাবান ছিলেন।

তাঁর জীবনে বন্ধু-বান্ধবের প্রভাব কখনো গম্ভীর হতে পায়নি। তাঁর পারিবারিক প্রভাবই তার চরিত্র নির্মাণ ও জীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে। নানা-নানী ও মা-খালাদের থেকে তিনি দুটো সম্পদ লাভ করেছিলেন–একটি সাহিত্য-প্রীতি এবং অপরটি নৈতিক-চেতনা। তাঁর জীবনে নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জাগে পারিবারিক পরিবেশ থেকেই। ধর্মবুদ্ধি, আদর্শবাদ ও উদারতার সমন্বয় ঘটেছিল এ পরিবারের পরিজনদের চরিত্রে। বাহার সাহেবের মধ্যে আমরা এসব দুর্লভ গুণের উত্তরাধিকার প্রত্যক্ষ করি। খেলোয়াড় ও আড্ডাবাজ বাহারের আদর্শবাদ ছিল অনাবিল ও অটল, নৈতিক চেতনা ছিল প্রবল। তাই এই প্রাণবন্ত প্রবল পুরুষের জীবনের কোনো নৈতিক উজ্জ্বলতা ছিল না, ছিল না কোনো কাপট্য বা মিথ্যাচার। আদর্শ চরিত্র ও মহৎ জীবনের অনুধ্যানেই তাঁর জীবন কেটেছে। তাঁর রচনাবলীর অধিকাংশই তাই চারিত্র্যপূজার ও কীর্তিমান পুরুষের কর্মের অনুধ্যানের নিদর্শন।

ধর্মভাব ও আদর্শবাদ তাঁকে অতীত ও বর্তমানের মুসলিম জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র- চিন্তায় উৎসাহী করেছে। তাঁর স্বধর্ম ও স্বধর্মীপ্রীতি বিধর্মী-বিদ্বেষ জাগায়নি। তাই তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও নিন্দা চিরকালই অসূয়ার হুল-মুক্ত ছিল। তার হিং ও হালিম তাই বিদ্বিষ্টমনের বিষ ছড়ায়নি, রসিকজনের চিত্তে কেবল রসই সিঞ্চিত করেছিল। গাল যে খেলো আর গাল যে দিল–উভয়েই রইল পাঠকের উচ্চহাস্যের আধার হয়ে। হিং ও হালিমে কলমের জোর যেমন প্রত্যক্ষ, তেমনি কলমের পশ্চাতে যেমন ক্রিয়াশীল ছিল, তার প্রসারও হত আভাসিত। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আর নিন্দা গালিও যে অশ্লীলতা-মুক্ত হতে পারে, তা বাহার সাহেব নতুন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

যৌবনে তিনি তাসে আসক্ত ছিলেন। তাসে নাশ এই আপ্তবাক্যের প্রভাবে তাঁর মা তাঁকে তাস খেলতে নিষেধ করেন। এই নিষেধের পরে তিনি জীবনে আর তাস স্পর্শও করেননি। এ-কথা আমি তাঁরই মুখে একদিন কথাপ্রসঙ্গে শুনেছিলাম।

সাহিত্যিক হিসেবে মহৎ জীবনের চরিত্র ও কৃতির আলোচনা মাধ্যমে নৈতিকচেতনা, আদর্শানুগত্য ও মহম্ভব জাগানোর সচেতন প্রয়াস ছিল তার। সৈয়দ আমীর আলী, স্যার সৈয়দ আহমদ প্রভৃতি তার প্রমাণ। তাঁর ভাষায় ও ভঙ্গিতে এক দুর্লভ লাবণ্য ও আকর্ষণ-শক্তি ছিল। বক্তা হিসেবে তিনি যেমন শ্রোতাকে অভিভূত রাখতে পারতেন, আলাপচারী হিসেবে যেমন উপস্থিত ব্যক্তিকে একটানা পাঁচ-সাত ঘণ্টা ধরে রাখতে পারতেন, লেখক হিসেবেও তিনি পাঠককে সহজেই মুগ্ধ করতে জানতেন। অনর্গল অনবরত রসিয়ে রসিয়ে অক্লান্তভাবে কথা বলার সে কী আশ্চর্য সামর্থ্য ছিল তাঁর। এজন্যেই তাঁর সঙ্গ-সুখ ত্যাগ করা দুঃসাধ্য ছিল তাঁর বন্ধু-বান্ধবের পক্ষে। তাঁর সম্পাদিত বুলবুল পত্রিকা এবং রচিত পাকিস্তান গ্রন্থ তাঁর সাহিত্যপ্ৰাণতার ও রাজনীতি প্রীতির নিদর্শন। তাঁর দেখবার দৃষ্টিও ছিল তীক্ষ্ণ। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রতিবেশের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখবার অদ্ভুত শক্তি রাখতেন। এ সূত্রে কলম্বোর চিঠি ও জেনেভার চিঠি স্মতব্য। রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত অবধি তিনি একটি তাজা তরুণ প্রাণ বয়ে বেড়াতেন। রসিকের দৃষ্টি নিয়ে তিনি জীবন ও জগৎকে, প্রতিবেশ ও প্রতিবেশীকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর চারদিককার ভবন থেকে তিনি জীবনরস গ্রহণ করেছেন অবাধে এবং দিয়েছেন অকাতরে সবাইকে যারা তাঁকে বেষ্টন করে থাকতেন। তিনি এভাবে অন্তরে-বাইরে এক আনন্দলোক সৃষ্টি করে জীবনকে উপভোগ করতে ও করাতে চেয়েছেন। জীবনে তিনি চাকরি করেননি। তাই তার সময় ছিল অঢেল, প্রয়োজন ছিল সামান্য, লোভ ছিল অজ্ঞাত, ঔদাসীন্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল ঔদার্য, সবটা মিলে এক নির্ভাবনার জীবন। তিনি ভালোবাসতে জানতেন। জীবনভরে ভালোবাসা দিয়েছেন এবং ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। তাঁর জীবনে প্রীতির লেনদেনই ছিল মুখ্য। রাজনীতিক জীবনে তার প্রতিপত্তি ও সাফল্য আসে এই স্বতঃস্ফূর্তপ্রীতির পথেই।

Exit mobile version