দেশী দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথে পুরাণের ব্যবহার প্রাচীন ভারতকে ফিরে পাবার অভিপ্রায়প্রসূত যে নয়, নতুন-জাগা চেতনা প্রকাশের মাধ্যম মাত্র, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই রিভাইভাল নয়, নবচেতনাই জীয়নকাঠি।
কারো কারো চিন্তায় রেনেসাঁস ও রিভাইভাল সমার্থক হয়ে গেছে। যেন একটির সঙ্গে অপরটির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। যেন রিভাইভালিজমই রেনেসাঁসের প্রসূতি অথবা রেনেসাঁসই রিভাইভালিজমের জনক কিংবা অগ্রজ; অর্থাৎ একটি অপরটির কখনো কারণ এবং কখনো ফলরূপে প্রতীয়মান। এমনকি বাঙলা তর্জমায় পার্থক্য প্রায় দুর্লক্ষ্য। শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য, স্থাপত্যাদি কলা কিংবা চিন্তার ক্ষেত্রে নবজন্ম, নবজাগরণ, পুনরুজ্জীবন, পুনর্জীবন, পুনর্জাগরণ, পুনরভ্যুদয়, পুনরুদ্দীপন, পুনরুদ্যম, পুনরুদ্বোধন প্রভৃতি অর্থেই শব্দদুটো ব্যবহৃত হয়। সাধারণ অভিধা হচ্ছে রিভাইটালাইজেশন। যে-ঐতিহ্য যে-অতীত ভরে তুলে না, কেবলই ধরে রাখে; যে tradition অগ্রগতির অন্তরায় তা পরিহার করবার, তার প্রতি নির্মম ও বীতরাগ হবার শক্তি থাকা চাই– নইলে আবেগের ঘূর্ণিপাকে অপচিত হবে জাতীয় সব প্রয়াস।
কাজেই প্রাণে প্রেরণা, চিত্তে চেতনা এবং মনে স্বতঃউৎসারিত উদ্যম না জাগলে, কেবল ইতিহাস পাঠের ফলশ্রুতির অনুসরণে কিংবা অনুকরণে revivalism-এর চর্যা গ্রহণ করলেই রেনেসাঁস আসবে না অথবা রেনেসাঁস এসেছে কল্পনা করে revival-এর উৎসাহ-বোধ করলেই প্রয়াস সফল ও সার্থক হবে না। মনে রাখা দরকার, যাত্রা অভিন্ন হলেও ফল ভিন্ন হতে বাধা নেই। বস্তুত প্রায়ই ভিন্ন হয়। তাছাড়া অনুকৃতিতে নির্বোধ পায় আনন্দ, বুদ্ধিমানে পায় লজ্জা।
ঐক্যসূত্র
প্রাণী হিসেবে মানুষ একটা Species বা প্রজাতি। এ কারণে মানুষ মাত্রেরই জীবন- চেতনায় কতগুলো মৌলিক ঐক্য রয়েছে। ঘৃণায় ও ভালোবাসায়, লোভে ও ত্যাগে, ক্ষমায় ও প্রতিহিংসায়, সমাজবোধে ও সহযোগিতায়, দায়িত্বচেতনায় ও কর্তব্যবোধে, দ্বন্দ্বে ও সংগ্রামে মানুষ প্রায় সর্বত্রই অভিন্ন। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বোধের তারতম্য বা মাত্রাভেদ আছে মাত্র।
আবার প্রাচীন গোত্রীয় সমাজভুক্ত মানুষে কিংবা পরবর্তীকালের ধর্মীয় মতভুক্ত সমাজেও একপ্রকার আচারিক ঐক্য মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেছে।
তাছাড়া, ভৌগোলিক পরিবেষ্টনীগত অভিন্নতাও মানুষের জীবনযাত্রায় ঐক্যদান করে।
কাজেই মানবিক ঐক্য, গোত্রীয় ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, ভৌগোলিক ঐক্য ও ভাষিক ঐক্য মানুষের মনে, মননে ও ব্যবহারিক জীবনযাত্রায় তাদের স্ব স্ব প্রভাব রাখে।
এদের প্রত্যেকটিরই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। কখনো অভিন্ন ভাষার প্রভাবে কখনো অভিন্ন ধর্মের প্রেরণায়, কখনো ভৌগোলিক জীবনের প্রয়োজনে, কখনো গোত্রীয় আকর্ষণে অতীতে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনে ও জীবিকায় বিকাশ, প্রসার ও সমৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। এখনো যে তা একেবারে অবলুপ্ত তা বলা যাবে না।
অতএব দেখা যাচ্ছে চিন্তার ও জীবিকার অভিন্নতা তথা মতের ও স্বার্থের ঐক্যই মানুষকে দিয়েছে সজ্ঞাবদ্ধতা, দিয়েছে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে যৌথ প্রয়াসের প্রেরণা। কেননা সাধারণ মানুষের জীবনচেতনা ও অধিকারবোধ তখনো সূক্ষ্ম হয়ে ওঠেনি। স্বাতন্ত্র্যবোধ ও আত্মপ্রত্যয়প্রসূ জ্ঞানের ও সামর্থ্যের অভাবে তারা তখনো সর্দার বা গোত্রপতি-নির্ভর জীবনে স্বস্তি খুঁজেছে। বৈষয়িক জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য তখনো নিজের হাতে নেবার উপায় ছিল না পরিবেশ ও পরিবেষ্টনীগত কারণেই। তাই গ্রীক City state থেকে অত্যাধুনিক কাল অবধি প্রবল দুরাত্মারাই জনগণের জীবন-জীবিকা নিয়ন্ত্রণের তথা শাসন-শোষণের নির্বিঘ্ন অধিকার পেয়ে এসেছে। তারাই অজ্ঞ ও দুর্বল জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছিল যে রাজার সুখেই প্রজার সুখ, রাজার গৌরবেই রাজ্যের গৌরব, রাজার ঐশ্বর্যই জাতির সম্পদ, রাজার যশই দেশের যশ, রাজার বিলাসেই গণ-সংস্কৃতির বিকাশ। বসুন্ধরা বীরভোগ্যা, রাজা ও রাজপার্ষদ–দু-ই দেশ ও জাতির প্রতিভূ এবং তাঁদের যশ-মান-সম্পদই জাতীয় সমৃদ্ধি ও গৌরবের প্রতীক। আর মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগ তার নিয়তি-নির্ধারিত। রাজার কেবল শাসন-শোষণের বিধিদত্ত অধিকারই আছে, পোষণের দায়িত্ব কিংবা দুঃখমোচনের কর্তব্য তার নয়। তাই কোনো রাজা যদি দীঘি-সড়ক-সরাই দিতেন, তিনি হতেন মহানুভব, মহামতি বদান্য রাজর্ষি।
.
০২.
সে-দিন ও সে-মন আর নেই। আবিষ্কৃত যন্ত্রের প্রয়োগে আজকের দিনে মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠেছে। ভাব-চিন্তা-কর্মেও এসেছে বক্রতা ও বৈচিত্র্য। পণ্য উৎপাদনের সহজতা, জনসংখ্যাবৃদ্ধি, জনসংখ্যার অসম সংস্থিতি এবং যন্ত্রবিজ্ঞানে অধিকারের রাষ্ট্রিক তারতম্য প্রভৃতি অসামান্যরূপে জটিলতর করেছে মানুষের জীবিকার সমস্যা। ফলে মানুষ মরিয়া হয়ে খুঁজেছে বাঁচার পথ। সে-বাঁচার পথ এক-এক জনের চোখে এক-এক রকম। মেরে বাঁচা, কেড়ে বাঁচা কিংবা বন্টনে বাঁচা যেমন, তেমনি সহযোগিতায়, সহ-অবস্থানে ও সমদর্শিতায় বাঁচাও সম্ভব। কাজেই নানা বিরুদ্ধ-পথের বিভ্রান্তি ও বিবিধ বিপরীত মতের সংঘর্ষে মানুষের বৈষয়িক ও মানসিক তথা জৈবিক ও মানবিক সমস্যা জটিল ও বিপুল হচ্ছে। আর আনুপাতিক হারে মানুষ কখনো স্বাতন্ত্রে, কখনো সহযোগিতায়, কখনোবা জাতীয়তায়, কখনো মানবতার আদর্শে, কখনো আত্মরক্ষার নামে এসবের সমাধান খুঁজেছে। তাই দুনিয়াব্যাপী সমস্যা-পীড়িত দুর্বলরাষ্ট্রে নানা আনুষঙ্গিক উপসর্গও দেখা দিয়েছে। ফলে আজকের পৃথিবীতে সর্বত্র মতাদর্শের হট্টগোল উঠেছে। গরজ ও সুবিধেমতো গলাবাজি করেই জয়ী হতে চায় সবাই।